উ দা সী ন তাঁ ত ঘ র | পর্ব ২
মনে পড়ছে আমার এক ছাত্রীর কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ে সে গবেষণা শুরু করেছে কবিতা সিংহের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে। প্রায় দশ বারো বছর আগে কবিতা সিংহ’র বেশীরভাগ বই বাজারে পাওয়া যেত না। দীর্ঘদিন কোনো প্রকাশক তাঁর বই প্রকাশের কর্তব্য এবং আগ্রহ বোধ করেননি। শুধু ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ আর দু-একটি পরিচিত উপন্যাস কেবল পাওয়া যায়। আমি ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে কিছু লেখা জোগাড় করে দিলেও তা যথেষ্ট নয়। নিরুপায় অবস্থায় তাকে জানালাম কবিতা সিংহের মৃত্যুর পর খবরের কাগজে কয়েকজন লেখিকার শোকবার্তা ছাপা হয়েছিল। আশা করা যায় তাঁদের কাছে নিশ্চয়ই উল্লেখযোগ্য অনেক বই মিলবে। সে বহু আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তাঁদের বাড়িতে উপস্থিত হয়। অথচ কারোর কাছেই কবিতা সিংহের কোনো বই পাওয়া গেল না। কিন্তু খবরের কাগজে তাঁদের মূল দাবি ছিল, কবিতার মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখিকা কোনো যোগ্য স্বীকৃতি পেলেন না। কারোর আবার ধারণা পুরুষতান্ত্রিক লেখালেখির ধারা নারী হিসেবে তাঁকে কোনো গুরুত্ব দেয়নি। যাঁরা এসব বলে মায়াকান্নার শোকলিপি তৈরি করেছিলেন, কার্যত দেখা গেল তাঁরাই পাঠক হিসেবে কবিতা সিংহকে উপযুক্ত মর্যাদা দেননি। আমাদের চারপাশে লেখকের স্বীকৃতির একটা বড়ো অংশই বায়বীয়, মিথ্যে কথার ফানুস মাত্র।
কবিতা সিংহের বই ছিল না তাঁদের কাছে, তার মানে এই নয় তাঁরা কবিতা সিংহের বই পড়েননি। কোনো বন্ধুর কাছ থেকে নিয়ে, অথবা স্থানীয় গ্রন্থাগার থেকে নিয়েও পড়া সম্ভব। আজ থেকে কুড়ি-তিরিশ বছর আগেও নানা সাধারণ গ্রন্থাগারে প্রচুর পাঠক নিয়মিত বইপত্র আদান প্রদান করতেন। বই কেনার সামর্থ্য থাকলেও লাইব্রেরী থেকে বই নিয়ে পড়ার আলাদা একটা পাঠক সমাজ ছিল শহরে এবং মফসসলে। সেইসব সাধারণ পাঠকের কেউ কবি বা লেখক নন। তাঁরা অনেকেই হয়তো ভাতঘুমের সঙ্গে বইটি ব্যবহার করেন। তাঁরা এমন এক পাঠকদল যাঁরা প্রায় পুনর্পাঠে বিশ্বাস করেন না, কিন্তু প্রিয় লেখকের প্রতিটি বই পড়ার চেষ্টা করেন। এই নিতান্তই সাধারণ পাঠকেরাই বাঁচিয়ে রেখেছিলেন বিভিন্ন গ্রন্থাগারকে। তাঁদের বাঁকা চোখে দেখে আমরা ভেবেছিলাম এঁরা রুচিহীন অদীক্ষিত পাঠক। গোগ্রাসে তাঁরা বই গেলেন আর গোল গোল কাহিনির প্রতিই তাঁদের চোরাটান। আমরা জানতাম তাঁরা আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বা নারায়ণ সান্যাল পড়বেন, কিন্তু কেউ কমলকুমার বা সন্দীপনের পাঠক হবেন না। ‘এক ব্যাগ শংকর’-এর প্রতিই এঁদের যাবতীয় আকর্ষণ। মেধাবী দূরত্ব বজায় রেখে এঁদের প্রায় অশিক্ষিত লোকজন ভেবে একধরণের আত্মতৃপ্তি নিয়ে আমরা বড়ো হয়ে উঠছিলাম। পড়ার চেয়ে মিথের মূর্তি তৈরি করে আমরা একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম লিটল ম্যাগাজিন অথবা দুরন্ত কবিসম্মেলনের দিকে।
