Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

বই কথা । 

সো না লী   ঘো ষ

নিঃস্বার্থ প্রকৃতিই পারে হৃদয়ের রঙ বদলাতে

পর্নোগ্রাফি

বুদ্ধদেব হালদার

হাওয়াকল

মূল‍্য ১৬৫/-

জীবন একটি সাধন ক্ষেত্র, আর প্রতিটি মানুষ সাধক। প্রত‍্যেকের জীবনের শৈলী আলাদা, তার ব‍্যাকরণও । বহমান সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা আত্মোপোলব্ধির চরম সীমায় পৌঁছোই। কবিদের জীবনবোধ তদ্ভিন্ন নয়, বরং তাঁরা সন্ধান দেন  আরেক সাধনপীঠের।

অধুনা কবি বুদ্ধদেব হালদারের ‘পর্নোগ্ৰাফি’তে সেই সাধন ভূমির চূড়ান্ত একটি পর্যায় রচিত হয়েছে।

কবি ক্রমাগত আত্মকথন করে গিয়েছেন, আর বোধের ভূমিতে রেখে গিয়েছেন তাঁর জীবন দর্শন। আমাদের চর্বিতচর্বন জীবনের পাশে বসে এত কথা অবলীলায় সাবলীলভাবে বলা যায়, তা কবি হাতে ধরে পাঠককে শিখিয়েছেন। আমাদের প্রথাগত চেতনাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন, কোনো আবরণের সাহায্য না নিয়েই তিনি বলেন-
‘এবং নানাবিধ পেটের সমস্যাই শেষ পর্যন্ত একজন ধান্দাবাজকে বিখ‍্যাত কবি বানিয়ে ফেলতে সক্ষম। আমি অবশ‍্য যাকে নকল করি, তিনি একজন সাইকো’। (সাইকো)

আমাদের কবিতা পড়ার ধরণে প্রতি মুহূর্তে বদল এনেছেন তিনি, চেনা ছক থেকে বের করে এনেছেন আর তাই হৃদয়ে প্রেম নয়, ‘গজিয়ে ওঠে ম‍্যাজিক মাশরুম’। প্রাক্তন প্রেমিকার প্রত‍্যাবর্তন বা স্মৃতিচারণ চান না কবি, বরং মনের ভেতর জমা যন্ত্রণাকে সরাসরি ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, “অথচ তুমি স্বামীর জিভে জিভ রেখে বলছ, ‘Night is an inhuman time’ ” (নিভাকে লেখা চিঠি ২০)। আর এখানেই তো সেই চরম আধুনিকতাবাদ, যেখানে ‘একটা গভীরতা নিয়ে সমুদ্ররঙের ডটপেন এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়’। আমাদের মতোই কবি অস্থির হয়ে ওঠেন, ডাক্তারের শরণাপন্ন হন, সমীর চন্দ্র দাসকে জানান- “কিছু একটা করুন। বাঁচতে চাই” (১৭ডিসেম্বর)। এ যেন আমাদেরই আর্তনাদ।

আবার তিনিই নিপাট দার্শনিকের মতোই বলেন-

‘এভাবেই কেটে যাবে দিন। নিভে যাবে প্রিয় নদীটির আলো, আর
একদিন একা হয়ে যাবে সমস্ত মানুষ যে যার মতন। আমরা এসব নিয়ে
কিছুই ভাবব না। বরং নখ খুঁটতে খুঁটতে গভীর রাতের অ্যানিম্যাল প্ল্যানেটে
আমরা দেখব কীভাবে সেপ্টেম্বর এলেই কবিরা দীর্ঘকবিতা লিখতে বসেন।’ (পর্নোগ্ৰাফি)

চলমান জীবন নদীর মতোই একা, তাকে বয়ে নিয়ে যেতে হয়, একাকী বেঁচে থাকার
শর্তই যে কোনো কিছুর গভীরে প্রবেশ না করা। শুধু পর্যবেক্ষণ করে যাওয়াই ভালো থাকার নামান্তর ।

