ছো ট গ ল্প
এক
সকাল থেকেই আকাশটা গুম মেরে ছিল। জলভরা মেঘের হম্বিতম্বি শুনে আড়চোখে একবার বোধহয় দেখেওছিল পিয়াল। এখন এসি কভারের ওপর একটানা চটরপটর শব্দে ওর খেয়াল হল, ঝেঁপে বৃষ্টি এসেছে। কেউ আসার আগে পিয়াল একেবারেই আন্দাজ করতে পারে না। বুঝতে পারে ওর পারিপার্শ্বিক পরিবেশে কিছু বদল হলে। দু’হাত দিয়ে কাঠের চেয়ারটা পিছনে ঠেলে কম্পিউটারের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে উঠে দাঁড়াল ও। বুকশেলফের পাশেই মস্ত জানলা। হয়ত খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়বে। সারা রাত ধরে ভিজবে বইগুলো। জল টানতে টানতে ভিজে সপসপে হয়ে যাবে। এক সময় জমা জলের চলাচলে ধুয়ে যাবে তাদের বুকে লেখা নায়ক নায়িকার নাম, ঠিকানা, হাসি-কান্না, জানা অজানা সমস্ত কাহিনি!
“আপনাকে তো কোনও বিশ্বাস নেই পিয়ালদা। কী করতে কখন যে কী করে বসেন!”
কথায় কথায় বলত নদী। সে ছিল বলেই কোনও গুরুদায়িত্ব তখন পিয়ালের কাঁধে এসে পড়ত না। সে এক জীবন ছিল! সবেতে থেকেও না থাকার অনুভূতি।
পুরনো আমলের বাড়ি। কাঠের জানলা, দরজাগুলো এখনও বেশ ভাল। সেনদের আর কোনও উত্তরাধিকার থাকলে পিয়ালের মত উদাসীন হয়েই দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারত। অন্দরের গল্পগুলো নিরাবরণ হয়ে পড়ার ভয় একবারের জন্যও পেতে হত না তাকে। যদিও এই বংশের গতিপথে এখন পুরু শ্যাওলার জট। মেটে রঙের ভারি পর্দা সরাতেই দমকা হাওয়ার সঙ্গে কুচি কুচি জলের কণা এসে পিয়ালের গোটা মুখে, গলায় আর চুলে ছড়িয়ে পড়ল। চোখদুটো বুজতেই কয়েক সেকেন্ডের জন্য মনে হল নদী ওর ঠিক পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আগের মতই ঘাড়ের রোমে নদীর উষ্ণ গভীর নিঃশ্বাসের ওঠাপড়া স্পষ্ট অনুভব করল পিয়াল। আপনা থেকেই ওর ঠোঁটদুটো সামান্য ফাঁক হয়ে গেল। পিয়াল কি ক্ষমা চাইবে? বিলাপ করবে? নাহ! শব্দ বেরুল না একটাও। এই নৈঃশব্দ্যই বোধহয় নিজের প্রতি করুণা! আচ্ছা, চলতে চলতে যে মানুষের পিঠ একেবারে দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছে, তার কি নিজের প্রতি শুধু করুণাই আসে? গোধূলির নিরালায় আলো ছায়ায় বসে এসব কথা জিজ্ঞেস করার মত কেউ নেই পিয়ালের। কার কাছে মেলে ধরবে ও নিজেকে? দেওয়াল জোড়া আয়নায় নদীর আসা-যাওয়া, তাকে স্বপ্নে দেখা ওসব তো মনের ভুল মাত্র। সম্পর্কের মায়াজাল ছিঁড়ে যে চলে গিয়েছে সে আর ফিরবে কেন? জবাব দেবেই বা কেন? অবশ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল কিনা পাত্র পাত্রী কারোরই ঠিক জানা নেই। হাত বাড়িয়ে জানলার পাল্লা দুটো শক্ত করে টেনে ধরল পিয়াল। হাওয়ার স্রোত যেন অবাধ্য মাছ! হাতের উপর ঘাই মারছে ক্রমাগত। অথচ পরিস্থিতির বিপরীতে ছুটে এসে একসময় এই পাল্লা দুটোই জুড়ে যাবে ঠিক। কর্মব্যস্ত দিনের শেষে সব মালিন্য ভুলে বাধ্য জীবন সঙ্গীর মত ওরা আলিঙ্গনে আবদ্ধ হবে! অপেক্ষা করবে আর একটা নতুন আরম্ভের। আহা, এমন মাপে মাপে ছন্দে ছন্দে যদি কেউ মানুষের জীবনটাও সাজিয়ে দিত! অনেকের অবশ্য হয়! জীবনের প্রতিটি পল অনুপলে সুর, তাল, লয় সবকিছু পারফেক্ট, সাজানো-গোছানো। ঝড় এসে উল্টেপাল্টে একটু খেলা করে গেলেও আবার আগের মতন হয়ে যায় জীবন। পিয়ালের চোখে পড়ল মেরিন ব্লু রঙের জানলার পাল্লায় কোণ ঘেঁষে একটা মেরুন রঙের সোয়েটের টিপ আটকে রয়েছে। নদী চলে যাওয়ার চার বছর পরেও!
