গ ল্প
যেহেতু বহুদিন আমি কোনও মেয়ের শরীরের গন্ধ পাই না, তাই নিজের কাঁধ ও হাতের সংযোগস্থলে নাক নিয়ে গিয়ে নিজের চামড়ার গন্ধ শুঁকি।
গরমের রবিবারগুলো এমনই হয়।
বিছানায় গা লাগিয়ে শুয়ে থাকা মুশকিল হয়ে পড়ে। মেঝেতে শরীরের যতটা সম্ভব ছড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা শুয়ে আছি সেই কখন থেকে। একটি বাতানুকূল যন্ত্র আমরা সহজেই কিনে আনতে পারতাম।
তবে সুখ হল মধ্যবিত্তের সবথেকে ভয় এবং সন্দেহের বিষয়।
বাবা বাগানে ফুলগাছগুলোকে পরিচর্যা করছে। খালি গায়ে গরমের মধ্যে কাজ করলেও বাবার গায়ে তেমন ঘাম দেখা যাচ্ছে না। গরমের দুপুরে এই আলোর মধ্যে বাবার এই উন্মুক্ত গা মিলেমিশে এক সুন্দর দৃশ্য তৈরি করেছে। দৃশ্যটি ভেসে আছে আমার চোখের ওপরে। আমি অনেকক্ষণ বাবাকে এভাবে দেখতে চাইছিলাম। বাবা একটা কঠিন চাকরি করতো বলে আমার মনে হত। কবরস্থানের ওপরে ফুলগাছ লাগানোর চাকরি। তিন বছর হল সেই চাকরির মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে। আমার বাবা বলত,প্রতিটি ফুলগাছের নীচেই আসলে একটি মৃতদেহ থাকে। তাই, নিয়ম না থাকা সত্ত্বেও ঠাকুরদা-ঠাকুমার দেহ আমাদের বাগানেই কবর দিয়েছিল বাবা। সেখানকার ফুলগুলো বাবার যত্নেই সবথেকে সুন্দর, উজ্জ্বল।
আমাদের বাগানে একটি গাছ ছাড়া সমস্তই গাছ ফুলের। শুধু একটি নিম গাছ আছে। বাবার হাতেই লাগানো। বাড়ির দক্ষিণদিকে গাছটির নীচে কিছুটা ঝোপ জঙ্গল। নিম গাছটি বেশি বড় হয়নি। প্রবল ঝড়ের সময় মাঝেমাঝেই সেটাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে বাঁচাতে হয়।
প্রায় ভোর অবধি জেগে থাকি বলে সমস্ত দিন শরীর ক্লান্ত থাকে। সকালে ঘুম থেকে উঠে কোনোক্রমে খেয়ে দেয়ে শরীর আবার ঘুমের প্রার্থনা করে। প্রায় স্নানের আগে অবধি একটা লম্বা ঘুম। মায়ের সেই ফুরসৎ নেই। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়েও সারাদিন রান্নার কাজ। তবু তার মাঝে আমাদের স্নানের আগে চা খাওয়ায় মা।
চা খেয়ে গামছাটা প্রতিদিনই কিছুক্ষণ খুঁজে পাইনা।
স্নানের ঘরে প্রতিদিন গিয়েই আমার তিনটি কথা মনে পড়ে।
আমার নাম দীপ শেখর চক্রবর্তী।
আমার নাম রাখা রয়েছে দীপ শেখর চক্রবর্তী।
লোকে আমাকে দীপ শেখর চক্রবর্তী নামে জানে।
সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে স্নান করতে পারি এখন। স্নান বিষয়টা আমার কাছে প্রতিদিনের একটা নিয়মমাত্র নয়। স্নানের মধ্যে দিয়ে প্রায় প্রতিদিনই আমি জল এবং শরীরের ভেতর একটা সম্পর্ক বোঝার চেষ্টা করি। আমার মনে হয় খুব কম মানুষই বাথরুমে আত্মহত্যা করতে পারে। যদিও আমি সেভাবে তথ্য ঘাঁটিনি। এই মনে হওয়ার পেছনে যে বিশেষ কোনও কারণ আছে এমনটাও নয়। হয়ত জল এবং শরীরের সম্পর্কের জন্যেই।
দুপুরের খাওয়ার সময়ে বাবা সেই ভয়ানক কথাটি তুললো,
– জানিস, খবরে কী বলছে?
