শ্র দ্ধা জ্ঞা প ন
কবিতা এবং দর্শনকে মিলিয়ে দেওয়ার দক্ষতায় শঙ্খ ঘোষ বরাবরই অনন্য। তাঁর কবিতা এবং গদ্যে ‘নিঃশব্দ’ তেমনই এক দর্শন, যার সঙ্গে তিনি মিলিয়ে দিয়েছেন তাঁর সৃষ্টিকে। বলা ভালো একাত্ম করেছেন। অলোকরঞ্জনের একটি উক্তি দিয়ে এ লেখা শুরু হতে পারে- ‘…শব্দের ভিতরে অন্তঃশীল নৈঃশব্দ্যই তাঁর উপাস্য একটি শর্ত। তাঁর একটি কথার সঙ্গে আরেকটি কথার ভিতরে অন্তর্গত কথার প্রাণগ্রন্থিই নীরবতা। আমার মনে এখনো গাঢ় এই প্রতীতি, তাঁর কবিতার কেন্দ্রীয় চরিত্রলক্ষণই সমীচীন স্তব্ধতা’১ এই যে ‘স্তব্ধতা’, এ কি শুধু শব্দহীন নীরবতা, নাকি তার অতিরিক্ত কিছু? তা বুঝে নেওয়ার আগে আমাদের মনে রাখতে হবে শঙ্খ তাঁর সমস্ত লেখায় ‘নিঃশব্দ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, ‘নৈঃশব্দ্য’ নয়।
কিন্তু ‘শব্দ’ই তো লেখকের সব, ‘নিঃশব্দ’ কীভাবে হয়ে উঠবে তার বিকল্পায়িত কোনও পন্থা? আসলে এর মূলে রয়েছে ‘সংযোগ’। আমরা কথা বলি কেন? সংযোগ স্থাপনের জন্যই তো! কিন্তু এই কথা বলতে বলতে আমরা কি খেয়াল করি, বহু ব্যবহারের ফলে কিছু শব্দ তার গুরুত্ব হারাচ্ছে! শব্দের অর্থগত এই যে অবনমন, তাকে আঘাত করাই শঙ্খের ‘নিঃশব্দ’চর্চার প্রাথমিক লক্ষ্য। ‘দেখার দৃষ্টি’ নামে গ্রন্থে শঙ্খ বলছেন, ‘নীরবতারও একটা ভাষা আছে। সে-ভাষা পড়তে অনেক সময় ভুলে যাই আমরা। শুধু যে পড়তে ভুলি তা নয়, তার ব্যবহারও হয়তো ভুলে যাই জীবনে, ভুলে যাই যে অনেকসময়ে নীরবতা একটা সামর্থ্য। ভাষার সংযোগের সঙ্গে নীরবতার সংযোগ মিলে গিয়ে যৌথভাবে গড়ে ওঠে একটা সংযোগের ভাষা। জীবনব্যবহারে সেই ভাষাটাকে বারেবারেই হারিয়ে ফেলি আমরা। আর তখনই বেড়ে ওঠে চিৎকার, তখনই বেড়ে ওঠে আমি, তখনই বেড়ে ওঠে পরস্পরের মধ্যে সেতুহীন এক দূরত্ব।’২
কবিতা এবং দর্শনকে মিলিয়ে দেওয়ার দক্ষতায় শঙ্খ ঘোষ বরাবরই অনন্য। তাঁর কবিতা এবং গদ্যে ‘নিঃশব্দ’ তেমনই এক দর্শন, যার সঙ্গে তিনি মিলিয়ে দিয়েছেন তাঁর সৃষ্টিকে। বলা ভালো একাত্ম করেছেন। অলোকরঞ্জনের একটি উক্তি দিয়ে এ লেখা শুরু হতে পারে- ‘…শব্দের ভিতরে অন্তঃশীল নৈঃশব্দ্যই তাঁর উপাস্য একটি শর্ত। তাঁর একটি কথার সঙ্গে আরেকটি কথার ভিতরে অন্তর্গত কথার প্রাণগ্রন্থিই নীরবতা। আমার মনে এখনো গাঢ় এই প্রতীতি, তাঁর কবিতার কেন্দ্রীয় চরিত্রলক্ষণই সমীচীন স্তব্ধতা’১ এই যে ‘স্তব্ধতা’, এ কি শুধু শব্দহীন নীরবতা, নাকি তার অতিরিক্ত কিছু? তা বুঝে নেওয়ার আগে আমাদের মনে রাখতে হবে শঙ্খ তাঁর সমস্ত লেখায় ‘নিঃশব্দ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, ‘নৈঃশব্দ্য’ নয়।