দুই
মাখনের মত পেলব রাস্তা। ল্যাম্প পোস্টের হলদেটে আলো মুহূর্তের জন্য ছুঁয়েই পিছলে যাচ্ছে বাষ্পধূসর শূন্যের দিকে। মেয়েটা মাথা নিচু করে লাইট পোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে। আলোর নিচেও একলা, অতি সাবধানী একটি ছায়ার মত। তার কাঁধে ছাপোষা পাটের ব্যাগ। কোমর ছাপানো চুল এখন হাতখোঁপা করে বাঁধা। ওই চুলের অবাধ্য ঢাল দেখেই কবে কোন বিজ্ঞাপনের লোক নাকি টিভিতে সুযোগ করে দিতে চেয়েছিল! মেয়েটা পাত্তা দেয়নি। বরং রাশি রাশি কালো মায়া সুতোকে কড়া শাসনে বেঁধে রাখাটাই নিয়ম করে নিয়েছে সেই থেকে। মেয়েটার ছাপা শাড়ি, ব্যাগের ভিতরে টাকাকড়ি রাখার লুকোনো পকেট, অতি সাধারণ ফর্সা ত্বকে মিশে থাকা ফুলের হালকা সুবাস, সবকিছুই খুব গুছিয়ে মধ্যবিত্ত মানসিকতার গল্প বলে। কিন্তু তার চোখ দুটো! কী গভীর! কী মায়াময়! দৃষ্টির পরতে পরতে অদ্ভুত সব স্বপ্নকে বশ করে ঠিক যেন পোর্সেলিনের পুতুলের মতো দাঁড় করিয়ে রেখেছে! আলতো করে জিয়ন কাঠি ছোঁয়ালেই জেগে উঠে কথা বলে ফেলতে পারে তারা। এই মেয়েটাই নদী। বাস্তবের চৌকাঠ পেরিয়ে যখন কোনও শিল্পীর অসতর্ক আঙুল আচমকাই মেঘ ছুঁয়ে ফেলে, তখনই বুঝি এইরকম নদীদের জন্ম হয়!
প্রথম কবে নদীকে দেখেছিল পিয়াল? সম্ভবত রিকশা স্ট্যান্ডেই। হ্যাঁ, সেই বুঝি প্রথম দেখা। তার আগে কখনও পাশ কাটিয়ে এসেছে গিয়েছে কিনা পিয়ালের মনে পড়ে না কিছুতেই। বর্ষার শুরু। কোঁকড়া চুলের মুকুটে জলপাথরের কণা সাজিয়ে নিয়ে একটা রিকশার জন্য অপেক্ষা করছিল পিয়াল। কপালের মধ্যিখানে ভাঁজ। ওর রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরক্তি ডানা বাঁধছিল। রিকশাওয়ালা মুখ ফুটে দশ টাকা বেশি চাইতে নিমেষেই সব অপেক্ষা উবে গেল। অমায়িক গলায় রিকশাওয়ালাকে ভাঙা মন্দিরের রোড ম্যাপ বোঝাতে লাগল পিয়াল। এইটুকু পথের দাম কি এত বেশি হতে পারে? ছেলেমানুষ পিয়াল ভাবেইনি, ফিরতি পথের দাম নিয়ে প্রত্যাবর্তন প্রত্যাশীর কি হিসাব করা মানায়? মেয়েটা তখনই পাশ থেকে নাক গলিয়ে বলে উঠেছিল,
“জীবনটাই তো পদে পদে খরচা হয়ে যাচ্ছে। গরিব মানুষটাকে না হয় দশটা টাকা বেশি দিলেন! কী যায় আসে?”
