Hello Testing

4th Year | 2nd Issue

৩১শে বৈশাখ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 15th May, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

গু চ্ছ  ক বি তা

রে হা ন   কৌ শি ক

হুইস্কিরংয়ের বিকেল এবং অন্যান্য কথা

 

‘শোনো, চিন্তা অন্ধকারের শত্রু। চিন্তা অসত্যের প্রতিপক্ষ। চিন্তা মিথ্যের বিরোধী। অন্ধকার, অসত্য এবং মিথ্যের যোগফল শাসক। শাসক মানেই ক্ষমতা। ক্ষমতা মানেই মারণাস্ত্র। আদিকাল থেকে মারণাস্ত্র তাক করা থাকে চিন্তার দিকে। চিন্তা চিরকাল চাঁদমারি। সুতরাং চিন্তা ও ক্ষমতার পারস্পরিক দ্বন্দ্ব শাশ্বত।

 

সক্রেটিস এই সত্য বুঝত কিন্তু মানত না। প্লেটো, অ্যারিসস্টল, গ্যালিলিও, রুশোও মানত না। রুশদি থেকে তসলিমা— দিন যত যায়, নিষিদ্ধ-তালিকা দীর্ঘতর হয়। গৌরি, কালবুর্গি, দাভোলকারের লাশ পৃথিবীর ছড়ান রাস্তাকে ক্রমশ ভারী করে তোলে।

 

সূর্য কি একাই আলো দেয়? মানুষ দেয় না? চিন্তা থেকে প্রসারিত দ্যুতি সহ্য করার মতো কর্নিয়া তৈরি হয় না ক্ষমতার। ক্ষমতা সেই চতুর শেয়াল, সমস্ত পৃথিবী জুড়ে অন্ধকারের সাধনা করে। চক্ষু-কর্ণ-জিহ্বা ও চিন্তাহীন একটা সংঘের প্রার্থনা করে।

 

এবং শেয়ালের সৌখিন সিংহাসনের অদূরে মাথা নাড়ে বশংবদ গাধারা। রাস্তার বাঁকে-বাঁকে দোলে চিন্তার বিরুদ্ধে হুমকির পরোয়ানা! নতুন চিন্তার প্রতি মৃত্যুর দণ্ডাদেশ!

 

এই সংঘের সম্মুখে কেন থাকব আমি? আমি নির্বাসন চাই। আমি চাই দ্বিতীয় আর-এক গ্রহ। হুইস্কিরংয়ের বিকেলবেলায় আমি গিটার বাজাব স্বাধীন। ডেকে নেব সক্রেটিস থেকে তসলিমা। গৌরি, কালবুর্গি, দাভোলকার আবার কফিমগ নিয়ে আড্ডা দেবে রোদ্দুরে হেলান দিয়ে।’

 

‘ছি! এত কাপুরুষ তুমি? আলবিরুণীর মতো হাঁটো। হিউয়েন সাঙয়ের মতো বেরিয়ে পড়ো পথ থেকে পথের গভীরে। শ্বাপদের বানানো অন্ধকার ভেঙে আলোর দ্যুতিতে ভাসিয়ে দাও মানুষের বুক। মানুষের বুকের ভিতর ঘুমন্ত ঝর্না আছে। সেই জলে ধুয়ে যাবে চিন্তার বিরুদ্ধে গেঁথে রাখা সমস্ত অক্ষর। তবে হ্যাঁ, যদি সত্যিই তুমি কখনো ভালোবেসে থাকো আমাকে, পৃথিবীকে।’

pujo_16_sketch2

 

মৃত্যুর দেহ কি সুগন্ধে ভাসে? বাঁশি শোনে ঝর্নাজলে? অনন্তের ঘুঙুর শুনে নৃত্যের কী কী মুদ্রা গ’ড়ে তোলে মৃত্যুশরীর? সমস্ত জানাও, সমস্ত।

 

কেউ-কেউ চায় খরা আর খিদে নিয়ে বসে থাকুক বাঁকুড়ার মাঠ। পলাশের রং ফিকে হোক পুরুলিয়ার জঙ্গলে। টের পাই— আশ্চর্য এক শঙ্খচূড় হাঁ করে বিষদাঁত ফুটিয়ে রেখেছে আমার খুলিতে।

