ছো ট গ ল্প
‘স্যরি, বাঁচানো গেল না। শেষের দিকে যথাসম্ভব রক্ত নিতে পেরেছিল। কিন্তু অজ্ঞান অবস্থায় সম্ভবত কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। ভেরি স্যরি !’—কথাটা শেষ করেই নির্মলেন্দুর কাঁধে হাত রেখে তাকে সান্ত্বনা দিলেন ডাক্তার চৌধুরি, তারপর মাস্ক খুলে নার্সিংহোমের করিডোর দিয়ে চলে গেলেন অন্যপ্রান্তে। নির্মলেন্দু চশমাটা খুলে রুমাল দিয়ে নিজের ভিজে চোখজোড়া একবার মুছে নিয়ে সুরপার দিকে তাকিয়ে দেখল, সুরপা ভেঙে পড়ে কাঁদছে । একজন নার্স আইসিইউ থেকে বেরিয়ে এসে বলল, ‘আপনারা ভিতরে যেতে পারেন।’ নির্মলেন্দু সুরপার পাশে গিয়ে বসতেই সুরপা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। মেয়ের মৃত্যুশোকের দিনেও নির্মলেন্দুর ষাট বছরের পুরুষ চিবুক সুরপা বুকের স্পর্শে ঈষৎ আন্দোলিত হল, কিন্তু নিমেষে মিলিয়েও গেল । যে ক’দিন নার্সিংহোমে চিত্রা ভর্তি ছিল, সেই ক’টা দিন তারা দু’জনেই এসেছে । দীর্ঘ তিরিশ বছর পর এই সন্তান-শোক সুরপাকে বাধ্য করল নির্মলেন্দুর বুকে নিজেকে এভাবে পেতে দিতে । মেয়ের বয়স যখন তিন বছর, সুরপা তখন বিভোর ছিল তার নিজস্ব লাবণ্যে, ভরন্ত যৌবনে । আত্মবিশ্বাসে কোথাও তার খামতি ছিল না, সহজেই সে ভাঙতে পেরেছিল নির্মলেন্দুর সঙ্গে গড়ে ওঠা এই জীবনের দাম্পত্যকে । ভয় হয়নি চিত্রার কথা ভেবেও । সন্তানের প্রতি সুরপার ভালবাসা ছিলই, কিন্তু নির্মলেন্দুর সঙ্গে থাকার জন্য সেটা যথেষ্ট ছিল না । সুরপার কেবলই মনে হত, তার শরীর মনের প্রকৃত দাবিদার, তার অন্তরঙ্গ প্রেমিক যেন জীবনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে । যে পুরুষ পারে তাকে নারী হিসাবে ফুটিয়ে তুলতে, সেই পুরুষের কাছেই তার আত্মা বিশ্রাম পাবে, যে আত্মা অনেক দিন ভুগেছে নির্মলেন্দুর সংসারে ।
তিরিশ বছর আগে তাই নির্মলেন্দুকে ছেড়ে যখন দীপ্তেশকে বিয়ে করে সুরপা, তখন নতুন প্রেমের অহংকারে পুষ্ট ছিল সে । নির্মলেন্দুকে তার অপরাধী মনে হত । চিত্রাকে পৃথিবীতে এনে নির্মলেন্দু যেন বাঁধতে চেয়েছিল সুরপাকে, পারেনি। মেয়ে হিসাবে সে স্বাবলম্বী, ডিভোর্স দিয়ে অন্য পুরুষের হাত বেছে নেওয়ার অধিকার তার আছে। নির্মলেন্দুর গুমোরকে সে জুতোর তলায় পিষে দিয়ে দীপ্তেশের কাছে চলে আসে, আর ফেরেনি ওদের বাবা-মেয়ের জীবনে । চিত্রা বড় হওয়ার পর, মেয়ের সঙ্গে সুরপা যোগাযোগ রাখত, কিন্তু ইচ্ছে করেনি নির্মলেন্দুর ব্যাপারে খোঁজ করার । দীপ্তেশের কাছে যেদিন ঝড়ের মতো ভেঙে পড়ে তার বছর চল্লিশের বিগলিত শরীর, সেদিন শুধু চিত্রার কথাই তার মনে পড়েছিল । দীপ্তেশই সেই পুরুষ যার নিঃশ্বাসের গরমে ফুটেছিল সুরপার জীবনের কুঁড়ি । তখন নির্মলেন্দুর জন্য তার স্রেফ করুণা জেগেছিল মনে । সে চেয়েছিল নির্মলেন্দু কাউকে বিয়ে করুক, অন্তত চিত্রার জন্যে ।
কিন্তু নির্মলেন্দু আর বিয়ে করেনি । আর এই ব্যাপারটাই আশ্চর্য করেছিল সুরপাকে । সুরপা দীপ্তেশের সঙ্গে বহুকাল সুখেই ছিল, কিন্তু নির্মলেন্দুর চিরকাল একা থেকে যাওয়াটা তাকে গভীরে কোথাও পরাস্ত করত প্রতিদিন । সম্পর্ক থাকুক বা না-থাকুক, ভালবাসা ও ঘৃণায় মানুষ চিরকাল জিততে চায়, আর সেটা না পারলেই সমস্ত জীবন সে থেকে যায় বিভ্রান্তি নিয়ে, প্রতিদিনের আগুন তাকে রোজ পুড়িয়ে মারে । ভাল থাকার সুখে আর কতকাল নিজেকে বঞ্চিত রাখা যায় ? তাই, হঠাৎ একদিন সুরপা দীপ্তেশকে বলে বসল, ‘তুমি আমাকে চিরকালের জন্য যাযাবর করে তুললে !’ কী মনে করে সুরপা আর দ্বিতীয়বার মা হতে চায়নি । আজ তার মনে হচ্ছে, ‘মা’ শব্দটা যেন ওর জন্যে কখনওই উপযুক্ত ছিল না । চিত্রাকে যদি সে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখত, তা হলে হয়তো মেয়েটা বাঁচত । কিন্তু অলিখিত ভাঙন বোধহয় প্রতিটি সংসারের নিয়তি । নইলে মেয়েকে তো মানুষ করেছে নির্মলেন্দু, কিন্তু সেও কেন ভেঙে ফেলল ‘বিয়ে’ নামক সামজিক প্রতিষ্ঠানের বাধ্যবাধকতাকে ? আশ্চর্য লাগে, চিত্রার ঐ চার বছরের ছেলেটাকে দেখে ! মায়াভরা মুখ নিয়ে সে তার শৈশবেই মা-কে হারাল ।
ইন্টারকেয়ার রুমের ভিতরে ঢুকে নির্মলেন্দু দেখল, মেয়েটার দেহ থেকে খুলে নেওয়া হয়েছে চিকিৎসার সরঞ্জাম । স্যালাইন ও রক্তের বোতলের সরু পাইপ গুটিয়ে রাখা । চারঘন্টা পরে এসে ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেট দেবে, তারপর ওরা মেয়ের মরদেহ নিয়ে যেতে পারবে দাহ করার জন্য । সুরপা মেয়ের মাথার কাছে গিয়ে বসল, কপালে একবার হাত বুলিয়ে সরিয়ে নিল অগোছালো চুল, বুকের চাদরটা টেনে দিল গলা পর্যন্ত । নির্মলেন্দু এই ফাঁকে কাচের দরজা ঠেলে বেরিয়ে গিয়ে ফোন করল আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের। নির্মলেন্দু যখন ফোনে ব্যস্ত, সেই সময় চিত্রার চার বছরের ছেলেকে নিয়ে দরজা ঠেলে ঢুকল এক প্রৌঢ় লোক— চোখে চশমা, মাথার চুল ও গালের দাড়িতে নুন-মরিচের ছাপ, বয়স অন্তত ষাটের কাছাকাছি হবে, নির্মলেন্দুর চেয়ে মাত্র পাঁচ বছরের ছোট, নিখিলেশ—চিত্রার বর্তমান স্বামী !
