উ ই ন্ডো সি ট
একটা বড় ফাঁকা, দরজা, যার ভেতর থেকে অনেক কিছু যাতায়াত করতে পারবে। চার দেওয়ালের মধ্যে আবার দুটো অর্ধেক ফুটো, জানালা বলে ডাকি। সেখান থেকে কিছু জিনিস যাওয়া-আসা করতে পারে। আবার ঠিক ছাদের কাছাকাছি দুটো চারটে ছোট ছোট ফাঁকা… ঘুলঘুলি বলে ডাকা যায়।
এরপর মনসিঁড়ি ঠেলে ঠেলে উঠিয়ে নেওয়া ওপরে, চিলেকোঠা। বেরিয়ে গিয়ে আরো ফাঁকা ফাঁকা আকাশ। আমার নেশা লাগে। জানালা দেখবো নাকি বিছানার ওপর টুল রেখে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করব ঘুলঘুলি। এতগুলো ফুটো কেন! একটা দরজার পরেও জানালা, জানালার পরেও ঘুলঘুলি… আশ মেটে না-
হাঁটতে হাঁটতে দেখি বহুতল, বহুতলের গা ঘেঁষে বটগাছের মরা শেকড় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে রয়েছে। একসময় ওর শরীর ছিল পূর্ণতায়, সেই শরীরে বর্ষাকাল আসত, রোদ্দুর আসা-যাওয়া পাখি কিচিরমিচির উড়ে যাওয়া… সেই ভরাট সংসার ছিন্ন করে এখন বহুতল।
বি টি রোড হেঁটে হেঁটে যায় আরো। আমার সাইকেল জুড়ে স্লো মোশন, পিছনের দিকে বয়ে চলেছে মফস্বল…
কিছু দূরে গঙ্গার ঘাট। সংকীর্তনের গুঞ্জন কমে আসে, চিৎকারসম বেজে ওঠে ডিগবাজি ডিগবাজি গান। চায়ের দোকানগুলো উবে গিয়েছে ফাস্টফুড সেন্টারের দাদাগিরিতে।
কোন ফাঁকায় যাবো ভাবতে ভাবতে ফেরিঘাট লোক পারাপার করায়। কে আসছে আর কে যায় টিকিট কোনদিনও সেটা বুঝতে পারে না। হাত থেকে হাত গুটিয়ে গিয়ে চ্যাপ্টা হয়ে পড়ে থাকে হাঁটার রাস্তায়, হাওয়া সেই টিকিটকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। কখনো গঙ্গার জলে, কখনো কোন একা বোকা মানুষের সাইকেলে ক্রিং ক্রিং শব্দ করে এগিয়ে যায়।
সেই টিকিট তোমাকে খোঁজে। এই টিকিটে জাদু আছে। আলাদিনের আশ্চর্য টিকিট হাতে নিয়ে ঘষলেই তুমি পেয়ে যাবে কাঙ্ক্ষিত ডেস্টিনেশন। কিন্তু চলে যাওয়াগুলোর কোনো স্টপেজ নেই। ফলে সাইকেল চলতে থাকে। সবাই ওঠে, গন্তব্য ঠিক করতে না পেরে আবার নেমে যায়।
টিকিট হাতে হেঁটে যাচ্ছ তুমি। টিকিট এক্সপায়ার হওয়ার আগেই তোমাকে নির্দিষ্ট করে নিতে হবে কোথায় যাচ্ছ। একটা জলটানা রাস্তা, রাস্তায় ভরাট মানুষজন… আনন্দ মানুষজন… মশগুল মানুষজন… কোথাও কেউ একা বোকা নেই। এখান থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একসময় আলাদিনের আশ্চর্য টিকিটকে বলি, ‘আমি আমার কাছেই যাবো’-
না, কোন ম্যাজিক ঘটে না। কোথাও কোন ধোঁয়া উঠে পাল্টে যাওয়া দৃশ্য নেই। অনেকটা দূর থেকে পোঁটলাপুঁটলি সমেত কিছু মানুষ হেঁটে আসছে। আবছা দেখা যায় একটা ল্যাংটো ছেলে কচু পাতা মাথায় দিয়ে বৃষ্টি আড়াল করছে। এক মেয়ে ফিঙে পাখির পালকে হাত বোলাতে বোলাতে এগিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু ম্যাজিক গেল কোথায়! টিকিটের ম্যাজিক? আমি যে বললাম আমি আমার কাছেই যাবো, সেই যাওয়াটা হচ্ছে কোথায়?