কিন্তু ‘শব্দ’ই তো লেখকের সব, ‘নিঃশব্দ’ কীভাবে হয়ে উঠবে তার বিকল্পায়িত কোনও পন্থা? আসলে এর মূলে রয়েছে ‘সংযোগ’। আমরা কথা বলি কেন? সংযোগ স্থাপনের জন্যই তো! কিন্তু এই কথা বলতে বলতে আমরা কি খেয়াল করি, বহু ব্যবহারের ফলে কিছু শব্দ তার গুরুত্ব হারাচ্ছে! শব্দের অর্থগত এই যে অবনমন, তাকে আঘাত করাই শঙ্খের ‘নিঃশব্দ’চর্চার প্রাথমিক লক্ষ্য। ‘দেখার দৃষ্টি’ নামে গ্রন্থে শঙ্খ বলছেন, ‘নীরবতারও একটা ভাষা আছে। সে-ভাষা পড়তে অনেক সময় ভুলে যাই আমরা। শুধু যে পড়তে ভুলি তা নয়, তার ব্যবহারও হয়তো ভুলে যাই জীবনে, ভুলে যাই যে অনেকসময়ে নীরবতা একটা সামর্থ্য। ভাষার সংযোগের সঙ্গে নীরবতার সংযোগ মিলে গিয়ে যৌথভাবে গড়ে ওঠে একটা সংযোগের ভাষা। জীবনব্যবহারে সেই ভাষাটাকে বারেবারেই হারিয়ে ফেলি আমরা। আর তখনই বেড়ে ওঠে চিৎকার, তখনই বেড়ে ওঠে আমি, তখনই বেড়ে ওঠে পরস্পরের মধ্যে সেতুহীন এক দূরত্ব।’২
কিন্তু সার্বিক অবনমনকে আঘাত করতে গিয়ে শঙ্খ শব্দ থেকে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবেননি। ভেবেছেন ভাষা দিয়েই ভাষার মিথ্যেকে জয় করতে। শঙ্খ বলেছেন, ‘আমাদের জীবনযাপনকে ঘিরে ধরেছে পঙ্গপালের মতো শব্দাবলি, কিন্তু ক্রমে টের পাই যে অল্পে অল্পে তার পরিবহণ গেছে নষ্ট হয়ে। নিষ্ফলা কথায় দিন কাটে দ্রুত, রাতে ঘরে ফিরে দেখি হাতে সঞ্চয় ঘটেনি কিছু। অভ্যাসবশে কথা বলা আর মিথ্যে বলার এই সমূহ সর্বনাশ শিল্পেও তার চিহ্ন রেখে যায়, কবিতারও অবয়ব হয়ে ওঠে কলরোলময়, বার্তাবিহীন, অভ্যাসতাড়িত। …হতে পারে যে অপঘাতী এই মিথ্যা বাণিজ্যের ভিতরে দাঁড়িয়ে প্রথম আবেগে শব্দেরই ওপর একটা ভুল অভিমান তৈরি হয়। মনে হয় যার পরিবহণ নেই তাকে আমার প্রয়োজনও নেই। কিন্তু, শব্দজাত মিথ্যেকে উপেক্ষা করার চেষ্টায় এ হলো শব্দকেই উপেক্ষা করা।’