ভারি রাগ হয়েছিল পিয়ালের। কোথাকার কে, চেনা নেই, জানা নেই, গায়ে পড়ে উপদেশ দেবে! পিয়ালের মন বলেছিল, কড়া কড়া ক’টা কথা শুনিয়ে দাও না অপমান করে; রিকশাওয়ালার সঙ্গে এই বেয়াদব মেয়েও একটু শিক্ষা পাক; কিন্তু মেয়েটার ঠোঁটে লেগে থাকা স্থির হাসির কাছে মুহূর্তেই ওর সমস্ত কার্পণ্য ধরা পড়ে গেল। বড় বাড়ির একমাত্র ছেলে পিয়াল সেন পাঁচ-দশ টাকার রিকশা ভাড়ারও হিসেব রাখে! পিয়ালের মনে হল ও একটু একটু করে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে ওই অতল শান্ত চাউনির কাছে। চোখ সরিয়ে রিকশায় উঠে পড়েছিল ও।
মায়ের অসুখ ধরা পড়ার পর আবার সেই মেয়ের সঙ্গে দেখা। পিয়ালের ছোট মাসি সঙ্গে করে নিয়ে এল তাকে।
“ও কিন্তু ভাল বাড়ির মেয়ে বাবুসোনা। অবস্থার পাকে পড়ে আয়ার কাজ করছে।”
মায়ের হবু আয়াটির মুখের দিকে না তাকিয়েই ইন্টারভিউ নেওয়ার ঢঙে পিয়াল জানতে চাইল,
“প্রেসার দেখা, ইনসুলিন দেওয়া, বেডপ্যান ব্যবহার করানো সব ঠিকমতো পারবেন তো? মায়ের যত্নে যেন বিন্দুমাত্র গাফিলতি না হয়!”
“চিন্তা করবেন না। ঠিক সামলে নেব আমি।”
গলার স্বর শুনে চমকে তাকাতেই সামনে আবার সেই বিরল চোখ জোড়া! পিয়ালের আর কিছুই জিজ্ঞেস করার ছিল না। মনের ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠেছিল, পারবে। পারলে এই মেয়েটাই পারবে। মায়ের মুখ থেকে সাবানের বুদবুদের মত যে অসংলগ্ন কথাগুলো বেরিয়ে আসবে, সেগুলোকে অলিতে গলিতে না ছড়িয়ে জলের প্রবাহে মিশিয়ে বহুদূরে কোনও এক অচেনা পাহাড়ি গাঁয়ের দিকে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা কেবল একটি নদীরই আছে।
তিন
প্রথাগতভাবে প্রেম নিবেদন না করলে কি বুঝে নিতে নেই ভালবাসা আছে! নদী বলত,
“কিছুতেই না। সমানে সমানে বোঝাবুঝিটা হয় ভাল।”
অথচ বোঝাপড়া হলেও সমানে সমানে কবেই বা তেমন ভালবাসাবাসি ছিল? সমানে আর সমান্তরালে প্রেম নেই বলেই তো গাছের ছায়ারা আকাশের গা ছুঁয়ে জলের কোলে লুটোপুটি খায়। মাটির পিপাসা বুঝে নেয় রাজপুত্রের মত যুবা মেঘ। নদীর বুকে মুখ দেখে চাঁদ আর সূর্য; সন্ধ্যায়, সকালে। নরম আদুরে মাটির ভিতর ডালপালা মেলে মিশে যায় আপাত কঠিন পৌরুষ। শাখাহীন বৃক্ষের মন বাঁধা পড়ে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বীজের মোহে। ঝড় ওঠে না, বাদল আসে না; তবুও ভালবাসাবাসি মিহি ধুলোর মত প্রতিনিয়ত উড়ে যায় এক মেরু থেকে অন্য মেরুর দিকে। বহুফসলি জমির মত বারবার বুক চিরে সবুজ ফলায়। তত্ত্ব কথা শুনিয়ে কেউ কি তাকে বাঁধতে পারে কোনওদিন?
কর্কটের দংশন যে কতখানি তীব্র, মাকে ছুঁয়েও বুঝতে পারত না পিয়াল। মাঝে মাঝে উঁকি মেরে দেখত সারা বাড়ির উজ্জ্বল আলোর মাঝে মায়ের ঘরটাই অমাবস্যার রাতের মত স্থির, নিটোল অন্ধকার। একটানা একটা গোঙানির সুরে পাথরে বাটা স্নিগ্ধ শ্বেত চন্দনের মত কথার প্রলেপ লাগিয়ে চলেছে নদী। হাত বুলোচ্ছে মায়ের নেড়া মাথায়। নীলচে সবুজ রঙের শিরাওঠা শুকনো বুকে। মায়ের চোখে একফোঁটাও ঘুম নেই। রক্তবর্ণ আগুনের গোলার মত দুটো কোটরে ঢোকা চোখ! নদী তার শীতল গভীর চাউনিতে সেই অস্থিরতার আগুন শুষে নিচ্ছে একটু একটু করে। মা বলছেন,
“আমি চাইনি, কিছুতেই চাইনি এ সন্তান পৃথিবীতে আসুক। তখন আমি একেবারেই ছেলেমানুষ! কাউকে আগলাব সে ক্ষমতা কোথায়?”
