ব ই ক থা ৩
ভাঙা দেরাজের গল্প
মন্দিরা ঘোষ
প্রকাশক । বার্ণিক প্রকাশন
প্রচ্ছদ । কৃষ্ণেন্দু মন্ডল
১২০ টাকা
এস্রাজের মোটিফ আঁকা প্রচ্ছদের নিচে যে ভাঙা দেরাজ সেখানে এক ভালোবাসাময় জগতের আকাশ আর অনিবার্য প্রেম-বিরহ-বিষাদের রাগ রাগিনী । দেরাজটি ভাঙা কেন? হয়তো সময়োত্তীর্ণ তাই । অনুভবের পরতে পরতে যে দেখা থাকে তারই যেন এক বাঙ্ময় চিত্রকর্ম – কবি মন্দিরা ঘোষের চতুর্থ কাব্য সংকলন ‘ভাঙা দেরাজের গল্প’।
দেরাজের প্রতিটি প্রকোষ্ঠের গল্প মন্দিরার সিগনেচার শব্দবন্ধ, মেটাফর ও অ্যালিগরির ঔজ্বল্যে মানবিক বোধ এবং বৌদ্ধিক চেতনার দিগন্তকে প্রসারিত করে পাঠককে এক অনন্য অনুভবে জারিত করে । এইখানেই হয়তো এই কাব্য সংকলনটি সফলতার ভিকট্রি ল্যাপে দড়িটা ছুঁয়ে ফেলে !
গ্রামের ভেঙেপড়া জমিদার বাড়ি, রাঙা ধুলোর পথ, শাল-পিয়ালের জঙ্গল পেরিয়ে এসে যিনি হাওড়া শহরের একটি বর্ধিষ্ণু পরিবারের গৃহবধূর নিশ্চিন্ত জীবন আঁকড়ে ধরে থাকতে পারতেন, তিনি স্বপ্রতিভায় ও অদম্য অধ্যাবসায়ে তাঁর চতুর্থ কাব্য সংকলনটি নিয়ে পাঠকের দরবারে হাজির হচ্ছেন, ঘোষণা করছেন – “গুটিপোকার পরম্পরা আর নাগরিক হতাশার কুয়ো থেকে/ উঠে আসে ভাঙা দেরাজের গল্প” – ভাঙা দেরাজের গল্প / পৃ ১১
যে দার্শনিক বোধের পঙক্তিটি বর্তমান লেখাটির শিরোনাম সেটি “ফলাফল হারিয়ে যায়” কবিতা (পৃ ১৩) প্রারম্ভিক পঙক্তি যার শেষ স্তবকের – “নাভির দেবতার পাতে সন্ধি আচার /বৃন্তপলাশের ঘুম ভাঙা মুহূর্ত /রক্তের তছনছ/ ছেঁড়াখোঁড়া যুদ্ধের পাতায় ফলাফল হারিয়ে যায়” ব্যঞ্জনাটি চিরকালীন।
যাপনের অন্তক্ষরণে বিষাদের সুর আছড়ে পড়ে “ঢেউ” কবিতাটিতে (পৃ ১৫) – “এত ঝড়, স্তব্ধতা, অন্ধকার ! এত কান্না কুড়ানো মেঘ! এত শ্রাবণগন্ধ শোক ! / কাকে নেবো আমি!”