৩ তাহলে কী করা উচিত? শব্দেরই কোনও ‘বিশেষ প্রয়োগরীতি’ দিয়ে আমরা পৌঁছে যেতে পারি নীরবতায়। তাতে ভেঙে ফেলতে হয় শব্দ অথবা প্রতিমার ‘অভ্যস্ত পারম্পর্য’, আর শব্দকে অতিক্রম করে আমরা পৌঁছে যেতে পারি শব্দাতীত তাৎপর্যে। তীব্র এই এক্সপোজারের যুগে কাজটি কঠিন। কারণ নিঃশব্দের জন্য দরকার হয় নিভৃতি। নিঃশব্দ-চর্চার জন্য দরকার হয় ‘নেপথ্য নির্জনের’। শঙ্খের মতে, ‘আরও বেশি ব্যক্তিগত আড়াল’ থেকে তাকে ধরতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে বড় কোনও আত্মবিস্তারের দিকে। ‘নিঃশব্দের তর্জনী’ গ্রন্থে শঙ্খ বলেছেন, ‘‘লিখতে হবে নিঃশব্দে কবিতা, এবং নিঃশব্দ কবিতা। শব্দই জানে কেমন করে সে নিঃশব্দ পায়, ঐশ সূত্র না ছিঁড়েও। তার জন্য বিষম ঝাঁপ দেবার দরকার আছে দুঃসহ আড়ালে থেকে। দুঃসহ, কেননা অন্তরাল সহ্য করাই মানুষের পক্ষে সবার চেয়ে কঠিন। কবিকে তো আজ সবটাই খেয়ে ফেলেছে মানুষ, তাই মানুষের এই শেষ দায়টা মেনে নিয়েও ঘুরছে সে, অন্তরাল ভেঙে দিয়ে এক শরীর দাঁড়াতে চাইছে অন্য শরীরের সামীপ্যে। তা যদি না হয় তাহলেই সহ্য যায় পেরিয়ে, -কিন্তু তবু সেই দুঃসহ আড়ালে বসে সে তৈরি রাখবে একটা দৈনন্দিনের মুখোশ; তাকে কেউ চিনবে না, আঙুল তুলে বলবে না ‘এ লোকটা কবি’, আর তার ভিতর থেকে গোপনে জন্ম নেবে নিঃশব্দ কবিতা।’’৪
এই যে দুঃসহ আড়ালের কথা বলছেন শঙ্খ, সেই আড়াল কিন্তু প্রকৃতির মধ্যেও নেই। আর প্রকৃতি তো সর্বদাই লগ্ন হয়ে আছে মানুষের সঙ্গে। ফলে, আলাদা করে প্রকৃতির কাছে গিয়ে সে আড়ালের সন্ধান পাওয়াও দুষ্কর। ফলত শঙ্খ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন, ‘মৌন জানে শুধু মানুষের বুক’। আর সেই মৌনতাকেই শব্দে ধরেন কবি। কীভাবে? শব্দমধ্যস্থ অবাচ্যতার মধ্যে সত্যের প্রবাহ এনে। তাই তিনি বলেন, ‘…নিঃশব্দ মানে শব্দ থেকে পালানো নয়, শব্দকে ঈথারমণ্ডিত করে তোলা মাত্র, অভ্যস্ত শব্দসম্পর্কের আলস্য ভেঙে দিয়ে তার মধ্যে সত্যের প্রবাহ নিয়ে আসা। কবিরই সেই কাজ।’৫ অর্থাৎ ‘নিঃশব্দ’ হল শব্দমধ্যস্ত সেই ‘অবাচ্যতা’, যা দিয়ে আমরা আবিষ্কার করে নিতে পারি সত্যকে। পক্ষান্তরে সত্য দিয়েই কেবল ধরা সম্ভব সেই অবাচ্যতা, সেই নিঃশব্দকে। যদিও সত্যের ধারণাটি বড় গোলমেলে। তবু এটুকু বলা প্রয়োজন যে, ‘শব্দজাত মিথ্যেকে’ উপেক্ষা করতে গেলে ‘সত্য’ এক জরুরি শর্ত। যা দিয়ে কবি শব্দকে পৌঁছে দেন ‘আলোর তটভূমিতে’, যেখানে ‘শব্দের পারম্পর্য নতুন করে গাঁথা হয়ে যায়’ এবং