প্র চ্ছ দ কা হি নী
২০২০, মার্চ মাসের পর থেকে একবছর অতিক্রান্ত। মাঝে সংক্রমণের সংখ্যা কমলেও আবার তা ঊর্ধ্বমুখী। একটা হিসেব বলছে এপ্রিলের ১০ তারিখের মধ্যে দেশে করোনায় আক্রান্ত ১,৩০,৬০,৫৪২ জন। তাঁদের মধ্যে অ্যাক্টিভ রোগী ৯,৭৯,৬০৮ জন। রাজ্য সরকারের বুলেটিন অনুযায়ী এখনো পর্যন্ত রাজ্যে কোভিডে মোট মৃতের সংখ্যা ১০,৩৭৮। এই যে হিসেব এর পেছনে নিশ্চয়ই অন্য একটি কারণ রয়েছে। কী সে কারণ? কারণটা আর কিছুই নয়; মানুষের অসাবধানতা এবং হুঁশ না ফেরা। প্রতিষেধক আবিষ্কার এবং প্রয়োগের কাজটা জোরদার হলেও আগামী কয়েক মাস যে গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্বে যেসব দেশে করোনার প্রকোপ নতুন করে ছড়াতে শুরু করেছে, তাদের মধ্যে ভারত রয়েছে। এই করোনার ধাক্কা গতবছর অর্থনীতিকে যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল, তার রেশ ক্রমশই দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ বিষয়ে আরো সতর্ক হতে বলছেন পৃথিবীবাসীকে। কোথাও কোথাও নতুন করে লকডাউন ঘোষণা করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য সম্বন্ধে মানুষের উন্নাসিকতা, সাবধানতা বিষয়ে উদাসীন মনোভাব, প্রতিবেশী এমনকি পরিবার সম্বন্ধে আশ্চর্য যুক্তিহীন ভাবনা- একে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করছে। সেই কবে শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে আমরা দেখছি কলেরা রোগ নিয়ে মানুষের সচেতনতার অভাব। একা বৃন্দাবন (‘পণ্ডিতমশাই’) লড়ে যাচ্ছে এই পুরাতন চিন্তার বিরুদ্ধে। বাস্তব ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবদ্দশায় এই জনস্বার্থ নিয়েই নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন পার্শ্ববর্তী গ্রাম ও অন্যান্য অঞ্চলে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস ‘চতুরঙ্গ’ (১৯১৪) উপন্যাসে উদার ও ঋজু চরিত্রের জ্যাঠামশাই জগমোহন মারা যান মহামারিতে। রবীন্দ্রনাথের বর্ণনায়: ‘পাড়ায় প্লেগ দেখা দিল। পাছে হাসপাতালে ধরিয়া লইয়া যায় এজন্য লোকে ডাক্তার ডাকিতে চাহিল না। জগমোহন স্বয়ং প্লেগ-হাসপাতাল দেখিয়া আসিয়া বলিলেন, ব্যামো হইয়াছে বলিয়া তো মানুষ অপরাধ করে নাই।’
এ প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘সেই সময়ে কলকাতায় লাগল প্লেগ। চারদিকে মহামারী চলছে, ঘরে ঘরে লোক মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। রবিকাকা এবং আমরা এবাড়ির সবাই মিলে চাঁদা তুলে প্লেগ হাসপাতাল খুলেছি, চুন বিলি করছি। রবিকাকা ও সিস্টার নিবেদিতা পাড়ায় পাড়ায় ইনেসপেকশনে যেতেন। নার্স ডাক্তার সব রাখা হয়েছিল।’
সময়কে যদি কিছু আগে থেকেও দেখতে চাই, দেখব বঙ্কিমচন্দ্রের লেখাতেও বাংলার এই সংকট বড় হয়ে দেখা দিয়েছে লেখায়। ‘রোগ সময় পাইল। জ্বর, ওলাউঠা, ক্ষয়, বসন্ত। বিশেষত বসন্তের বড় প্রাদুর্ভাব হইল। গৃহে গৃহে বসন্তে মরিতে লাগিল। কে কাহাকে জল দেয়, কে কাহাকে স্পর্শ করে। কেহ কাহার চিকিৎসা করে না; কেহ কাহাকে দেখে না; মরিলে কেহ ফেলে না। অতি রমণীয় বপু অট্টালিকার মধ্যে আপনা আপনি পচে। যে গৃহে একবার বসন্ত প্রবেশ করে, সে গৃহবাসীরা রোগী ফেলিয়া পলায়।’ (আনন্দমঠ)
বঙ্কিমচন্দ্রের এই বর্ণনা আমাদের সেই সময়কার বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতে সাহায্য করে। কিন্তু সেখানেই প্রশ্ন থেকে যায়। সেই যুগ থেকে প্রায় ১৫০ বছর পেরিয়ে এসেও আমরা কি প্রকৃত শিক্ষিত হতে পেরেছি? জনস্বাস্থ্য সম্বন্ধে আমাদের ভাবনা কি সুগঠিত? এমনকি নিজের স্বাস্থ্য সম্বন্ধেও কি আমরা সচেতন?