 

দাবির চিৎকার নিষিদ্ধ আছে এই দেশে, এই রাজ্যপাটে। সুতরাং প্রজাদের ঠোঁটে ভালো থাকবার গল্প। তাদের উন্মাদমাদল শুনে বকশিস দেয় বিদেশি-পর্যটক।

 

স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ছড়ানো লিফলেট নয়, এই লালমাটি জানে— অস্থির স্পন্দন। কাতর কলস জানে— জলহীন-শস্যহীন মানুষের প্রকৃত বিলাপ। জেনেছি আমিও। শবরবালিকা, তুমি চেনো মৃত্যুদেশ। বনান্তরে ছড়িয়ে থাকা তোমার সফেদ-হাড়ের গুচ্ছ শ্বাসরুদ্ধ সময়ের লিপি।

 

চিৎকার যখন করিনি, তূণ উজাড় করে আমার সমস্ত শর যখন উড়ে যায়নি শাসকের দিকে, জেনো— আমিই তোমার হত্যাকারী।

pujo_16_sketch2

 

এমন নয় যে বর্ষাঋতু ডানা ঝাপটে তোলপাড় করছে সমস্ত আকাশ। এমন নয় যে শুদ্ধ-শ্রাবণ ধ্যানে বসেছে খোলামাঠে। তবু বৃষ্টি পড়ে। অধিকাংশ রাতের বৃষ্টিই যেন নাৎসি-চর, ঘিরে ফেলে সমগ্র আমাকে। আমি তো ইহুদি নই। সোভিয়েত স্পাইও নই। সামান্য প্রেমিক। হুইস্কিরংয়ের বিকেলবেলায় প্রেমিকাকে বেহালা শোনাবে বলে যে আজও নাছোড়বান্দা জেদ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় পাহাড়-নদী ও জঙ্গলে।

 

কান্নার কথাকলি নাচে। বিষাদ-বিহঙ্গ ওড়ে। বিপরীতে দুরন্ত পলাশ দোলে একাকী পাঁজরে। তাড়া-করা এই বৃষ্টি থেকে কোথায় পালাব এখন? কে দেবে আশ্রয়ের অভ্রান্ত করতল? আমি আর কতদিন বাঁচব এইসব ভয়, অন্ধকার ও ধ্বংসের ফণা থেকে?

 

আমি বাসে উঠি। ফিলটারহীন সিগারেট ঠোঁটে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি শূন্য-প্রান্তরে। গোঁয়ার জুয়াড়ির মতো সাদা ক্যানভাসে আঁকতে থাকি সহস্র রেখা, যদি কেউ জীবন্ত হয়! যদি কেউ জেগে ওঠে সম্মুখে একবার!

 

সমস্ত বিফলে গেছে। শুধুমাত্র বৃষ্টি আসে। ঘিরে রাখে অবিশ্বাসী চোখে।

pujo_16_sketch2

 

দরজা, জানালা নয়। দেয়াল ভেঙেছি। এসো, হাওয়া, এসো। যে-সমস্ত চাবুকচিহ্ন রেখে গেছে অটোমান দলপতি, মিশরের ফ্যারাও, রোমান সম্রাট, আজ জন্ম থেকে জন্মান্তরের সেইসব ক্ষত মুছে দাও প্রগাঢ় চুম্বনে। নিরেট বছরগুলো গড়িয়ে গিয়েছে, আর বয়স বেড়েছে কেবল একাকী রক্তের। দু’হাতে ঝাঁপানো বলতে যা বোঝায়, সেরকম জীবন দেখেনি এই-সমস্ত বেঁচে-থাকা। গোনাগুনতির দিন টানাটানি করে বসেছিল পরাধীন ঘরে।

 

বাঁশি! বাঁশি বাজবে আমাদের বুকে? শুকনো শাখার শিরায় ফিরবে প্রকৃত ফাল্গুন? বসন্তের আভা? দস্তখত করো। দস্তখত ক’রে নিশ্চিন্ত করো কাঙাল-আমাকে।

 

হ্যারিকেনের দম বাড়াব মুগ্ধ হাতে। দেখে নেব স্পষ্টতর মুখ। নির্ভয়ে ছুঁয়ে থাকব আশ্রয়-আঙুল। ধীবর-ধমনী জুড়ে ফিরুক মাছের মোহ, আশ্লেষ-ধ্বনি।

