Hello Testing

4th Year | 2nd Issue

৩১শে বৈশাখ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 15th May, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

উ ই ন্ডো  সি ট

স ম্বি ত   ব সু

sambit

পাথরের সবাক গন্ধ

যেদিকে যাওয়ার ছিল, সেদিকে গেলাম না মোটে। এই যেমন ভেবেছিলাম, সকালবেলা উঠে ছোট ছোট আলুর তরকারি দিয়ে কচুরি খাব– সেসব কিছুই হল না। উল্টে দুঃসংবাদ: এখন আর সেই স্বাদ নেই রে সম্বিত। এদিকে জল জমে গেল রাস্তায়। চায়ের দোকান থেকে প্লাস্টিকের ডিঙায় ভেসে চলছে লালপিঁপড়ের জলদস্যু সংস্করণ। এসব দিনে ডিমগোলার আওয়াজেই ডিমভাজা খাওয়া হয়ে যায়। মশাদের জন্যও গুরুত্ব দিয়ে লেখা হয় সরকারি বিজ্ঞাপন। রোনাল্ড রস সরণিতে আমাদের দেখা হয়েছিল, মনে আছে? একটা ভাঙা গাছের ওপর বসেছিলাম আমরা। অথচ সেখানেও প্রাণ– কাঠপিঁপড়ে, তোমাকে কামড়ায়নি, আমাকেও না। আমরা নিজেদেরকেও না। তবু হাত থেকে বারবার পড়ে গেল নানা দেশের ফ্যাসিবাদ বিরোধী কবিতা-গদ্যের সংকলন। ফিরে এসে দু’তিন লাইন লিখলাম: রাতে গুনগুন করতে করতে/ যে সমস্ত ডানাওয়ালা তারিখ কামড়ায়/ তাদের পিষে ফেলবার কথা ভাবতে পারি না/ চাই, প্রত্যেক তারিখে রক্তের সুষম বণ্টন।

ভেবেছিলাম, দিনটা হবে আমার, কিন্তু রিভার্স সুইপ। এ আগেও হয়েছে। যাচ্ছিলাম একেবারে হারিয়ে। উড়ে। জীবনের মধ্যে কী হু-হা হাওয়া বইছিল তখন, কোচিং কাট মেরে বসেছিলাম রাতের রোদ্দুরে। হাতে বাদাম। হাতে ঘাস। অশ্লীল ভাগ্যরেখাও হাতে। হাতে থেকে হাতে ছড়িয়ে গিয়েছিল তারিখের দীর্ঘ স্বপ্ন। শামুক দিয়ে তৈরি সেই দেওয়াল ঘড়ি থেকে শামুকটাই বিদায় নিয়েছে। অপেক্ষার জন্য কোনও চিরকুটও রেখে যায়নি। এখন শুধু ১ থেকে ১২। 

এর মধ্যেই পৃথিবী ঘুরছে। আমি ঘুরছি। তুমিও ঘুরছ। আমার ও তোমার মধ্যে তাহলে কে বেশি পৃথিবী? তার দিয়ে টানটান এই শহর তার কথা কিছু কিছু জানে। দু’টি পাণ্ডুলিপি শুধুমাত্র একইরকমভাবে শেষ হতে চেয়েছিল বলে, সম্পাদনায় ক্রমশ দূরে চলে গেছে। এই গাঢ় দুঃখের কথা জানে একটি চিঠি, একটি হাতে আঁকা ছবি ও কলম। সমতলে, সমুদ্রে, পাহাড়ে, জঙ্গলে এই পাণ্ডুলিপি দেখতে পায় আরেক পাণ্ডুলিপির অপস্রিয়মাণ ছায়া।

সকলেই থাকে না; কেউ কেউ থাকে। চলে যাওয়ার সময় সাক্ষী থাকে একটা-দুটো অ-মানুষ– কুকুর-বিড়াল। সাক্ষী থাকে শেষ জড়িয়ে ধরা, ফুলগাছ, দোলনা, অন্যমনস্ক পরপর সিগারেটের টান, কবিতা বই, অচেনা পাখিদের গজল্লা। সাক্ষী বজ্রপাত– যা হয়েছিল শরীরের ভেতর। সাক্ষী পোস্টম্যান, যে হেমন্তের অরণ্যে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই যুবক-যুবতীকে চুম্বনরত দেখে খামের বাড়ি দেখিয়ে দেয়।

কিন্তু ঘুরে যায় মাথা। নেই নেই নেই। কখনও স্পষ্ট বোঝা যায়, এই চলে যাওয়া। এই যে বিচ্ছেদ মুহূর্ত শুরু হল। এই বাক্যের পর সব কথা শেষ হয়ে গেল। পুরনো ঠোঁট খসে গেল একেবারে। পুরনো হলুদ পাতার হাত ঝরে গেল। সেই ঠোঁটের পথে ঘুরে ঘুরে আর কোনও দিন বেঁচে থাকা ভিক্ষে করা হবে না দুপুরবেলায়। আবার কখনও হঠাৎই উধাও। বলা-কওয়া নেই। আভাস নেই। ফুসমন্তর।

