Hello Testing

4th Year | 2nd Issue

৩১শে বৈশাখ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 15th May, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

প্র চ্ছ দ  কা হি নী

শ্যা ম শ্রী   রা য়   ক র্ম কা র

shmyashree2

একটি আবহমান হত্যা ও ডিলান

১৯৬১ থেকে ২০২১ এক অভাবনীয় অতিক্রম, এক আশ্চর্য ছায়াপথ।  সেই পথের যাত্রা এখনো একই রকম  আলোকসম্ভব ও দ্যুতিবিজড়িত। মানুষের সীমা যেখানে শেষ হয় ঈশ্বরের সেখান থেকেই শুরু। কিছু কিছু মানুষ থাকেন যাঁরা সেই সীমাকে অতিক্রম করে যান। তাঁদেরই একজন বব ডিলান। ঊনআশি এমন এক বয়স, যখন মানুষের আর কোনো দিকে দৌড়নোর নেই, সাফল্যের পেছনে ছোটার দায় নেই, ব্যর্থতার ভারে নুয়ে পড়ারও। তেমনই এক সন্ধিক্ষণে যদি কেউ গিটার হাতে নতুনের অত্যুজ্জ্বল বিভাময় একটি দিব্য বলয়ে আমাদের স্থাপন করেন, তখন তাঁকে মানুষের সীমা অতিক্রমকারী এক ঈশ্বর বলেই মনে হয়। প্রতিভার ঈশ্বর। 

ডিলান যেন এক অশেষের নাম। তিনি নিজেও সে কথা উপলব্ধি করেন বলেই লেখেন-  ‘I contain multitudes’। দু’হাজার কুড়ি সালে প্রকাশিত হয়েছে ডিলানের নতুন অ্যালবাম ‘রাফ অ্যান্ড রাউডি ওয়েজ’। স্বর্ণময় কেরিয়ার পার হয়ে বয়সের উপান্তে এসে নতুন অ্যালবামের ঝুঁকি নেওয়ার দাপট দেখানো ডিলানের পক্ষেই সম্ভব।

ডিলানের শ্রেষ্ঠতম গান কোনটি? এই প্রশ্নের উচ্চতায় এসে আছড়ে পড়বে অগুণতি লিরিক। জনপ্রিয়তম ‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড’ নাকি রোমান্টিকতার চূড়ান্ত উপস্থাপন ‘ট্যাম্বোরিন ম্যান’!  ডিলানের নিজের পছন্দের তালিকায় উপরের দিকে থাকা মাস্টারপিস ‘ইটস অলরাইট মা’, নাকি আইরিশ এবং স্কটিশ ব্যালাডের  আদলে লেখা ‘টাইমস দে আর চেঞ্জিং’, কাকে বসানো হবে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে? এই প্রশ্নের কোনো সহজ উত্তর নেই; অন্তত নেই বলেই শ্রোতারা বিশ্বাস করেছেন এতকাল। কিন্তু অতিমারীর এই উচ্চকিত ষড়যন্ত্রের সময়ে ডিলান যখন ‘মার্ডার মোস্ট ফাউল’- এর মতো গান রচনা করেন, তখন আমাদের সঙ্গীতবোধ, জীবনবোধ ও ইতিহাসের স্মিত ধারণার ওপর দিয়ে ক্রমবর্ধমান জলস্তরের মতো গানটি প্রবাহিত হতে থাকে। আমাদের শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসতে থাকে। গানটি আমাদের ক্রমাগত  ঠেলতে ঠেলতে যেন এক নতুন ও স্বচ্ছতর উন্মোচনের দিকে নিয়ে যায়। সেই জলস্তরের নির্জন যেমন আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখে, তেমনই বিহ্বল করে রাখে তার উন্মোচনের বৈভব। 

সতেরো মিনিটের এই গানটি ধীর লয়ে আমাদের একটি পরিক্রমার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যায়। সেই পরিক্রমার কেন্দ্র একটি হত্যা, সেই পরিক্রমার বিস্তার একটি ইতিহাস। উনিশশো তেষট্টি সালে ঘটে যাওয়া প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির হত্যাকে কেন্দ্র করে গানটি একটি অপটিক্যাল ইলিউশনের মতো আবর্তিত হতে থাকে। সেই আবর্তনের কোনো বিন্দু যদি বিটলসকে স্পর্শ করে, তবে কোনোটি রোলিং স্টোন, আবার কোনোটি প্যাটসি ক্লাইনকে।

সঙ্গীতের ইতিহাসে তাঁর প্রত্যেক সমসাময়িক ঔজ্জ্বল্যকে তিনি বিশ্বস্ত হাতে ছুঁয়ে থাকেন এই প্রদক্ষিণে। গানটি শুরু হয় গল্পের ছলে- 

‘ডালাসের এক কালো দিন, তেষট্টি,  নভেম্বর

একদিন, এমন দিন, কলঙ্কের অধ্যায়

প্রেসিডেন্ট কেনেডি, শত সাফল্যের নায়ক 

যত উজ্জ্বল বাঁচার দিন, তত উজ্জ্বল মরার

উৎসর্গের আগে কেঁপে ওঠা মেষশাবকের মতো

তিনি বললেন, “বলো সত্যিই কি চিনেছো? আমায়?” 