ছোটবেলা থেকেই পিয়াল জানত ওর মা একজন বোকাসোকা নরম মনের মহিলা যাঁকে জাপটে ধরলে ভিজে গোলাপ ফুলের মত একটা সুন্দর গন্ধ নাকে আসে। নরম ছোঁওয়া মেখে নিলে অসময়েও ঘুম চলে আসে। পিয়াল ভাবত, সাড়ে সতের বছরে জন্ম দেওয়া একটিমাত্র সন্তানকে অসীম স্নেহ করা ছাড়া ওর মা আর কিছুই বোঝেননি কোনওদিন। কিন্তু নদী এসে ওর অসুস্থ মাকে ছুঁয়ে দিতেই কোথাও যেন একটা আমূল পরিবর্তন ঘটে গেল। মৃত্যু শয্যায় শুয়ে প্রৌঢ়া মহিলা একটি শান্ত মেয়ের কাছে শুরু করলেন আত্মকথন। নদী জেনে যাচ্ছিল মায়ের ছেলেবেলা, কৈশোর আর যৌবনের প্রায় সব গল্প। সেসব পিয়াল জানতেই পারেনি কোনওদিন। উঠতে বসতে চলতে ফিরতে মেয়েটাকে তখন শুধু মায়ের আয়া নয়, মায়ের সহচরী মনে হত পিয়ালের। মায়ের সঙ্গে যে মেয়ের পরম সখ্য তাকেই তো প্রাণ ভরে ভালবাসা যায়। দুনিয়ার প্রতিটি পুরুষ সঙ্গিনী রূপে এমন এক নারীকেই তো চেয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। কী এক মায়া মন্ত্রবলে পিয়ালও ভালবেসে ফেলল নদীকে। একেবারে নিঃশব্দে! বলা নেই, কওয়া নেই, লুকিয়ে চোখের দেখা নেই, কিন্তু একজন অহংকারি পুরুষের হৃদয়ে ফুলে ওঠা প্রেমের ঢেউ দুলছে, কী যে অসম্ভব বোঝা! মাঝেমধ্যে দুটো একটা দিন খাওয়ার টেবিলে পাতলা রুটি আর মাংসের কষা বেড়ে দিয়ে যাওয়ার সময় বিস্কুট রঙের ছাপা কাপড় পরা নদীকে পিয়াল বলত,
“রাতের খাবারটা তো এখানেই খেয়ে যেতে পারো!”
চার
“শুধুমাত্র ছবি বানাবে বলেই তুমি দেশে ফিরে এলে? ভাবা যায় না!”
টেবিলের উল্টোদিকে পাশাপাশি চেয়ারে বসে মুখ চাওয়াচায়ি করল অনিকেতদা আর সুগন্ধা। পিয়াল বুঝল ওর মধ্যবিত্ত মানসিকতা নিয়ে খুব সন্তর্পণে ওরা একটা শীতল ঠাট্টা করে নিল। হয়তো এবারেও প্রত্যাখ্যাত হবে ওর ভাবনা। ভাবতেই হাসি পেয়ে গেল পিয়ালের। নিজের দেশটাকে এরা কী ভীষণ টেকন ফর গ্র্যান্টেড মনে করে এখনও! সাদা চামড়ার দীর্ঘদেহী মানুষ, আশি-নব্বই বছর গড় আয়ু, পাথরের দেওয়াল, কাঠের মেঝে, হাঁটু অবধি চামড়ার বুট পরে বরফ পেরোন, রাতজাগা একটা সভ্যতা, ঘন সবুজ আইভির কার্পেট দিগন্ত জোড়া ধানখেত, আদুল গায়ের চাষা, আর মাটির কাছাকাছি ঝুঁকে তুলে নেওয়া নরম কলমি, কুমড়ো ফুল কিংবা লজ্জাবতীর পরশ অপেক্ষা কতখানি লোভনীয় এদের কাছে! অথচ পিয়াল জানে এই অনিকেত মুখার্জী প্রত্যন্ত সুন্দরবনের চাষী পরিবারের ছেলে। হালে কিছু ভাল মানের ডকু বানিয়ে নামডাক করে ফেলেছেন। দুটো আন্তর্জাতিক পুরস্কার রয়েছে ওঁর ঝুলিতে। আশেপাশে জুটে গিয়েছে সুগন্ধার মত আরও কিছু মেয়ে, যারা মানুষকে দেখতে জানে না। জায়গাকে ভালবাসতে শেখেনি। জন্ম থেকেই শুধু সভ্যতার মধ্যে ঘোড়ার গতি খুঁজে বেড়াচ্ছে। যে সভ্যতা মানুষকে যত দ্রুতগামী বানায়, স্বপ্নিল নেশা, নির্ঘুম রাত্রি, ধোঁয়ার মত রঙিন আলো, ঝাঁক ঝাঁক সম্পর্ক, অবাধ যৌনতা দেয়, সেই সভ্যতার কাছে মাথা নুইয়ে নিজেকে নিবেদন করে এই মেয়েরা। নিষ্ঠা আর প্রেম থেকে এরা শত শত হস্ত দূরে।
