Hello Testing

4th Year | 2nd Issue

৩১শে বৈশাখ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 15th May, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

ব ই ক থা  

অ নি ন্দ্য সু ন্দ র   পা ল

anindya

কাব্যগ্রন্থ : ঘুণ ধরা শরীর

ঘুণ ধরা শরীর

রাজীব মৌলিক

প্রকাশক । প্ল্যাটফর্ম

প্রচ্ছদ । রাজদীপ পুরী

১৫০ টাকা

বাংলা কবিতার এখন এক দুর্বিষহ সময়, যেখানে সামাজিক ও অর্থনৈতিক এক দৈন্য অনিবার্যভাবে এসে পড়েছে সাহিত্য-শিল্পকলার স্বরান্তরের প্রসারে। বিহ্বল ভঙ্গিতে সন্ধিবিচ্ছেদের মতো ভেঙে যাচ্ছে শব্দ ও বাক্যের অন্তর্নিহিত সূক্ষ্মকোণ, অন্তঃস্থলের নিবিড় অনুভূতিপুঞ্জ, আকর্ষণ ও বিকর্ষণের উন্মুক্ত জঙ্ঘা। বারবার এই তিন মেরুতে আহত হতে হতে যতবার এই ‘ঘুণে ধরা শরীর’-এর মুখোমুখি হয়েছি, ততবারই যেন নীল স্তব্ধতা ভেদ করে প্রস্ফুটিত হয়েছে ছন্দবদ্ধ শাসন। যেখানে প্রতীকে-ব্যঞ্জনায়-রূপকে আন্দোলিত হয়েছে রহস্যতিমির। কবি স্বতন্ত্র সাহসে আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্য, নাগালহীন প্রভৃতি বহুলপ্রচলিত ধারণাকে পিছনে ঠেলে সূক্ষ্মতা, আশ্লেষব্যঞ্জনা, সংরক্ত-প্রেমের মতো উপজীব্য বিষয়গুলো নিঃশব্দে এক অমোঘ দর্শনমূলক টেক্সটে প্রতিষ্ঠা করেছেন।

কাব্যগ্রন্থের একেবারে সাক্ষাৎপর্বে : ‘এভাবে আতর মেখে শরীর ছুঁয়ো না/ জানো তো, প্রেমের চেয়ে সংসার ঢের গুণ ত্যাগী।’ এই শব্দবহুল গভীরতায় অনন্ত জীবন যেন উদ্যত ভঙ্গিতে লিখে চলে ঐশ্বর্যহীন বাস্তবতার। ভিতরে ভিতরে প্রাথমিক ভাবেই ঝড় ওঠে, প্রশ্ন আসে, পুনরায় কিছুটা শান্ত হলে বুঝতে পারি অন্তরঙ্গতা একটা সাক্ষাৎকার, যেখানে পারস্পরিক নিয়মে চেয়ে থাকে মানুষ ও তার প্রেম এবং ব্যক্তিগত নগ্নতা। আবার কিছুটা যেতেই চোখে পড়ে- ‘ভেঙে পড়লেও/উঠে দাঁড়ানোর কথা কিংবা/চে গুয়েভারের কথা বলতাম’, যা একজন কবির গঠনমূলক অভিব্যক্তি। আবার একটু এগোলে শেষ হয় এমন বাক্য দিয়ে- ‘আমি তাকে তাই স্বৈরতন্ত্রের কথা বললাম/হিটলারের কথা বললাম।’ বোঝাই যায় ভিন্ন ভিন্ন মেরুতে সোশিয়ালিসম্, হিউম্যানিজম্ ও নাৎসিজম্ মতো বিষয়কেও কবি রিলেট করতে পেরেছেন বাস্তবিক প্রেমের নিরিখে। মোহন মাধুরীর মতো ঘোমটা সরিয়ে দেখাতে চেয়েছেন জীবনের কিনারাগুলো প্রসারিত বিস্তৃত অনুধাবিত হলেও সেই পরাবাস্তবের চোরাস্রোতে কেবল যেন সান্ত্বনা। যাঁর রাগ-বিপর্যয়-ক্ষিতি শেষপর্যন্ত নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে সমাজের গূঢ় নাশকতায়। যেখান থেকে মুক্তির পথ হয়ত সেই একনায়ক কিংবা মুষ্টিগত মননশীলতা, তা নিপুণ হলেও, সমপরিমাণে ক্রোধান্ধ। এই স্বরমিশ্র বাহুল্য রাজীব মৌলিকের কবিতার একটি স্মিত বৈশিষ্ট্য। এমন ধীর স্থির তীক্ষ্ণ শক্তিশালী ধারা অনুরিত আছে এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কাব্যের অন্দরে অন্দরে কিংবা লাইনে লাইনে। ভণিতাহীন সংযোজিত এক উৎকীর্ণ কোয়ার্টেট ভঙ্গি এই কবিতার বইয়ের সমস্ত কবিতায় ছড়ানো: ‘গল্প হবে, কবিতা হবে, গান হবে/ দিনশেষে ফুলগুলো আয়ুষ্মান হবে।’ ‘স্মরণসভা’ এই বইয়ের অন্যতম ফলবান কবিতা।

