Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

বি শে ষ  র চ না 

সারা পৃথিবীর মতো এদেশেও এমন অনেক ভাষা ছড়িয়ে আছে সেসব ভাষার আজও কোনো নিজস্ব লিপি নেই। মানুষের মুখে মুখে ঘোরে সেসব ভাষা। শুধু তাই নয়, সেসব ভাষাতেও আছে নানান মৌখিক লোকসাহিত্য। অথচ বাইরের দুনিয়ার মানুষের কাছে সে ঐশ্বর্যের হদিশ প্রায় নেই বললেই চলে।

ভারতের উত্তরপূর্ব অংশে এমন একাধিক জনগোষ্ঠীর সমাবেশ লক্ষ্য করা যায় যেগুলির প্রত্যেকটিই স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল ও স্বতন্ত্র।  পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক রীতিনীতির মতো তাদের ভাষাও আলাদা আলাদা। আর বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, এক্ষেত্রে মুখে মুখেই রচিত হয় তাদের লোকসাহিত্য। অনুবাদের মাধ্যমে তার যেটুকু এসে পৌঁছেছে বাইরের দুনিয়ায়, তা নিঃসন্দেহে চমকে দেওয়ার মতো। এমনি এক জনগোষ্ঠী হল ‘মিসিং জনগোষ্ঠী’। এই জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা হল ‘মিসিং ভাষা’। 

মিসিং ভাষা ও মিসিং জনগোষ্ঠী সম্পর্কিত কিছু তথ্য...

আসাম-এর ভৈয়ামের জনজাতিসমূহের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম জনজাতি এই মিসিং জনগোষ্ঠী’।  আসামের ধেমাজি, তিনসুকিয়া, লখিমপুর, ডিব্রুগড়, শিবসাগর, গোলাঘাট, যোরহাট, দরং, শোণিতপুর জেলায় মিসিংরা প্রধানভাবে বাস করে।  এই জনগোষ্ঠীর ভাষা হল ‘মিসিং ভাষা’। ২০০১ সালের জনগণনা অনুযায়ী প্রায় ৫,১৭,১৭০ সংখ্যক (উইকিপিডিয়ায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী) মানুষ এই ভাষায় কথা বলে থাকেন। শিক্ষা-দীক্ষায় যথেষ্ট অগ্রসর এই জনগোষ্ঠী লেখাপড়া শেখেন অসমিয়া মাধ্যমে। অসমিয়া ও অন্যান্য প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁরা অসমিয়া ভাষা ব্যবহার করেন, কিন্তু নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় তাঁরা সর্বত্র মিসিং ভাষাই ব্যবহার করে থাকেন। মিসিং ভাষার ভাণ্ডারে রয়েছে ছড়া, গান, কবিতা, লোককথা ইত্যাদির বিপুল সম্ভার। কিন্তু তা সবই মৌখিক। এই লিপি না থাকার ব্যাপারে মিসিং-দের ভেতর একটি লোক বিশ্বাস প্রচলিত আছে—

“ভগবান বিশ্ব-সৃষ্টির পর বিশ্বের সব জাতের মানুষের জন্য আলাদা আলাদা ভাষা তৈরি করেন। ভাষার সঙ্গে লিপি। মিসিংদের জন্য তিনি যে ভাষা তৈরি করেন তা তিনি তাঁদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে তার লিপিটা টুকে নিতে বলেন। মিসিংদের কেউ সেটা টুকে নেওয়ার উপযুক্ত কিছু না পেয়ে একটি হরিণের গায়ে লিখে রাখে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ব্যাপারটা ভুলে গিয়ে সেই হরিণটাকে মেরে তার মাংস খেয়ে ফেলে। ফলে মাংসের সঙ্গে তারা তাদের লিপিও উদরস্থ করে। সেই থেকে তারা লিপি ছাড়া।”

মিসিং ভাষার বিপুল সাহিত্য সম্ভারকে প্রথম অনুবাদের মাধ্যমে বহির্বিশ্বের কাছে নিয়ে আসেন অসমিয়া ভাষার প্রথম সারির কবি ও অধ্যাপক জীবন নরহ মহাশয়। তিনি মিসিং সমাজের লোক। লেখেন অসমিয়া ভাষায়। তিনি মিসিং জনগোষ্ঠীর মানুষদের মুখে মুখে ঘোরা মিসিং ভাষার লোককবিতাগুলিকে সরাসরি অসমিয়া ভাষায় অনুবাদ করেন। অসমিয়া কবিতা অনুরাগীরা অভিভূত হয়ে পড়েন তাঁর এই অনুবাদে। রাতারাতি আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় মিসিং কবিতা।

