Hello Testing

4th Year | 2nd Issue

৩১শে বৈশাখ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 15th May, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

উ দা সী ন  তাঁ ত ঘ র পর্ব ৬

প ঙ্ক জ   চ ক্র ব র্তী

pankaj

সৌজন্যসংখ্যা নেই, স্তাবকতা আছে

ছোটো পত্রিকার লেখকের সম্মানের ব্যাপারে আজ আর সম্পাদকের মাথাব্যথা নেই। লেখা জোগাড়ের তৎপরতা ছাড়া কোনো বাড়তি কর্তব্য অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে। সম্পাদক চান লেখকের তরফে কৃতজ্ঞতার ওম, ধন্যতার তৃষ্ণার্ত চাহনি। আত্মগৌরবের বশে যেকোনো সম্মানহানি নিয়েও একজন লেখক নীরব থাকেন। ছোটো পত্রিকার সমস্ত মৌলবাদ মনে মনে মেনে নেন। তিনি জানেন বড়ো পত্রিকার বিরুদ্ধাচরণ বাজারে খায় বেশি। ছোটো পত্রিকার বিপক্ষে গেলে তাঁকে ভিটেমাটি ছাড়তে হবে। অতএব নমনীয় নীরবতা। শুধুমাত্র দু-একটি মুদ্রিত অক্ষরের জন্য আজীবন আত্মসমর্পণ।

সমস্ত বিরুদ্ধতা বাদ দিয়ে আপাতত বলা যাক সৌজন্যসংখ্যার কথা। যেকোনো পত্রিকায় একটি অক্ষর লিখলেও একজন লেখকের সৌজন্যসংখ্যা পাওয়ার অধিকার আছে। রুচিশীল সম্পাদকমাত্রই তা জানেন। এবং সেই কাজে দীর্ঘদিন তাঁরা কোনো কার্পণ্য করেননি। অথচ গত কুড়ি বছরে এই বিষয়টি দ্রুত পাল্টে গেছে। লেখককে,প্রধানত তরুণ লেখককে সৌজন্যসংখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন বেশির ভাগ সম্পাদক অস্বীকার করে চলেছেন। লেখকের সাম্মানিক দেওয়ার ব্যাপারে সমস্ত সম্পাদকই আর্থিক সামর্থ্যের কথা তোলেন এবং তা একপ্রকার স্বীকৃত রীতি কিন্তু সৌজন্যসংখ্যার কার্পণ্য দেখে সন্দেহ হয় এরা আদৌ সম্পাদক কিনা! ছোটো পত্রিকার ‘ছোটো’ সম্পাদককে অতঃপর কী বলা যায় যখন চতুর্দিকে আত্মপ্রত্যয়হীন, আত্মসম্মানহীন লেখক সরবরাহ।

ঠিক কবে থেকে এই অসংগতির সূত্রপাত? কবে থেকে এই দীনতা? খুব মোটাদাগে বলা যায় ১৯৯৯ সাল থেকে। অর্থাৎ জীবনানন্দের জন্মশতবর্ষ। সেই প্রথম বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন প্রত্যক্ষ করল স্পেশাল ইস্যুর বাজারমূল্য আছে। স্পেশাল ইস‌্যু ঘরের টাকা ঘরে ফিরিয়ে আনে। পাঁচশো পাতার ঢাউস ম্যাগাজিন নিমেষে ফুরোয়। ফলত মৌলিক গল্প কবিতার দিন সঙ্কুচিত হয়ে গেল। ভালো কবিতা পাওয়া গেলেও ভালো প্রবন্ধ, গল্প অনিশ্চিত এবং সময়সাপেক্ষ। অতএব নিয়মিত পত্রিকার জন্য প্রয়োজন হল স্পেশাল ইস্যুর। ‘গবেষণা’ এবং ‘সংরক্ষণযোগ্য’ এই দুটি প্রতারক শব্দের বানিজ্য বিস্তার ঘটল। লিটল ম্যাগাজিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসপ্রেমী হয়ে উঠল। যেকোনো লেখকের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে অজস্র মোচ্ছব, দরিদ্র নরনারায়ণ সেবা। ঝুঁকি কম, সাফল্য বেশি। সম্পাদক শুধু প্রাথমিক ছক কষে নেন। তারপর দুএকজন মান্য সমালোচক, অজস্র প্রস্তুতিহীন অধ্যাপক এবং গবেষককে বই বা বিষয় ভাগ বাটোয়ারা করে দেন। ভাবনাহীন, উদ্ধৃতিসম্বল রাশি রাশি লেখায় সংকলিত পত্রিকা গায়ে গতরে ফুলে ওঠে। পাঠক আকৃতি দেখেই ভাবে সংগ্রহযোগ্য। আসন্ন গবেষক কিনে নেন ভবিষ্যতের  রেফারেন্স হিসেবে। অধ্যাপক কেনেন সামান্য আপডেট থাকার লজ্জা নিয়ে কিংবা তাঁর গবেষকের গবেষণার গ্রন্থপঞ্জী সমৃদ্ধ করতে। সবই আগামীর জন্য।কেউ পড়েন না। শুধু পাঁচশত পাতার  দৃশ্যসুখ। এতেই খুশি তাবৎ ছোটো পত্রিকার সম্পাদক।