তারই মধ্যে রণিত হয় ‘নিঃশব্দ সংগীত’। কেন শব্দের ভিতরে অন্তঃশীল নৈঃশব্দ্যকে খোঁজেন কবি? খোঁজেন এক ‘শুচি অন্ধকারের’ জন্য। যে অন্ধকারের বোধ তাঁকে উজ্জীবিত করে তোলে কর্মের দিকে, সৃষ্টির দিকে। ‘এই সৃষ্টিরই জন্য কখনো কখনো শব্দের ভিতরে অন্তঃশীল নৈঃশব্দ্যকে খোঁজেন কবি, খোঁজেন সেই ভাষা যার মধ্যে নীলাঞ্জন অন্ধকার সংহত হয়ে আছে।’৬ ‘ইশারা অবিরত’ গ্রন্থের একটি আলোচনায় শঙ্খ বলেছিলেন, ‘আমাদের ভালো লাগার, আমাদের সম্পর্কের, আমাদের দৈনন্দিন যাপনের চারপাশে ঘিরে আছে একটা নিঃশব্দ বলয়। সকলে হয়তো তাকে দেখতে পান না, দেখতে চান না, কিন্তু যিনি যাপন করতে করতে জীবনকে লক্ষও করতে থাকেন, তিনি জানেন শব্দহীন এই অদৃশ্য বলয়ের টান। সে নীরবতার কোও নাম নেই, কিন্তু আর্তনাদ আছে। সে-নীরবতা আমাকে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয় না, আরো বেশি সংসক্ত করে দেয় জীবনের সঙ্গে।’৭
কবি সমালোচক তারাপদ আচার্য শঙ্খ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘সমগ্র কবিজীবন জুড়ে তিনি হয়ে উঠেছেন এক চরিত্রবান নীরবতা।’৮ বস্তুত শঙ্খের কবিতার দিকে যদি নিবিড়ভাবে তাকাই তাহলে অনিবার্যভাবেই এ কথার সত্যতা মূর্ত হয়ে ওঠে। বলাবাহুল্য, এই নীরবতারও বীজ তিনি পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ থেকেই। রবীন্দ্রনাথ যেমন ‘মুখর কবিকে নীরব’ করে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন তাঁর দেবতার কাছে, শঙ্খও তেমনই বারবার বাণীবিরল এক কবিতাশরীরের কাছে পৌঁছাতে চেয়েছেন। লিখেছেন- ‘ভিতরে আগুন নিয়ে তবু শূন্যে চেয়ে থাকে খরা/ নিঃশব্দ ঝরানো নয়, নিঃশব্দ বুকের মধ্যে ধরা’ (নিঃশব্দ/তুমি তো তেমন গৌরী নও)। লিখেছেন-
‘এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো
শব্দহীন হও
শষ্পমূলে ঘিরে রাখো আদরের সম্পূর্ণ মর্মর
লেখো আয়ু লেখো আয়ু
ভেঙে পড়ে ঝাউ, বলির উত্থান, ওড়ে ঝড়
তোমার চোখের নীচে আমার চোখের চরাচর
ওঠে জেগে
স্রোতের ভিতরে ঘূর্ণি, ঘূর্ণির ভিতরে স্তব্ধ
আয়ু
লেখো আয়ু লেখো আয়ু
চুপ করো, শব্দহীন হও।’ (আয়ু)