মাথা নাড়ালাম, খবর আমি তেমন দেখিনা।
বাবার মুখ কিছুটা থমথমে। কিছু একটা খুবই বিরক্ত করে তুলেছে বাবাকে।
– সরকার এবার থেকে নির্দিষ্ট করে দেবে যে বাড়ির বাগানে ঠিক কী কী ফুলগাছ লাগানো যাবে। ওদের তালিকার বাইরে যদি ফুলগাছ লাগানো হয় তাহলে সেই জমি নিজেদের দখলে নিয়ে নেবে ওরা।
সে কি! এ কি ধরণের জুলুম?
– কেউ কোনও কথা তোলেনি এই নিয়ে?
– তুলেছিল, তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিল পাশ হয়ে গেছে।
ওপরের ঘরে উঠে এলাম। ছিটকিনি দিয়ে দিলাম দরজায়।
তালিকাটি কি এখনও ওরা প্রকাশ করেছে?
উত্তর জানিনা। ওপরের ঘরে এলে অন্য এক পৃথিবীর কথা মনে পড়ে। বিশেষত, এই দুপুরবেলায়। ঠাকুরদার একটা ছবি এই ঘরের দরজার ওপরে ঝুলছে। তীব্র, উজ্জ্বল চোখ, মুখে নম্র হাসি।
ঠাকুরদা খুবই আদর্শবাদী ছিলেন।
আদর্শবাদী মানুষ শুধুমাত্র নিজেই যে আত্মহত্যা করেন এমন নয়, আশেপাশের মানুষজনকেও আত্মহত্যা করতে উৎসাহ দেন। তাই আদর্শবাদ সবথেকে বিপজ্জনক।
বাবার মনে ইটের মতো জমে থাকা বামপন্থাও তাই আমাদের জন্য বিপজ্জনক ছিল।
সুতরাং আমাদের পরিবারের পুরুষদের ইতিহাস খুঁড়লে বোঝা যাবে যে তারা সকলেই আত্মহত্যাপ্রবণ। আমি সচেতনভাবে এই পথ এড়িয়ে যেতে চেয়েছি।
আমার কোনও স্থির আদর্শ নেই। আমি ভ্রমণে অভ্যস্ত।
আমার কোনও স্থির পেশা নেই। আমি ভ্রমণে অভ্যস্ত।
আমার কোনও স্থির নারী নেই। আমি ভ্রমণে অভ্যস্ত।
ঠাকুরদার ছবি থেকে চোখ সরিয়ে বিছানা নিই। দুপুরবেলা কিছুটা ঘুম, বইপত্র আর লেখা দিয়ে কেটে যেতে পারে। তবে এমন গরমে বিছানাতেও বেশিক্ষণ গা লাগিয়ে শুয়ে থাকা যায়না।
আজ রবিবার।
ওপরের বারান্দা থেকে ঠাকুরদার ও ঠাকুমার কবরের ওপরের ফুলগুলো দেখা যায়। বাগানের মধ্যে সবথেকে উজ্জ্বল। অন্য পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে নিমগাছটা।
আজ বাড়িতে সুমি আসার কথা। আজ রাতে থাকবে।
সুমি এলে কোন ঘরে শুতে দেওয়া হবে? হয়ত আমার নীচের ঘরের পাশের ঘরটায়। ওটা তো ফাঁকাই থাকে। এই কয়েক বছর আগে অবধিও ও এলে আমার ঘরেই শুত। এখন ছোটমাসির বারণ। সুমি বড় হয়ে গেছে?
সুমি কতদিন হল বড় হয়েছে?
গত বছর ওর কলেজে ওঠাকে যদি ছোটমাসি বড় হওয়ার সূচক হিসেবে ধরে নেয় তাহলে খুবই ভুল করবে। সুমি ও আমি তার অনেক বছর আগে থেকেই এমন আলোচনা করেছি যাতে বোঝা যায় ওর বড় হওয়াটা কেবল কলেজে ওঠা নয়।
আমরা আদিরসাত্মক হাস্যরসে নিজেদের মাতিয়ে তুলতাম।
সম্পর্ক যেমনই হোক না কেন ছেলে মেয়ের মধ্যে কিছু যৌনতামূলক অস্বস্তি থাকেই। তা একদিক থেকে বেশ স্বস্তিরও। সুন্দর। যা কিছু নিষিদ্ধ তার প্রতি মানুষের সেই চিরকালীন কামনা। সুমিকে আমি কামনা করি কিনা জানিনা, তবে সুমির পাশে শুয়ে থাকতে আমার ভালো লাগতো।
কৈশোরে বন্ধুদের কাছে শোনা সেইসব গল্পগুলো মনে আছে?