নিয়মরক্ষা করার মতো দায়ে পড়ে নির্মলেন্দু চিত্রার আগের শ্বশুরবাড়িতে খবর দিল যে চিত্রা আর নেই । মৃত্যুর খবর শুনে চিত্রার আগেরপক্ষের স্বামী দু’একটা খোঁজ খবর নিল শুধু, অনুশোচনা দেখাল না । অথচ এই ছেলের হাতে সে একদিন তার একমাত্র মেয়েকে তুলে দিয়ে বলেছিল, ‘মেয়েটাকে দেখো।’ নার্সিংহোমের কাজ ফুরোতে এবং ডেথ সার্টিফিকেট পেতে ঘন্টা চারেকেরও বেশি সময় লেগে গেল । তারপর চিত্রাকে আনা হল ফ্ল্যাটে, যেখানে সে তার বাবা নির্মলেন্দুর সঙ্গে বেশ কিছুমাস থাকত মৃত্যুর আগে অবধি । নিখিলেশের সঙ্গে দমদমের ফ্ল্যাটে খুব বেশি বছর সে থাকতে পারেনি । শেষের দিকে তার শরীর এতটাই বিপন্ন হয়ে পড়ে, অসুখ তাকে এমনভাবেই চেপে ধরে চারপাশ থেকে, তখন নির্মলেন্দুই চিত্রাকে বলে, ‘মা, তুই আমার কাছে এখানেই থেকে যা।’ বিগত দিন সাতেক সে ভালই ছিল, সুস্থ ছিল আগের চেয়ে। রক্তের প্রয়োজন হয়নি, ইঞ্জেকশান ও ওষুধপত্র চলছিল নিয়মমাফিক, কিন্তু দু’দিন আগেই গভীর রাত্রে ঘুম ভেঙে যায় চিত্রার, শুরু হয় শ্বাসকষ্ট । ওষুধ খেয়েও কিছুতেই অস্বস্তি কমছে না দেখে নির্মলেন্দু ফোন করে হেমাটোলজিস্ট ডাক্তার চৌধুরিকে । তাঁর পরামর্শেই নির্মলেন্দু চিত্রাকে আবার ভর্তি করে নার্সিংহোমে । আজ চিত্রাকে নিয়ে ফিরছে সেই ফ্ল্যাটে, যেখানে ছোট থেকে ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠেছে সে ।
দুপুরের খানিক পরে চিত্রার দেহ ফ্ল্যাট থেকে শ্মশানগামী হল । দাহকার্য শেষ করে সন্ধেবেলায় যখন তারা ফ্ল্যাটে ফিরে এল, তখন একে একে সব আত্মীয়রা বিদায় নিয়েছে । নির্মলেন্দু, সুরপা আর নিখিলেশ ফ্ল্যাটে রয়ে গেল, সঙ্গে ছিল চিত্রার চার বছরের মা-হারা ছেলেটা । শোকের গভীরতা যাই হোক না কেন, শিশুর মন তাতে দ্রবীভূত হয় না । সুরপা সকলের জন্য চা করে এনে বাচ্চাটাকে একটা কেক আর একটু দুধ খাইয়ে দিল । নিখিলেশের সঙ্গে বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে সিগারেট খাচ্ছিল নির্মলেন্দু । উভয়ের শোকই যথাসম্ভব মনের গভীরে চাপা, বাইরে শুধু পারস্পরিক সান্ত্বনা । সুরপা সেটা ভালভাবেই বোঝে । কিন্তু অদ্ভুত লাগে তার এই নিখিলেশ লোকটাকে । স্ত্রী’র মৃত্যুতে কোনও ক্লেশ নেই চোখেমুখে, যেন সে চিত্রাকে অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছিল । চিত্রার মতো অমন সুন্দর প্রস্ফুটিত যুবতী এই পুরুষটার জন্য তার বিয়ে ভেঙে ফেলল ! এমন নির্বিকার পুরুষকে সুরপার কখনওই পছন্দ হত না । যৌবনের অপছন্দগুলো তার মধ্যবয়সেও রয়ে গেছে । নির্মলেন্দুর মধ্যে ছিল না অস্থিরতার মাধুর্য, ছিল না হিংস্র কামড় যা একটা মেয়ে বিয়ের পর আশা করে তার দাম্পত্যে, তাই নির্মলেন্দুর সঙ্গে জীবনটা তার শেষ অবধি গেল না । কিন্তু চিত্রা তার পেটের মেয়ে হয়ে নিখিলেশের মতো একটা উদাসীন পুরুষের সন্তান কী করে চেয়ে বসতে পারে ? বাইরের ঘরের সোফায় চিত্রার ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে ছিল সুরপা । এ ছেলে তো চিত্রা আর নিখিলেশেরই ছেলে । চিত্রা যখন তার প্রথম পক্ষের স্বামীকে ডিভোর্স করে তখন তার বাচ্চা হয়নি । ভিতরের ঘরের আলো নেভানো অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে বারান্দায় বসে থাকা নিখিলেশকে একদৃষ্টিতে চেয়ে দেখছিল সুরপা । হঠাৎ মনের গভীরে পাপের একটা ছটা এসে লাগল । মুখ ঘুরিয়ে নিল সে । সেদিন রাত্রে নির্মলেন্দু অনেক করে বলার পরেও নিখিলেশ থাকল না, ছেলেকে নিয়ে চলে গেল । যাওয়ার সময় একটা খামবন্দি চিঠি সুরপার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘চিত্রার লেখা চিঠি, আপনাকে।’
চিঠিটা হাতে নিয়ে বাইরের ঘরে সোফায় এসে বসে পড়ল সুরপা । সামনের কাচের টেবিলে খামসুদ্ধু চিঠিটা রেখে তার ওপর ফ্ল্যাটের চাবির গোছাটা রাখল । নির্মলেন্দু ততক্ষণে পরনের পাঞ্জাবিটা খুলে রেখে পাজামা ও স্যান্ডো গেঞ্জি পরে বিছানায় শুয়েছে । ‘চিঠির ব্যাপারে তুমি কিছু জানতে ?’ ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে নির্মলেন্দুকে প্রশ্ন করে সুরপা ।
—না ।
—তোমার মেয়ে হঠাৎ আমাকে কেন চিঠি লিখতে গেল ?
বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করল সুরপা ।
— আমার মেয়ে ? চিত্রা তোমার কেউ নয় ?
নির্মলেন্দুর এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া উচিত বলে মনে করল না সুরপা । বরং, সে একটা বিষয় ভেবে আশ্চর্য হল, কেন চিত্রা এই চিঠি তাকে বেঁচে থাকতে পাঠাতে পারেনি ! পাঠালই যদি, তাও নিখিলেশের হাত দিয়ে । চিত্রাকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার সময় সে নিজে হাতে চিত্রার কপাল রাঙিয়ে দিয়েছে সিঁদুরে । তার সৌভাগ্যবতী মেয়ে শাঁখা-সিঁদুর নিয়ে চিতায় উঠেছে, অথচ ফেলে গিয়েছে তার দুর্ভাগ্যের সংসার, যে সংসার সে নিজেই বেছে নিয়েছিল । ঘরের নেভানো আলোটা জ্বেলে দিয়ে সুরপা বলল, ‘আর শুয়ে থেকো না, ওঠো । একটু কফি করি, মাথাটা অসহ্য যন্ত্রণা করছে ।’
বাইরের ঘরে বড় সোফাটায় নির্মলেন্দু পা তুলে আরাম করে আধাশোয়া হয়ে ছিল, সুরপা ট্রে-তে দু’কাপ কফি নিয়ে এসে সামনের কাচের টেবিলে রাখল । নির্মলেন্দুর কাপটা এগিয়ে দিতেই নির্মেলন্দু বলল, ‘চিঠিটা পড়লে ?’
—এইবার পড়ব । মেয়েটার কথা ভীষণ মনে পড়ছে জানো । সেই ছোটবেলায় ওকে নিয়ে আমরা দার্জিলিং গিয়েছিলাম, পুরনো সেই ছবির অ্যালবামটা দেখছিলাম আলমারি থেকে বের করে । ওর নতুন পোশাকগুলোয় এখনো লেগে আছে শরীরের গন্ধ, অথচ মেয়েটাই নেই !
নির্মলেন্দু নিশ্চুপ হয়ে কফি খেতে লাগল । শুধু একবার বলল, ‘জীবনের কোনও ব্যাপারেই কোনও দিন মেয়েটা অভিযোগ জানায়নি, অথচ ওরই রক্তে শ্বেতকণিকাগুলো বিদ্রোহ করে বসল ।’ নির্মলেন্দুর এই কথার উত্তরে সুরপা কোনও কথা বলল না । কফির কাপে একটা চুমুক দিয়ে শাড়ির আঁচলে চশমাটা মুছে চোখে পরল, তারপর খামটা ছিঁড়ে ভিতর থেকে ভাঁজ করা মোটা ধবধবে সাদা কাগজের চিঠিখানা খুলে মেলে ধরল চোখের সামনে ।
সুরপা চিঠিটা পড়তে শুরু করার আগে সঙ্কোচে চশমার আড়াল থেকে ফিরে তাকাল নির্মলেন্দুর দিকে । নির্মলেন্দুর চোখে চোখ পড়তেই সে চিঠিতে ফিরিয়ে আনল দৃষ্টি । নির্মলেন্দু বলল, ‘চিঠিটা পড়তে তোমার সুবিধা হবে কি আমি অন্য ঘরে গেলে ?’