বিরক্ত হই রাগ উঠে গিয়ে। চারদিকে তাকিয়ে দেখি ফাঁকা… এইতো! এইতো ম্যাজিক হচ্ছে। এবার আমি আমার কাছে যাব।
পায়ের ছোট্ট আঙুলে আচমকা ব্যথা শুরু হল। তাকিয়ে দেখি লাল হয়ে ফুলে রয়েছে। পাশে এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া কেন্নো। সেই ছোটবেলায় বর্ষাকালে জামরুল গাছের নিচ দিয়ে হেঁটে যেতে দেখেছি এই কেন্নোর সংসার। ব্যথা ফেলে হাঁটতে থাকি। কেউ কোথাও নেই, সত্যিই কেউ কোথাও নেই। আমি ধীরে ধীরে প্রস্তুত হচ্ছি সেই ম্যাজিকের। সেই আমার কাছে যাওয়ার। গঙ্গার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়ে একটা নৌকো, জানতে পারি, ওপারে সেই আমার আমি-র সন্ধান রয়েছে। কাদা পেরিয়ে উঠে পড়ি নৌকায়। নৌকোর ভেতরে গিজগিজ করছে পোকামাকড় জীবাণু। আমি জানি এসব সত্যি নয়। আলাদিনের আশ্চর্য টিকিটের খেলা। ফলে, আমি ভয় পাই না।
গলুই ঠেলে ঠেলে চলতে থাকি মাঝনদীতে। এক জীবাণু মুখোমুখি বসে, প্রস্তাব দেয়, ‘পৃথিবী শূন্য হলে তুমি তোমার কাছে পৌঁছতে পারবে’।
আমি হাসি। কেননা আমি জানি এসবই জাদুবাস্তব চলছে। বলি, ‘আমি কিন্তু সাঁতার জানি, নৌকা উল্টে তোমাদের মেরে ফেলে আমি দিব্যি সাঁতরে ওপারে অপেক্ষায় থাকা আমার কাছে চলে যেতে পারবো’-
নৌকোর সমস্ত পোকামাকড় জীবাণু হেসে ওঠে। একটু খটকা লাগে। কারণ ওদের সব হাসির শব্দগুলো আমার কেমন চেনাজানা পৃথিবীর মতোই লাগছে। আমি বারবার নিজেকে বোঝাচ্ছি এটা জাদুবাস্তব, এটা আলাদিনের আশ্চর্য টিকিটের প্রভাব, অন্য কিছু নয়। নৌকোটা উল্টে দিয়ে আমি সাঁতরে ওপারে চলে যাব এমন স্থির করে ফেলে টিকিটটাকে খুব যত্ন করে খুব সামলে পকেটের ভেতরে রেখে নৌকো উল্টে দিতে গিয়ে দেখি, আমি ছাড়া আর সবকিছুই ভ্যানিশ! এবার কিছুটা আতঙ্কিত হই। টিকিটটাকে আরেকবার ঘষে নিই। আলাদিনের আশ্চর্য টিকিটকে বলি, ‘কোনটা সত্যি?’
টিকিট খুব নিচু স্বরে কিছু বলে যায়… কিন্তু বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে যায় সেইসব কথা।
এই নৌকোর সবটাই দরজা সবই জানালা, ঘুলঘুলি, চিলেকোঠা, ছাদ…
আমি কোন ফুটো দিয়ে বেরোবো বুঝতে পারছি না…