পরবর্তী কালে অসমিয়া ভাষা থেকে তা বাংলায় অনুবাদ করেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক মানিক দাস মহাশয়।  নিতান্ত ভালোলাগা থেকে স্বয়ং জীবন নরহ মহাশয়ের সাহচর্যে তিনি সম্পন্ন করেন তাঁর অনুবাদের কাজ কঠোর পরিশ্রম ও নিষ্ঠার সাথে। প্রাবন্ধিক-অধ্যাপক শ্রী প্রশান্ত চক্রবর্তী ও গদ্যকার-অধ্যাপক শ্রী কান্তারভূষণ নন্দী কর্তৃক সম্পাদিত ‘ফিনিক্স’ পত্রিকায় সেই অনুবাদের কিছু অংশ প্রকাশ পায়। বর্তমানে ‘যাপনকথা’ পত্রিকা সম্পাদনারত মাননীয় কান্তারভূষণ নন্দী মহাশয় আমাদের হাতে সেই অনুবাদের অংশটি তুলে দিয়ে বিশেষ সহযোগিতা করেন। আমরা তা পুনঃপ্রকাশের অনুমতি পেয়ে সম্পাদকদ্বয়ের কাছে আন্তরিক ভাবে ঋণী। আরও বেশি সংখ্যক মানুষকে মিসিং কবিতার সঙ্গে পরিচয় করানোই আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য…

মিসিংদের জীবনযাত্রার সংক্ষিপ্ত রূপরেখা...

মিসিংরা অসমের একটি প্রধান উপজাতি। শদিয়া থেকে শুরু করে তেজপুর পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে এঁদের বসতি লক্ষ্য করা যায়। সোঅনশিরি ও ব্রহ্মপুত্র সহ অন্যান্য ছোট ছোট নদীর তীরেও এঁরা বসবাস করে থাকেন। মিসিংরা তিব্বতী-বর্মী গোষ্ঠীর অন্তর্গত। এঁদের দৈহিক গঠন মঙ্গোলীয়দের মতো। মাঝারি উচ্চতা, ফর্সা গায়ের রঙ। মিসিংরা নিজেদের চন্দ্র-সূর্যবংশীয় বলে মনে করেন। চন্দ্র তাঁদের পিতা আর সূর্য তাঁদের মাতা। যাবতীয় মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে চন্দ্র-সূর্য বন্দনা করার রীতি আছে। এই জনগোষ্ঠী অনেকগুলি ভাগে বিভক্ত। তার মধ্যে আটটি প্রধান। নদীর তীরে এঁদের বসবাস বলে মাচা বেঁধে তার উপর ঘর তৈরী করেন তাঁরা। রঙচঙে পোশাক তাঁদের বিশেষ পছন্দের। মিসিং মেয়েরা তাঁত বোনায় বিশেষ পারদর্শী। আয়-ব্যায়ের দায়িত্ব মিসিং পুরুষদের হলেও হাস-মুরগি-শূকর ইত্যাদি পুষে মহিলারা তাঁদের সহায়তা করে থাকেন। পুরুষরা প্রধানত চাষ বাদ করে থাকেন। শিক্ষা-দীক্ষায় এই জনগোষ্ঠী যথেষ্ট অগ্রসর। হিন্দু হলেও তাঁদের নিজস্ব কিছু লোকাচার আছে। অসমিয়াদের মতো তাঁরা বছরে তিনটি বিহু পালন করে থাকেন।

সমৃদ্ধ লোকভাষা হওয়ার কারণেই লিপির অনুপস্থিতি সত্ত্বেও এই মিসিং ভাষা আজও টিকে আছে এই মিসিং জনগোষ্ঠীর ভেতর। প্রিয় পাঠকদের কাছে এই সংখ্যার বিশেষ আকর্ষণ হিসাবে রইল মানিক দাস মহাশয় কৃত কিছু মিসিং কবিতার বাংলা অনুবাদ—

মিসিং ভাষায় রচিত কিছু কবিতার বাংলা অনুবাদ...