—না, ব’সো ।
—পড়ো তা হলে চিঠিখানা ।
কথাটা বলে সোফায় নিজেকে হেলান দিয়ে চোখ বুজল নির্মলেন্দু । সুরপা পড়তে শুরু করল—
মা,
অনেক দ্বিধা ও জীবনের অনেক শূন্যতা নিয়ে তোমাকে এ চিঠিখানা লিখছি । আর হয়তো তোমাকে চোখে দেখার সুযোগ ঈশ্বর আমাকে দেবেন না । ভাগ্যের অশেষ কৃপায় আমি এ জীবন থেকে দ্রুত ছুটি পেলাম । বাবার কাছে জীবনের শেষ ক’দিন কাটাতে যাচ্ছি, জানি না আর আমার ফেরা হবে কি না ! আমার হতভাগ্য জীবনে তোমার প্রতি যদি কোনও অপরাধ থেকে থাকে, তুমি মা হয়ে সেটা ক্ষমা করে দিও ।
বাবা আমার সাধ করে নাম রেখেছিল চিত্রাঙ্গদা, তোমাদের আদরের চিত্রা । যে মেয়ে বাবা-মায়ের আদরে বড় হওয়ার কথা, সে মেয়ে একা একাই ঘরকন্নার সমস্তটা শিখে ফেলল । জ্ঞান হওয়ার পর দেখতাম আমার বাবা মগ্ন থাকত তাঁর ওকালতির কাগজপত্র নিয়ে । আমার লেখাপড়ার বিষয় ছাড়া আর কোনও ব্যাপারে তাঁর জিজ্ঞাসা ছিল না । দু’একদিন আমার সাজ নিয়ে একটু আধটু হাসতেন । ছোটবেলায় আমার অসুখ করলে তিনি সর্বদা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন ডাক্তার ডাকতে । আমার পছন্দ, অপছন্দ, জরুরি জিনিস, শখের উপকরণ, কোনও বিষয়েই তিনি কোনও খামতি রাখেননি এটা বোঝানোর জন্য যে আমার জীবনে তুমি নেই । পরে জানলাম, তুমি তোমার জীবনকে নতুনভাবে সাজাতে অন্যত্র চলে গিয়েছ আমাকে বাবার কোলে রেখে । বাবা আমাকে মানুষ করল, বলা ভাল আমিই তাঁকে মানুষ করলাম । আমাকে মানুষ করা ছাড়া তাঁর আর কোনও দ্বিতীয় স্বপ্ন ছিল না বলে তুমি চলে যাওয়ার পরে আমি আর কোনও নতুন মা-কে পাইনি । ভেবেছিলাম তোমাকে আবার ফিরিয়ে আনব আমার ঘরে, আমার পুরনো ফ্রকে, হেয়ারব্যাণ্ডে, যুবতীবেলার চুড়িতে, লিপস্টিকের রঙের মধ্যিখানে, কিন্তু তুমি আর এলে কই ! তাই, নিরুপায় হয়ে নিখিলেশের হাত দিয়ে তোমাকে এ চিঠিটা পাঠালাম ।
এমএ পড়তে পড়তে আমার বিয়ে হয়ে গেল । প্রেমিকের অভাব আমার যৌবনে কখনও হয়নি, কিন্তু আমাকে গ্রহণ করার মতো কোনও মানুষ যখন এগিয়ে এল না, বাবা তখন আমার সম্বন্ধ করল এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে । আমি উঠে এলাম আমার শ্বশুরবাড়ি হালতুতে । আমার স্বামী অসিত, সে একজন নামকরা ইঞ্জিনিয়ার, কোল ইণ্ডিয়ার বড় অফিসার । শ্বশুরবাড়ির পারিবারিক বৃত্ত খুব বড় নয়, —শ্বশুরমশাই, শাশুড়ি মা এবং এক অবিবাহিত ননদ মধুশ্রী । মানুষের তুলনায় বড় চেহারার বাড়িতে এসে প্রথম কিছুদিন আমার ভালই কাটলো, তবে মাঝেমধ্যে বাবার শরীরের কথা ভেবে চিন্তায় পড়তাম । আমাকে যথাসম্ভব ভাল রাখার জন্য অসিত আমাকে বেড়াতে নিয়ে যেত পাহাড়ে, দু’একবার স্বাদ বদল করে সমুদ্রে । তবু, ভিতরে একটা টানাপোড়েন ছিল, বিয়ের আগে আমি যেমনটা মেলে থাকতাম আমার নিজের বাড়িতে, এখানে এসে যেন কিছুতেই তেমনটা মেলতে পারছি না নিজেকে । যেন অদৃশ্য শত্রু এসে কেটে দিয়েছে আমার দু’টি ডানা । অসিতের সংসারে যথেষ্ট সুখ ছিল, আমার জায়গায় অন্য কোনও মেয়ে হলে হয়তো সে সুখীই হত । কিন্তু আমার চঞ্চল মন, যা এতদিন মাছের মতো সাঁতরে বেড়াত নদীর জলে, তা কেমন যেন আটকা পড়ে গেল এ বাড়িতে বিয়ে হয়ে এসে । আমি সংসার করতে লাগলাম, বন্ধু পাতালাম তরুণী ননদের সঙ্গে, তবু মনের অনেক নিচে এক চিলতে উদাসীনতা লেগে রইল ।
একদিন ঘর গোছাতে গিয়ে আয়নায় দেখলাম বিয়ের চিহ্নটুকুতে ঢাকা পড়েনি আমার আগেকার সৌন্দর্য । ভিতরে অভাব যাই থাকুক না কেন, ঈশ্বর আমাকে বাইরে কোনও অংশে বঞ্চিত করেনি । ভাগ্যে যা ঘটার তা ঘটে গিয়েছে ভেবে স্থির করলাম বন্ধ থাকা লেখাপড়াটা আবার চালু করব । সেই মতো অসিত ফিরলে রাত্রে তাকে বললাম ।
—ভাবছি আমি আবার ইউনিভার্সিটিতে যাব, মাস্টার্সটা কমপ্লিট করব । কী বলো ?