এর সামগ্রিক ক্ষতির দিকে আমাদের লক্ষ্য নেই। শুধু বিস্মৃতির পুনরুদ্ধার আর চর্বিতচর্বণ। নতুন সৃষ্টির জন্য কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে এইসব বৃহৎ সংখ্যার লেখককুল মূলত অপ্রস্তুত অধ্যাপক অথবা গবেষক। তাঁদের সৌজন্য সংখ্যা না দিলেও চলে। প্রমোশন অথবা ইন্টারভিউ বোর্ডে নম্বরের জন্য লেখা ছাপলেই তাঁরা ধন্য হয়ে যান। নিজেরাই সংগ্রহ করে নেন। এমনকী পয়সা দিয়ে লেখা ছাপতেও দ্বিধাবোধ করেন না। আর এই পথেই ‘ সংগ্রহযোগ্য’ অপরিণামদর্শী লিটল ম্যাগাজিনের সাফল্য আসে। দু-একটি পুরস্কার জুটে যায়। লিটল ম্যাগাজিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে অ্যাকাডেমিক পরিসরে। এই তো চেয়েছিলাম আমরা। প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে পাল্টা এক দুর্ভেদ্য প্রতিষ্ঠান। এখন অপেক্ষায় আছি ‘ মেমসাহেব’ গ্রন্থের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের।

যেসব সম্পাদক সৌজন্যসংখ্যা দিতে চান না তাঁদের তরফে আর্থিক সামর্থ্যের কথা ওঠে। একটি পাঁচশো পাতার লিটল ম্যাগাজিন করতে যে প্রচুর খরচ হয় সেকথা অস্বীকার করার উপায় নেই। বিজ্ঞাপনের সৌভাগ্য সকলের থাকে না। কিন্তু সম্পাদক কাগজ,প্রেস, বাঁধাই সব ব্যাপারে যখন খরচ করতে প্রস্তুত তখন সৌজন্যসংখ্যা দিতে কার্পণ্য কেন? লেখকের সাম্মানিক তো কবেই বাতিল হয়ে গেছে! একজন সম্পাদক যখন বাজেট করেন তখন লেখক কপি তার অন্তর্ভুক্ত হবে না কেন? যাঁর আর্থিক সামর্থ্য নেই তাঁকে পাঁচশো পাতার স্পেশাল ইস‌্যু করার দিব্যি কে দিয়েছে? কী প্রয়োজন যদি লেখকের সম্মানটুকু না থাকে? লেখককে যে সম্পাদক করুণা করেন তাঁর কি আদৌ সম্পাদক হওয়ার যোগ্যতা আছে? রুচিহীন এইসব মানুষ পথ ছেড়ে দাঁড়াবেন আমরা প্রত্যাশা করি। যাঁরা ‘ সৌজন্যসংখ্যা নেই জেনেই লেখা পাঠাবেন’ এই মর্মে ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেন তাদের রুচিহীন ঔদ্ধত্যের কাছে বাংলা সাহিত্য কিছু প্রত্যাশা করে না। যাঁরা সাতশো কবির শারদীয়া সম্মেলন করেন তাঁরাও নিশ্চিন্ত থাকুন খ্যাতিপ্রত্যাশী কাঙাল কবির অভাব হবে না। নিজের কবিতাটি মুহুর্তে ফেসবুকে তুলে দেবার দ্বিধাটুকু আজ আর কোথাও অবশিষ্ট নেই। এসব জেনেই তরুণ কবির সামনে তাঁরা মেলে ধরেন স্বপ্নের চাষযোগ্য জমি। কেউই ভরসা রাখেন না এত কবিতার ভীড়ে তাঁর কবিতা কেউ পড়বে। শুধু কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ফেসবুকে লটকে দেওয়া মুহুর্তের অপেক্ষা।