মা নি ক   দা স

তোমার দিকে এই আমার শেষ চাহনি

(বিলাপগীতি)

 

১।

ঝলমল করে বেড়ে ওঠে ঘাস

ও আমার সোনা,

আলতো করে ছেঁকে ধরেছে তোকে

আহা, আগে যদি জানতাম,

আহা, আগে যদি বুঝতাম

সময়ের ঘূর্ণিঝড়ে

তোকে হারিয়ে যেতে দিতাম না

 

দিনের পর দিন

আমার কাছ থেকে তোকে

ছিনিয়ে নিয়েছে

অমাবস্যার অন্ধকার,

ও আমার সোনা।

 

২।

ও আমার মা,

সৃষ্টিকর্তা কি কোথাও ভুল করেছেন,

ও আমার বাবা,

পালনকর্তা কি কোথাও ভুল করেছেন,

যার দরুণ আমার আজ এ-দশা?

এই আমার শেষ দৃষ্টিপাত

এই আমার শেষ বিদায়

তুমিও ভুলে যেয়ো আমাকে

আমিও ভুলে যাব তোমাকে

আমরা যে চিরকাল একা

 

৩।

ও আমার সোনামুখ,

তোমাকে অভিশাপ দিলেও

ফলে না

তোমার কথা ভাবলেও

আমার ভাবনা খেই পায় না

কোন মুখপোড়া আমাদের পৃথক করেছে

যার দরুন আমরা কখনও

আপন হব না।

 

৪।

জ্ঞান হওয়ার আগে থেকেই

তোমার সঙ্গে আমার পরিচয়

ও আমার আদরের ধন,

তখন থেকেই তোমার চোখে

আমার চোখের ভাষা

তোমার অন্তরের সাথে

আমার অন্তরের মিল

বেলাভূমিতে বালিঘর গড়ে

খেলাচ্ছলে মাটির ভাত রেঁধে খেয়েছি

তৃষ্ণায় আপং ভেবে

নদীর জল খেয়েছি

সেই তখন থেকেই তোমার সঙ্গে আমার প্রেম,

ও আমার আদরের ধন।

 

৫।

তুমি আমার কাছে হৃদয়ের ফুল

একসাথে ফুটব বলে ভেবেছিলাম

জীবনকালে সুখে-সন্তোষে থেকে

একসাথে মরব বলেও ভেবেছিলাম

 

তুমি কেন আমার সঞ্চিত প্রেমটুকু

বাতাস যেভাবে কাত করে উড়িয়ে

নিয়ে যায়,

সেভাবে উড়িয়ে নিলে?

 

৬।

মা-বাবার সুখের সংসারের

এই অভাগিনীর জন্ম

হে বিধাতা,

কার পাপের ফলে আমার জন্ম?

নাকি আমার জন্মের সময়

মা-বাবা কোনো দোষ করেছিলেন?

আমি সারা জীবন

দুঃখের ভার বয়ে যাচ্ছি

নিঃসঙ্গতা আমাকে দহন করছে

হে বিধাতা,

দুঃখের ভার আমাকে চেপে ধরছে।

 

৭।

হে মোর পিতৃদেব,

সূর্য বলতে একটাই।

হে মোর মাতৃদেবি,

চন্দ্র বলতে একটাই।

চন্দ্রপিতা শোন,

সূর্যমাতা শোন,

কী করে এতদিন একা একা আছি

আমার ভাবনা তার খেই পায় না।

 

৮।

সূর্যোদয়ের মুহূর্ত থেকেই,

চাঁদের আলো ছড়ানোর সময় থেকেই,

তারাদের ঝিকিমিকি শুরু হওয়ার কাল থেকেই

তুমি আমার।

তুমি সম্পর্ক ছিঁড়ে চলে গিয়েছিলে

এখন কান্না জুড়ে কী লাভ?

আর, তোমার থেমে-থেমে কান্নার

অর্থই-বা কী।

রূপবান জামাইবাবা কাছে ঘেঁষো না

(ছেলেভুলানো গান)

 

১।

আমার ছোট্ট সোনা কেঁদো না,

ঘুঘুপাখিটা উড়ে যায়নি

উড়ে গেলে তবে তো কাঁদবে!

 

২।

কাঁদবে না তো!