অসিত বালিশে হেলান দিয়ে সিগারেট খাচ্ছিল । আমার দিকে না তাকিয়েই বলল, ‘বেশ তো, তোমার যা ভাল মনে হয় করো । আমার কোনও আপত্তি নেই ।’ মৃদু হেসে মেনে নিয়েছিলাম ওর কথা । তখনও বুঝিনি, আপত্তি না থাকলেও, আমার প্রতি ওর কোনও উৎসাহ নেই । লেখাপড়ায় ব্যস্ত হয়ে যাওয়ার কিছুদিন পরেই আমার শ্বশুরমশাই চোখ বুজলেন । শাশুড়ি মা হলেন সংসারের কর্ত্রী । বছর ফিরতে ননদ মধুশ্রীরও বিয়ে হয়ে গেল । তার কিছুদিন পর অসিত চাকরিসূত্রে দিল্লি চলে গেল, আমাকে কথা দিয়ে গেল মাসে সে একবার করে বাড়ি আসবে, এসেই আমাকে নিয়ে উত্তর-ভারত বেড়াতে যাবে । ততদিনে আমি যেন মন দিয়ে লেখাপড়া করি, পরীক্ষায় পাশ করে যাই ।
বাড়িতে তখন মাত্র দুটি মানুষ, আমি আর আমার শাশুড়ি । আমাদের শাশুড়ি-বৌয়ের মধ্যে সৌজন্য ছিল বাইরে থেকে, কিন্তু আমি নিশ্চিত জানতাম তাঁর কর্তৃত্বে আমার ভাগ বসানোটা তিনি কিছুতেই মেনে নেবেন না । আমি সংসারে মন হারালাম । বাইরের বারান্দায় যেখানে আমি দুপুরবেলায় বই পড়তাম, কাগজ-পেন্সিল নিয়ে ছবি আঁকতাম, তার উল্টোদিকের ফাঁকা জমিটায় একটা বহুতল উঠে গেল । আমার দৃষ্টি সেই বহুতলের পাঁচিলে ধাক্কা খেয়ে আবার আমার মধ্যেই ফিরে আসতে লাগল । স্বামীকে টেলিফোনে জানালাম, আমি নতুন একজন মাস্টারের কাছে ভর্তি হয়েছি । প্রতিমাসে ফি বাবদ দু’হাজার টাকা এবার থেকে বেশি লাগবে।
অসিত আপত্তি করেনি দু’হাজার টাকা বাড়তি দিতে । কেন করেনি সেই কথাটাই আজ আমাকে আশ্চর্য করে ! যদি করত, হয়তো আমি বিরক্ত হতাম, কিন্তু আমাদের দাম্পত্যে অন্তত তাতে একটা ঝোড়ো বাতাস আসত, উড়িয়ে নিয়ে যেত নিঃশব্দে সম্পর্কের কোণে জমে ওঠা ঝুল কিংবা ধুলোবালিকে । আমার বিষয়ে অসিতের সমস্ত প্রশ্রয় তিলে তিলে পরিণত হত ওর নিরুৎসাহে, আমি সেটা ঢের বুঝতাম ওর চোখের দিকে তাকিয়ে । সংসারের চৌকাঠের মধ্যে আমি নিজেকে দত্তবাড়ির বৌ বলে ভাবতাম, সেই গরিমা আমার মুছে গেল নিখিলেশের কাছে পড়তে এসে । নিখিলেশ, তোমার জামাই, আমার বর্তমান স্বামী ।
অরুণাকে মনে আছে তোমার ? আমার সঙ্গে বিএ ফাইনাল দিয়েছিল অরুণা, নিখিলেশ সম্পর্কে অরুণার কাকা হয় । নিখিলেশ আমাকে গ্রহণ করার পর থেকে অরুণা আমার সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখেনি । সেটাই স্বাভাবিক, আমাদের সমাজে ‘মেয়েমানুষ’ শব্দটার সঙ্গে পবিত্রতা বা অপবিত্রতা বিষয়টা জড়িয়ে । আমরা যে রক্তমাংসের, আমাদের ভিতরেও যে জাগতে পারে বাঁচবার স্ফুলিঙ্গ, এ কথা জগৎ কখনও স্বীকার করে না । যাই হোক, আমার সত্তা সেদিন থেকে দু’টুকরো হল, যেদিন জানতে পারলাম নিখিলেশ মানুষটা আমার চেয়েও একা, অন্ধকারে নির্ধূম জ্বলছে ওঁর পুরুষত্ব।
আমার সেই মাস্টারমশাইকে আমি প্রথম থেকেই সরিয়ে রেখেছিলাম শ্রদ্ধার দূরত্বে, কেননা তাঁর বয়স আমার পিতার বয়সের প্রায় কাছাকাছি, বিদ্যা ও জ্ঞানার্জনে তিনিই আমার শিক্ষক । এছাড়াও আরেকটি বিষয় যা আমি নিজেকে তখনও বুঝিয়ে রেখেছিলাম, তা হল আমি একজন পতিব্রতা স্ত্রী, নিজেকে মেলে ধরার ব্যাপারে আমি যতদূর সম্ভব আড়ষ্ট হয়ে থাকলাম । নিখিলেশ তখনও পর্যন্ত আমার মাস্টারমশাই, আমি যখনই তাঁর বাড়িতে পড়তে যেতাম, মুগ্ধ হতাম তাঁর গভীরতায় । মস্ত একটা দোতলা বাড়িতে অসীম নির্জনতাকে বুকে নিয়ে বাস করত মানুষটা । ঘরগুলোতে যৎসামান্য একার মতো আসবাব, বাকি দেওয়ালের সমস্ত অংশ জুড়েই যেন বইয়ের বাগান । আমি সেই প্রাচুর্যে নিজেকে হারাতাম, খুঁজতাম, কিছু সময়ের জন্য আমার বিবাহিত সত্তাটা পড়ে থাকত আমার মনের বাইরে । এমনই একদিন মেয়েমানুষি অবহেলায় ভুল করে আমার কানের দুলজোড়ার একটা ওঁর বাড়িতে খোয়ালাম । পরদিন পড়তে গেলে ছুটির পর সে আমাকে একটু দাঁড়িয়ে যেতে বলল ।
—এই কানের দুলটা বোধহয় তোমার, গতকাল আমার ঘরে হারিয়েছিলে, নাও ধরো ।
আমি নির্লজ্জের মতো তাঁর হাত থেকে হারানো দুলটা নিলাম । সে আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ, আমিই দৃষ্টি ফেরালাম অন্যত্র । কিন্তু আমার মনের দৃষ্টি সজাগ রইল তাঁর ওপর । ইতিমধ্যে আমি আরেকটা ব্যাপার জেনেছিলাম, নিখিলেশ অধ্যাপনা ছাড়াও লেখালিখি করে । তাঁর কিছু লেখা আমি ইতিমধ্যেই পড়েছিলাম, সেইসূত্র ধরে শুরু হল লেখাপড়ার বাইরে বাড়তি কথার আলাপ । জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি লেখেন, সে কথা আগে বলেননি তো আমাকে !’
শুনে শিশুর মতো হাসল নিখিলেশ । বলল, ‘লেখার কথা মুখে বলা যায় না কি ? মানুষ তো লেখার ভাষাতেই নিজেকে সুদূরে নিয়ে যায়, কথার ভাষায় ফিরিয়ে আনে কাছে ।’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর সংলাপে ?’