 

হাওয়া, এই সুসময় এই সঙ্গমকাল এত দেরি ক’রে এনে দিলে!

pic333

 

ধুলোর ঢোলক হয়ে বেজে ওঠে প্রথম চুম্বন। রেখায়-রেখায় কেঁপে ওঠে বিদ্যুৎ-কণা। পুনরায় ডাক দেয় অশ্বারোহণ। তুমি কি ক্লান্ত খুব? পঠিত-পুস্তক হ’য়ে সরে গেছ বাতিল-বইয়ের র‌্যাকে? আমি তা মানি না।

 

বসন্ত চিরকাল পরাগ ওড়ায়। হাওয়ায় ভাসিয়ে দেয় পালকের চিঠি। এই হাত ছুঁয়ে দাঁড়াও আবার। দুলে উঠবে আমলকীর বন বিকেলের হলুদ আভায়। মেরিলিন মনরোর সাহসী সিল্যুয়েট দেখা দেবে সন্ধের মায়াবী ফ্রেমে।

 

জেনো— তুমি ও আমি নির্ভর এই গ্রহ। প্রাণ-সংকলন। আমাদের স্বরলিপি পিঠে নিয়েই এই পৃথিবী টক্কর দেয় মহাশূন্যে। অনন্তের দেশে। সুতরাং আমাদের নিভে যাওয়া বেমানান।

 

ধুলোর ঢোলক বাজুক। রোমাঞ্চিত বিদ্যুৎ জাগিয়ে তুলুক অন্যান্য গ্রহ ও নক্ষত্রদেশ।

pujo_16_sketch2

 

চেয়েছিলে— দুরন্ত দুপ্লেক্স। সেগুনের ফ্লোর। গহনার ধাতব-শব্দে ভারী হোক দক্ষিণের হাওয়া। বস্তুত, চেয়েছিলে— ছায়া। গাঢ়তর ছায়া। হুডিনির মায়াবী বিভ্রম। ফলত, তুমি কি আর মনে রাখবে আমার অক্ষর? ছন্দের গায়ে রোদ লেগে যে-বিকেল নেমে আসে আমার ভিতর?

 

বাতাসে স্পর্ধার কেশর উড়িয়ে সবাই কি প্রথম হতে পারে রেসকোর্সের মাঠে? আমি তা চাইওনি কোনোদিন। আমি সেই নক্ষত্রদেহ— যার করুণ আলো আর ছাই সমান-সমান। ব্রাজিলের ক্যাফে যখন বৃদ্ধ অশ্বের মতো একাকী ও নির্জন, পাওলো কোহেলোর পাণ্ডুলিপি নিয়ে মুখোমুখি কথা বলি দুপুরের রোদে। পিকাসোর কিউবিজমের ধাঁধায় অন্ধ-পতঙ্গ মতো উড়ে যাই রাত্রি নেমে এলে।

 

কারও জন্য কোনো ব্যারিকেড রাখিনি কোথাও। খোলা-পথ পড়ে আছে, যাও। রাস্তার ধুলোয় লিখিনি কোনো নিষেধের পরোয়ানা। বরং তাকিয়ে দেখো— দূরে যাওয়ার সমস্ত পথের ভিতর জাগিয়ে রেখেছি সবুজ-সিগন্যাল। আসার মতো যাওয়াও যেন সুগন্ধ ছড়ায়, মায়াজ্যোৎস্নার দাগ রাখে গোপন পাঁজরে। অনর্থক বিতর্ক থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি দীর্ঘ অভ্যেসে।

 

অপেরার কীরকম দৃশ্য তোমাকে নদী ক’রে তোলে, সমুদ্রস্নানের পর লবণাক্ত দেহ কীভাবে শুকোবে ব’লে মনস্থির করেছ আগামী বসন্তে— চাইলে, জানাতে পারো।

 

পৃথিবীর সমস্ত খোলামাঠ আমার ঘর। হাওয়ার তরঙ্গ ই-মেল অ্যাড্রেস। আমি থাকব, কোথাও-না-কোথাও।

আরও পড়ুন...