দুই।
‘আজ মঙ্গলবার । পাড়ার জঙ্গল সাফ করবার দিন। সব ছেলেরা দঙ্গল বেঁধে যাবে ।… সঙ্গে নিতে হবে কুড়ুল , কোদাল , ঝাঁটা , ঝুড়ি। … এবার পঙ্গপাল এসে বড় ক্ষতি করেছে। ক্ষিতিবাবুর ক্ষেতে একটি ঘাস নেই। অক্ষয়-বাবুর বাগানে কপির পাতাগুলো খেয়ে সাঙ্গ করে দিয়েছে । পঙ্গপাল না তাড়াতে পারলে এবার কাজে ভঙ্গ দিতে হবে।’ (সহজ পাঠ। দ্বিতীয় ভাগ।)
এ শুধু লেখার জন্য লেখা নয়। রবীন্দ্রনাথের জীবনের অভিজ্ঞতা এখানে কাজ করেছে ছোটদের জন্য ভাবনা তৈরি করতে। একদিকে বাস্তব অভিজ্ঞতা আর অন্যদিকে ছোটবেলা থেকেই জনস্বাস্থ্য সম্বন্ধে শিক্ষিত করার প্রয়াস, এই লেখাগুলোতে আমরা লক্ষ্য করি। ‘সহজ পাঠে’র প্রথম প্রকাশ ১৩৩৭ সনের বৈশাখে। কিন্তু তার বেশ কিছু বছর আগেই রবীন্দ্রনাথ পাবনা প্রাদেশিক সম্মিলনীর অভিভাষণে যা বলেছিলেন তাতেও গ্রামবাসীর স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি নিয়ে তাঁর সুচিন্তিত ভাবনা প্রকাশ পেয়েছে। “শিক্ষা দাও, কৃষিশিল্প ও গ্রামের ব্যবহারসামগ্রী সম্বন্ধে নূতন চেষ্টা প্রবর্ত্তিত কর । গ্রামবাসীদের বাসস্থান যাহাতে পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যকর ও সুন্দর হয় তাহাদের মধ্যে সেই উৎসাহ সঞ্চার কর এবং যাহাতে নিজেরা সমবেত হইয়া গ্রামের সমস্ত কর্তব্য সম্পন্ন করে সেইরূপ বিধি উদ্ভাবিত কর…।”
‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতায় কবি সেই একই কথা উচ্চারণ করেছিলেন বহু পূর্বে। ১৩০০ সনের ফাল্গুন ২৩ তারিখে রামপুরে অবস্থানকালে তিনি এই কবিতাটি লেখেন। এখানে কবি স্পষ্ট করে দিয়েছেন গত শতাব্দীর বেদনার করুণ কাহিনিকে। কষ্টক্লিষ্ট প্রাণ বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে শুধু বেঁচে থাকে এই মানুষগুলো । তাদের ভেতর সাহস শেষ হতে হতে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে । তাই মাথা তুলে প্রতিবাদ করার মতো ভাষা তাদের নেই । কবির বক্তব্য স্পষ্ট-
‘সে অন্ন যখন কেহ কাড়ে,
সে প্রাণে আঘাত দেয় গর্বান্ধ নিষ্ঠুর অত্যাচারে,
নাহি জানে কার দ্বারে দাঁড়াইবে বিচারের আশে, দরিদ্রের ভগবানে বারেক ডাকিয়া দীর্ঘশ্বাসে
মরে সে নীরবে। এই-সব মূঢ় ম্নান মূক মুখে
দিতে হবে ভাষা; এই-সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে
ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা; ডাকিয়া বলিতে হবে– ‘মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে;
যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা-চেয়ে, যখনি জাগিবে তুমি তখনি সে পলাইবে ধেয়ে।
যখনি দাঁড়াবে তুমি সম্মুখে তাহার তখনি সে পথকুক্কুরের মতো সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে। দেবতা বিমুখ তারে, কেহ নাহি সহায় তাহার;