প্রকান্ড সেই শিমুল গাছটার তলায়

ইয়া বড় এক অজগর

এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে।

 

৩।

আমার ছোট্ট সোনার কান্নাটা

নলখাগড়ার বাঁশির মতো

কানে এলেই আত্মহারা হই।

সোনা আমার,

একখানা চাদর বুনে দেব

তোকে বুকে জড়িয়ে রাখবে।

 

৪।

জামাইবাবু এসেছেন ছাতা হাতে

দুলকি  চালে

রূপবান জামাইবাবু কাছে ঘেঁসো না

গামু কেঁদে উঠবে!

 

৫।

ও আমার সোনাধন,

উজানেও অগভীর জল

ভাটিতেও অগভীর জল

মাঝখানে কাঁটাবন

গাঁয়ের ছেলেরা গাছে চড়ে ফল খায়,

পিঁপড়ে কামড়ায় কিন্তু!

 

৬।

সামনে শিমুল,

পেছেন শিমুল,

ওপারে সাদা মেঘ।

মেঘের ওপর দেবতাদের ফুলবাগিচা,

ফুল ফোটে আকাশ আলো করে।

 

৭।

বুড়ি ঠাকুমার বউমা

ঢেঁকিতে পাড় দিতে জানে না

পা পড়ে ভুল জায়গায়

সোনা আমার, কাঁদে না,

ঢেঁকি ডাকবে কিন্তু!

আমার সোনাকে

ঝলমলে টুপি কিনে দেব,

খেলা করবে আনন্দে।

শোনো আমার ফুলকুঁড়ি

(প্রণয়গীতি)

 

১।

নিজেকে ভালো বলে বড়াই কোরো না

ওহে জোয়ান ছেলে,

বেশি জানার মতো ভানও কোরো না

ভেবেচিন্তে কথা বলবে

না-হলে পরে একা হয়ে যাবে

মৃদু মাথা নুইয়ে

বাঁকা দৃষ্টির ঝলক দেবে না,

ধরা পড়বে।

ভেক করে ফুঁপিয়ে কাঁদবে না

ধরা পড়ে যাবে।

 

২।

নিজেকে বেশি রূপসী বলে ভেবো না,

ওহে বাড়ন্ত মেয়ে,

বেশি সেজেগুজে মন ভোলাতে

কারো দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ো না

পড়ে যদি কেউ তোমাকে বিয়ে না-করে

তাহলে সারা জীবন চোখের জল ফেলবে।

কারো দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য

ছল করে তাকিয়ো না

 

৩।

উজানের দিকে তাকালেও

শেষ হয় না

ভাঁটির দিকে তাকালেও

শেষ হয় না

আকাশের দিকে তাকালেও

শেষ হয় না

তুমি কাছেই রয়েছ

অথচ মনে হয় যেন অনন্ত দূর।

 

৪।

দূর-দূয়ান্তের ভালোবাসা

গভীর জলের মতো গভীর

একান্ত কাছের ভালোবাসা

চঞ্চল-অস্থির

 

৫।

নদীচর ছেড়ে

কোথায় উড়ে গেল অইকলি*,

ও আমার ফুলকুঁড়ি,

সর্বহারা করে

কোথায় গেলে সই?

ও আমার ফুলকুঁড়ি,

তোমাকে বলিনি কি

ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে

আঘাত না-করতে;

হৃদয় গলিয়ে দেওয়া

ভালোবাসা না-দিতে?

 

*অইকলি- এক বিশেষ প্রজাতির পাখি।

 

৬।

ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসাটা

নূতন ওঠা কাস্তেচাঁদের মতো,

চোখের জল মুছে কাঁদাটা

কারো ভালোবাসা

খুঁজে বেড়ানোর মতো।

 

৭।

 চাঁদ ডোবা রাতে, ওগো,

গলা ছেড়ে কেঁদো না,

আমাকে যদি ভালোবাসছই, ওগো,

আর কাউকে প্রেম নিবেদন করো না।

 

৮।

আনন্দে যখন নাচতে থাকি

তখন আত্মহারা হয়ে যাই।

তুমি আমার সোহাগ-সুন্দর,

তোমাকে কাছে পেলে

খিদে-তেষ্টা উবে যায়।

নাচে মগ্ন থাকার সময়

তুমি পাশ কেটে গিয়েছ;

ডাক না-দিয়ে বিদায় নিয়েছ।

 

৯।

তুই বন্য লতার মতো,

ক্ষীণকটির সোনা আমার,

মৃদুমন্দ মনের ভাব।

হালকা কোম্ল ফুলগুলো

একসাথে ফুটে যেভাবে সরে গেছে

সেভাবে তুইও সরে গেছিস।

 

১০।

তোর আমার ভালোবাসা

হে প্রেম, হে প্রীতি,

মাঝপথেই ছাড়াছাড়ি!

