ধা রা বা হি ক | পর্ব ১১
তখনও তাঁর সঙ্গ উদযাপন করতে পারিনি আমি। ষাটের দশকের শেষভাগে প্রিয় বন্ধু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা তাঁর একটি চিঠির শেষের কিছু অংশ এরকম ছিল, ‘… তুমি মাঝে মাঝে আমায় সাধারণ যোগবিয়োগে ফেলে দাও এই দুঃখ। আমায় সবসময় তা স্পর্শ করে না, কিন্তু তোমায় তা যে কোনো কারণে ভীষণ স্পর্শ করে। তোমার দুঃখ বাড়ে। ভালোবাসা প্রকাশ করা আমার হল না। তবু এই সকল দুঃখ না বাড়ার জন্য আমি প্রাণপণ করছি সুনীল। তোমার প্রতি আমার কোনরূপ বাধা নেই বলেই আজ পরোক্ষে সামান্য হৃদয় নিক্ষেপ করলাম। কিছু মনে কোরো না। তোমার সঙ্গে এখানে যেদিন দেখা হবে সেদিন কিন্তু এইসব মালিন্য থাকবে না মনে। সেদিন চিৎকার করে আহ্লাদ করবো।…..’
হ্যাঁ, তাঁর হৃদয়ের স্পর্শ যাঁরা পেয়েছেন তাঁরা জানেন কতটা প্রশস্ত ছিল ওই ছোট্ট গৃহ। এই চিঠিটি চাইবাসা থেকে লিখেছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। বাংলা কবিতার এই বিরল ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার তার কয়েক বছর পরেই। ইতিমধ্যে তাঁকে নিয়ে নানা ধরনের মিথ্ তৈরি হয়ে ঘুরতে শুরু করেছিল কবিতা -পাড়ার পড়শিদের মুখে মুখে। কিন্তু তাঁর হৃদয় – ভর্তি ভালোবাসার ছোঁয়া পেয়েছিলেন কতজন জানা নেই। তবে সে সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।
তখন আমারও শিলঙের প্রবাস জীবন শুরু হয়ে গেছে। আমি সেখানে যাওয়ার বহু আগে থেকেই আমার সেজো মামা রেলের চাকরি সূত্রে গুয়াহাটির মালিগাঁও-এ থাকতেন। প্রথমবার শক্তিদা সপরিবারে শিলং এসেছিলেন। মনে আছে, সেবার ট্রেনে এসে নেমেছিলেন জালুকবাড়ি স্টেশনে। পরে সেই স্টেশনের নাম পাল্টে রাখা হয় কামাখ্যা। সেদিন স্টেশন থেকে ওঁদের নিয়ে মামার রেলের কোয়ার্টারেই উঠেছিলাম। এবং বিকেলেই শক্তিদার ইচ্ছে অনুযায়ী তাঁকে নিয়ে যেতে হয়েছিল গুয়াহাটির পিটিআই অফিসের তৎকালীন কর্ণধারের কাছে। উত্তর পূর্বাঞ্চলে তখন সন্ধের পরবর্তী সময়কেই গভীর রাত আখ্যা দেওয়া হতো। যানবাহনের গতিবিধিও এতটা মসৃণ ছিল না তখন। ফলে সেই রাতে তাঁকে আড্ডার আসর থেকে টেনে তুলে মালিগাঁও-এ ফেরার কথা ভাবতেই পারতাম না যদি গুয়াহাটির আমার কয়েকজন বন্ধুর সহযোগিতা না পেতাম। তো সেই রাতে আমাদের দু’জনকেই মীনাক্ষী বৌদির তোপের মুখে পড়তে হয়েছিল।
সে সব অন্য বিষয়। খাওয়ার টেবিলে রাতে, আমার মামির অনুরোধে শক্তিদার রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার সৌভাগ্যও প্রথম হয়েছিল আমাদের। পরের দিন শিলং। তার তিনদিন পর আবার গুয়াহাটির মামার বাড়ি। সেখান থেকে শক্তিদা, বৌদি – তাতার – তিতিরকে নিয়ে কাজিরাঙা ঘুরতে গেলেন। আমি শিলং ফিরে গিয়েছিলাম। কয়েকদিন পরেই সেখানে শক্তিদার চিঠি পাই – ‘প্রিয়বরেষু, আমরা গতকাল তোমার মামা – মামীর ঘাড় থেকে নামতে পারলাম। কাজিরাঙা থেকে লিখছি। সকাল। একটু পরেই জোড়হাটের পথে দুলিয়াজান যাবো। তারপর পরশু নাগাদ ডিমাপুর – কোহিমা – মণিপুর সেরে আবার তোমার মামার বাড়ি। তোমার মামার বাড়ি আমার মামার বাড়িতে পর্যবসিত। ফিরবো ২৮ তারিখে। যদি পারো ২৭শে এসো। ২৯শে গাড়ি ধরবো। কৃষ্ণা ও বাচ্চাকে আমার শুভেচ্ছা স্নেহ জানিও। শক্তিদা’