আবার কবির সারা চেতনায় বাসা ধরা ঘুণপোকাকে জানান-
‘তোমাকে আজকাল ভুলে থাকার চেষ্টায় আছি আমি, আর
উপবিদ‍্যার ভিতর সারাটা শহর জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটানীল অ্যাম্বুলেন্স’ (মদ)

মনের মানুষকে ভুলে থাকার যন্ত্রণা, কীভাবে কুরেকুরে খায়, ‘নীল অ্যাম্বুলেন্স’-এর শহর জুড়ে ঘুরে বেড়ানো তারই প্রমাণ। হৃদয়ের ভেতরে যে বাঁচার তীব্র আকাঙ্ক্ষা জন্ম নেয়, সেখানে তাঁর বক্তব‍্য খুব সাবলীল-

‘তোমার গভীরে বাঁচতে চাইছি খুব। ভাগ করে নিতে চাইছি যাবতীয় নিঃশ্বাস। তোমার
দরজার একপাশে গলাতে বকলেস বেঁধে আটকে রাখো আমায়।
তোমার বর দেখুক, তোমার ছোট্ট ছেলেটিও দেখুক, সারাটা দুনিয়া
দেখুক, তোমার প্রেমিক আদতে এক কুকুর’ (ঘুরন্ত প‍্যাডেল অথবা ছেঁড়া সময়ের গল্প)

প্রেমিকের হৃদয়ের দহন অবলীলায় কবি তুলে ধরেন। প্রেমকে প্রয়োজন তার, তাকে ছাড়া অস্তিত্ব বিপন্ন বোধ করে সে, প্রেমিকের সেই রোমান্টিক প্রতিমূর্তির উপর হাতুড়ি মেরে কবি দেখিয়েছেন তার অন্তঃসারশূন্য দশা। যা অতি বাস্তবতার একটুকরো রূঢ়তা।

আবার তিনিই পেলব সুরে পাঠকের কানে কানে ফিসফিস করে বলেন-

‘হাঁসের শরীর নিয়ে তুমি বেঁচে আছ, যেখানে নীল
উঠোনে গড়িয়ে নামে চাঁদ। গাছে গাছে নড়ে ওঠে
কথকতা, পদ্মবনে উছলে পড়ে হৃদয়’ (কবি চলিয়া যায়)

আধুনিক মন যতই সংঘর্ষময় হোক, প্রকৃতির প্রলেপে মানুষের হৃদয় বানভাসি হয়। আসলে মানুষ নয়, নিঃস্বার্থ  প্রকৃতিই পারে হৃদয়ের রঙ বদলাতে। কোথাও যেন অনুমিত হয় তুমি আমি আমরা আসলে একই। আসলে কবিরাই পারেন তাঁদের যাদুস্পর্শে , আমাদের ভেতরে ‘আরশি নগর’ গড়ে তুলতে। তাঁর এই বইতে রাজনীতি, ধর্ম, মনস্তত্ত্ব, সমসাময়িক সমস‍্যা, আত্মিক সংকট, প্রেম এবং তা থেকে উদ্ভূত জটিলতা- এ সকল কিছুতে তিনি এমন ভাবে কলম চালনা করেছেন, যে বুঝতে অসুবিধা না হয় এগুলি আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সাধনার অঙ্গ এ বিষয়গুলির সঙ্গে সঠিক মাত্রায় সম্পৃক্ত হতে পারলেই, জীবনের জটিল রসায়ন সহজবোধ‍্য হবে।

চেনা জীবনের প্রতি এক তীব্র আসক্তি জন্মাতে কবি যেভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন, তাতে এই বইটি পাঠককুলকে যে ভিন্ন জীবনবোধের সন্ধান দেবে, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সোনালী ঘোষ

আরও পড়ুন...