মুখে করে আস্ফালন, জানে সে হীনতা আপনার
মনে মনে।’
অনেক পরে শ্রীনিকেতন শিল্পভান্ডার উদ্বোধনের ভাষণে (১৯৩৮ সাল) রবীন্দ্রনাথ স্মরণ করেছিলেন তাঁর অতীত অভিজ্ঞতা। ‘কর্ম উপলক্ষে বাংলা পল্লী গ্রামের নিকট -পরিচয়ের সুযোগ আমার ঘটেছিল। পল্লীবাসীদের ঘরে পানীয় জলের অভাব স্বচক্ষে দেখেছি, রোগের প্রভাব ও যথোচিত অন্নের দৈন্য তাদের জীর্ণ দেহ ব্যাপ্ত করে লক্ষগোচর হয়েছে। অশিক্ষায় জড়তাপ্রাপ্ত মন নিয়ে তারা পদে পদে কিরকম প্রবঞ্চিত ও পীড়িত হয়ে থাকে তার প্রমাণ বার বার পেয়েছি।’
তিন।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু তার ভবিষ্যৎ রূপরেখা তৈরি করে দিয়েছিলেন আমাদের সামনে। এই ভারতবর্ষের প্রাণের উৎসধারা যে গ্রাম, তা বারবার উল্লেখ করেছেন তিনি। এও জানতেন- ‘বিদেশী রাজা চলিয়া গেলেই দেশ যে আমাদের স্বদেশ হইয়া উঠিবে, তাহা নহে ।’ গ্রামের উন্নতির জন্য তিনি প্রথম বেছে নেন নিজের অধীনে থাকা জমিদারিকে।
‘আমি একলা সমস্ত ভারতবর্ষের দায়িত্ব নিতে পারব না। আমি কেবল জয় করব একটি বা দুটি ছোটো গ্রাম।… আমি যদি কেবল দুটি- তিনটি গ্রামকেও মুক্তি দিতে পারি অজ্ঞতা অক্ষমতার বন্ধন থেকে, তবে সেখানেই সমগ্র ভারতের একটি ছোটো আদর্শ তৈরি হবে।’
গ্রাম উন্নয়ন এবং পল্লী সংগঠনের জন্য রবীন্দ্রনাথ হিতৈষী বৃত্তি ও কল্যাণ বৃত্তি চালু করেন । এই বৃত্তি দু’টি চালানোর জন্য যে অর্থ সংগ্রহ করা হতো, তা জমি এবং প্রজার উন্নয়নে ব্যয় করতেন তিনি । যেমন- রাস্তাঘাট নির্মাণ, মন্দির-মসজিদ সংস্কার, স্কুল- মাদ্রাসা স্থাপন, চাষীদের বিপদে- আপদে সাহায্য ইত্যাদি। অমিতাভ চৌধুরী তাঁর ‘জমিদার রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে জানাচ্ছেন এমনই একটি বিষয় : ‘গ্রামোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি পড়ল শিক্ষা ও চিকিৎসার দিকে। প্রত্যেকটি গ্রামে জমিদার ও গ্রামবাসীদের টাকাতেই যৌথ উদ্যোগে বসল প্রাথমিক বিদ্যালয়, তিন বিভাগে তিনটি মাইনর স্কুল এবং সদর কাছারিতে হাইস্কুল। সেখানকার ছাত্রাবাসও তৈরি হল একই পদ্ধতিতে। ছাত্রাবাস ও ইস্কুলবাড়ির খরচ হিতৈষী সভা থেকে দেওয়া সম্ভব ছিল না বলে রবীন্দ্রনাথ এস্টেট থেকে সব টাকা দেন।
শিলাইদহে স্থাপিত হয় মহর্ষি দাতব্য চিকিৎসালয়। এই চিকিৎসালয়ে হোমিওপ্যাথি-কবিরাজী-অ্যালোপ্যাথি, তিন পদ্ধতিতেই চিকিৎসা হত। কুইনিন বিলি হত বিনামূল্যে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও চিকিৎসা করতেন মাঝে মাঝে। তা ছাড়া পতিসরে বসানো হয় বড়ো হাসপাতাল এবং কালীগ্রাম পরগণার তিনটি বিভাগে থাকেন তিন জন ডাক্তার। হেলথ কো-অপারেটিভ করে চিকিৎসার ব্যবস্থা সারা ভারতে সর্বপ্রথম চালু করেন রবীন্দ্রনাথ, করেন তাঁর জমিদারিতেই।’