সে মৃদু হেসে জবাব দিল, ‘সংলাপে প্রতিটা মানুষ সাজায় নিজেকে ।’
নিখিলেশের বাড়ি থেকে ফিরে সেদিন সমস্ত সন্ধেটা বসে রইলাম অন্ধকারে । আমার প্রতি তাঁর যে একটা বিশেষ দৃষ্টি আছে, সেটা আমি বুঝতে পারি, কিন্তু যেমনভাবে আমি চাইছি দৃষ্টিটা ঠিক সেইভাবে আমার ওপর পড়ছে কি না এটা নিয়েই মনের গোপনে একটা সন্দেহ জন্মে রইল । মেয়েদের স্বভাব ঠিক কোন জায়গায় এসে খারাপ হয়ে পড়ে তা কি আগে থাকতে বলা যায় ? পুরুষই-বা কোন বয়সে এসে হঠাৎ হারায় তার সংযম, তাও আমরা জানি না । যে আশা নিজের চোখে স্বয়ংসম্পূর্ণ, বস্তুত তা অন্যের চোখে স্বভাবদোষের । শুধু এটুকু জানি, লেখাপড়ার ক্লাসের পর বহুদিন অনেক দেরি পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে আমি আলোচনা করতাম সাহিত্যের নানা প্রাসঙ্গিক দিক, খুঁজতাম জীবনের অনেক গূঢ়তম মুহূর্তের মানে । অরুণার কাছে জানলাম, ওঁর স্ত্রী অনেক বছর আগেই ওঁকে ডিভোর্স দিয়েছে ওঁর এই নিষ্ঠুর গাম্ভীর্যের জন্য । আজ এতদিন পরেও সেই গাম্ভীর্যের এতটুকু নিঃশেষ হয়নি । সমস্ত বাড়ির ঘর দুয়ার বন্ধ করে সে একাকী লেখালিখি করে, বই পড়ে, সম্পূর্ণ ডুবে থাকে মদের নেশায় । তবু, নিষ্ঠুরতার আড়ালে শিশুর মতো লুকিয়ে থাকে তাঁর পুরুষ-সুষমা, যা সে বাইরে কখনও প্রকাশ করবে না । আমার প্রতিটি দিন কাটতে লাগল মনের গোপন অত্যাচারে । আমাদের মধ্যে কী সেই সত্য চাপা পড়ে আছে, যা আমার সমস্ত দিনটাকে মেঘলা করে দিচ্ছে, এবং তাঁকেও টেনে নিয়ে যাচ্ছে ভয়ানক আঁধারে ! একটা ডুবন্ত ইচ্ছা হঠাৎ করে ভেসে উঠতে লাগল আমার স্বপ্নে, বেঁচে থাকাকে লঙ্ঘন করে, আমার বিবাহিত জীবন পার হয়ে ।
কিছুদিন পর আমি অনুভব করলাম অসিতের সঙ্গে আমার যে বিয়ের সম্পর্ক, তাতে যেন আমার উপস্থিতিটাই আছে, কিন্তু ওতে আমি নেই । স্বামীর প্রতি আমার আর মন ছিল না । শেষে বিষয়টা এতদূর গেল আমি অসিতের প্রত্যেকটা কথাতেই বিরক্তিবোধ করতাম । শ্বশুরবাড়ির পরিবেশ আমার পক্ষে দুঃসহ হয়ে উঠল । আমি বাবার কাছে চলে আসলাম কিছুদিনের জন্য । বাবা আমাকে অনেকদিন পরে দেখতে পেয়ে শুরুতে স্বস্তি পেয়েছিল, কিন্তু শেষটায় তাঁর ধারণা বদলে গেল । অসিত মাঝেমধ্যেই টেলিফোন করে ফেরার কথা বলত, আমি অজুহাত দিতাম । শাশুড়ির কথায় সে আমাকে নিতে আসলে আমি পরীক্ষার কথা মনে করিয়ে তাকে ফেরৎ পাঠাতাম । আসলে আমি একটা উত্তর চাইছিলাম নিখিলেশের কাছ থেকে, চাইছিলাম সে ধরা পড়ুক, আমার প্রতি তাঁর বাহ্যিক অবজ্ঞা সরিয়ে সে স্বীকার করুক যে আমি শুধু তাঁর প্রিয় ছাত্রী নই, তাঁর জীবনেরও একজন বিশেষ কেউ ।
আমি নিশ্চিত জানতাম, আমার মনের গোপনে যে ফুল ফুটতে শুরু করেছিল তা যদি দিনের আলোয় তার নিজস্ব পাপড়ি মেলে ধরে, তবে আমাকে সব হারাতে হবে জীবনে । শ্বশুরবাড়িতে আমার স্থান হবে না, এমনকি বাবার কাছেও আমার দরজা চিরদিনের মতো বন্ধ হয়ে যেতে পারে । তবু, আমি সেই সুতীব্র ঝড়ের অপেক্ষায় দিন গুনতে লাগলাম । যে মানুষটা আমাকে জীবনের যোগ্য নারী হিসাবে ফুটিয়ে তুলেছে, যার জন্য আমার প্রতিটি লতাপাতায় ভোরের প্রথম শিশির, কেন সে আমাকে তুলে নেবে না তাঁর নিজস্ব ফুলদানিতে ? নিখিলেশের আগের স্ত্রী ওঁকে স্বামী হিসাবে হয়তো বাইরে থেকে পেয়েছিল, কিংবা নিখিলেশই হয়তো পারেনি স্ত্রী’র হাতে নিজেকে সম্পূর্ণ ছেড়ে দিতে । পুরুষমানুষ কখনও নিজের দুর্বলতা স্বীকার করে না, সেইজন্য মেয়েদের মধ্যেই আছে সেই গুণ, যা দিয়ে তারা বুঝে নেবে পুরুষের যন্ত্রণার উৎসটা ঠিক কতটা গভীর । একদিন শীতের দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বন্ধ দেখে, আমি গিয়ে পৌঁছালাম নিখিলেশের বাড়ি । সারাটা দুপুর দোতলার বারান্দায় বসে সে বই পড়ছিল, আমাকে দেখে উঠে এল । দেখলাম, তাঁর চোখেমুখের করুণ দুর্দশা আজও কাটেনি । সকাল থেকে মদের নেশায় নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছে । আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘আজ তো পড়া নেই আমার কাছে, হঠাৎ কী মনে করে আসতে হল ?’