দূর সম্পর্কের দিদির সঙ্গে রাতে শুয়ে ঘুমের ভান করে তাকে জড়িয়ে ধরা। যে কোনও উপায়ে তার বুক ছুঁয়ে নেওয়া। এই গল্পগুলো একটা বয়সে কি ভীষণ উত্তেজিত করে তুলতো আমাদের।
সুমি আমেরিকান পপ সঙ্গীত ভালোবাসে।
দুপুর দ্রুত কেটে যায়। সমস্ত গা ঘেমে নেয়ে একাকার। কষ্ট করে হলেও একটু বিছানায় গা লাগিয়ে শোওয়ার চেষ্টা করি। কতগুলো বই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, তবে একটাও পড়ার মতো নয়। সমস্তই গোলগাল গল্প বলে পাঠককে ধাপ্পা দিতে চায়। এই বাড়িটা ছেড়ে আসলে আমার বহুদূর কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করে আজকাল।
একটা বয়সের পর নিজের সমস্ত অভ্যেস ছেড়ে যাওয়া খুব প্রয়োজন।
কিন্তু আদৌ কি আমি এই বাড়িটা ছেড়ে যেতে চাই?
বিকেলে আরেকবার চা আসে। এটা মায়ের একটা অভ্যেস হয়ে গেছে। কিছুতেই এই চা করা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেনা মা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি ফুলের বাগানটা দেখি। বাবা বলে প্রতিটি ফুলগাছের নীচে একজন মৃত মানুষের দেহ থাকে। আমি জানি কথাটা সবসময় সত্যি নয়। চাকরির অভিজ্ঞতাই বাবার মধ্যে এমন একটা ধারণা তৈরি করে দিয়েছে।
শোনা যায় এই অঞ্চলটায় নাকি নকশাল আমলে অনেক খুন হয়েছে। খুন করে মুণ্ডুগুলো কেটে নিয়ে যেত। শরীরটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিত ধানক্ষেতে অথবা নর্দমায়।
সুমি এল সন্ধের দিকে।
আমার দিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত মধুর হাসি হেসে নিল সুমি। গরমে ঘামিয়ে গেছে। ওর সারা গায়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বুকের কাছটায় জামাটা ভিজে গেছে।
কতটা বড় হয়ে গেছে সুমি?
রাতে খাবার টেবিলে বাবা আবার ফুল সংক্রান্ত সরকারের নির্দেশিকার কথা তুললো। আমার বিরক্ত লাগছিল। রাতের খাওয়ার টেবিলে কিছুতেই মা বসতে চায়না। সবাইকে পরিবেশন করে এক কোণে চেয়ার টেনে হাতে নিয়ে খায়। আজ সুমি এসেছে বলে বাড়িতে মাংস রান্না হয়েছে। বাবা মাছ মাংস কিছুই খায়না। রাত্রিবেলা একটু পাউরুটি আর ঝোল দিয়েই খাওয়া শেষ করে বাবা চলে যায় আবার সেই বাগানের ধারের বারান্দায়। অনেক রাত অবধি সেখানেই বসে থাকে।
রাতের বিছানায় মা বাবাকে পায় না আজ কত বছর সেই সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই আমার।
ছোটমাসি ফোন করেছিল রাতে সুমির ফোনে।
মায়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে, সুমিকে কিছু জিনিস বুঝিয়ে ফোন রেখে দিল ছোটমাসি। সুমি কিছুক্ষণ শুধু পুতুলের মতো মাথা নাড়িয়ে গেল-
হ্যাঁ,হ্যাঁ,হ্যাঁ।
কত রাত অবধি আমার ঘরে সুমি থাকতে পারবে সেই নিয়ে কোনও নির্দেশ দিয়েছে কিনা ছোটমাসি তা আমার জানা নেই। ওকে না দিয়ে মাকেও দিতে পারে। খাওয়া দাওয়া শেষে দু’জনেই আমার ঘরে এলো। মায়ের পুরনো শাদা নাইটিটা পরে সুমিকে আশ্চর্য লাগছিল।
মা পাশের ঘরে ওর বিছানা করে দিয়েছে। ঘর থেকে চলে যাওয়ার আগে বলে গেলো,
– বেশি রাত করিসনা।
কিন্তু ঠিক কতটা রাত হলে বেশি রাত হয় সেই নিয়ে আমার ও সুমির কোনও ধারণা নেই। যেমন ধারণা নেই কতটা বড় হয়ে গেছে ও। কতটা বড় হওয়ার জন্য আমার পাশে এখন ওর শোওয়া নিষিদ্ধ।
মা চলে যাওয়ার পর বিশেষ কোনও কথা হলনা। পাশের ঘরে শুতে চলে গেল সুমি।
রাতের বেলা বাবার সেই ফুলের বাগান সংক্রান্ত সরকারি কথাটা মনে করে মাথাটা গরম হয়ে গেল। একি সরকারের বাবার সম্পত্তি? আমাদের বাগান, আমরা যা ইচ্ছে ফুলগাছ লাগাবো। সরকার ঠিক করে দেবে আমরা কি ফুলগাছ লাগাবো আর কোনটা লাগাবো না?