তার দু’তিন দিন পর আরও একটা চিঠি। দুলিয়াজান থেকে…
‘শংকর ,
কাজিরাঙা থেকে গোলাঘাট, জোড়হাট হয়ে গতকাল রাত ন’টা নাগাদ দুলিয়াজানে পৌঁছেছি। চা বাগানের মধ্যে দিয়ে ট্যাক্সিতে। বৃষ্টি নেই। গুমোট ভাব আছে। রোদ্দুরে ঝকমক করছে চতুর্দিকের সবুজ। এই সবুজ বাংলাদেশের সবুজের চেয়ে শ্বাসরোধী। ভালো লাগছে। এখান থেকে অরুণাচল খুব কাছে। একটা গাড়ি পেয়ে সকালে গিয়ে রাতে ফিরে আসা যেতে পারে। চেষ্টা চলছে। বিহু আজ সন্ধেয় দেখা যেতে পারে। পরশুর মধ্যে নোঙর তুলতে হবে। মণিপুর রোড থেকে কোহিমা। টেলিফোনে যোগাযোগ করবো আজ সন্ধেবেলা। কোহিমা থেকে মককচং, সেখান থেকে মণিপুর হয়ে গৌহাটি। ২৭ রাতে কিংবা ২৮ সকালে। আগের চিঠি পেয়েছিলে তো? মেঘালয় ট্যুরিস্ট অফিস থেকে আমার জন্য যতগলো Handouts পাও নিয়ে এসো তো? নিশ্চয় এসো। আমি তোমার মামার বাড়িতেই যাচ্ছি। ভালোবাসা।
শক্তিদা’
তো এইসব চিঠি পড়ে শক্তিদাকে যতটুকু বোঝা যায় তার থেকেও ঢের সংসারে এক সন্ন্যাসীর মতন জীবন কাটাতে দেখেছি তাঁকে। পরের বছর শীতে কলকাতায় গেলে একদিন আনন্দবাজার অফিস থেকে বেরিয়ে তিনি সারাটা বিকেল – সন্ধে আমার সঙ্গে কাটিয়েছিলেন। কফিহাউসে নয়। কলেজস্ট্রিটের বিভিন্ন প্রকাশকের ঘরে। সেখান থেকে প্রকাশিত তাঁর যাবতীয় বইগুলিতে ভালোবাসায় আমার নাম লিখে আমার কাঁধের ঝোলা উপচে দিয়েছিলেন। ‘চলো বেড়িয়ে আসি’ – এই নামে একটি ভ্রমণের বইও লিখেছিলেন তিনি। ব্যতিক্রমী, তবে অসাধারণ গদ্যে। সেই বইটি আনন্দবাজারে আলোচনার জন্য কিছুদিন আগে আমাকে দেওয়া হয়েছিল। ঘটনাচক্রে তার আগের শনিবারই সেটি প্রকাশ পায় ‘পুস্তক পরিচয়’ বিভাগে। সেদিনই শক্তিদা সেই বইটির প্রকাশকের ঘরেও নিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে। তাঁকে বলেছিলেন, ‘এই যে শংকর, কাগজে লিখে তোমার বই-এর প্রচার বাড়িয়ে দিয়েছে।’ আর আমাকে বলেছিলেন, ততদিনে আমি ‘তুই’ সম্বোধনে উত্তীর্ণ হয়েছি, ‘আমাকে একটা ট্রামে তুলে দে। বাড়ি ফিরবো।’ মনে আছে, প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে থেকে একটা ট্রামে উঠেছিলেন তিনি। পরের দিন সন্ধেয় সপরিবারে আমাকে তাঁর বাড়ি যাবার প্রতিশ্রুতি আদায় করে একলাফে উঠে পড়ে ছিলেন ওই ট্রামে। যার পেছনটা, আমি একা একা দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, সন্ধের ধূসরতায় মিলিয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে।
* ক্রমশ