‘দিনগুলি রাতগুলি’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পর শঙ্খ দীর্ঘ বিরতি নিয়েছিলেন। এক দু’বছর নয়, ১১ বছর। শঙ্খ নিজেই জানিয়েছেন, ‘প্রগল্ভতায় সরলীকরণে একমুখিতায় যেদিকে চলেছিল আমার আমার লেখাগুলি, সেদিক থেকে যেন সরে আসতে চাইছে কলম, অথচ তার পথ পাচ্ছি না’৯ সেই সময় দু’টি ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছিল তাঁকে। এক, রামকিঙ্করের ছবি। দুই, সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী। নীরবতা যে কতখানি বাঙ্ময় হতে পারে, তার দেশজ দৃষ্টান্তে যেন মুক্তির স্বাদ পেয়ে যান শঙ্খ! চিন্তা শুরু হয় তাঁর, কবিতা কি এমনভাবে নিঃশব্দকে ধরতে পারে? কয়েকবছর জুড়ে থমকে থাকা হাত ফের সচল হয়ে ওঠে। নীরবতা আর বিচ্ছরণের মুখোমুখি এসে দাঁড়ান শঙ্খ। লেখা হতে থাকে ‘নিহিত পাতালছায়া’র কবিতাগুলি। তেমন একটি কবিতা ‘জল’-
‘জল কি তোমার কোনো ব্যথা বোঝে? তবে কেন, তবে কেন
জলে কেন যাবে তুমি নিবিড়ের সজলতা ছেড়ে?
জল কি তোমার বুকে ব্যথা দেয়? তবে কেন তবে কেন
কেন ছেড়ে যেতে চাও দিনের রাতের জলভার?’
এই কাব্যগ্রন্থেরই ‘নাম’ কবিতায় তিনি লেখেন-
‘কোনো জোর কোরো না আমায়।
শব্দগুলি খুলে যাক, খুলে-খুলে যায়
যেমন-বা ভোর
জলস্রোত বহুদূর টেনে নিয়ে যেমন পাথর
জনহীন টলটল শব্দ করে
দিগন্তের ঘরে
আমাদের নাম মুছে যায় চুপচাপ। খুব ক্ষীণ
টুপটুপ খুলে পড়ে ঘাসের মাথায় নীল, আর কোনো দিন
কোনো জোর কোরো না আমাকে।’
নিঃশব্দ যেন জমাট বেঁধে আছে এসব কবিতায়। কবি শব্দ দিয়েই ধারণ করেছেন সেই অসীম নিঃশব্দকে। আর এইভাবে নিঃশব্দ থেকে শব্দের দিকে যেতে যেতে একটা সীমায় পৌঁছানো পর তার অভিমুখ ফের ঘুরে যেতে নিঃশব্দেরই দিকে। শঙ্খের ভাষায় ‘শব্দে-নিঃশব্দে এইরকম একটা ওঠানামা চলতে থাকে কেবলই।’ ‘নিহিত পাতালছায়া’র প্রায় ১০ বছর পর ফের তেমন এক নিঃশব্দের কাছে এসে পৌঁছান শঙ্খ। সে কাব্যগ্রন্থের নাম ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’। দৃশ্য আর দৃশ্যাতীত মিলেমিশে এক হয়ে যায় চার লাইনের ছোট ছোট কবিতায়-
‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ, রক্তে জল ছলছল করে
নৌকোর গলুই ভেঙে উঠে আসে কৃষ্ণা প্রতিপদ
জলজ গুল্মের ভারে ভরে আছে সমস্ত শরীর
আমার অতীত নেই, ভবিষ্যৎও নেই কোনোখানে।’
