বই কথা । ১
অসতীপ্রবণতা
অদিতি বসুরায়
ঋত প্রকাশন
নামকরণের মধ্যে যেমন নতুনত্ব আছে, তেমনই রয়ে গিয়েছে প্রচ্ছন্ন বিরোধিতার গন্ধ। অদিতি বসুরায়ের লেখা ‘অসতীপ্রবণতা’ বইটি হাতে এল কিছুদিন আগে। এই বই মোটেই ক্লিশে হয়ে যাওয়া ফেমিনিস্ট বকরবকর বা স্লোগান নয়, বরং পাতা উল্টোলে ধাক্কা দেয় এক ঝলক টাটকা অক্সিজেন। অদিতি নতুন কবি নন, দীর্ঘদিন ধরেই লিখছেন। তাঁর কবিতার ভাষায় সারল্যের সঙ্গে মিশে থাকে উৎকণ্ঠা, আবার স্পষ্ট কথা খুব গভীর ভাবে উচ্চারিত হয়।
কিন্তু ‘অসতীপ্রবণতা’ বইটিতে তাঁর মধ্যে এক আশ্চর্য উদাসীনতা, যা প্রেম ও প্রেমহীনতার মধ্যবর্তী এক উপত্যকায় আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়। যে উপত্যকায় দাঁড়িয়ে অদিতি লিখছেন, ‘আগেই বলেছি, তবু বলি,–ওহে/টারজান নাম দেব, চল জঙ্গলে ফিরে যাই।’
গভীর একটা বেদনাবোধ যেমন কবিতাগুলোয় ধরা পড়ছে, তেমনই আছে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠার চিরকালীন আকুতি। ‘তোমার মাথায় যে রাজার মুকুট/আমি তার ডাকনাম রেখেছি ‘দুঃখ’।
ধর্ষণ কবিতাটির কয়েকটি লাইন স্বব্ধ করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। এ কবিতা মুখোশ টেনে ছিঁড়ে ফেলে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। কোনওরকম জটিলতার আশ্রয় না নিয়ে খুব সহজ কথায় গল্প বলতে চেয়েছেন কবি। ‘তুমি ভাবো, এর থেকে অফিসের বসও কি ভালো ছিল?/ গাড়িতে উঠেও যে প্রেমিক ফুল কিনে দেয়, সে-ই? কলকাতা থেকে কত দূর, বোলপুর?’ একই ভাবে লক্ষ্মী মুর্মু কবিতায় শেষ লাইনটি রক্তাক্ত করে দেয়, ‘লক্ষ্মীর উন্মোচিত, ছেঁড়াখোঁড়া যোনি ভাইরাল হল, অতঃপর।’
কলমের ডগায় লেগে এই আগুনই আবার পাঁপড়ি হয়ে ছড়িয়ে পড়ে অন্যত্র। যেমন দাম্পত্য কবিতায় অদিতি লিখছেন, ‘শিবিরে মাঝে মাঝে সাদা পতাকা ওড়াতে ভালোবাসি আমিও/তুমিও পায়রা পোষো দেখাদেখি….’। বিষাদের মাঝে এই লাইন মন ভালো করে দেয় দ্রুত।
কয়েকটি নারী চরিত্রকে নিয়েও এই বইতে কবিতা আছে। যেমন সিলভিয়া প্লাথ, মেরলিন মনরো বা পার্ক স্ট্রিটে ধষির্তা সুজেট জর্ডন। চরিত্রগুলিকে কবিতার মধ্যে দিয়ে ধরতে চেয়েছেন অদিতি। অধিকাংশ লেখাতেই লুকিয়ে আছে ভালোবাসা খুঁজে নেওয়ার স্পষ্ট কন্ঠস্বর। এই খোঁজই হয়তো সারাজীবন করতে হয় কবিকে। ঋত প্রকাশনকে ধন্যবাদ, এমন একটি কবিতার বই উপহার দেওয়ার জন্য। ছাপা সুন্দর, চিরঞ্জিৎ সামন্তের প্রচ্ছদ চোখ টানে।
অদিতির কাছে প্রত্যাশা অনেক, ভবিষ্যতে তাঁর হাত থেকে আরও অনেক ভালো কবিতার জন্ম হবে, এতে কোনও সন্দেহ নেই।
সব্যসাচী সরকার