হায় আমার দুঃখ!

 

১১।

উজানে চাঁদটা

লাজরাঙা হয়ে বেরিয়েছে।

তুমি আমার হৃদয়ের ফুল,

তুমি বেরিয়েছ রংচঙে সাজে

শিথিল পায়ে।

 

১২।

এত বৃষ্টি হয়ে গেছে

অথচ কচুপাতা ভেজেনি,

ইনিয়ে-বিনিয়ে এত কেঁদেছি

অথচ আমার চোখের জল

তোর হৃদয়ে ঢোকেনি।

 

১৩।

তুমি একবারটি ডাকও দিলে না,

চট করে একটু ফিরে তাকিয়ে

ফের সোজা পথ ধরলে।

অমন করো না

হৃদয়ে দুঃখ দিতে নেই।

 

১৪।

মামা, চলো,

পিসিমা, তুমিও চলো।

 

মহুয়ার রস রেখেছি এক কলসি

দাদা-ভাই-জামাইবাবু— যে-ই আসুক

ঘরে যেটুকু আছে দেব

লজ্জা দিয়ো না কিন্তু!

 

১৫।

আচ্ছা, তুমি কোথায় আছ?

গেলেই-বা কোথায়?

তুমি আমার হৃদয়ের ফুল

অনেক দিন হলো তোমাকে দেখছি না।

তুমি যেখানেই থাক-না কেন

মনে রেখো,

তুমি আমার প্রাণসখা।

তাই বলে কি কোনোদিন

দেখা দেবে না?

 

১৬।

তুমি ফুল হয়ে ফোটো,

ও আমার মধুর ভালোবাসা,

হেলেদুলে ফোটো।

তোমার দিকে কেউ বাঁকা চোখে

না-তাকালেও

তোমার সুবাস আনন্দ ছড়াবে।

 

১৭।

তুমি লাল হয়েও ফোটো না

সবুজ হয়েও ফোটো না

ধবধবে সাদা হয়ে ফোটো

যেরক্ম বৃষ্টির ফুল সাদা।

 

১৮।

সূর্য যেমন একটাই

আমার ভাবনাও একটাই।

বেড়ে উঠে সরে যাওয়া আখ গাছের মতো

তুমিও আমার কাছ থেকে সরে গেছ।

 

১৯।

তুমি সোনা ধবধবে ধবলা

তুমি চাঁদের মতো আলো

আখখেত ঢুঁড়ে

আখ খেতে যাবার দিন থেকেই

তোমার সঙ্গে আমার প্রেম।

তুমি আমাকে ভুলে গেলে

নাকি আমি তোমাকে?

মনের তলাকার ভাবনাগুলো যে

হারিয়ে গেছে।

 

২০।

আজ তোমার সঙ্গে দেখা

কালও দেখা হেব।

আজকের দেখাটা স্মরণীয়

কাল তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে না।

 

২১।

ও আমার ফুলকুঁড়ি,

চারদিকে মেঘ।

আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছি,

দেখি, খন্ড খন্ড মেঘ

তোমাকে দেখার জন্য

এদিক-ওদিক তাকিয়েছি

দেখি, সেখানেও বিক্ষিপ্ত মেঘ।

 

২২।

কে কীভাবে বড় হয়েছি

কেউ জানে না।

এসো, সাথিরা, একজোট হই,

প্রেম-ভালোবাসা বিনিময় করি—

যাতে রোজ সকাল-সন্ধ্যা মনে থাকে।

 

২৩।

বৃষ্টিফুলের মতো ফুটতে ইচ্ছে করে,

ও আমার সোনা,

কিন্তু ফুটব কোথায়?

ফুটলেও আমার দিকে তাকাবে কে?

 

২৪।

ফুল হয়ে ফোটার ইচ্ছে ছিল

ফোটা হলো না

তোমার মতো গানও

গাওয়া হলো না

ঘুঘুপাখির মতো

ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদতেও পারিনি।

অন্তরের গোপন কথা

অন্তরেই থেকে গেল—

নিরালায় বলা হলো না।

 

২৫।

খাবার জোটেনি বলে কাঁদব না

তেষ্টার জন্যও কাঁদব না।

তোমাদের জন্যই শুধু কাঁদছি

যে যাবার সে চলে গেছে

মন খারাপ করা কেন?