পিয়াল আর কথা বাড়াল না। অনিকেতদাও সম্ভবত বুঝে ফেলেছেন যে তাল কেটে গিয়েছে। হাজার চেষ্টা করেও আর প্রসঙ্গে ফেরা সম্ভব নয়। সুগন্ধা আনমনে একখানা সিগারেট ধরিয়েছে। নাক মুখ থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে তার ঠোঁটের ওপরের তিলটাকে প্রতি দশ সেকেন্ডে একবার করে ঢেকে দিচ্ছে। বাইশ তেইশ বছরের বাচ্চা ওয়েটারটির সঙ্গে চোখে চোখে ফ্লার্ট করছে সে। খানিকটা বিরক্ত হয়েই দু’জনকে বিদায় জানিয়ে উঠে পড়ল পিয়াল। মন অস্থির হলেই ও চাকদায় মাসির কাছে চলে যায়। কফিশপ থেকে বেরিয়ে গাড়িটা ঘুরিয়ে নিল পিয়াল।
মায়ের মতই মোটাসোটা গোলগাল চেহারার ছোট মাসি। গোলাকার মুখের একটা পাশে ঝুলে থাকা আলুথালু লম্বা বেণী। সবচেয়ে বড় কথা মা আর মাসি দুজনের গায়েই অবিকল এক গন্ধ! তুমুল পশলায় ভিজে গোলাপের মত। জড়িয়ে ধরলেই পিয়ালের মনে হয় জন্মদিনের পায়েসের মত মিঠে একটা ঘ্রাণ ওকে অবশ করে দিচ্ছে। মাসি বোধহয় বাগানের দিকে কোনও কাজ করছিল। পিয়ালের ডাক শুনে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এল।
“কী রে বাবুসোনা? তুই এমন ভর দুপুরে?”
“কেন? আসা বারণ নাকি?”
সিঁড়ির তলায় জুতোদুটো খুলে বসার ঘরে ঢুকে মেঝের ওপর চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়ল পিয়াল। একটু স্নেহের জন্য প্রাণটা ছটফট করছে ওর। যাহোক করে হাত ধুয়ে এসে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে ছোট মাসি ওর মাথাটা কোলের ওপর টেনে নিল। ফোলা ফোলা নরম আঙুলগুলোতে মাটির সোঁদা গন্ধ লেগে রয়েছে। পুত্রস্নেহে পিয়ালের চুলে বিলি কাটতে কাটতে ভদ্রমহিলা বললেন,
“এবার একটা বিয়ে কর বাবুসোনা। আমি চোখ বুজলে কে আর আদর করবে বল!”
“আদর তো আজকাল কিনতে পাওয়া যায় মাসি। ফেল কড়ি মাখ তেল টাইপ!”
বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল পিয়াল। এসব কথা মাসির মাথায় ঢুকবে না। সেকেলে চিন্তা ধারার মানুষ। থাকুক নিজের বিশ্বাস নিয়ে। আটত্রিশ বছর পেরিয়ে গেল, পিয়াল কখনও জ্ঞানত কারও বিশ্বাসে আঘাত করেনি। ও অন্যকে স্পেস দিতে জানে। এক ছাদের তলায় যখন সোফিয়ার সঙ্গে থাকত তখনও মেয়েটাকে ভরপুর স্বাধীনতা দিত পিয়াল। বিদেশের মাটিতে অবশ্য বাঁধনের মানেটাই আলাদা। মেয়ে মানেই একজন পুরুষের মা, বোন, মেয়ে কিংবা সঙ্গিনী নয়। একটা স্বাধীন মানুষ। তবে সোফিয়াকে বুঝতে পিয়াল বোধহয় একটু ভুল করে ফেলেছিল। মেয়েটা যে আদ্যোপান্ত বশ্যতা চায়, সেটা কল্পনাও করতে পারেনি পিয়াল। মানুষের মনের ভিতর দেশটাকে পুরোপুরি বোঝা বড্ড কঠিন। নাহলে সবুজাভ নীল রঙের ছোট চুল আর নাক, কান, ভ্রূ, ঠোঁট, নাভি মিলিয়ে গোটা শরীরে প্রায় খান পনেরো পিয়ার্সিং করানো একটা প্রচণ্ড উদ্ধত স্বভাবের মেয়ে নিবিড় হতে হতে বলতে পারে,
“আমাকে আঘাত কর। পানিশ মী!”