তখন শহর এবং মফসসলে সরকার পোষিত অজস্র লাইব্রেরী ছিল। ছিল গুরুত্বপূর্ণ জেলা গ্রন্থাগার। সাধারণ পাঠক ন্যাশনাল লাইব্রেরী বা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের মতো গ্রন্থাগারে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করতেন না। আর ছিল মূলত স্থানীয় শিক্ষিত মানুষদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরি বিভিন্ন লাইব্রেরী পাড়ায় পাড়ায়। বেশ কিছুদিন আগেও একদল সক্রিয় মানুষের উদ্যোগে তৈরি হত এইসব ছোটো লাইব্রেরী বা স্থানীয় ক্লাব অথবা ব্যায়াম সমিতি। এইসব লাইব্রেরীতে শিক্ষিত বিভিন্ন ছেলেমেয়ে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতেন বই ভালোবেসে। আর্থিক দুরবস্থা থাকলেও পাঠকের দাবি মেনে বিভিন্ন নতুন বই কেনার চেষ্টা ছিল। থাকতো দু-তিনটি খবরের কাগজ এবং ম্যাগাজিন। এসব বিভিন্ন সহৃদয় মানুষের আর্থিক সহায়তায় তৈরি। আজ বিভিন্ন সরকারি লাইব্রেরী পাঠকের অভাবে বন্ধ। পাড়ার লাইব্রেরীগুলোরও একই অবস্থা। বই আছে অথচ পাঠক নেই। অনেক পাঠকই আজ লাইব্রেরী না গিয়ে নিজেই কিনে নিচ্ছেন নানা বই। বাড়ির ব্যক্তিগত লাইব্রেরীর জৌলুস বাড়ছে। সেইসব রুচিবোধসম্পন্ন মানুষেরা আজ আর নেই। তাঁদের উত্তরপুরুষেরা রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী বা গ্রন্থাগার নির্মাণের স্বপ্নও দেখেন না। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর প্রয়োজনবোধটুকুও অবশিষ্ট নেই। লোকাল নেতার হাতে যাবতীয় সুখ-দুঃখ আর সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের ভার দিয়ে তাঁরা দূরে সরে গেছেন। এখন ছোটো পত্রিকা এবং প্রকাশনীর সুবর্ণযুগ। তাদের পাঠকেরা মূলত নিজেরাও কবি অথবা লেখক। ছোটো প্রকাশনীর বইয়ের একটা বড়ো অংশের ক্রেতা বই কেনেন ব্যক্তিগত পরিচয়সূত্রে। সাধারণ পাঠক আজ এক বিলুপ্ত প্রাণী। কোথাও নেই অথবা হেমন্তদিনের ভ্রমণকারীর স্মৃতিলোকে আছেন।
মেধাবী দীক্ষিত পাঠক বা গবেষকের চেয়ে সাধারণ পাঠকের মূল্য এবং গুরুত্ব অনেক বেশি বলে আমি মনে করি। তাঁরা একটি বই পড়ে শুধু ভালো মন্দের কথা বলেন। পাঠপ্রতিক্রিয়ার সুযোগ তাঁদের নেই। লেখককে তাঁরা চেনেন না। লেখকের নাম ছাড়াই বই পড়তে তাঁদের অসুবিধা নেই। আসলে তাঁদের জীবনে পাঠপ্রতিক্রিয়ার ফেসবুক ছিল না। লেখককে খুশি করতে লেখা এবং বিনিময়ে নিজের বইয়ের রিভিউ লিখিয়ে নেওয়ার রাজনৈতিক ইস্তাহারে সাধারণ পাঠকের কোনো ভূমিকা নেই। তাঁরা কমলকুমার-অমিয়ভূষণ- ইলিয়াসের কেউ নন। কিন্তু বাংলাসাহিত্যে তাঁদের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। ন্যাশনাল লাইব্রেরীর চেয়েও এইসব স্থানীয় লাইব্রেরীর অবদান অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বিকাশে। সাহিত্যের পাঠশালা দীর্ঘদিন বেঁচে আছে সাধারণ পাঠকের জোরে।