একদিকে নিরুত্তর সংঘর্ষ, অন্যদিকে সীমানা লুপ্ত মেঘমল্লার ধ্বনি- এই দুইয়ের মধ্যে দেশ কাল সমুদ্র শরীর ডুবে যাচ্ছে কবির ভাবনায়। তিনি লেখেন- ‘বৃদ্ধ বয়সে লোকটি প্রেসিডেন্ট হলো/অথচ যুবক ছেলেটির চাকরি হলো না’ কিংবা ‘কবিতা লিখি বলে/ মা আমাকে মরে যেতে বলে।’ অথবা ‘শুধু চেতনা নেই। অনুভূতি নেই।/বেঁচে থাকার ইচ্ছে নেই/মরে যাওয়ার আকুতি নেই।’ পড়তে পড়তে মনে হয় কালো মেঘে ঢাকা পড়ে যাচ্ছি আড়ালের তারকাপুঞ্জের মতো। প্রচন্ড ক্ষোভ, আক্ষেপ, শ্লেষ, বেয়ারুর মতো রতিচেতনা সমস্ত কনসেপ্ট ফর্ম ছন্দ ছেড়ে কবি এখন জর্জরিত ক্ষীণ অভিব্যক্তির সংস্কারে। কবি বুঝতে পারছেন জীবন মৃত্যু পর্যায় একটা আবহমান, তবুও তিনি নিরুপায়, সন্ধিহীন, এলোমেলো, কিন্তু উপেক্ষাবর্জিত।

কবিতা কতটা অসাংগঠনিক সেইটা এই বই হাতে না নিলে বোঝা দায়। যেসব ব্যাপারে আমরা ভীষণ উদাসীন, সেইসব ব্যাপার কবি ভাবনার রুজিরুটি, আবার যা আমাদের মদ্যবহুল, চাতুর্যের প্রকাশশৈলী, তা কবির অনারুঢ় অসাংকেতিক অনুৎসাহী কিন্তু তা কখনই স্বপ্নবিমিশ্রিত নয়। তাই কি ধরে নেওয়া যায় কবির কাছে খোলস কিংবা বোরখা আলাদা? নাকি বিসর্জন কিংবা খিদে একটা মেটাফা, যেখানে কবি সেক্স ফুড ডিমান্ড একটা রিপুর নেগেটিভিটি বলে ধরে নিচ্ছেন? তা না হলে তিনি লিখবেনই বা কেন ‘দুটি আপেল ছাড়া ওর কাছে তখন/কামড়ে খাওয়ার মতো কিছুই পড়ে থাকে না’ কিংবা ‘এক মৃত মানুষের সঙ্গে আমার ভালোবাসা হয়েছে/শুনেছি তার মন নাই।’ সমস্ত মৃদুলস্বতঃস্ফূর্ততা ছেড়ে কলম গর্জে উঠেছে ঘোরতর ঘূর্ণিঝড়ে, যেখানে সবকিছু মহাকর্ষময়, অস্থির, স্থিতিস্থাপক। প্রাচীন রিপুকে তাঁর চুম্বক মনে হচ্ছে, যার সমধর্মিতা বলতে শুধুই বিকর্ষণ, আকর্ষণ কেবল বিপরীতমর্মিতা।