তুমুল ক্ষমতার অধিকারিণী, ঝকঝকে স্মার্ট মেয়েরাও কি মনের গোপনে কোথায় পৌরুষের জয় লালন করে? সুঠাম পেশীর নিচে পিষ্ট হতে হতেই প্লেজার খুঁজে নেয়? ডমিনেটেড হতে চায়? ছোট মাসি বিয়ের কথা বলতেই একসঙ্গে সোফিয়া আর নদীর কথা মনে পড়ল পিয়ালের। জীবনের পথে একাধিক নারীর ছোঁয়া পেতে পেতে হাঁটতে হাঁটতে পিয়াল এই দু’জনকেই সবচেয়ে বেশি ভালবেসেছে। সোফিয়াকে পিয়াল নিজে থেকে মুক্তি দিয়েছিল; কিন্তু নদী! তার চলে যাওয়া এখনও পিয়ালকে ক্ষতবিক্ষত করে। শ্বাস আটকে আসতেই পিয়াল ভাবনা বদলের চেষ্টা করল।
“তুমি কখনও বিয়ের কথা ভাবনি মাসি? কেউ আসেনি তোমার জীবনে?”
কোলে শুয়ে শুয়েই পিয়াল দেখল ছোট মাসির দুধে আলতা মুখখানা রক্তের মত লাল হতে হতেও দুর্যোগের সন্ধ্যার মত কালো হয়ে গেল। পিয়ালের মনে পড়ল অনেক ছোটবেলায় সে একবার শুনেছিল ছোট মাসির প্রেমিকের কথা। বড়দের আপত্তিতেই সারাজীবন আইবুড়ো থেকে গেল মহিলা। এভাবে কত প্রেমের সম্ভাবনাকে যে অঙ্কুরেই শেষ করে দিয়েছিল পুরনো মানসিকতার মানুষগুলো! কিন্তু তাদের পছন্দে সেজে ওঠা ক’টা সংসার সফল হয়েছে আজ অবধি? সে খবর কেউই রাখেনি শেষ পর্যন্ত।
নদীর নাকি একটা বিয়ে হয়েছিল। পিয়ালের মাকে দেখাশোনার কাজে ঢোকার আগে নদীই বলে নিয়েছিল সব কথা।
“ডিভোর্স নিয়েছ?”
“ও বাড়ি ছেড়ে আমি স্বেচ্ছায় বেরিয়ে এসেছি। এই বিচ্ছেদই কি যথেষ্ট নয়?”
পিয়াল একটু ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল।
“এই তোমাদের মধ্যবিত্তদের সমস্যা। ডিভোর্স হলে তো খোরপোশের টাকাটা পেতে!”
“আচ্ছা যে মানুষটার সঙ্গে আমি থাকতে চাই না, তার টাকাকে সম্বল করে বাঁচব কেন বলুন তো?”
