গু চ্ছ ক বি তা
লেভেলক্রসিংয়ের ওপারে দু’একটা জানলায় সারারাত আলো জ্বলত
আর টপ করে পাশের বাড়ির ছাদে লাফিয়ে উঠত ঘোর লালচে চাঁদ।
তুমি বলতে, অনেকটা মেঠো পথ পেরিয়ে ধুলোর ঝড় সরে যাবে।
আর একটা রাস্তা একদম কিছু না বলেই বেঁকে যাবে
সেখানে একটা কাঠের বেড়া দেওয়া সাদা খামারবাড়ি
দরজায় বেগুনি প্যাস্টেলরঙা অর্কিড জড়ানো।
জানবে, ওটাই আমাদের বাড়ি।
সামনের গলিতে তখন লাইটপোস্টের ছায়া ক্রমশ লম্বা হয়ে যাচ্ছে।
রাজাবাজারের দিকে রোজ রাতেই বাজির শব্দ শোনা যেত।
আমি দেখতাম, আমাদের বাড়ির মুখোমুখি দেওয়ালগুলোয় আলাদা-আলাদা রং।
আমি ভাবতাম, কমলালেবু রঙের দিন আসছে।
আমি ধরে নিতাম, আমার হাতের নিচে একটা হাত ঘেমে উঠছে।
কাঁপছে অল্প-অল্প।
আর বেগুনি রঙের রোগা অর্কিডের শাখা একা-একা এগিয়ে যাচ্ছে…
দু’একটা হারিয়ে যাওয়া চিঠি শুধু যেখানে যেতে পারে।
খুব যত্নে অনেকক্ষণ ধরে যাদের গায়ে স্ট্যাম্প লাগানো হয়েছিল।
মুখে বলতাম, ‘‘শোনো, শাস্তি বাধ্যতামূলক হওয়াই ভাল।
সমস্ত ফাঁকা হল, অনন্ত পর্যন্ত চলে যাওয়া করিডর, আবছায়া নৌকো
এরা প্রতিশোধ নেবে, মেনে নেওয়াই ভাল।’’
তুমি হাসতে আর বলতে, ‘‘এই শীতেই খুঁজে বের করবে ছোটবেলার ড্রয়িংখাতা।’’
বলতে, ‘‘সোনালি রিবনবাঁধা উপহারের বাক্সে গুটিসুটি ঘুমিয়ে আছে আমাদের সমস্ত যাওয়া।
ঠোঁটটা অল্প হাঁ।’’
তুমি হাসতে আর অন্ধকারের মধ্যে খালি শোনা যেত, লিফ্ট ঝাঁপ দিচ্ছে।
আর কারও কিচ্ছু যায় আসত না। কখনও।
একটা লাল সন্ধে কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল।
আর কাঠের দরজার উপরে একটা স্টাফড হরিণের প্রকাণ্ড মাথা।
হঠাৎ হঠাৎ অন্ধকার সিঁড়ির নিচে উড়ে আসত পোড়া কাগজের টুকরো
কীভাবে দিনগুলো পেরোবে ভেবে চিন্তায় চিন্তায় ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছিল টাটকা রং-করা বাসস্ট্যান্ড।
এক্ষুণি আসব বলে কেউ কোনওদিন আসেনি
হেমন্তকাল এসব জানত?
কেন বলেনি কখনও?
শুধু স্বপ্নের ভিতর এঘর ওঘর করতে করতে একদিন ভেঙে পড়ছিল চিনামাটির বিদেশি পুতুল।
হেমন্তকাল জানত এইভাবে দিনের পর দিন কেঁপে যাওয়া অসহ্য খারাপ আলো।
জানত ক্রমাগত ডুবে যাওয়া ভেসে ওঠা ডোবা…
আয়নার ভিতর সম্পূর্ণ ঢুকে পড়ার আগে একবার থমকেছিলে
আর চারদিকের বাড়িতে জ্বলে উঠল উত্তেজক সাইকেডেলিক আলো।
একবার মৃত্যুর জন্য থমকেছিলে।
একবার কাঠফাটা দুপুরের জন্য।
একবার অস্ফুটে বলেছিলে, আর কত দূর?
একবার… একবার
মনে আছে আয়না আচমকা কেঁপে উঠে স্থির হয়ে গেল।
আমরা দেখলাম খুব নিষ্ঠুর একটা শনশনে হাওয়া অবুঝের মতো মিলিয়ে যাচ্ছে।
এবার বলো কোনদিকে?