দু’ক্ষেত্রেই যে ছিল, সে ‘হাওয়া’ হয়ে গেছে। এখন এই হাওয়া-ই হারানোর আইডেনটিটি কার্ড। সে হাওয়ায় কাঁপছে মফস্‌সল, সে হাওয়ায় চোখের পাতা কাঁপছে, এবং হয়তো সে হাওয়াতেই কাঁপছে দূরের নক্ষত্র। এই এখনও।

হারাতেও সবাই জানে না, কেউ কেউ জানে। তারাই জানে, যারা হারিয়ে যাওয়ার পরও থেকে যায়। দেখা হওয়া, কথা হওয়া আর নিয়ন্ত্রণ করে না উপস্থিতি। ‘কী খবর’-এ আটকে থাকে না সেই পুনর্কথন। সেই কথা, যে-কথা শুরু হয়েছিল প্রেমেরও অনেক আগে, তা ঘুরে বেড়াচ্ছে একান্ত মনোলগে। একবার সে, একবার আমি। সে তো ছুঁয়েছে আমাকে, সুতরাং, আমি মাঝে মাঝে সে হতে পারি। অনেকটা ‘পরশপাথর’ ফরমুলা। বাংলাভাষার থেকে সেই প্রেম ধার নিতে পারে চমৎকার এক ত্রিবিন্দু…

এই ত্রিবিন্দুর কথা ভুলে যাওয়া যাবে না। মনে পড়বে, হারানো চকমকি পাথরকে। পাথরের মধ্যেকার দূরত্ব যতই থাক, দাবানল-সম্ভাবনা ছিল তাদের। একথা কোনও দিন তারা যেন না ভোলে। ভুলে না যায়, সঙ্গে না থাকলেও অনুষঙ্গে আছে। দিব্যি অনুষঙ্গে সঙ্গে আছে।

অনেক দিন পর ভোরবেলা ছাদে গেলাম। কয়েকটা পাখি, দিনের বেলায় যাদের ডাক শোনা যায় না, শুনলাম। পাতলা, খারাপ কাগজে ছাপা, কিন্তু নিয়মিত দ্বিমাসিক কবিতাপত্রের ভেতরে যেন আকস্মিক কোনও পঙ্‌ক্তি! অক্ষয় নয় এই স্মৃতি। ভুলে যাব। কিন্তু আজ ভোরে এর থেকে বড় সত্যি আর কী আছে! এই কবিতাপত্র হাতে নেওয়ার মতো সত্যি।

একটা বাড়ি পরের আমগাছে অনেক আম। সেই গাছের কাছের ছাদে দু’জন। খালি গা, কোমরে গামছা। আম পাড়ছে একজন। আরেকজন জমাচ্ছে। হাত থেকে মাঝে মাঝে ছুড়ছে পাথরও। কিন্তু টিপ সম্ভবত লাগছে না। যে গাছে উঠে পাড়ছে, একবার তার কাছ থেকে কাঁচা খিস্তিও নতুন রোদের মতো ভেসে এল। সামনের ছাদে একটা সাদা-খয়েরি বিড়াল কী আশ্চর্য হয়ে যে তাকিয়ে আছে তাদের দিকেই! গতিবিধি লক্ষ করছে। অনেক দিন আগে, শিবপুর বাজারে এক আমবিক্রেতাকে দেখেছিলাম, যে প্রবল গরমে ঘেমে-নেয়ে স্রেফ ‘সাগর, সাগর’ বলে চেঁচাচ্ছিল। মনে পড়ে, তার গলায় আলগোছে ফেলা ছিল গামছা। হয়তো প্রস্তুত ছিল সাগর স্নানের জন্য। ‘হিম’ শব্দটা রাখলে তার গরমবোধ কম হত।

লক্ষ লক্ষ বছরের প্রাচীন এই ভোরবেলা আজ ছাদে কুড়িয়ে পেলাম। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা কেউ ছাদে ওঠেননি? আজ একেবারে নতুন কি কিছুই হচ্ছে না– একথা আমি একাই ভাবছি, এরকম মনে করতে ইচ্ছে করে না। মনে হয়, ওই বিড়ালও এ নিয়ে চিন্তামগ্ন। না হলে সে এত অনুসন্ধিৎসু কেন? ওই বালক, যে হয়তো জীবনে প্রথমবার আম পাড়ার সঙ্গী হয়ে এসেছে, সে-ও তো এই অভিজ্ঞতায় নতুন। আমগাছের নীচে ওই শিরশিরে আমের গন্ধ তার শরীরে ঘুরছে এখন। বাড়ি গিয়ে ওই আম তৃপ্তি করে খাবে। আমি দেখতে পাই সেই সাদা আঁটি, বিন্দুমাত্র আম না-লেগে থাকা।

তারপর অনেক দিন কেটে যাবে। এই ভোর ও আমপাড়ার স্মৃতিও একেবারে পিছনের তাকে চলে যাবে তার। মাতৃগন্ধ, পিতৃগন্ধ হারিয়ে ফেলার পর এক প্রবল গ্রীষ্মে যদিও সে ফিরে পাবে এই আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকার বিষণ্ণ ও তীব্র গন্ধ।

আরও পড়ুন...