বি শে ষ র চ না | পর্ব ৭
ঝাড়বাতি
এবার অন্যরকম একটি ছবি তুলে ধরি। আমার দেখা এক তরুণ কবি সেই ছবির নায়ক। নব্বই দশকের কথা। আমি তখনও শিলং থেকে বরাবরের জন্য কলকাতায় ফিরে আসিনি। ছেলেটি কবিতা লিখত জানতাম। একই শহরে থেকেও ডাকে লেখা পাঠিয়েছিল। সম্পাদকের সঙ্গে দেখা না করার মানসিকতা আমার পছন্দ হয়েছিল। তাকে চিনতাম আমি। তারপর ঘনঘন নজরে পড়ছিল। সঙ্গে এক তরুণী। কখনও ওই ছোট শহরের কোনো রেস্টুরেন্টে, কখনও বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের ভিড়ে পাশাপাশি। দু’জনকেই চিনতাম। কিন্তু কারো সঙ্গেই পরিচয় ছিল না। মেয়েটি খুব ভালো গান গাইত। কয়েকটি অনুষ্ঠানে তাকে গাইতেও দেখেছি। ছেলেটি গান গাইতে না জানলেও নিশ্চয়ই খুব ভালবাসত সুরের মূর্ছনা। ফলে, এই ধরণের কোনো অনুষ্ঠান হলেই আমি ওদের দু’জনকে একই সঙ্গে দেখতে পেতাম। অথচ ওদের বাসস্থান শহরের দুই প্রান্তে। যে পাহাড়ি-শহরের যান চলাচল সন্ধের পর স্তব্ধ হয়, সেখানে ওদের মিলিত হয়ে দু’দণ্ড গল্প করার সময় কি শুধুই দিনের আলোয়? ছেলেটিকে দেখলেই আমার সত্তর দশকের কোনো প্রেমিকের কথা মনে পড়ত। পোশাক-পরিচ্ছদে সে যথেষ্ট আধুনিক হলেও তার উজ্জ্বল হাসির মধ্যে এক ধরণের কাপট্যবর্জিত নিষ্পাপ মুখশ্রীও ফুটে উঠত। নিশ্চয়ই সে তখনও কোনো চাকরি জোটাতে পারেনি। তা না-হলে ওই অসময়ে ঘনঘন প্রেমিকার সঙ্গে তাকে দেখা যেত না। হয়তো সদ্য কলেজ বা ইউনিভার্সিটি ডিঙিয়েছিল সে। কিংবা বেশ কিছু ইন্টারভিউয়ের ফলের অপেক্ষায়। আর শ্যামবর্ণা তন্বী মেয়েটির মায়াবী দৃষ্টি তার প্রতি যথেষ্ট সম্ভ্রম জাগাত। সে খলখল করে হেসে গড়িয়ে পড়ত না, অথচ ঠোঁটে ছিল তার হাসির ছোঁয়া। আবার তার হাসির আড়ালে কেমন যেন এক দুঃখের আভাসও পেতাম। সে কলেজ পর্ব শেষ করেছিল সদ্য। তখন শুধু গানেই ডুবে থাকতে চাইত। বেশ কয়েকটি গানের পরীক্ষায় পাশ করে ডিগ্রি নিয়ে বসেছিল। এসবই মেয়েটির বাবার কাছ থেকে জেনেছিলাম। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারি একটি দপ্তরের অধস্তন কর্মী ছিলেন। আমার সঙ্গে মাঝেমধ্যে রাস্তায় দেখা হলে কিছু সুখ-দুঃখের কাহিনি সেরে নিতেন। যেহেতু তাঁর মেয়েটির প্রতি আমার কিছু স্নেহ-মাখানো দুর্বলতা ছিল, অর্থাৎ তাকে ভালোভাবে, যাবতীয় দুঃখীভাব সরিয়ে প্রজাপতির মতন উড়তে দেখার ইচ্ছা জাগত- এই কারণেই তাঁর ওইসব ব্যক্তিগত কাহিনি তেতোমুখে গিলতে হত আমাকে।
একদিন তিনি জানালেন, “মেয়ের বিয়েটা তাড়াতাড়ি দিতে পারলেই নিশ্চিন্ত।” শুনে ভালো লাগল না। কেননা আমি জানতাম ওই তরুণ কবিটির সঙ্গে তার প্রেম তখনও পূর্ণতা পায়নি। বাধা দিয়ে বলেছিলাম, “আরে রাখুন, কী এমন বয়েস হয়েছে আপনার মেয়ের!” তাতে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার অভিব্যক্তির কোনো পরিবর্তন হত না। তিনি একটু অন্যমনস্ক, কুঁজো হয়ে ধীর পায়ে অফিস থেকে বাড়ি ফিরতেন প্রতিদিন। স্বাভাবিকভাবেই তিনি জানতে পারতেন না যে, তাঁর মেয়ে প্রজাপতির মতন ভেসে বেড়াচ্ছিল তখন। ভাসতে ভাসতে কোথায় গিয়ে পৌঁছবে তা ছেলেটি বা মেয়েটি কেন, কারোর পক্ষেই জানা সম্ভব ছিল না।
একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র হাতে পেয়ে যেতে হয়েছিল একদিন। কলকাতা থেকে কয়েকজন প্রথিতযশা সঙ্গীতশিল্পী এসেছিলেন। ওই তরুণ কবিটিকে আমি এই সংস্থার অন্যান্য অনুষ্ঠানেও একজন ব্যস্ত কর্ণধার হিসেবে ছুটোছুটি করতে দেখেছি আগে। অথচ সেদিন অডিটোরিয়ামে ঢোকার সময় ছেলেটিকে দেখতে পেলাম না। পরিবর্তে মেয়েটিকে হলুদ শাড়ির বুকে ব্যাজ লাগিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম একপাশে। তখনও অনুষ্ঠান শুরু হয়নি। হলের ভিতরে ব্যস্ততার গুঞ্জন। কিন্তু মেয়েটি ওভাবে অমন বিষণ্ণ কেন? তার দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি, বুকে দু’হাত ভাঁজ করে দেওয়ালে আলতো হেলান দেওয়া- পরিষ্কার বুঝছিলাম তার মন ভালো ছিল না সেদিন। আমার মনটাও খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম ছেলেটি ব্যস্ততায় ছুটোছুটি করবে আর মেয়েটি তার অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে গল্পের ফাঁকে দূরে ছেলেটির দিকে সলজ্জ দৃষ্টি ছুঁড়ে দেবে- এটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আশ্চর্য, কবিটিকে কোথাও দেখতে পাইনি। না, মঞ্চের পর্দা সরে যাবার পরেও, সেখানেও না! ততক্ষণে মঞ্চে সংস্থার অন্য সদস্যদের সমবেত উদ্বোধনী সঙ্গীত শুরু হয়ে গিয়েছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে আরো একবার পেছনের দরজার দিকে তাকিয়েও ওই তরুণ কবিটিকে দেখতে পাইনি সেদিন। হয়তো এজন্যই মেয়েটিও আজ মঞ্চে ওঠেনি। তার তো সমবেত সঙ্গীতের প্রধান গায়িকা হিসেবে হারমোনিয়াম ধরার কথা ছিল। তাকে তো এভাবেই দেখে অভ্যস্ত ছিলাম আমি। তার ওভাবে একা দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছিল সেদিন। ততক্ষণে স্থানীয় এক শিল্পী রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে শুরু করেছিলেন। ‘আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ…’- এই গান সেদিন সঠিক সুরের মাধুর্যে তেমন ফুটে না উঠলেও, স্রেফ ওই মেয়েটির অন্যমনস্ক দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি গানটিতে প্রাণ সঞ্চার করেছিল বলা যায়। আমি ওই দৃশ্য বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারছিলাম না। এবং মিনিট পনেরো পর চলেই যাব বলে ঠিক করেছিলাম। তখন কলকাতার একজন আমন্ত্রিত শিল্পী মঞ্চে উঠেছিলেন। এমন সময়, হঠাৎই প্রথম দরজার ভিতর ও বাইরে একটু চাঞ্চল্য লক্ষ্য করলাম। ব্যাজ পরিহিত কয়েকটি তরুণ খুশিতে উচ্ছল। ওই তো, ওই যে সেই ছেলে! তরুণ কবি। কাঁধে একটা চামড়ার ব্যাগ। অন্য একজন তার কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে রাখল দরজার পাশে। সবাই, কাছাকাছি থাকা অধিকাংশ সদস্যই এসে তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে যাচ্ছিল। তবে কি শহরের বাইরে গিয়েছিল সে? কোনো চাকরির ইন্টারভিউ বা অন্য কিছু পরিকল্পিত কাজ সেরে তার এই ফিরে আসা? প্রথমে বাড়ি না গিয়ে সরাসরি অনুষ্ঠানে চলে আসার উদ্দেশ্যই বা কী? আমি মুচকি হেসে লক্ষ্য করছিলাম ছেলেটির দৃষ্টি বন্ধুদের এড়িয়ে কিছু খোঁজার চেষ্টা করছিল যেন! হলের চতুর্দিকে ঘুরে একেবারে মাঝামাঝি জায়গায় এসে স্থির হয়ে গিয়েছিল তার চোখ। উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল তার চোখমুখ। সবার অলক্ষ্যে হাত তুলে কী যেন ইঙ্গিতও করেছিল সে। আমিও ঘাড় ঘুরিয়ে তার দৃষ্টি অনুসরণ করেছিলাম। প্রত্যাশিতভাবেই লক্ষ্য করেছিলাম মেয়েটির মুখ থেকে আশঙ্কার যাবতীয় মেঘ সরে গেল যেন। তাকে হাসতেও দেখলাম। সব দেখা সাঙ্গ হলে আমিও উঠে দাঁড়িয়েছিলাম বাড়ি ফেরার জন্য, একজন তরুণ কবির সুখানুভূতির যাবতীয় রেশ নিজের অঙ্গে মেখে বেঁচে থাকার আশায়।