অথবা “দেয়ালে কান্না খুঁড়ছে সরীসৃপের নখ, ম্যাতিসের জয় অফ লাইফ থেকে গড়িয়ে পড়ছে /শরীরের উপপাঠ।” কবিতাটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে “বিষাদের মহাসংগম”।
মানবিক সম্পর্কটি যেন পুনরসংজ্ঞায়িত হয় “হিন্দোল” কবিতাটির (পৃ ১৬) এই পঙক্তিতে – “একটা সম্পর্ক আলোর মতো/ যাকে ঠিক না ছুঁলেও কাছে আসে অথবা আসে না / যাকে মাত্রাজ্ঞানে আটকে রাখে সুতো কিংবা সুতোর মতো আড়াল” ।
বর্তমান অতিমারী সময়ের একটি দলিল হয়ে উঠেছে ভাঙা দেরাজের এক একটি কবিতা। সভ্যতার বেপরোয়া ঔদ্ধত্য পরাজিত হয়েছে ভয়ঙ্কর অতিমারীর সংক্রমণে । তাই উচ্চারিত হয় –
“এগোনোর কাছে হাঁটু ভেঙে গেছে মিছিলের”
বা “ভয় জড়িয়ে নিয়েছি স্নায়ুর অভিসারে/ ক্রমশ সাদা হতে থাকা আঙুলে মৃত্যুর ক্যাকোফোনি /অন্তরীণ আকাশে ঢুকে পড়েছে স্যানিটাইজার এর গন্ধ” । অন্তরীণ সময়ের একাকীত্বের অনুভবটি বিম্বিত হয়েছে – “দুহাতে মেঘ ধরে বসে আছি /বুকের সিস্মোগ্রাফের ছবিতে হারিয়ে যাচ্ছে রক্তের কম্পন /পুরোনো গিটারের পিকগ্লাইডে গড়িয়ে পড়ছে /আলোর মতো তোমার স্পর্শ দিনের তালিকা”। সেই অনুভবের আকুল আর্তিটি ধরা থাকে শেষ স্তবকে কবিগুরুর গানের মূর্ছনায় – ‘হাতখানি ওই বাড়িয়ে আনো /দাও গো আমার হাতে-/ ধরব তারে, ভরব তারে, রাখব তারে সাথে’– হে বন্ধু হে প্রিয় / (পৃ ১৭)
এই অতিমারী কারণে অন্তরীণ যাপনের ছন্দোবদ্ধ অনুভূতির ছবিটি আঁকা হয় “থমকে থাকার খেলা” কবিতায় (পৃ ২১) ।
আতঙ্কগ্রস্ত সময়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের নৈরাশ্য আর বাঁচার লড়াইটিও বিধৃত “মানবতাহীন” কবিতায় (পৃ ২২)।
একদিন এই দুঃসময় কাটিয়ে ওঠার আলো জ্বলে ওঠে মন্দিরার সুনিপুণ অক্ষরমালায় –
“সব বন্দী আলো রোদ হয়ে ওঠার অপেক্ষায়/ করাতকলে কাটা পড়ছে পাখির পায়ের দাগ/ নামাজের রং মেখে এবার উঠে দাঁড়াবে /ছেঁড়া ছেঁড়া সবুজ জনপদ”।
তবু সংবেদনশীল অনুভবের লেন্সে ধরা পড়ে – “এখনো গ্রিলের গায়ে লেগে থাকা/ বৃষ্টি ফোঁটা সাবালক হলো না বলে /জলাশয় হয়ে উঠছে ঘর”। – দুর্যোগ কাটিয়ে / (পৃ ২৩)
সময়ের ভাইরাস মেটামরফসিসে কিভাবে সম্পর্কের ভাইরাস হয়ে ওঠে তার ছবি “মাক্ষিক ভোর” কবিতাটিতে-
“ঝলমলে রোদেও জমে ওঠে বিন্দু বিন্দু অন্ধকারের গোপন /প্রতিষেধক হীন ব্যাধিঘুমের চোখে নির্ঘুম রাতের আঁচড় / উড়ে আসে পুরোনো চিঠির বাষ্প, দারুণ দিনের উষ্মা ঘর /ছোটো ছোটো ঢেউ মাখা ঝিনুককলহ/ উন্মাদ নখের দাগের কালশিটে মেলানিনের শতসহ্যের বিষযাপন !” – মাক্ষিক ভোর / (পৃ ২৬)