লজ্জা ভেঙে বললাম, ‘ইচ্ছে হল । আজ ভাল লাগছিল না বাড়ি ফিরতে ।’
সে আমাকে মধুসূদনের কাব্য থেকে একখানা তর্জমা শোনাতে আরম্ভ করল, অমিত্রাক্ষর ছন্দে। আমি ব্যাগ থেকে আমার দিনকয়েক আগে লেখা কবিতাগুলো বের করে তাঁকে দেখালাম । পাঞ্জাবির পকেট থেকে সে চশমাটা বের করে চোখে দিল, তারপর পৃষ্ঠাগুলো উল্টেপাল্টে লেখাটা পড়তে লাগল কিছুক্ষণ ধরে । আমি তার ঘরের সোফায় নিজেকে এলিয়ে দিয়ে বসলাম, চুলের বাঁধন খুলে এমনভাবে সহজ হয়ে বসলাম তাঁর সম্মুখে যেন আমাদের মধ্যে নেই কোনও বাধ্যবাধকতার দূরত্ব । খেয়াল করলাম, তাঁর দৃষ্টি আমাকে অবজ্ঞা করল । লেখাগুলো সম্পর্কেও আশানুরূপ মন্তব্য না পেয়ে একগুচ্ছ নিরাশা নিয়ে যখন বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি, হঠাৎ সে জীবনের প্রসঙ্গ টেনে জিজ্ঞেস করল, ‘লেখার জন্য, বাঁচার জন্য যদি কখনও তোমাকে একা থাকতে হয়, পারবে থাকতে ?’
তাঁকে অভয় দিয়ে বললাম, ‘আমি তো একাই । বাইরে থেকে সেটা চোখে পড়ে না ।’
নিখিলেশ একটা সিগারেট ধরালো । বলল, ‘সারাবেলা নেশা করে গেল, তুমি এসেছ যখন দু-কাপ কফি করে আনি, কথা আছে এই প্রসঙ্গে ।’
আমি তাকে বাধা দিয়ে বললাম, ‘কফিটা আমিই করে আনতে পারি যদি অসুবিধা না হয় ।’
—তা হলে তো ভালই হয় । ফ্রিজে দুধ রাখা আছে, পেয়ে যাবে ।
কফি করে এনে দেখলাম, আমার কবিতাগুলোর বেশ কিছু লাইন সে সংশোধন করে দিয়েছে । গিয়ে বসলাম তার পাশে। কফি খেতে খেতে সেই সংশোধনগুলোকে আরও একবার নতুন চোখে দেখে নিলাম । লেখার গভীরে যেমন জীবনের দুঃখ লেগে থাকে, অক্ষরে অক্ষরে যেমন স্পর্শের বার্তা গাঁথা থাকে, সেরকমই আমার মনে হল এই সেই সুস্পষ্ট মুহূর্ত যার জন্য আমার হৃদয় চিরটাকাল অপেক্ষা করে আছে । নিখিলেশ আমার দিকে ফিরে বলল, ‘কেন এরকম পাগলামি করছ চিত্রা ?’
হঠাৎ এই প্রশ্ন শুনে খাদে গড়িয়ে পড়লাম । বললাম, ‘পাগলামি কীসের ? আমি আপনাকে চাই।’
—তুমি তো বিবাহিত, স্বামী আছে তোমার । নিজেকে বিপন্ন করে তুমি আমায় চেয়ে কী পাবে জীবনে? এটা তোমার ভুল চাওয়া চিত্রা, নিজেকে বোঝাও ।
—অনেক বুঝিয়েছি । ক্ষণে ক্ষণে থামিয়েছি নিজেকে । তবু প্রণয়ের আঙুল আমার সব বাধা ছিঁড়েছে, আমাকে দু’হাতে ঠেলেছে আপনার দিকে ।
নিখিলেশ কোনও উত্তর করল না, শুধু জড়িয়ে ধরল আমাকে । আমার পাতলা ব্লাউজের ওপর খেলে বেড়াতে লাগল তাঁর অভিজ্ঞ আদুরে হাত । একজন সদ্য বয়স্ক পুরুষের বসন্তবাতাসে কচি পাতার মতো দোল খেতে থাকল আমার যুবতী শরীর । কিছুটা সময়ের জন্য আমি তাঁর বুকে নিরাপত্তা অনুভব করলাম যা আমি অসিতের বুকে কখনও খুঁজে পাইনি । স্বস্তিতে আমার চোখ বুজে এসেছিল, কিন্তু সম্বিৎ ফিরল খানিকবাদেই । চেয়ে দেখলাম আমার মধ্যে স্বচ্ছ দৃষ্টির জাল ফেলে নীরবে তাকিয়ে আছে নিখিলেশ । তাঁকে ধরতে এসে আমিই যেন ধরা পড়লাম তাঁর জালে । মুক্তির পথ দেখতে না পেয়ে তাঁর রক্তশূন্য ঠোঁটে আমি চেপে ধরলাম আমার সলজ্জ ঠোঁট । আর তাতেই আমার মরণ নিশ্চিত হল ।
বহুদিন পর শ্বশুরবাড়ি ফিরে গিয়ে বুঝতে পারলাম, ও-বাড়িতে আমার জায়গা আর আগের মতো নেই । বাড়ির বৌ যতদিন নিয়মের তলায় বাস করে ততদিন শ্বশুরবাড়িতে তার মর্যাদা থাকে, নিয়ম ভেঙে বাঁচতে চাইলেই অধিকারগুলো একে একে মুছে যায় । শাশুড়ি মা প্রায় ছোটবড় কথা শোনাতে লাগল সামান্য ভুল খুঁজে পেলেই । অসিতের পক্ষ থেকে কোনওরূপ সমর্থন পেতাম না আমি । সে কেবলই আমার মন জুগিয়ে চলত, আমাকে বুঝত না । কিছুমাস এভাবে চলার পর, আমার মন বিদ্রোহ করে বসল । বাবার কাছে পুনরায় ফিরে আসলাম, এবং সিদ্ধান্ত নিলাম এ বিয়ে চিরকালের জন্য ভেঙে দেওয়ার । ডিভোর্স হল, আমি একরকম মুক্তি পেলাম আমার বৈবাহিক দাসত্ব থেকে । কিন্তু মানুষের মন থেকে বিভ্রান্তি মুছে ফেলা বোধহয় ঈশ্বরেরও অসাধ্য । দু’বছর পেরিয়ে যেতেই মনে হল আমি অসম্পূর্ণ, খণ্ডিত, দ্বিধাগ্রস্ত । যতক্ষণ না নিখিলেশকে পাচ্ছি, আত্মার কোথাও যেন এতটুকু শান্তি