অ গ্নি রা য়ে র ডা য়ে রি | পর্ব ২
দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জ ফাঁড়ি থেকে যত পথ তত মত! গড়িয়াহাট মোড়ের প্রহর শেষের আলোয় রাঙা চৈত্র সেলের দিকে যেতে চাইলে এক। হাজরা মোড়ের সিনেমা পাড়ার নুন শো-র জন্য অন্য। আবার সদাব্যস্ত বিরিয়ানিগন্ধী পার্ক সার্কাসের জন্য তার উল্টো।
সেগুলি আপাতত নয়। আজ এখানে পাততে বসেছি এর বাইরের সেই নির্জন রাস্তাটির ফাঁদ। বালিগঞ্জ ধাবার লাগোয়া বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড, যা দু’পাশের অভিজাত, নীরব, খেলানো গাড়িবারান্দাওয়ালা বাড়ি, কৃষ্ণ ও রাধাচূড়ার রং কাটাকুটি, কাঠচাঁপা, দেওদার গাছের ফিসফাস নিয়ে ক্রমশ এগিয়ে যায় অনন্তের দিকে। এই রাস্তায় শৈশব পুইয়ে কৈশোর কাটিয়ে ক্রমশ বয়ঃসন্ধির দিকে হেঁটে গিয়েছি স্কুল পোশাকে বছরের পর বছর। কখনও শরতের মেঘ মাথায়, অথবা ঝানু গ্রীষ্মে। দেওয়ালে তখনও কংগ্রেসের সাহসী শ্লোগান, ‘বন্যার ত্রাণে টাকা লুটেছি, মরিচ ঝাঁপিতে মানুষ মেরেছি, ভোট না দিলে খুন করবো আমরা সিপিএম’ (মাঝে আরও কিছু লাইন থাকতে পারে, আজ আর মনে নেই)। দেওয়ালে কাস্তে-হাতুড়ি-তারার গ্র্যাফিটি আর এক তরুণ নায়ক অনিল কাপুরের নতুন ছবি ‘সাহেব’-এর পোস্টার। ল্যাম্পপোস্ট আলো করে রয়েছেন তাপস পাল! হাতে গোনা প্রাইভেট বাস, অটো চলাচল নেই, মন্থর টানা রিকশার টুংটাং। আর ছিল মাটি ফুঁড়ে ওঠা একটি টকটকে লাল ডাকবাক্স। স্কুল যাওয়ার সময় বাড়ি থেকে প্রায়শই ধরিয়ে দেওয়া হত নীল ইনল্যান্ড লেটার। ওই লালের মধ্যে নীল ঠিকানা লেখা চিঠি গলিয়ে দিয়ে আবার হাঁটা। রাস্তা এসে পড়ত ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজে, যার উল্টোদিকেই আমার ফাইনাল গন্তব্য, অর্থাৎ বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুল।
কথায় কথায় জেনেছিলাম এই রাস্তাতেই নাকি থাকেন সুচিত্রা সেন। যাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়ে গিয়েছে বসুশ্রী-ইন্দিরা-পূর্ণতে, আর তার চেয়েও বেশি বিস্তীর্ণ পারিবারিক বড়োদের আড্ডায় থেকে, হল কালেকশনে! যাঁকে তখনও খুব কম হলেও মাঝে মাঝে দেখতে পায় নাকি কলকাতা। একবার তো আমারই মনে আছে, বাবার সঙ্গে এয়ারকন্ডিশন মার্কেটে গেছি আমি আর দিদি, একটি পরিচিত চশমার দোকানে। যাওয়ার পরেই পরম আক্ষেপে পরিচিত দোকানি বাবাকে বললেন, ‘এহ্ হে! এই তো মিসেস সেন এসেছিলেন, চটপট চলে গেলেন!’ তখন খুব ছোট হলেও, মনে আছে উত্তমের পরম ভক্ত বাবার মুখে ‘হারানো সুর’ আবার হারিয়ে ফেলার আক্ষেপ!