আমার সেই গবেষক ছাত্রীটির কথায় ফিরে আসি। কবিতা সিংহের বইয়ের জন্য অনেক বড়ো লাইব্রেরী তাকে নিরাশ করেছে। শেষপর্যন্ত মুর্শিদাবাদের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্থানীয় লাইব্রেরী থেকে পাওয়া গেল কবিতা সিংহের প্রচুর বই। আর কবিতার বইগুলি পাওয়া গেল মণীন্দ্র গুপ্ত এবং দেবারতি মিত্রের সহায়তায়। আরেকজন সহকর্মী গবেষকের কথা বলি। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীকে নিয়ে সে কাজ করতে চায়। তখন দু-একটি বই ছাড়া তাঁর কোনো বই বাজারে পাওয়া যায় না। অনেক অপেক্ষাকৃত বড়ো লাইব্রেরীতেও সব বই মিলল না। শেষপর্যন্ত বর্ডারের কাছের এক স্থানীয় গ্রন্থাগারে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর অনেক বই পাওয়া গেল। এই মুহুর্তে মনে পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপিকার কথা। বহুদিন আগে পড়া একটি উপন্যাস স্মৃতি থেকে তুলে আনেন তিনি। অথচ বইটি আর পাওয়া যায় না। আমাদের পাশের পাড়ায় মন্দিরের ভিতর কিছুটা জায়গা নিয়ে একটি ছোটো লাইব্রেরী ছিল। সরকার পোষিত নয় বরং কিছু মানুষের স্বেচ্ছাশ্রমে চলে। নিতান্তই ছোটো সেই লাইব্রেরীতে আমি পেয়ে যাই দুষ্প্রাপ্য বইটি। দীপালি দত্তরায়ের ‘লাল হলুদ সবুজ আলো নেই’ উপন্যাসটি। এছাড়াও উপরি হিসাবে লেখিকার আরেকটি উপন্যাস ‘বনসাই’ পাওয়া গেল। একটি স্কুলের ছোটো লাইব্রেরীতে আমি হঠাৎ পেয়ে যাই তারাপদ রায়ের প্রথম বই ‘তোমার প্রতিমা’র কৃত্তিবাস সংস্করণ। পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রচ্ছদসহ। আরেকটি ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরি লাইব্রেরীতে আমি দেখতে পাই পঞ্চাশের বিস্মৃত কবি দুর্গাদাস সরকার সম্পাদিত কয়েক খণ্ড বাঁধানো ‘মাসিক বাংলাদেশ’ পত্রিকার বেশ কিছু সংখ্যা। নারায়ণচন্দ্র ভট্টাচার্য প্রণীত অনেক দুষ্প্রাপ্য বইও। অথচ আজকের প্রযুক্তির জীবনে এই সব স্থানীয় গ্রন্থাগারের কোনো মূল্য নেই। আজ আমরা অনেকখানি দরিদ্র হয়ে গেছি ভিতরে ভিতরে।
মফসসলের বিভিন্ন প্রান্তিক অঞ্চলের সরকারী লাইব্রেরীর গ্রন্থাগারিকরা সুখে ছিলেন। কোনো পাঠকের জিজ্ঞাসার উত্তর বা গবেষকদের সাহায্য করার ক্ষমতা বেশিরভাগের ছিল না। তাঁরা কেবল চাকরি করতেন। বই কেনার মরসুম এলে তাঁরা গ্রাহক পাঠকদের কাছে বইয়ের তালিকার আবেদন জানাতেন। সাধ্যমত সেসব বই কিনে জনরুচি বজায় রাখতে হত। কিন্তু আজ সেইসব অলৌকিক মানুষ কোথায়? যাঁরা সুদূর এক পাঠক বা গবেষকের কথা ভেবে প্রত্যন্ত লাইব্রেরীতে কবিতা সিংহের বা জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর বইগুলি আনিয়ে রেখেছিলেন! কোন দুর্নিবার প্রাণশক্তি নিয়ে একটি ব্যক্তিগত উদ্যোগের লাইব্রেরী কোনো একদিনের পাঠকের জন্য সঞ্চয় করে রাখেন দীপালি দত্তরায়ের বই? কোনো ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা জানানোর সুযোগটুকু না রেখে তাঁরা হারিয়ে গেছেন। আমাদের অগোচরে, নিজেকে প্রচ্ছন্ন রেখে তাঁরা সাহিত্যের অনেকগুলি দরজা খুলে দিয়েছিলেন সাধারণ পাঠকের জন্য। বিনিময়ে আস্ফালন বা বিষোদগার করেন নি। সেইসব অলীক মানুষের ছায়া আজ আর আমাদের জীবনে পড়ে না। সেইসব মানুষের উপর দিয়ে চলে গেছে মর্যাদাহীন হেমন্তের দিন। একটা হল্টস্টেশনের নির্জন রেলব্রিজের মতো তাঁরা ছিলেন নেই-মানুষের দলে নিজেকে যথাসাধ্য গোপন করে।