যারা বেঁচে আছে তাঁরা কোথায়?

 

এসো, সমবেত হই

নেচে-কুঁদে রং-তামাশা করি।

 

২৬।

সিরিকি* পার হয়ে যাব

তবু তোর কাছে যাব না

ওহে জোয়ান ছেলে,

অবনিরও* পার হয়ে যাব

তবু তোর কাছে যাব না

চাষবাদ না-করা

গান গেয়ে বেড়ানো জোয়ান ছেলে,

ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদলেও

আমি তোর সঙ্গিনী হব না।

 

*সিরিকি- একটি নদীর নাম

*অবনরি- আরেকটি নদীর নাম।

 

২৭।

সারাদিন চোখের জল

ফেলে দেখেছি

কথা না-বলে, কিছু না-খেয়ে

থেকে দেখেছি

ও আমার অনজাল*,

হৃদয়ের ব্যথা পাবার মতো করে

আমাকে ভাবতে দিয়ো না।

হে আমার হৃদয়,

দুঃখ পাবার মতো করে

আমাকে ফোঁপাতে দিয়ো না।

 

* আনজাল- আদরের ডাক নাম।

 

২৮।

তুমি গাছপালার মতো

তরতর করে বেড়ে উঠছ;

প্যাঁচিয়ে বেয়ে ওঠা লতার মতো

আমিও তোমার শরীরে বেয়ে উঠছি।

 

২৯।

আমরা যেখানে নৃত্য করি

সেখানটা বালুচর,

আমারা যেখানে গা ধুই

সেটা নদীর জল,

ওগো বন্ধু আমার,

আমি যেখানে তোমাকে খুঁজে বেড়াই

সেখানে শুধু এজার-চারা*।

 

*এজার- এক ধরণের গাছ

 

৩০।

নদীপারের বাতাস

ঝিরঝির করে বয়, সোনা,

ঝিরঝির করে বয়।

বালুকাবেলায় নখ দিয়ে

ফুল-লতা পাখি আঁকার দিন থেকে

আমি তোমাকে আমার বলে ভেবেছিলাম

এখন কোথায় তুমি, সোনা?

কোথায় গেলে?

নাকি মাঝপথে শত্রু এসে

ফুসলে নিয়ে গেছে কোথাও?

 

৩১।

ও আমার লচপচি*,

তোর মুখখানা

জ্যোৎস্নার মতো উজ্জ্বল।

না-দেখার ভান করে

মাথাটা সামান্য বাঁকিয়ে

তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।

দেখা হলে ভালো লাগে,

সরে গেলে বুকে বাজে।

 

*লচপচি- আনন্দে চঞ্চলা। আদরের ডাকনাম।

 

৩২।

শিমুল ফোটার সময়

তোমার সঙ্গে আমার

দেখা হয়েছিল।

আবার একদিন

শিমুল ফোটার দিনেই

আমাকে বিদায় দিয়ে

চলে গেছ।

এখন তুমি কোথা থেকে

মাঝরাতে স্বপ্নে

আমার সঙ্গে হেসেখেলে

কথা বলো?

 

৩৩।

পারলে, ও আমার ফুলকুঁড়ি,

খুদে তারাদের এনে

মুক্তোর মালা গেঁথে

তোমাকে দিতাম।

একা পেলে,

ও আমার ফুলকুঁড়ি,

মনের সব কথা খুলে বলতাম।

গ্রীষ্মের তাপ আমাকে

নাইয়ে-ধুইয়ে ছেড়েছে,

তোমার ভালোবাসা

আমাকে হৃদয় চাপড়ে কাঁদাচ্ছে।

 

৩৪।

আমার ভাবনার এই হৃদয়

না-দেখা এক অরণ্য,

অরণ্যের নির্জনতায়

পাখপাখালির চাপা কান্না।

আমার চোখের জল এক নদী,

বাড়ন্ত যৌবন একটি নৌকো,

নৌকায় চড়ে পারহারা হলে

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মরব।

 

৩৫।

তোমাকে না-দেখে থাকতে পারি না,

ও আমার সোনা,

অন্যের বাড়ন্ত সমবয়সীদের দেখলেও

আমার চোখ জুড়োয় না।

ও আমার সোনা,

দীর্ঘশ্বাস ফেলে কী হবে?