তো সে যাই হোক। একটু উঁচুর দিকের ক্লাস তখন। আচমকা ছুটি হয়ে গিয়েছ, বোধহয় রেনি ডে-র কারণেই। বাস চলছে না। বারবার হারিয়ে ফেলার কারণে তখন প্রায়শই ছাতাহীন আমি হেঁটে ফিরছি ফাঁড়ির দিকে, ওই রাস্তা দিয়ে। একটা সময় আর এগোনো যাচ্ছে না এমনই ধুম বৃষ্টি। সপ্তপর্ণী বলে একটি তৎকালীন মাল্টি-স্টোরিডের থেকে একটু এগিয়ে (নাকি পিছিয়ে?) একটি বড় ছাতিম জাতীয় গাছের নীচে কোনওমতে দাঁড়িয়ে আছি। হ্যাভারস্যাক (তাই বলা হত তখন) মাথায় ঢেকে, চশমা ঝাপসা।
একটি অ্যাম্বাসাডর গাড়ি এসে দাঁড়ালো সামনে বাঁদিকে। ঢুকবার কথা, কিন্তু বৃষ্টিজনিত কারণে সামনে কোনও বাধা, সাইড কাটতে একটু পাঁয়তারা কষতে হচ্ছে। পথ জনহীন আঁধারে বিলীন! এমনকি একটা কুকুরও নেই ভেজার জন্য। সম্ভবত স্কুল ড্রেস পরে একটি বেচারা কিশোরের ফ্রেম কৌতুহল তৈরি করে থাকবে গাড়ির সওয়ারির, বা অন্য কারণে, কাঁচটা নেমে গেল কয়েক সেকেণ্ডের জন্য। এবং ছোটবেলা থেকে ভারী চশমার কাঁচ, আরও ঝাপসা জলের জন্য, সামনেও উপর্ঝরণ। কিন্তু তার মধ্যেও ওয়াশের কাজের মতো জানলায় একটি ছবি! যে ছবির জন্য তখনও কলকাতা পাগল। রিনা ব্রাউনকে তো, আগেই বলেছি, ততোদিনে দেখা হয়ে গিয়েছে নুন শো-এ। গায়ে কাঁটা দিয়েছিল? মনে নেই। যা ভাবছি তা সম্পূর্ণ ভুলও হতে পারে ওই ইলিউশনময় পরিবেশে। তবে এই কয়েক সেকেণ্ডে ওই ঘনঘোর বরিষায় এক কিশোরের ম্যাজিক স্পেল তৈরি হয়েছিল নির্ঘাত। বান ডেকে উঠেছিল ছাতিমের গন্ধে। কাঁচ উঠে যায়, এবং গাড়ি ঘুরে যায় যথারীতি। আমি গোলমেলে মাথা নিয়ে ভিজতেই থাকি।
এর অনেক, অনেক পরে, মানে সম্পূর্ণ অন্য জন্মে, এই তো প্যানডেমিকের কিছু আগে, মুনমুন সেন ডেকেছিলেন ডিনারে। সেই বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড। সেই বাড়ি (যদিও এখন ভেঙেচুরে অনেকটা পাল্টে নেওয়া হয়েছে বলেছিলেন, আমার বোঝার কথা নয়)। ছবি তুলবো না এই আস্থা আছে বলেই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন, সুচিত্রা সেনের ঘর, পুজোর জায়গা, টেবিল, আলমারি, বেলজিয়াম গ্লাসের পানপাত্র সমূহ।
না, সে সব দেখে আলাদা করে কোনও ম্যজিক তৈরি হয়নি। এমনকি গভীর রাতে বেরিয়ে নির্জন বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে ওই বাড়ির সামনে দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে গাছটা খুঁজে পেলাম না আর। ছাতিমের ওই গন্ধটাও পঁয়ত্রিশ বছরের ওপার হতে ফিরে এলো না তো! আর ফেরার কথাও কি ছিল? সেই মুগ্ধ কিশোরটি হয়তো এখনও ওই ফ্রেমেই চিরবন্দি হয়ে আছে। ভরা বর্ষায়।
* ক্রমশ