গ্রামের রাস্তাঘাট, পানীয় জলের ব্যবস্থা, জলাশয়গুলির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে চাষীদের যাতে বাড়তি কিছু রোজগার হয় তারও চেষ্টা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি কুটির শিল্পের উন্নয়নের দিকে নজর দেন। বয়ন শিল্প, পটারির কাজ ইত্যাদির ওপরেও জোর দেওয়া হয়। পল্লী সংগঠনের এই কাজের সূচনা হয় শিলাইদহতেই। সেখানে রবীন্দ্রনাথ গ্রামবাসীদের ভেতর শক্তি চর্চায় জোর দিয়েছিলেন। মেছের সরদার নামে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব একজন লাঠিয়াল ছিল। শিলাইদহ গ্রামের ছেলেদের লাঠি খেলা শেখাতো সে। শচীন্দ্রনাথ অধিকারী জানাচ্ছেন এখানকার কর্মধারার প্রধান তিনটি দিক সম্বন্ধে । এক: হাতে কলমে কৃষি শিক্ষা। দুই: আদর্শগ্রাম তৈরি এবং তিন: ব্রতী-বালক গঠন। এই কর্মধারার অঙ্গ ছিল বিদ্যালয় স্থাপন, শরীরচর্চা, জঙ্গল পরিষ্কার করা, স্বাস্থ্যের উন্নতি ইত্যাদি। তবে শিলাইদহের তুলনায় পতিসর এবং পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতন, শ্রীনিকেতন, কালীগ্রামের কাছাকাছি অঞ্চলগুলিতে এই ব্যবস্থা আরো বেশি সংগঠিত হয়।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বভারতীর পল্লী সেবা বিভাগের ব্রতীবালক-সম্মিলনী বা বয় স্কাউট-এর কথা বলতেই হয়। বীরভূমে প্রায় ২৬টি কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিল এই সম্প্রদায়ের। এবং ৬০৮ জন ব্রতী কাজ করছিল মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। নৈশ বিদ্যালয় , স্বাস্থ্যোন্নতি থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজ এরা সুন্দরভাবে পরিচালনা করত। আনন্দবাজার পত্রিকায় ১৯২৫ -এর ২৪শে এপ্রিল এদের কাজের একটি সুন্দর চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
‘ব্রতীবালক-সম্প্রদায় নানাভাবে পল্লীগঠন ও সমাজসেবা করিয়া থাকে। তাহারা ইতিমধ্যেই কয়েকটি গ্রামে ম্যালেরিয়া দূর করিতে সমর্থ হইয়াছে। এইজন্য তাহারা কুইনাইন বিতরণ, জঙ্গল পরিষ্কার, মশক ধ্বংস, খানাডোবা বন্ধ করা, জলনিকাশের বন্দোবস্ত করা এবং রাস্তাঘাট পরিষ্কার করা এই সমস্ত উপায় অবলম্বন করিতেছে। তাহারা কলেরা দূর করিতেও চেষ্টা করিতেছে। মেলা প্রভৃতিতে সেবা-সঙ্ঘ গঠন করা তাহাদের একটি কাজ। গত বৎসর অগ্নিদাহে বীরভূমের কয়েকটি গ্রাম ভস্মীভূত হইয়াছিল; ব্রতীরা ঐ সমস্ত গ্রামের দুঃস্থ অধিবাসীদের যথাসাধ্য সাহায্য করিতে চেষ্টা করিয়াছে। তাছাড়া ব্রতী-সম্প্রদায়-বালিকা-বিদ্যালয় ও নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করিয়া গ্রামে গ্রামে শিক্ষা বিস্তারের সহায়তা করিতেছে ও চলন্ত লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠা করিয়াও তাহারা ঐ কাৰ্য্য করিতেছে। গ্রামবাসিগণের নিকট ম্যাজিক লান্টার্নসহ বক্তৃতা প্রভৃতি দ্বারা স্বাস্থ্যবিষয়ে শিক্ষাদানও তাহাদের কার্যপদ্ধতির অন্যতম।