রাজীবের কবিতাগুচ্ছ পড়তে পড়তে পাঠকের মনে পড়তেই হবে শঙ্খ ঘোষের কথা, পিটার হান্টের কথা কিংবা জন হোরগ্যানের কথা। কিন্তু কবি এখানে এক সূক্ষ্ম জাগতিক ইন্দ্রিয়জ চেতনার জন্ম দিয়েছেন। গড়পড়তা জীবন ত্যাগ না করেই আলোকপাত করেছেন কবিতার ব্ল্যাক-হোল থিওরি। অবাক লাগবে কিছুটা দৃশ্যমান হবে, ব্যতিক্রমী হবে, যত মুখোমুখি হবে নিগূঢ় অন্তরচেতনায় ততই নিজেকে একজন পাঠক, নিজেই নিজেকে আবিষ্কার করবে কোনো এক নিভৃত নগ্ন প্রান্তিকে। যেখানে গলা ভর্তি আর্তি, দৈন্য, অপচয়, অসম্পূর্ণতা, তবু তার শরীর তার এক একটি অঙ্গ একটি দর্শন, হেগেল-এর এক একটা বাণী, আশ্চর্য চিত্রকল্পের ধর্ম-বিগ্রহ।

আলোচনার একবারে অমিতলগ্নে এসে বলতেই হয় আধুনিক কবিতার নির্দিষ্ট একটি প্যাটার্ন আছে, কিছু প্রচলিত ধারণা আছে, কিছু প্রচলিত মেটাফোর আছে, এক একজন সহৃদয় পাঠক এক একভাবে সেটি ব্যাখ্যা বা আলোচনা করতেই পারেন কিংবা ভিন্ন ভিন্ন ভাবনায় উপনীত হতেই পারেন, এতে কোনো অন্যায় নেই বরং স্বাধীনতা অনেক বেশি। তবুও মেনে নিতে হবে কবির নিয়মে তা একটি টেক্সট মাত্র, যা আমি আগেই বলেছি। কারণ কাঠে ঘুণ ধরা আর শরীরে ঘুণ ধরার মধ্যে আপেক্ষিক বা শব্দযুক্ত ব্যতিক্রম থাকলেও বস্তুত কোনো পার্থক্য নেই। জীবনের স্থাপন ও পচন দুটোই ইকোসিস্টেমের একটি পার্ট, কাঠ কিংবা শরীর দুটোই দাহ্য বস্তু। কিন্তু তাঁর কবিতার আড়ালে যে থেকে যাচ্ছে সমাজতত্ত্ব, ক্যাপিটালিসম, বিষাদ, বাস্তবতা, তা-ই রাজীব মৌলিকের কবিতাকে করে তুলেছে আরও ঔপপত্তিক , ক্রিয়াত্মক ও অ্যানালিটিক- ‘এই তো জীবন! পিঠ ঠেকলেও দেওয়ালে/ কিছু পাথর, পাথরই; ভাঙে না কোনো কালে।’ অথবা ‘আদতে আমি ফুল বিশেষজ্ঞ/বৃন্ত দেখলেই বুঝে যাই/তার রূপের রহস্য/অহংকারের পরিণতি।’

আরও পড়ুন...