ইদানিং বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি পত্রপত্রিকায় বা সামাজিক মাধ্যমে বিস্মৃত কবি বা লেখকের পুনরুদ্ধার প্রকল্প। দু’টি পত্রিকার দু’জন সমালোচকের কথা বলি। তাঁরা যথাক্রমে সুশীলকুমার নন্দী এবং পূর্ণেন্দু পত্রীর প্রতি পাঠকের উদাসীনতা নিয়ে অভিযোগ করেন। লেখার অর্ডার পাওয়ার আগে তাঁরাও যে উদাসীন ছিলেন সেকথা অবশ্য মনে রাখেন নি। অপরের দিকে অনুযোগের এই ভণ্ডামি আমাদের একধরনের মুদ্রাদোষ। সম্প্রতি ফেসবুকে নিত্য মালাকার, স্বদেশ সেন, শম্ভু রক্ষিতের কবিতা নিয়ে কিছু কবি বনাম পাঠক একহাত নিচ্ছেন যেসব পাঠক তাঁদের রচনা নিয়ে উদাসীন তাঁদের প্রতি। শুধু অনুযোগ নয় বরং বিষোদগার। কোনো দলের অন্তর্ভুক্ত না হলে কবিরা যে পাঠকের মনোযোগ পান না সে বিষয়ে তাঁরা নিশ্চিত। এই দলে একদিন তাঁরাও ছিলেন সেকথা বেমালুম চেপে যান। শুধু পাঠকের দায় নিয়ে প্রশ্ন তুলে সহমত মন্তব্য কুড়োন। একথা দোষের বলছি না। কিন্তু তাঁদের উদ্দেশ্য এবং প্রবণতা নিয়ে আপত্তি আছে। তাঁদের কাজ কবি সম্পর্কে বৃহত্তর পাঠকের মনোযোগ তৈরি করা। প্রয়োজনে সঠিক বিপণনের মাধ্যমে পাঠকের হাতে বই তুলে দেওয়া। এটুকুই। এর বেশি কোনো দাবি নয়। পাঠককে অযোগ্য ভাবার আগে তৈরি হওয়ার সুযোগটুকু তাঁরা করে দিতে পারেন। এই মাত্র। তার বেশি কিছু নয়। বিস্মৃত কবির বদলে যে কোনো মূল্যে নিজের দিকে আলো টেনে নেওয়ার সুযোগ এবং পন্থা আমাদের ছাড়তে হবে।
আসলে এইসব মায়াকান্নার কোনো প্রয়োজন নেই। দরকার নেই কোনো অভিযোগের। বরং নিজের কাজটুকু নেপথ্যে থেকে করে যেতে হবে। সম্ভাবনার সমস্ত পথ খুলে রাখতে হবে। বিশ্বাস রাখতে হবে সুদূর পাঠকের উপর। পরিযায়ী গবেষকের জন্য অকৃতজ্ঞতার দরজাও খোলা রাখতে হবে। শুধু লেখকের মৃত্যুর পর সস্তা বাইট দিয়ে অলৌকিক পাঠকের উপর দায়-দায়িত্ব ছেড়ে দিলে ইতিহাস সেই ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দেবে একদিন। আর আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে প্রযুক্তির সঙ্গে আমরা যেন আধুনিক চিন্তায় গ্রন্থাগার নির্মাণ করে নিই। সেইসব মানুষের আজও প্রয়োজন আছে যাঁরা নিজস্ব মননে একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিস্মৃত অথচ গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের আবিষ্কারের পথ খোলা রাখেন।
আর, হে সাধারণ পাঠক, দিবানিদ্রা আকুল অথবা রাতের ঘুমে আপনার সঙ্গী ছিল বই। আমরা সমস্ত উপহাস ফিরিয়ে নিচ্ছি। আপনি যতক্ষন না আসছেন আমাদের আকুলতা শেষ হবে না। কবিবন্ধু-পাঠক আমরা পেয়েছি। তার অক্ষম ঈর্ষা আর নীরবতার রাজনীতি আমরা জানি। শুধু আপনার সামান্য ভালোমন্দ, বোবা মনের লজ্জাটুকু আমাদের দিন। হে সুদূর, আমাদের পিপাসা আজও আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে।
* ক্রমশ