মোটের উপর সঙ্ঘবদ্ধতা, সহযোগিতা ও স্বাবলম্বন দ্বারা যে অসাধ্য সাধন হইতে পারে, ব্রতী সম্প্রদায় তাহা ভালরকমই বুঝিয়াছে এবং তাহা কাৰ্য্যে পরিণত করিতে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করিতেছে। ভগবানের ইচ্ছায় তাহাদের কাৰ্য্য সফল হইবে, এ বিষয়ে আমাদের অণুমাত্র সন্দেহ নাই। আমরা আশা করি, বাংলার প্রত্যেক শহরে ও গ্রামে যুবকদের লইয়া ব্রতী সম্প্রদায় গঠিত হইবে। এস্থলে বলা উচিত, এই ব্ৰতী সম্প্রদায় গঠন ও বিস্তারের মূলে শ্রীযুত রবীন্দ্রনাথের শক্তি নিয়োজিত হইয়াছে। তাঁহার এই দেশ সেবাব্রত পূর্ণ হউক, ইহাই আমাদের আন্তরিক কামনা।’
১৯২৮ সালে বোলপুর থানার অন্তর্গত গ্রামগুলিতে জল কষ্ট শুরু হয়। এর ফলে বিভিন্ন গ্রামে কলেরা রোগের প্রকোপ দেখা দেয়। শ্রীনিকেতন পল্লীসেবা বিভাগের ডাক্তার নিকটবর্তী গ্রামের অধিবাসীদের কলেরা টিকা দেওয়া শুরু করেন। ঐ বছর এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রায় ৮০০ লোককে টিকা দেওয়া হয়েছিল।
চার।
গ্রাম বা পল্লী সংগঠনের পাশাপাশি গ্রাম সংস্কারের দিকেও লক্ষ্য ছিল রবীন্দ্রনাথের । রথীন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন যে, কালীগ্রামে গ্রামসংস্কার বা প্রতিষ্ঠান গঠন হয়েছিল, তাতে প্রত্যেক গ্রামের বাসিন্দারা সেই গ্রামে একজন বয়স্ক মানুষকে প্রধান হিসেবে নির্বাচিত করত। প্রতি বিভাগে যতজন প্রধান নির্বাচিত হতো তাদের সকলকে নিয়ে বিভাগীয় হিতৈষী সভা গঠন করা হয়। তিন বিভাগের প্রধানরা মিলে পাঁচজনকে কেন্দ্রীয় হিতৈষী সভার সভ্য মনোনীত বা নির্বাচন করত। তাদের বলা হতো পরগনার পঞ্চপ্রধান। এছাড়া জমিদারের একজন প্রতিনিধি থাকতো। বার্ষিক সভার প্রধান দুটি কাজ হল, বিগত বছরের হিসাব পরীক্ষা করা আর আগামী বছরের জন্য কাজের খতিয়ান তৈরি করা। এছাড়া প্রজাদের প্রতি কোন রকম অত্যাচার ঘটলে জমিদার মশায়কে সে বিষয়ে জানানো ছিল এদের উদ্দেশ্য।
পরবর্তী সময়ে এমন আরেকটি সংস্কার সমিতি গড়ে ওঠে শান্তিনিকেতনে। ২২ শে সেপ্টেম্বর অধ্যাপক জগদানন্দ রায়কে সভাপতি করে এই সমিতির কাজ শুরু হয়। এর সম্পাদক-কোষাধ্যক্ষ ছিলেন সুজিত কুমার মুখোপাধ্যায়। স্বাভাবিকভাবেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই সমিতির মধ্য দিয়ে গ্রামে গ্রামে উন্নয়নমূলক কাজ করবার আহ্বান জানান সকলকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, বয়স্ক শিক্ষার সূচনা ইত্যাদি চালু হয়। এছাড়া সাপ্তাহিক ধর্ম সভা ও কীর্তনের আয়োজন হয়েছিল। আর সেই সমস্ত কাজের