ব ই ক থা ১
কাগজই ভালো ছিলো
সজল দাস
প্রকাশক । তবুও প্রয়াস
প্রচ্ছদ । রাজদীপ পুরী
১০০ টাকা
দেবারতি মিত্র লিখেছিলেন, ‘মানুষের জীবনে এবং মননে ধ্রুব সত্য বলে কিছু নেই। দর্শন এ কথা বলে এবং বিজ্ঞানও তাতে সায় দেয় আজকাল।’ এই কথাগুলোই যেন ভেসে আসছিলো কবি সজল দাসের কবিতার বই ‘কাগজই ভালো ছিলো’ পড়তে পড়তে। ‘শূন্য কোনো মাথার ভিতরে বেড়াতে এসে’ শীর্ষক কবিতাগুলো তিনি সাজিয়েছেন নানান অনুভূতির নিযুত মালায়। এই বিচিত্র ভাবনার কারণ তো অবশ্যই কবির সমাজ, তা বাসযোগ্য হোক বা নাই হোক — তার প্রায় সমস্ত পরতেই কবির স্পর্শ লাগবেই, তাই তো স্বাভাবিক। সেই স্পর্শকেই সম্বল করে এই কাব্যগ্রন্থও সেজেছে হাতানিয়া-দোয়ানিয়ায়।
তিন সংখ্যক কবিতাটি সুন্দরের জলছবি, যেখানে তিনি সাজিয়েছেন ফুলের পাশে শিশুকে, তারপর এসেছে বৃষ্টি…. কিন্তু এরপরেই এক বিচিত্র মোচড়, ‘বৃষ্টির পর হালকা হয়ে যায় / মনে হয়, মায়ের প্রেমিক ছিল।’ ভেঙে পড়ছে একমাত্রিক নান্দনিকতা, যার চরম প্রকাশই হয়তো ঘটেছে শেষ দুটো পংক্তিতে- ‘পাথর / ঘুরে আসবে বলে / নরম আর লঘু মন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে লেখা।’
অন্য একটি লেখায় প্রকাশিত এক স্ববিরোধ — যা হয়তো কেবল স্রষ্টাকেই মানায়। ‘পাথর ভাঙছ আর বাতিল করছ মূর্তিকেই / যেন এখনই সেরে উঠবে এই ছেনি…’ কিন্তু এই ভাঙা-গড়ার খেলা কি সবসময় সৃজনাত্মক হয়? ছেনির রোগ কি বাস্তবেই সারে? উত্তরও তো রয়েছে এখানেই- ‘গাছের মৃত্যুর পর পাতা একাই ভাসতে শিখেছে।’
‘নির্জনে’ কবিতায় ধরা পড়েছে কবির প্রখর্য, যেখানে তিনি উপবাসকে বিকেলের সঙ্গে তুলনা করেছেন । এক করুণ আবেদন ঝরে পড়ছে লেখাটির শরীর থেকে। ঠিক যেমন অন্য একটি কবিতায় আছে ‘শিশুর পাশে খেলনা ঘোড়া রেখে চলে গেছে মা…’ যে মা শিশুকে রেখে হারিয়ে যায় চিরঅনুদ্দেশে, সে শিশু তো খোঁড়া হবেই। তার স্থবিরতার শিক্ষক যথার্থই হতে পারে গাছ। মনে পড়ে বলাইয়ের কথা।
এভাবেই বুনতে বুনতে এই বইয়ের অন্তর্ভুক্ত ‘সম্পর্ক’ নামের লেখাটিতে এসে যেন কিছুটা থমকে যেতে হয় । কারণ, ‘অসতর্কতার ভিতরেও যে কিছুটা আগুন ছিলো / এটুকু বোঝার জন্যই / মানুষ প্রতিবার ঘর বানায়।’ এখানে ‘আগুন’ আর ‘প্রতিবার’ শব্দক্ষেপণে যেন কবিতাটি এক ক্লাসিক সাহিত্যের মর্যাদার দাবিদার ।
‘নৌকো’ লেখাটি পাঠককে দিতে পারে এক গভীর দার্শনিকতার আস্বাদ। কবি দেখেছেন, পারদর্শী ঢেউয়ে ভর করে মৃতদেহ ভাসে — যে মৃত অবস্থাতেই এই ভেসে থাকার কৃৎকৌশল শেখে- কিন্তু কীভাবে! কেউ তা জানে না। তবে হয়তো এই জীবনসাগরে নিজের অজ্ঞাতে এইভাবে ভাসমান জীবনের কৌশল মানুষ রপ্ত করতে পেরেছে।
কবিতাগুলি প্রত্যেকটিই ক্ষুদ্রদেহী, কিন্তু তাদের আবেদন বা ক্ষমতা ক্ষুদ্র নয়। প্রতিটি লেখায় শব্দকে ব্যবহার করা হয়েছে মেপে, যাতে তার অপচয় বা অবহেলা না হয়। শব্দকে করেছেন আলোকিত প্রয়োগ। তাঁকে ধন্যবাদ।