মনে পড়ে নব্বইয়ের মফস্সলের দিনগুলির কথা। ছোটো পত্রিকার অভাব নেই। কবিসম্মেলনের অভাব নেই। অজস্র পত্রিকা, সস্তার কাগজ, সাধারণ প্রচ্ছদ, বাজে ছাপা এবং ক্ষীণকায় আয়তন। কোনো সংখ্যা চার ফর্মা হলে রীতিমতো মুগ্ধতা আর ঈর্ষা তৈরি হত। রবিবারের কবিসম্মেলনে দেখা হলে লেখক কপি তুলে দেওয়া হত। যাদের সঙ্গে দেখা হবার সুযোগ নেই পত্রিকা দুভাঁজ করে সাদা কাগজে ঠিকানা লিখে বুক পোস্ট করা হত। তখন অবশ্য ভারতীয় ডাক এত উদাসীন এবং অকর্মণ্য ছিল না। আজ প্রযুক্তির দৌলতে মুদ্রণ,প্রচ্ছদ এমনকী যত্ন নিয়ে লেখা ছাপার ব্যাপারে আমরা অনেক অগ্রসর। অথচ দেহে ক্যানসার। মাথায় মুদ্রাদোষ। মনে রুচিহীনতা। আজ বেশিরভাগ লিটল ম্যাগাজিন যোগাযোগের সিঁড়ি। সম্পাদকের যশ, খ্যাতি, গোপন যোগাযোগের  বিড়ম্বনার সঙ্গে তার ভাগ্য জড়িত। রাজনৈতিক অভিসার তার নিয়তি।

এবার খুলে যাক ছদ্মবেশ। গবেষণার নামে মেদবৃদ্ধির নির্লজ্জ বেহায়াপনা বন্ধ হোক। পত্রিকার বাজেটে অন্তর্ভুক্ত হোক লেখকের জন্য সামান্য সাম্মানিক এবং যথানিয়মে লেখককপি দেবার সৌজন্য। শুধু সংকলন লিটল ম্যাগাজিনের ধর্ম নয়। স্পেশাল ইস্যুকে অস্বীকার করছি না। কিন্তু তাঁর দৃষ্টান্ত হতে পারে সুদূর এক্ষণ,ধ্রুবপদ বা এখনও জীবিত দাহপত্র,আচমন পত্রিকার কাজগুলি। হে বৃহৎ  লিটল ম্যাগাজিনের অপ্রতিরোধ্য সম্পাদক, আপনি আর্থিক সামর্থ্যের দোহাই দিয়ে ক্ষমতাহীন অথবা তরুণ লেখককে সৌজন্যসংখ্যা দেন না জানি কিন্তু গোপনে শঙ্খ ঘোষ বা কিংবদন্তি কোনো বিদ্বজ্জনের পায়ের কাছে লুটিয়ে থাকা অর্ঘ্যের খোঁজ আমরা রাখি। প্রত্যাখ্যান জরুরি অথচ উপায় নেই। তবু গোপন প্রতিরোধ কখনও কখনও দেখা যায়। তাই লেখা চাইবার আগে মনে রাখবেন মনীন্দ্র গুপ্ত বা দেবেশ রায়ের মেধা আমাদের নাও থাকতে পারে কিন্তু সুবোধ সরকার বা জয় গোস্বামীর পাদটীকা হওয়ার জন্য আমরা জন্মাইনি।

* ক্রমশ  

আরও পড়ুন...