নেই । আমার সম্পর্ক ধাক্কা খেল, তিরস্কারের মুখে পড়ল, নিখিলেশের অবজ্ঞা সহ্য করল, কিন্তু শেষ অবধি তাঁর ভাঙনকে আমি জুড়ে দিতে পারলাম আমার সমস্ত রক্তমাংস দিয়ে । আমাদের রেজিস্ট্রি হল, লজ্জা ও স্বভাবদোষ মাথায় নিয়ে আমি হয়ে উঠলাম ওঁর শূন্য সংসারের জীবন্ত স্ত্রী । আমাদের বিয়েতে সানাই বাজল না, শামিয়ানা খাটানো হল না, গায়ে হলুদ হল না, কেউ আমাকে নতুন করে সাজালো না, অথচ আমাদের বিয়েটা সারা হয়ে গেল অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে । ফুলশয্যার রাতে নিখিলেশের শরীর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল, আমি তাঁর সেবা করে কাটিয়ে দিলাম সেই অতৃপ্ত রজনী ।
একবছর পরে মা হলাম, জীবনে প্রথমবার আমার কোলে নেমে এল একটা ফুটফুটে শিশু । আমার মাতৃত্ব নাড়া দিয়ে উঠল কিছুদিনের জন্য । কিন্তু মনের ভিতরে একটা সংশয় কিছুতেই কাটছিল না । আমি কি নিখিলেশকে সত্যিই মুক্তি দিতে পেরেছি ওঁর সমস্ত ব্যর্থতার মায়াজাল থেকে ? বিছানায় আমার একরত্তি ঘুমন্ত ছেলেকে দেখে হঠাৎ কেমন হতাশ হলাম । মনে হল, ও কেন এল আমার আর নিখিলেশের মধ্যিখানে ? কী দরকার ছিল ওর আসার ! সেইমতো একদিন নিখিলেশকে বললাম, ‘আমাদের যেন আর সন্তান না হয়, আমি যদি কোনও ভুল করি, তা হলে তুমি আমাকে সামলাবে ।’ সে কোনও উত্তর না দিয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে নিল ।
সম্ভবত তিন বছর নিখিলেশের সংসারে আমার কেটে গেল ছেলেকে মানুষ করতে গিয়ে । জীবন থেকে আর কোনও কিছুই আমার চাওয়ার ছিল না । তবু, এক বিষণ্ন বর্ষার ভোরে আমি মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম, জ্বর এল । এর ক’দিন পরেই দাঁত ব্রাশ করতে গিয়ে অল্প রক্তক্ষরণ হল । ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ হলাম, কিন্তু দিনকয়েকের মধ্যে ভেঙে পড়ল আমার শরীর, ফিরে এল অস্বাভাবিক জ্বর ও হাতে পায়ে নিদারুণ ব্যথা । নার্সিংহোমে ভর্তি হতেই ধরা পড়ল আমার শ্বেতকণিকা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে । শুরু হল লিউকোমিয়ার চিকিৎসা । সেইসঙ্গে আমিও একরকম নিশ্চিত হলাম, এবার আমার ছুটি হতে চলেছে জীবন থেকে । বাবার কাছে গিয়ে জীবনের শেষ কিছুদিন থাকতে চাই । সমস্ত জীবন আমি তোমাকে কাছে পাইনি মা, আমার ছেলেটাও শেষ অবধি মাতৃহারা হবে । ঐটুকু ছেলেকে আমি তোমার কাছে রেখে যেতে পারতাম, কিন্তু নিখিলেশকে আমি কোনওভাবে একা হতে দিতে পারি না । তুমি ফিরে এসো মা, বাবার কাছে । আমাদের দীর্ঘতম জীবনে এই তো সংক্ষিপ্ত প্রার্থনা, আমরা যেন পরস্পরকে হারিয়ে যেতে না দিই ।
মা, আর কখনও হয়তো তোমাকে চিঠি লেখা হবে না, ভাল থেকো । প্রণাম নিয়ো ।
ইতি,
তোমার চিত্রা
চিঠিটা পড়া শেষ হতেই সুরপা প্রায় কান্নায় ভেঙে পড়ল । অদ্ভুত একটা বিপন্নতা আজ তাকে পেয়ে বসেছে । নির্মলেন্দুকে অতিক্রম করতে চেয়েছিল সে, কিন্তু হোঁচট খেয়ে তার জীবনটা আবার সেই আগেকার রাস্তায় ফিরে এসেছে । নির্মলেন্দু উঠে এসে সুরপার পাশে বসে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে, কিন্তু চেষ্টা বিফলে যায় । তবু সুরপাকে নিজের মধ্যে টেনে নেয় নির্মলেন্দু । বলে, ‘মেয়েটা সারাজীবন কষ্ট পেয়েছে, ওকে যেতে দাও । সন্ধেবেলা আর চোখের জল ফেলো না সুরপা ।’ সুরপা শান্ত হয়, তবু তার ভিতরের ভাঙন স্তব্ধ হয় না ।
নির্মলেন্দু বলে, ‘মেয়েটার শ্রাদ্ধের দিন নিখিলেশ আমাদের যেতে বলেছে । আমরা ছাড়া ওর আর নিজের বলতে কেউ নেই ।’
—আমি পারব না । বিশ্বাস করো, নিজের মেয়ের শ্রাদ্ধ আমি দু’চোখে দেখতে পারব না !
—বিশ্বাসই তো করতে চেয়েছি তোমায়, সমস্ত জীবন ধরে ।
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সোফা থেকে উঠে যায় সুরপা। চিত্রার ছবিটা দেওয়াল পেড়ে নিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে নেয়। বলে, ‘মেয়েটা বড় অভিমানী ছিল !’