তোমার আমার মিলন না-হলে

কী লাভ বেঁচে থেকে?

হে আমার দুধবরন রূপসী কন্যা

(উৎসবগীতি)

 

১।

নাচুনিরা দেরি কোরো না

তাড়াতাড়ি করো

সেজেগুজে বেরিয়ে পড়ো

পাখির মতো

ফুড়ুৎ করে চলে এসো।

বাইন মাছের মতো চুলগাছা

যত্ন করে আঁচরে নাও

এসো, এসো, উঠোনে পা ফেলি

ঝনঝনিয়ে নেচেকুঁদে মাতাল হই।

 

২।

হে আমার দুধবরন রূপসী কন্যা

দাঁড়াও, এখনই উঠো না—

জোড়া মিলিয়ে সিঁড়ি কাটাই হয়নি;

ওহে আমার রূপসী কন্যা,

দাঁড়াও, এখনই উঠো না

এখনও দেওধাই*-এর ধোঁয়া ওড়েনি।

 

ওঠো! ওঠো! দুধবরণ কন্যা,

জোড়া মিলিয়ে সিঁড়ি কাটা হয়েছে

দেওধাই-এর ধোঁয়া কুন্ডলী পাকিয়ে উঠছে।

 

*দেওধাই- নৃত্যভিত্তিক একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান।

 

৩।

তুমি আমার সামনে

আসা-যাওয়া করছ—

এই আছ এই নেই।

এসো, আজ উৎসবের দিন,

আমরা নৃত্য করি

বাদ্যযন্ত্র ঝনঝনিয়ে উঠছে

আকাশে গুড়গুড় শব্দ,

মেঘ আসছে।

আমরা বৃষ্টির ফুল,

এসো ফুটি!

নৃত্য করি—

আমরা জোড়া কপৌফুল*

একসাথে ফুটি।

 

*কপৌ- বিশেষ প্রজাতির অর্কিড।

পানকৌড়ি ডাকে ক-ল-পি ক-ল-পি

(দেওধনি গীত)

 

১।

বৃক্ষ-লতা ঝলমল করে বেড়ে ওঠে,

ওহে সুন্দর,

ফাগুনের ফুল হেলেদুলে নাচে

ওহে সুন্দর,

যুবক-যুবতীরা আনন্দে মাতোয়ারা

ওহে সুন্দর,

ইহজগতের মাটির পদক্ষেপগুলো

সার সার,

ওহে সুন্দর,

পদক্ষেপগুলো মুছে যায়,

ইহজগতের মাটির গ্রামগুলো,

হে আদি পুরুষেরা,

কল্যাণ করো।

ফাগুনের ফুলের মতো প্রস্ফুটিত করো,

উজ্জ্বল করো মাটির মানুষদের

ঢেউ খেলে উজান ঠেলে আসা

বাতাসের মতো!

 

২।

বৃক্ষ-লতার মাঝে

যেভাবে ফোটে ফুলের তোড়া

বসন্তের ফুল যেভাবে

মনোহর হয়,

হে অদৃশ্য ঈশ্বর,

আমরাও উঠতি ছেলে-মেয়ে,

আমাদেরও উজ্জ্বলভাবে বেড়ে ওঠা

বৃক্ষ-লতার মতো

সুন্দর কর,

অমঙ্গল থেকে রক্ষা করো

গ্রাম্য অতিথিকে পথ দেখিয়ে দাও

এই ঘোর অন্ধকার থেকে

আলোতে নিয়ে যাও

তোমার চলার পথ ধরে

আমরাও পথ খুঁজে নেব।

 

৩।

পানকৌড়ি ডাকে

ক-ল-পি

ক-ল-পি

ইনিয়ে-বিনিয়ে ডাকে

ক-ল-পি

ক-ল-পি

হে অপদেবতা,

তুমি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছ,

আমরা ইহজগতের বাদিন্দারা

যে-পথে চলেছি

সেই পথ আগলে ধরেছ

ক-ল-পি

ক-ল-পি।

ঋণ স্বীকার – ‘ফিনিক্স’ পত্রিকা ও গদ্যকার, অধ্যাপক শ্রী কান্তারভূষণ নন্দী মহাশয়।

আরও পড়ুন...