এসব রাতের বেলা হঠাৎ গজিয়ে ওঠা আবেগ।
প্যাচপ্যাচে গরমে ঘাম শরীরের ভেতর বসে গেছে। আরেকবার স্নান করে আসতে ইচ্ছে হল। বাথরুম এমন এক জায়গা যেখানে খুব কম মানুষ আত্মহত্যা করেছে। যদিও আমি তথ্য ঘাঁটিনি তবে এমন আমার মনে হয়। জল ও শরীরের মধ্যে অদ্ভুত সম্পর্কের জন্যই এমনটা হয় বলে আমার বিশ্বাস।
স্নান হল না।
মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়লাম। শোওয়ার আগে কেন জানিনা ছিটকিনি দিয়ে এলাম দরজায়।
সুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছে?
ফ্যানের ঘর্ঘর শব্দেও চারিদিকে এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য। আজ অন্ধকার কেন জানিনা আগের থেকে বেশি। কবে যে একটু বৃষ্টির মুখ দেখা যাবে! আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না। এত গরমে বিছানার মধ্যে শুয়ে থাকা অসম্ভব। কিন্তু রাতের বেলা তো আর মেঝেতে শুয়ে থাকা যায় না। বাবা কি এখনও বাগানে বসে আছে?
সুমির ঘর থেকে চাপা কথাবার্তা ভেসে আসছে। কারও সঙ্গে কথা বলছে ফোনে? খুব চাপা গলায়। নিশ্চয়ই ওর প্রেমিক। সুমি বড় হয়ে গেছে তাহলে।
বিছানায় এপাশ ওপাশ করি গরমে। ঘুম কিছুতেই আসবে না হয়ত আজ।
সুমি কথা বলেই চলেছে। ধীরে ধীরে ওর কথা হয়ে উঠছে কতগুলো আদরমূলক আওয়াজ। সেই আওয়াজ হয়ে উঠছে আরও ঘন। আরও গোপন করার চেষ্টা করছে সুমি। অথচ ওর সেই গোপন করার চেষ্টা এখন রীতিমত শীৎকার। সুমিকে ফোনের ওপার থেকে কেউ আদর করছে। সেই আদরে সুমির শরীর সাড়া দিচ্ছে। এই গরমেও ওর শরীর বিছানার মধ্যে লেপ্টে থাকতে চাইছে। ভিজে উঠছে মায়ের পুরোনো নাইটিটা।
জানলার কাছে উঠে আসি। আকাশে একটুও মেঘ নেই। অল্প আলোয় স্বপ্নের মতো দেখাচ্ছে ঠাকুরদা ঠাকুমার কবরের ওপরে ফুলগুলো। বাগানের মধ্যে সবথেকে উজ্জ্বল, বাবার নিজের হাতে যত্ন পাওয়া। সরকারের তালিকায় কি থাকবে এই ফুলের নাম? নাকি নির্দেশ মতো সমস্ত উপড়ে ফেলতে হবে? জানি না। সরকার এখনও সেই তালিকা প্রকাশ করেনি।
বাগানের এককোণে নির্লিপ্ত দাঁড়িয়ে রয়েছে নিমগাছটা। বেশি বড় হয়নি। ঝড়ের দিনগুলোতে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে হয় যাতে পড়ে না যায়। মাঝে মাঝে কেউ ছিঁড়ে নিয়ে যায় একটা ডাল অথবা পাতা।
সরকার নিমগাছ নিয়ে কোনও নির্দেশ দেয়নি। তার নীচে জংলা হয়ে আছে বহুদিন। বাবাকে বললে বলে- থাক।
নিমগাছ ফুলের বাগানের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে থাকে নির্লিপ্ত, সারা রাত।
একা, নিঃসঙ্গ…
একটি নিমগাছ আর তার সমস্ত শরীর জুড়ে শুধু তেতো।