শঙ্খের কবিতার ‘নিঃশব্দ’ নিয়ে বলতে গিয়ে কবি-সমালোচক সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন- ‘‘তাঁর কবিতা পড়তে পড়তেই পাঠক আভাস পেয়ে যান, শব্দের আড়ালে কীভাবে শব্দহীনতার দিকে ইঙ্গিত রাখতে চান তিনি, কথার ভেতরে খোঁজেন অকথিত নিস্তব্ধতা, যতটা সম্ভব অস্ফুটবাক থেকে অক্ষত রাখা যায় কবিতার স্বধর্ম। …শব্দের অন্তরালেও যে একটা শব্দাতীত কবিতাভুবনের সংকেত থেকে যায়, কোনো কথা না বলেও যে অনেক কথা আভাসে ইশারায় বলে নেওয়া যায়, যাকে আমরা বলতে পারি ‘আড়ালের ভাষা’, শুধু মিতকথনের কবিতায় নয়, তাঁর যে-কোনো কবিতার দৃষ্টান্তে এই বিশিষ্টতা আমাদের দৃষ্টি এড়ায় না।’’১০ বস্তুত, একথা আমাদেরও কথা। আয়োনেস্কো তাঁর জার্নালে লিখেছিলেন, ‘There are no words for the deepest experience’. (উৎস: অশ্রুকুমার সিকদার, কালের মাত্রা ও শঙ্খ ঘোষের কবিতা, নিঃশব্দের শিখা শঙ্খ ঘোষ) কবির কাছে একথা খুবই সত্যি। শঙ্খও সেকথা জানেন। তাই মিতকথন তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কিন্তু একই সঙ্গে উপলব্ধির তীব্রতা ও অন্তর্মুখিতায় সেই নিঃশব্দ বলয়কে শব্দ দিয়েই আয়ত্ত করেছেন তিনি। এখানেই তাঁর সার্থকতা।
তথ্যসূত্র
১. সন্তোষ মুখোপাধ্যায়, ডিসেম্বর ২০১৩, শঙ্খ ঘোষ: একটি ভূমিকা, সন্তোষ মুখোপাধ্যায়(সম্পা), শঙ্খ ভাবনার অনুষ্টুপ সংকলন: নিঃশব্দের শিখা-শঙ্খ ঘোষ, অনুষ্টুপ, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা: ২৬-২৭
২. শঙ্খ ঘোষ, সেপ্টেম্বর ২০১৫, গদ্যসংগ্রহ-৯, প্রথম প্রকাশ, দে’জ, পৃষ্ঠা-৪০
৩. শঙ্খ ঘোষ, জানুয়ারি ২০০২, গদ্যসংগ্রহ-৩, দে’জ, প্রথম প্রকাশ, পৃষ্ঠা-২৩
৪. তদেব, পৃষ্ঠা-২০
৫. তদেব, পৃষ্ঠা-২৮
৬. শঙ্খ ঘোষ, গদ্যসংগ্রহ-৩, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২২৭
৭. শঙ্খ ঘোষ, এপ্রিল ২০০২, গদ্যসংগ্রহ-৪, দে’জ, প্রথম প্রকাশ, পৃষ্ঠা-৪৯৪
৮. তারাপদ আচার্য, জানুয়ারি ২০০৬, শঙ্খ ঘোষের কবিজীবন, দে’জ, প্রথম সংস্করণ, পৃষ্ঠা-১০৬
৯. শঙ্খ ঘোষ, গদ্যসংগ্রহ-৪, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৪৫২
১০. সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়, ডিসেম্বর ২০১৩, শব্দ পেরিয়ে শব্দহীনতার দিকে শঙ্খ ঘোষের কবিতা, শান্তি সিংহ(সম্পাদনা), শঙ্খ ঘোষ, দিয়া পাবলিকেশন, প্রথম প্রকাশ, পৃষ্ঠা-১৫৯
* ছবিগুলি গুগল থেকে সংগৃহীত। এই অসাধারণ মুহূর্তগুলি যারা ক্যামেরা বন্দি করেছেন তাঁদের কাছে আমরা আন্তরিক ভাবে ঋণী।