সচেতন কবির উচ্চারণে সতর্কবাণীটিও শোনা যায় – “তোমরা এখনো বিবদমান !/ হাত ছুঁয়ে দ্যাখো/ শত্রুতার আগুন নয়/ ঠাণ্ডা পাথর হয়ে উঠছে আঙ্গুল” – মৃত্যুর গন্ধ / (পৃ ২৭)
“কীভাবে বাঁচাবো / প্রিয় সৃষ্টিসুখ মানুষ তোমায় !” অসহনীয় সময়ের বেড়াজালে অসহায় পৃথিবীর আর্তি আঁকা হয়ে যায়।
– অসহায় পৃথিবী / (পৃ ২৮)
“অন্ধকার একদিন জার্সি বদল করবেই” – এমন আত্মবিশ্বাসী পজেটিভ ন্যারেটিভে শেষ হয় “যখন কোন অবরুদ্ধ রাস্তার নাম ভাইরাস” কবিতাটি (পৃ ২০)।
জীবনে নারী পুরুষের ভালোবাসার আকাশটি মুখ তুলে নীল ছড়ায় যখন “হালকা নীল টিশার্টে সমুদ্রের গন্ধ” প্রাণের জোয়ারে ডাকে “গোলাপি টপে উপচে পড়া ঢেউ” আর তার “সিস্মোগ্রাফ”-কে । তখনই “একটার পর একটা প্ল্যাটফর্মের আলো /পেরোতে পেরোতে লেখা হয়ে যায় /অজস্র মুখের হিজিবিজি কবিতা” – ট্রেনজার্নি / (পৃ ১৮)
‘ভোরের সাক্ষাৎকার” কবিতাটির (পৃ ১৯) ক্লোজ শট্ –এ “দিনের শাড়িতে মেলা মন খারাপের হলুদ জ্যোৎস্না/ দীর্ঘশ্বাসের কলমে মেঘলা আকাশ।“ অথবা “নিঃসঙ্গতার ঝড় খুঁজে রাখছে একলা কোনো বুকের ভূগোল” । একাকীত্বের রঙে আঁকা ক্যানভাসটি । কিংবা এক অনিবার্য বোধের অকপট উচ্চারণ – “সব অকপট জানলায় দাঁড়িয়ে স্বার্থের গোপন সিঁড়ি ।” একাকীত্বের আরো একটি বিষাদময় ক্যানভাস “বিকেলবাড়ি” কবিতাটিতে (পৃ ২৯)- “একা একা রংচটা ব্লাউজ ব্যথা সেলাই করে /বালিশের ঢাকায় মোড়া তিতিরের গন্ধ/ কাঁসার থালায় ফুলকাটা বিকেলবাড়ির গান”। শেষ স্তবকের সেই অমোঘ দেখাটি – “হয়তো নীল খামের বিষণ্ণ অক্ষর /অপেক্ষা আঁকছে একা”।
হারিয়ে যাওয়া সময়ের যন্ত্রণার করুণ সুরটি শোনা যায় – “জানি সবটাই একার বিলাপ/ সকালের চায়ের কাপের নীচে / ভেসে ওঠে ছেঁড়া বুকের বোতাম” অথবা “আমরা তো ছিলাম কোথাও তুমুলভাবে /সমস্ত নগ্নতায় দাঁড়ি টেনে /ভোরের শিশিরের মতো স্বচ্ছ সহবাসে” পঙক্তিগুলিতে। আবার হৃত অতীত এবং বিপ্রতীপ বর্তমানের অভিঘাতে বেজে ওঠে অনন্য বোধের রাগিণী –
“পুকুরের পাড় ঘেঁষে উন্মাদ জীবন /কোন অলৌকিক অভিশাপের /ছিল কিনা জানা নেই /এঁটো আঙুলগুলিতে এখনো /ভোরের বিস্ময় জল ঝরে পড়া দেখি” -অলৌকিক অভিশাপগুলি / (পৃ ৩০)
হঠাৎ বাতাসে দুলে ওঠা পর্দার মতো শাশ্বত প্রেমের বন্দিশটি ধরা পড়ে যখন লেখা হয় –