সঙ্গে সঙ্গে সেখানেই সামাজিক সমস্যাগুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলত। ভুবনডাঙা, গোয়ালপাড়া ,পারুলডাঙ্গা, আদিত্যপুর, সর্বলেহনা প্রভৃতি গ্রামে সমিতির কাজ বিস্তার লাভ করে। এমনকি এখানে জাত পাতের ভেদাভেদও উঠে যায়। ভুবনডাঙা গ্রামের হাঁড়ি, ডোম, বাগদী, কায়স্থ, গন্ধবণিক ইত্যাদি সকল শ্রেণির সম্মিলনে একবার এক সার্বজনীন পংক্তি ভোজন হয়। সমিতির অন্যতম কর্মী অক্ষয়কুমার রায়ের চেষ্টাতেই এই সাফল্য আসে।
শ্রীনিকেতনের পল্লীর কর্মীদেরও পল্লী সংগঠনের বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হতো। বিশেষ করে কুটির শিল্প, বিপদে প্রাথমিক সাহায্য দান ও ব্যান্ডেজ বাঁধার শিক্ষা, পল্লী সংগঠন ইত্যাদি। এমনকি নৈশ বিদ্যালয় তৈরি করে বয়স্ক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। পারিপার্শ্বিক কুসংসর্গ, অনাচার থেকে যাতে নিজেদের বাঁচিয়ে চলতে পারে ; সে বিষয়েও বালক-বালিকাদের উপদেশ দেওয়া হতো ম্যাজিক লণ্ঠনের সাহায্যে। এই শিক্ষা সকলের মধ্যেই ভীষণ উৎসাহের সূচনা করে।
আসলে সেবা ও ত্যাগের ভাব জাগ্রত করাই রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্য ছিল । সেই সঙ্গে প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বশীল হতে তিনি উপদেশ দিতেন সকলকে। তাই বৃক্ষরোপণ উৎসবের সূচনা করে গ্রাম জীবনের মধ্যে সরসতা নিয়ে আসেন কবি।
‘শান্তিনিকেতনে প্রথম যেবার বৃক্ষরোপণ উৎসব হয় সেদিন এক তপ্ত বৈশাখের দিন। একালের মতো ২২ শ্রাবণ তো নয়ই, এমনকী মেঘমেদুর বর্ষাকালও নয়। ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ (১৯২৫) সেবার আশ্রমে গুরুদেবের পঞ্চষষ্টিতম জন্মোৎসব হল। সকলের ইচ্ছা এবার কবির জন্মদিনে নতুন কিছু একটা হোক। ঠিক হল বৃক্ষরোপণ হবে। তাই সকাল ছটায় জন্মোৎসব অনুষ্ঠানের পর সাড়ে সাতটায় গুরুদেব উত্তরায়ণেরও উত্তরে পাঁচটি গাছ (অশ্বথ, বট, বিল্ব, অশোক ও আমলকী) রোপণ করলেন। শান্তিনিকেতনে পঞ্চবটীর প্রতিষ্ঠা হল সেদিন। আচার্য বিধুশেখর শাস্ত্রী এই উৎসব উপলক্ষে একটি শ্লোক রচনা করেন-
পান্থানাং চ পশূণাং চ পক্ষিণাং চ হিতেচ্ছয়া
এষা পঞ্চবটী যত্নান রবীন্দ্রেণেহ রোপিতা।’
(রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ । পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়। )
রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গে আরো জানাচ্ছেন—‘বৃক্ষরোপণ উপলক্ষে সেদিন কবির সদ্য রচিত গান মরুবিজয়ের কেতন উড়াও গীত হয়। এইবারকার জন্মোৎসবে কলিকাতা হইতে বহু লোকের সমাগম হইয়াছিল। সন্ধ্যার সময়ে উত্তরায়ণে ‘লক্ষ্মীর পরীক্ষা’ ছাত্রীরা অভিনয় করে।’