“চিনেছি। হা হা! চিনেছি, আমরা জানিই তো তুমি কে-” 

বলতে বলতে গুলির আঘাতে ধ্বস্ত করে দিয়ে 

ওরা কুকুরের মত মেরেছিল তাকে প্রকাশ্যে, আলোয়

সময়ের খেলা ছিল সব। ওহে, সময়টা ছিল ঠিক 

অপরিশোধিত ঋণ ছিল, সব শোধ করো এইবার

ঘৃণা দিয়ে চেপে মারবো তোমাকে, অশ্রদ্ধা ছুঁড়ে ছুঁড়ে

শ্লেষে বিদ্রূপে মাখামাখি করে ছেড়ে দেবো রাস্তায় 

তোমার আসনে এবার কে? তাকে বসানো আমার দায়।’

গানটি খুব ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়; ভায়োলিন, পিয়ানো এবং হালকা পারকাসনের শৈল্পিক সঙ্গমদৃশ্যের ওপর দিয়ে সময়ের মতো মৃদু হয়ে বয়ে যেতে থাকে। ডিলানের কণ্ঠ এই গানের আরেক সম্পদ। গানের কথা যেভাবে হাওয়া মোরগের মতো দিক পরিবর্তন করতে থাকে, তাঁর কণ্ঠের অভিব্যক্তি যেভাবে লিরিকের ওপর দিয়ে অনায়াস দক্ষতায় বিচরণ করতে থাকে, শ্রোতা যেন এক চলৎশক্তিহীন গিনিপিগে পরিণত হন । গানটির আবর্ত থেকে তিনি কোনোভাবেই  নিজেকে মুক্ত করতে পারেন না। 

‘ওরা একবার তাকে মেরেছে, ওরা আবারও যেভাবে মারল

বলির বেদীতে বেঁধে রেখে তাকে কুপিয়ে কুপিয়ে কাটল

তার হত্যার সেই তারিখে, ভাবছি, কে যে বলেছিল আমাকে

ওহে খোকা! শুনে রাখ, শয়তান-যুগ এই সবে শুরু হয়েছে’

গানের এই অংশটি অবধারিতভাবে আমাদের খ্রিস্টের হত্যা এবং আশ্চর্য ভাবে গান্ধী হত্যার কথাও মনে করায়। সম্ভবত এই খ্রিস্টিয় অনুষঙ্গের  কারণেই রবীন্দ্রনাথের এই গানটিও অবচেতনে অনুরণিত হতে থাকে- 

‘একদিন যারা মেরেছিল তাঁরে গিয়ে

রাজার দোহাই দিয়ে’… 

কেনেডি এখানে একটি ধারণা, একটি বিশ্বাস, ঠিক যেমন গান্ধী। সেই ধারণা, সেই বিশ্বাসকে যখন উপর্যুপরি হত্যা করা হয়, আমরা সকলেই, ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, সেই হত্যার অংশীদার হয়ে পড়ি। কারণ আমরা হত্যাটিকে আটকাতে পারি না, আটকাবার চেষ্টা করি না, মেনে নিই। কেনেডি হত্যা বা গান্ধী হত্যা একটি আবহমান হত্যার সূচনা হয়ে ওঠে। ‘এইজ অফ অ্যান্টিক্রাইস্ট’ এখানে শুধুমাত্র ঈশ্বর বিরোধী একটা চেতনা নয়। ঈশ্বর আমাদের ভেতরকার পবিত্রতা, বিশ্বাস, আস্থা এবং অন্তর্নিহিত সু-চেতনার একটি প্রতীক। ঠিক যেমন ব্লেকের কবিতার সেই ল্যাম্ব বা বাইবেলের গল্পের মেষশাবকও একটি প্রতীক। ঈশ্বর স্বয়ং সেই মেষশাবকের প্রতিপালক। অর্থাৎ যতক্ষণ আমরা আমাদের অন্তঃস্থ পবিত্রতাকে লালন করছি, ততক্ষণ আমরাই ঈশ্বর। এই কবিতায় ডিলান কেনেডিকে সচেতনভাবেই সেই মেষশাবক বলে অভিহিত করেছেন। 

ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে মহাত্মা গান্ধী হয়ে ওঠেন সেই পবিত্রতার প্রতীক, কল্যাণ কামনার প্রতীক; কেবলমাত্র একটি রাজনৈতিক মতাদর্শের সমর্থক নন। তাঁর সর্বজনগ্রাহীতা তাঁকে একটি মাত্র মতাদর্শের ঘেরাটোপে বন্দী থাকতে দেয় না। আমাদের মনে রাখতে হবে যে এখানে মানুষ কেনেডি বা মানুষ গান্ধী আর বিচার্য নন। তাঁদের ব্যক্তিগত কুৎসা বা দুর্বলতা আর বিচার্য নয়। তাঁরা তখন সমগ্র রাষ্ট্রের তথা পৃথিবীর পবিত্রতা, সারল্য ও বিশ্বাসের রূপক হয়ে ওঠেন।  ঠিক এই কারনেই আমরা তাঁদের হত্যার দায় থেকে মুক্ত হতে পারি না। ঠিক এই কারণেই ডিলান তাঁর এই কবিতায় বলেন,-  ‘অনলি ডেড ম্যান আর ফ্রি’। 

এ কথা আর আলাদাভাবে বলে দিতে হয় না যে ‘মার্ডার মোস্ট ফাউল’ আদতে একটি দীর্ঘ কবিতা। ডিলানের আরো অনেক গানের মতো এটিও শুধুই একটি গায়নযোগ্য ছন্দোবদ্ধতা নয়, পূর্ণমাত্রার কবিতা। ‘মার্ডার মোস্ট ফাউল’-এর শ্রবণযোগ্যতা এবং পাঠযোগ্যতা পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। কেউ কারো কক্ষপথ থেকে এতটুকুও বিচ্যুত হয় না। 

* ছবিটি গুগল থেকে সংগৃহীত।  

আরও পড়ুন...