নদীর এই প্রশ্নের কোনও জবাব দিতে পারেনি পিয়াল। শুধু মনে হয়েছিল উচ্চ শিক্ষিত, মেধাবী, উত্তর আধুনিকা সোফিয়ার সঙ্গে এই নিরীহ মেয়েটার অনেক তফাত। অনেক। মনে পড়েছিল সোফিয়া যাওয়ার আগের দিন একটা হেডফোন নিয়ে তুমুল ঝগড়া বাঁধিয়েছিল ওর সঙ্গে। পাই পাই করে সমস্ত হিসেব বুঝে নিয়েছিল। অথচ এই সাধারণ মেয়েটা পরনির্ভরশীল হতে চাইছে না। একে দেখতে শান্ত জলরাশির মত হলে কী হবে? আসলে এ ছাই চাপা আগুন। ঘুম ভেঙে জেগে উঠলে জ্বালিয়ে দিতে পারে অনেক কিছুই।
পাঁচ
বৃষ্টি এলে মায়ের বিছানায় গিয়ে চুপ করে বসে থাকে পিয়াল। মনে হয় বার্মা সেগুনের কাঠের ওপর কালচে পালিশের পোঁচে, কাঠ খোদাই করা ময়ূর ময়ূর কারুকাজে, বিছানার আনাচে কানাচে কোথাও যেন মা লুকিয়ে রয়েছে। ওকে দেখছে। ওর সব ব্যথা বুঝে নিচ্ছে চুপটি করে। মাকে ছেড়ে পিয়াল বিদেশ যেতে চায়নি। বাবা জোর করে পাঠিয়েছিলেন। আঠেরো বছরে বাড়ি ছেড়ে লন্ডনে পাড়ি দেওয়ার আগে পর্যন্ত পিয়াল কোনওদিন ওর মাকে ওর বাবার দিকে চেয়ে কথা বলতে দেখেনি। অথচ ওদের বংশের কিন্তু গোঁড়া বলে কোনও বদনাম ছিল না। নদী তার নিজের জীবনের অনেক কথা বলেছিল পিয়ালের মাকে। ওই অসম্ভব রোগের যন্ত্রণা শরীরে নিয়েও মা কি সেই কথাগুলো বুঝেছিল? পিয়াল জানে না। সে কেবল দর্শকের মত দাঁড়িয়ে দেখত, দু’টি নারী নিজেদের মধ্যে কতকিছু ভাগ করে নিচ্ছে।
মা মারা যাওয়ার বেশ ক’মাস আগে একদিন দুপুরে ছোট মাসি এসে অনেক রান্না বান্না করেছিল। পিয়ালদের বাড়িটা সেদিন আবার আগের মত জমজমাট লাগছিল। লম্বা টেবিলের এক প্রান্তে বসে পিয়াল ভাত খাচ্ছিল। ডাল, আলুপোস্ত, বেগুনি, মাছের কালিয়া, আরও নানা পদ।
“নদীর মত একটা মেয়ে যদি এ বাড়ির বউ হয়ে আসত!”
মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে পড়তেই প্রায় দৌড়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গিয়েছিল ছোট মাসি। পিয়াল অনেকবার ভেবেছিল একবার বলবে ভালবাসার কথা। কিন্তু……।
“আপনি মাসিমার জন্য রঙিন শাড়ি এনেছেন কেন?”
পুজোর তখনও বেশ কিছুদিন বাকি। বাদামি কাগজের খামে মোড়া তাঁতের শাড়ি দুটো বুকে নিয়ে পিয়ালের বুকশেলফ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল নদী। চোখে মুখে তীক্ষ্ণ প্রশ্ন। অবাক হওয়ার প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে পিয়াল বলেছিল,
“মায়ের জন্য নয়। শাড়ি দুটো তোমার জন্য এনেছি। নিয়ে যেও।”
নদী চলে যাওয়ার আট দিন পর মাকে দাহ করে ফিরে গাঢ় নীল আর ময়ূরকণ্ঠী রঙের শাড়ি দুটো মায়ের আলমারির তাকে খুঁজে পেয়েছিল পিয়াল। সম্ভবত সেইদিনই প্রথম ওর খুব কান্না পেয়েছিল। জীবনে বারবার হেরে যেতে যেতে একবার না একবার মানুষের তো কান্না পাবেই। ভরা বর্ষার বন্যার মত বাঁধভাঙা কান্না।
ছয়
শেষের দিকে সারাদিন শুয়ে শুয়ে জানলা দিয়ে আকাশ দেখত পিয়ালের মা। মাঝে মাঝে চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ত। থাকতে না পেরেই পিয়াল একদিন জিজ্ঞেস করেছিল,
“তোমার কি বাইরে যেতে ইচ্ছে করে খুব?”
খানিক থেমে মা বলেছিল,
“হ্যাঁ। গঙ্গায়। আকাশের মত ভরাট নীল গঙ্গায় একবার আমায় নৌকা চড়াবি বাবু?”
কথাটা জিজ্ঞে করে মুশকিলে পড়েছিল পিয়াল। ডাক্তার বারবার করে বলেছেন,
“হার্ট খুব উইক। এখন একেবারে টানা হ্যাঁচড়া করা যাবে না। যতদিন আছেন, এইভাবেই চলুক।”
পিয়াল কিছুতেই মাথার ওপর থেকে ছায়ার মত ওই হাত সরতে দেবে না। কিছুতেই ও দুনিয়া ভাসানো অঝোর বৃষ্টির নিচে একলা দাঁড়াবে না। অথচ কিছুদিন যেতে না যেতেই নদী ব্যাস্ত হয়ে উঠল।
“আপনি বলেছিলেন যে মাসিমাকে নৌকা চড়াতে নিয়ে যাবেন! কবে নিয়ে যাবেন?”