অর্থাৎ, গ্রামকে মানব জীবনের এক উন্নত রূপ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই এর সংস্কার করে আদর্শ প্রতিরূপ হিসেবে তুলে ধরেছিলেন তিনি।
পাঁচ।
আমরা ফিরে যাব বেশ কিছু বছর আগে।
নতুন জমিদার হয়ে এলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বন্দুকের শব্দ, আলোর রোশনাই আর শঙ্খধ্বনিতে কাছারি মুখরিত। কিন্তু চিরাচরিত এই প্রথা রবীন্দ্রনাথের মনে অন্য এক প্রশ্ন তুলেছিল। তিনি হিন্দু-মুসলমান, ব্রাহ্মণ- চণ্ডাল সবাইকে একই ভাবে একই ধরনের আসনে বসার নির্দেশ জারি করেন। এমনকি এই মিলন অনুষ্ঠানে তিনি নিজেও দূরে থাকতে পারেননি। সবার সঙ্গে এক আসনে বসে প্রজাদের আনন্দ যজ্ঞে শামিল হন। সেদিন তিনি বিরাট প্রজা মণ্ডলের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘এই মিলন উৎসবে পরস্পরে ভেদ সৃষ্টি করে মধুর সম্পর্ক নষ্ট করে দেওয়া চলবে না।… আমি তোমাদেরই লোক।’
আসলে জনস্বাস্থ্য বলতে আমাদের ক্ষুদ্র দৃষ্টিতে যেটুকু মনে হয়, তার থেকে অনেক বেশি দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি স্বাস্থ্য বলতে শুধু প্রকৃতিগত কতকগুলি নিয়মকে বোঝেননি, মানুষের জীবনযাত্রা, সংস্কার , আত্মসম্মান ইত্যাদিকেও তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ‘পূজার সাজ’ কবিতাটিতে আমরা দেখবো কীভাবে কৃষক রমণী তার সন্তানদের আত্মমর্যাদার কথা বলছেন। এই আত্মমর্যাদাবোধ একজন মানুষকে তার দাঁড়াবার জায়গাটিকে নির্দিষ্ট করে দেয়। তাই একসময় পুত্র রথীন্দ্রনাথকে চিঠিতে তিনি লিখছেন, ‘আমি যা বহু কাল ধ্যান করেছি, রাশিয়ায় দেখলুম এরা তা কাজে খাটিয়েছে। আমি পারি নি বলে দুঃখ হল, কিন্তু হাল ছেড়ে দিলে লজ্জার বিষয় হবে।’ (১৯৩০)
পুণ্যাহের দিন নতুন জমিদারবাবুর নির্দেশে ‘দরিদ্র প্রজারা বুঝতে পারল, তাদের দুঃখের দিন ঘোচার লগ্ন উপস্থিত, আর আমলারা এবং সম্পন্ন মহাজনেরা জেনে গেলেন, তাঁদের দুঃসময়ের শুরু। আর রবীন্দ্রনাথ? তিনিও জেনে গেলেন তাঁর সম্মুখে কঠিন পরীক্ষা। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আরও সংকল্পবদ্ধ হলেন, আরো স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, এখানে তাঁকে কী করতে হবে, কীভাবে অগ্রসর হতে হবে এবং প্রতি পদে বাধা আসবে কোন্ পক্ষ থেকে।’ ( অমিতাভ চৌধুরী। জমিদার রবীন্দ্রনাথ)
ছয়।
বহু মানুষের কর্মধারা এসে মিলেছিল রবীন্দ্রনাথের এই সাধন যজ্ঞে। রথীন্দ্রনাথ, পিয়ার্সন, সন্তোষচন্দ্র মজুমদার, কালীমোহন ঘোষ, অতুল সেন প্রমুখদের নিরন্তর প্রচেষ্টা এবং আরো বহু মানুষের সহযোগিতা; রবীন্দ্রনাথের এই যে গ্রামীণ মানুষের জনস্বাস্থ্য ও আত্মোন্নতি- তাঁর সহায়ক হয়। বন্যা এবং দুর্ভিক্ষ তখন বাংলায় প্রায় প্রতি বছরের ঘটনা ছিল। সেই সময় কবির চেষ্টা ছিল আন্তরিক। বীরভূমে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে পল্লীবাসীদের সাহায্যের জন্য শান্তিনিকেতনের কর্মীবৃন্দ গ্রাম পরিদর্শনে যান। বল্লভপুর, সাঁওতাল পল্লী, ডাঙ্গাপাড়া, খেজুরডাঙ্গা ও কেনডাঙ্গায় দুই শত লোক মজুরির অভাবে অনশনে দিন যাপন করছিল। এমনকি কোপনা মাঝির পরিবার গত দুইদিন শুধু গাছের পাতা খেয়ে কোনমতে বেঁচে ছিল। এ কথা পত্র মারফত জানাচ্ছেন আনন্দবাজার পত্রিকার নিজস্ব সংবাদদাতা; ১৯২৮, ১৬ এপ্রিল। অবশেষে এই অন্নাভাবে হাহাকার করা মানুষগুলো নিজেদের গরু, হাঁস, ছাগল ইত্যাদি বিক্রি করতে শুরু করে। শান্তিনিকেতন, সুরুল ও বোলপুরের কয়েকজন প্রতিনিধি ‘রিলিফ কমিটি’ গঠন করে এই দুর্ভিক্ষের মোকাবিলায় নামেন। এমনকি জনসাধারণের কাছে সাহায্যের প্রস্তাব পাঠানো হয়। ঠিক একইভাবে বন্যার সময় রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীতে সাহায্য কেন্দ্র স্থাপন করেন। উত্তর ও পূর্ববঙ্গের বন্যাগ্রস্ত মানুষদের দুঃখ নিবারণের জন্য রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগতভাবে যেমন সাহায্য করতেন, পাশাপাশি অভিনয়, নাটক ইত্যাদির মাধ্যমে অর্থ তুলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন।
যে কথা দিয়ে আমাদের এই লেখা শুরু হয়েছিল, সেখানেই আরেকবার ফিরে যাওয়ার সময় এসেছে। একশো বছর অতিক্রান্ত। কিন্তু আজও সাধারণ মানুষের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক উন্নাসিকতা অবাক করে। আমরা প্রতিনিয়ত অন্যকে দোষ দিই, কিন্তু নিজেদের দায়িত্ব পালনকে সব সময় ভুলে থাকতে চেষ্টা করি। অভিযোগ আর বিদ্রূপ- এই আমাদের বর্তমান সময়ের হাতিয়ার। অবৈজ্ঞানিক আর অস্পষ্ট যুক্তিকেই আজকের মানুষ একমাত্র সঙ্গত ভেবে ভরসা করে বসে আছে। আমাদের গণতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্র, অর্থনীতি থেকে রাজনীতি সবই ক্ষমতালিপ্সুর হাতের পুতুল হয়ে উঠেছে। তাই জীবনের বিন্যাস জটিল থেকে জটিলতর। দ্বন্দ্ব, সংঘাত শহর এবং গ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। গভীর মতাদর্শ নেই বললেই চলে। ক্ষমতা, শুধু ক্ষমতাই যেন বিচার্য হয়ে উঠেছে জীবনধারণে।
‘এ দুর্ভাগ্য দেশ হতে, হে মঙ্গলময়,
দূর করে দাও তুমি সর্ব তুচ্ছ ভয়—
লোকভয়, রাজভয়, মৃত্যুভয় আর।
দীনপ্রাণ দুর্বলের এ পাষাণভার,
এই চিরপেষণযন্ত্রণা, ধূলিতলে
এই নিত্য অবনতি, দণ্ডে পলে পলে
এই আত্ম-অবমান, অন্তরে বাহিরে
এই দাসত্বের রজ্জু, ত্ৰস্ত নতশিরে
সহস্রের পদপ্রান্ততলে বারম্বার মনুষ্যমর্যাদাগর্ব চিরপরিহার —-
এ বৃহৎ লজ্জারাশি চরণ-আঘাতে
চূর্ণ করি দূর করো। মঙ্গলপ্রভাতে
মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে
উদার আলোক-মাঝে, উন্মুক্ত বাতাসে॥’
-নৈবেদ্য (১৩০৮)
* ছবিটি গুগল থেকে সংগৃহীত।