বলো হেমন্তকাল বলো। না বললে কিন্তু রেহাই নেই।
কালো রাতের মুদ্রায় বলো কিংবা শুনশান চিলেকোঠার কান্নায় বলো
খুব নরম গলায় একটার পর একটা বলো, অপেক্ষার শ্বাসরোধী গল্পগুলো।
কখনও ভুলতে দিতে না।
একটা লাল সন্ধে কাছেই দাঁড়িয়ে থাকত।
আর ঘুণধরা দরজার উপরে একটা স্টাফড হরিণের প্রকাণ্ড করুণ মাথা।
একবার সমুদ্রের ধারে পুরনো একটা গুদামঘরে
আমরা অনেকদিন লুকিয়ে ছিলাম।
‘চিন্তা নেই, দিনগুলো সোনার জলে মুড়ে যাবে’ – এসব তখন আমরা মাঝে মাঝেই বলতাম।
রাতগুলোকে অকারণ অবহেলা করতাম।
তাই শিগগিরি ওদের প্রতিশোধ নেওয়া শুরু হল।
তারপর থেকে যখন যেখানে যেতাম
একটা কালো ফিনফিনে পরদা আমাদের ঘিরে থাকত।
হাতে সময় থাকলে আমরা পরস্পরকে বোঝাতাম
অভিধান যাই বলুক ‘উপহাস’ শব্দটার মানে হয়তো পরিহাস-ই।
ক্ষোভগুলো আমরা নামিয়ে রাখতাম ওই গানটার সামনে
‘ওই আসনতলে মাটির পরে লুটিয়ে’…
আয়নার ভিতর যে একটা লুকনো নিবিড় রাস্তা আছে
এটা তুমি একবার বলে ফেলেছিলে
তারপর বহুবছর অনুতাপ করেছিলে।
শান্ত অনুতাপদগ্ধ কথার দু’দিকে ভর দিয়ে
আমরা সারাদিন বসে থাকতাম।
হিমবাহের নীরবতা নেমে আসছিল ধীরে ধীরে শিরা বেয়ে চোখের মণিতে।
হঠাৎ সমুদ্র থেকে একটা স্বপ্ন আমাদের ছুটিয়ে মারত শুরু করল।
একটা পোড়া নৌকোর কাঠে বন্দি একটা নিষ্পলক চোখের স্বপ্ন।
অ্যাকোয়ারিয়ামের জলে অনেক লাল-নীল-সবুজ পাথর
আর ওদিকে এক অনর্গল জলপ্রপাত দু’বেলা চিৎকার করে স্বপ্নের কথা বলে।
আর মৃত্যুর আঁশটে গন্ধে ভারী হয়ে ওঠে হাওয়া।
দৌড়ে-দৌড়ে ছাদের দিকে উঠে যেতে চাও তুমি প্রতি বিকেলে
এদিকে একটা সাদা গাড়ির ড্রাইভার কিছুতেই তোমায় দেখতে পায় না।
হাহাকার ছটফট করে জানলার ফুলকাটা পরদায়।
ঠেলাগাড়িতে বসে হাসতে-হাসতে চলে যায় ঘামে-ভেজা বাচ্চারা।
তুমি ভেঙে যেতে-যেতে দেওয়াল লিখতে থাকো
লিখতে থাকো রক্ত, লিখতে থাকো নাচ, লিখতে থাকো কাঁপতে থাকা আলো
আর গোপনে বল এগিয়ে যায় জনশূন্য বাউন্ডারির দিকে।
মৃত্যুর ছোট্ট আঙুল ধরে বাড়ি ফিরতে চায় বেগুনি ফুলে ঢাকা বিকেল
এতক্ষণ টানা অন্ধকার হাতড়ে-হাতড়ে চোখ যখন অন্ধকারেও দেখতে শিখেছে
কলুটোলার কাছে প্রত্যেক বাড়িতে একসঙ্গে আলো জ্বলে ওঠে।
হেলে পড়া সন্ধের ছায়া বিড়ালের মতো পায়ে পায়ে তোমার দিকে এগিয়ে আসে।
তুমি তাকে জল আর আগুনের প্রতিহিংসার গল্প বলে লোভ দেখাও।
বলো, মৃত্যু একদিন লাল-নীল পাথর হয়ে উপচে দেবে আমাদের অ্যাকোয়ারিয়াম
দেখে নিও। ঠিক এমনটাই বলে গেছে সক্কলে। চিরকাল। বিশ্বাস রাখো।
ছোটবেলার কথা ভেবে বাস থেকে অনেক আগে নেমে ভিড়ে মিশে যাও তুমি।
একটা কবিতা থেকে কত দূরে থাকে আর একটা কবিতা?
রাস্তা দিয়ে গাড়ি গেলেই আলো চমকে ওঠে ঘরের মধ্যে।
খাড়া খাদ অভিমানের মতো লুকিয়ে থাকে পায়ের খুব কাছে।
কেন রোজ আকাশি ছাতায় মুখ আড়াল করে কেউ মিলিয়ে যাবে গলির শেষে?
কেন রোজ সন্ধেবেলায় বলবে, এই শেষ দেখে নিও।
একটা বাড়ি থেকে কত দূরে থাকে অন্য বাড়ি?
একটা অপেক্ষা থেকে অন্য একটা ভুলে যাওয়া?
লাল বল সুযোগ পেলেই গড়িয়ে-গড়িয়ে হারিয়ে যেতে চাইছে খাটের তলার দিকে।
একটা মুখচোরা সন্ধেকে প্রাণপন লোভ দেখাচ্ছে জন্মদিনের বেলুন আর নরম পারফিউম।
সব কথার ভিতর অন্য দিকে তাকিয়ে হাসছে আরেকটা কথা,
সব বাড়ির মধ্যে একা রেলিং, পুরনো ওষুধের গন্ধ আর ভাঙা কাঠের ঘোড়া।