কতবার না বলা যায়? কতবার মুক্তির আবেদন ফেরাতে পারে মানুষ?
আগস্টের মাঝামাঝি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কঙ্কালসার এক মহিলা চেপে বসলেন নৌকায়। তাঁর দুই পাশে দুটি খুঁটি। সমান্তরাল। মনে যাই থাকুক না কেন তাদের পথ মিলবে না কিছুতেই। আকাশে মেঘ জমে জমে কালো হয়ে এলে মা বলল,
“আজ আমার জন্মতিথি।”
যুবতী নদীর বুকে তখন টিপটিপ বৃষ্টি। পিয়াল একবার চাইল মায়ের সখীটির দিকে। কী পরিপাটি করে মাকে সাজিয়েছে নদী। এই মাকে দেখেই একসময় পিয়ালের হিংসে হত। পাড়ার মহিলারা যখন বলত,
“যশোদার কোলে কানাই।”
তখন রাগে দাঁত কিড়মিড় করত পিয়াল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাতে মুখে মায়ের প্রসাধন ঘষে গাল ফুলিয়ে বলত,
“আমাকেও তোমার মত ফরসা করে দাও মা। আমি কিছুতেই এই কালো রং নেব না।”
মা ওকে কোলে বসিয়ে গান শুনিয়ে, ক্ষীরের লুচি খাইয়ে ভুলিয়ে দিত সব অভিমান। এত ভালবাসা তবুও তো মা কোনওদিন নিজের জন্মদিনের কথা বলেনি পিয়ালকে! আজ বলল, তাও এই নদীর সামনে! একটা প্রবল অপরাধবোধ পিয়ালের গলা চেপে ধরেছিল সেইদিন।
সাত
“নদীমিতা মাইতিকে আপনি চেনেন?”
“হ্যাঁ। সাড়ে তিন বছর ধরে আমার মাকে দেখাশোনা করেছে সে। কিন্তু হঠাৎ জিজ্ঞেস করছেন কেন?”
“গত আটদিন ধরে সে নিখোঁজ।”
“সে কী?”
পিয়ালের স্পষ্ট মনে পড়ে সেদিন বিকেল বিকেল চলে যাওয়ার আগে মুখটা কেমন করে নদী বলেছিল,
“জানি কষ্ট হবে। কিন্তু ক’টা দিন একটু চালিয়ে নিতে পারবেন না পিয়ালদা? আসলে এই ছুটিটা আমার ভীষণ প্রয়োজন।”
“এভাবে বলছ কেন? তিন বছরে একটা দিনও ছুটি নাওনি তুমি। নিশ্চিন্তে যাও নদী।”
যাওয়ার আগে মায়ের মাথায় একটা চুমু খেয়েছিল সে।
নদী চলে যাওয়ার পর, তার পঙ্গু বাবা, বাটপাড় বড়দা, মদ্যপ স্বামী, দেওর আর আগাছার মত ভিড় করে থাকা কিছু লোকজনকে ফেস করেছিল পিয়াল। সাময়িক ঝামেলা, পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ ইত্যাদি পেরিয়ে এসে পিয়াল আবারও সেই একা। চার বছর হতে চলল।
প্রথম প্রথম অনেকেই মনে করেছিল পিয়ালের সঙ্গে নদীর কিছু একটা ছিল। ঝড়ের মত পাক খেয়ে বদনামের রোলও উঠেছিল। কিন্তু সত্যিটা আর কে জানে? হয়ত এই জানলা, হয়ত বুকশেলফ, মায়ের খাট, কিংবা ওই দু’খানা তাঁতের শাড়ি… অথবা কাচের কুচির মত জলের কণা! নদীমিতা চলে গেল, মাও গেল পিছন পিছন।
এই বিরাট বাড়ি, জানলা দরজা, আয়না, এই বাড়ির সুনাম সবাই যে যার মত করে বাঁচছে এখন। পিয়ালকে দেখেও দেখছে না। শুনেও শুনছে না। কিন্তু পিয়ালের বুক জোড়া অপেক্ষা। সাগরের মত গভীর। মুহুর্মুহু বয়ে আসা ঢেউয়ের মত অশান্ত। পরপারে আরও কেউ কি এতটাই উদগ্রীব এই ভালবাসার বলয়ে পিয়ালের কাছে ফিরে আসবে বলে!