“হঠাৎ খসে পড়া পর্দার অনুচ্ছেদে/ ঝিঁঝিঁ পোকার ক্যারল / এসে পড়ে আলোর মতো তোমার মুখ / আর আমার এলোমেলো চুলের গোছা সরিয়ে দাও দু’হাতে” – ডিসেম্বর / (পৃ ৪২)
ছয়টি ছোটো ছোটো কবিতার সিঁড়ি বেয়ে এক অনাবিল উত্তরণে প্রেমিককে শিরোনামে বসিয়েছেন প্রেমিকা কবি বিশুদ্ধ উচ্চারণে আন্তরিক অনুভবে – “যেভাবে গাছের কাছে ছায়া/ নদীর কাছে জল /যেভাবে আগুনের কাছে অক্ষর / পাখির কাছে উড়ান আর / তুলির কাছে রং/ সেভাবেই আমার শিরোনামে তুমি” অথবা “তারে তারে সেতারের ঘুম/ চুরি করো কবিয়াল/এ জোৎস্না ভরে নাও ঠোঁটে” – শিরোনামে তুমি / (পৃ ৪৩-৪৪)
ভালোবাসার চিরন্তন রূপটি অরূপ হয়ে ধরা দেয়- “অবাধ্য শ্রাবণ যেন নিয়ম না মানা শিশু/ সব কথা ভুলে যখন তখন/ ভিজিয়ে দেয় সব” – স্তবকটির অনুভবে । ভালোবাসি / (পৃ ৪৮) প্রেমিকের সঙ্গে বিচ্ছেদের যন্ত্রণাস্রোত কবিতার সিঁড়ি বেয়ে গড়িয়ে নেমে পাঠককে ভেজায় যখন, মন্দিরা লেখেন – “বন্ধুহীন কোন শীতের বারান্দায় দুলছে হলুদ শার্টের উদাসীনতা/ রাত জাগা ঘড়ির কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত ভার্চুয়াল টিপ/ একটা রুলটানা ভোরের পাতা একা একা এলোমেলো হচ্ছে কেবল”। অলিখিত / (পৃ ৫৫)
আবার প্রেমিকার অভিমানের সুরটি কবির অনুভবের এস্রাজে বেজে ওঠে “ভালো থেকো” কবিতাটির (পৃ ৫৯) অন্তিম স্তবকে –
“গাছের পাতা রইল চুপ /হতভম্ব পাখি ভিজে একসা!/ চোখের ভিতর টলটলে নদী /সাদা খাতায় নোনা অক্ষর /ফুলে ফুলে উঠলো”
দাম্পত্য জীবনের দায়বদ্ধতায় ও সাংসারিক জীবনের প্রাত্যহিকতায় সংস্কারের আড়ালেও
চিরপ্রেমিকের অধিষ্ঠানটি সূচিত হয় “ভ্রুণপর্ব” কবিতার (পৃ ৬২) এই উচ্চারণে –
“আজও আবহে বালিকা বিকেল /শাঁখ সন্ধ্যায় সিঁদুরের প্রণিপাত /গরদ শাড়ির ভাঁজে শুয়ে /সমস্ত অনুধ্যানে তোমার নীল পদক্ষেপ/ ভ্রুণপর্বের সূচক হয়ে ওঠে”
“আত্মহননের শেষতম বিন্দুর কাছ থেকেও/ ফিরে আসা যায় /যদি স্বপ্নেরা ধরে থাকে হাত/ যে ভাবে ফিরে আসে কবিতা…” – ফেরা / (পৃ ৬০)
ভাঙা দেরাজে জীবনের জয়গানের মণিমুক্তো গুলি এভাবেই রাখা আছে আন্তরিক অনুভবী পাঠকের প্রতীক্ষায় । গল্পের শেষ পৃষ্ঠায় বিশুদ্ধ প্রাণের অমোঘ মন্ত্রটি ভালোবাসার আকাশ ঝেঁপে বৃষ্টিধারায় ঝরে পড়ে –
“স্পর্শ পেরিয়ে পেরিয়ে / শরীরে সেতার খুলি/ তারে তারে ছল ছল জল”। -স্পর্শ / (পৃ ৬৪)