গ ল্প
এই যে তোমার ছোট্ট মেয়ের জন্য, বার্থডে কেক কিনে নিয়ে বাড়ি যাচ্ছ তুমি, এইমাত্র সিগারেট ধরিয়ে আবার গুনগুন করে গানও গাইলে একবার!
একা একাই মুচকি হাসছো, ঘাড় দোলাচ্ছো, অথচ জানোই না, তুমি আজকেই মরে যাবে, চৌমাথায়! গড়িয়ার আগের মোড়ে, থেঁতলে পড়ে থাকবে দেহটা, কেক রক্তে মাখামাখি! ডান হাতটা উল্টে বাঁ দিকে, পায়ের জায়গায় মাংসপিন্ড, যেন নিজেই নিজের শেষ সিগারেট! আর সেই সময়, আমিই তোমায় রাস্তা থেকে ভিড়ের মধ্যে, মানে ঘিরে আসা জনতার মধ্যে থেকে ডাকবো, খু-উ-ব ডাকবো- “রণোওওওও ফিরে আ য়…”
সেই ডাক কেউ শুনতে পাবেনা। অ্যাম্বুলেন্স ক্যাকাফোনি, পুলিশ, স্পেকুলেশান, নোটবুক, মোবাইল, ক্রেডিট কার্ড, পার্স, ডাঁটি ভাঙা চশমা, অবশেষে হাসপাতাল।
চোখে টর্চ, বুকে স্টেথো, তারপর বরফ-ঠাণ্ডা মর্গ। তুমি পৌঁছে গেলে।
মানে আমি পৌঁছে দিলাম তোমায়! এবার বাকিদের পালা। সত্যি! কী কাণ্ড বলো তো ! কান্না পাচ্ছে আমার !
এই যে তোমার বাড়িতে, এই মাত্র খবরটা পৌঁছে গেল দাবানলের মতো, ‘মৌমিতা ম্যাডাম’ – তোমার বউ, এইমাত্র মুখে চামচ দিয়ে অজ্ঞান !
ওর জিভ যাতে না কেটে যায়, তাই চামচ দিচ্ছে বাচ্চু, তোমাদের সবসময়ের কাজের লোক ! মৌমিতা পরে আছে শিফন শাড়ি, গতবার বিবাহবার্ষিকীতে তোমার দেওয়া!
তোমার ডান চোখের ওপর জমা রক্তের ড্যালাটা! একদম ঐ কালারের !
মনে নেই? সেই শিফন জর্জেটটা, তোমার লাস্ট ক্লায়েন্টের পার্টিং গিফট!
অথচ মৌমিতা জানলো তুমি দিলে! যেমন গলার মব চেন, হাতের ব্রেসলেটে প্লাটিনামে এম লেখা আসলে মিত্রার নামে, ও জানেও না! মিত্রাও কি…
নাঃ ! এসকর্ট সার্ভিস করা, তোমার চোখা-ছিপছিপে চাবুক গার্লফ্রেন্ড অজ্ঞান হবে না। চামচ, মাই ফুট ! যত্নে মাসকারা বাঁচিয়ে চোখ মুছে নেবে।
যাক সে কথা। তোমার রোলার কোস্টার বাদামী টাভেরা, চার তলার সাজানো ফ্ল্যাট, শার্প পয়েন্ট হাউস কলেজ, রাজারহাটের জমিটা, সব কী হবে বলো তো !
এই রে! টায়রা এসেছে, তোমার ‘বনি’! তোমার প্রাণ! আজ ওর পাঁচ বছরের জন্মদিন না! ইসস ! এ সব আমার একটুও ভাল্লাগেনা। তবু …
কী সুন্দর জামা পরেছে টায়রা! টার্কোয়েজ ব্লু-টা ওকে হেভি মানায় ! গালগুলো ফুলোফুলো গোলাপের পাপড়ির মতো পিঙ্ক! বেবি পিঙ্ক! ও ছুটতে ছুটতে আসছে, হাতে একটা মস্ত পুতুল ! ওর মা’কে ঘিরে রেখেছে ফ্ল্যাটের মহিলারা। ও কিছুই বুঝতে পারছেনা! ওর যে হ্যাপি বার্থডে হবে আজ! বাবি কেন এখনো আসছেনা! এই যে, আসছে বলেছিল! সবচেয়ে বড় কেকটা নিয়ে! সারা ঘর টিনসেল আলোয় ঝলমল করছে! হোম থিয়েটারে বাজছে বার্থডের গান! কি সুন্দর তোমার ফ্ল্যাট! আজ দেখছি। দরজার বাইরে থেকে তেমন বোঝা যায়না, আজ ভিতরে এলাম। সুস্বাদু খাবারের গন্ধে ম ম করছে একেবারে ! উঃ ! টায়রার গভর্নেস কিন্তু দারুণ এক্সপার্ট ! আর ধারালো সুন্দরীও বটে! তুমি মাঝে মাঝে বুক, কোমর, তলপেট চাইলে আপত্তি করতো না ! তারপর যেদিন বেশি চেয়েছিলেন! হাজার হোক, মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে তো! আর পারেনি। তোমাকে থাপ্পড় মেরেছিল।
কী করে জানলাম? আরে, মনিকা-কে আমি ক্লাস টেন থেকে চিনি। আমাদের প্রেম ছিল আর তারপর বিয়ে, যাকে বলে লাভ ম্যারেজ !
মৌমিতা, তোমার বউ, সেদিন কিটি পার্টির নামে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ছিলো। তুমি জানতে না। উত্তর কোলকাতার ফ্ল্যাটে কী হয় দক্ষিণ জানেনা। যেমন, কেউ জানেনা, এখন মাকে ওরকম দেখে , ভিড় আর ব্যস্ততার মধ্যে পুলিশকে ঢুকতে দেখে, বনি- তোমার টায়রা, সবার অলক্ষ্যে ছাদে লুকোতে যাবে। আর ছাদে জলের ট্যাঙ্কের আড়ালে লুকোতে গিয়ে, পাইপে ধাক্কা খেয়ে, কার্নিশে পা পিছলে- এক্কেবারে নিচে ! তোমাদের পাঁচতলা অ্যাপার্টমেন্টের লেনের রাস্তায়! নীল একটা ফুলের মতো ! এলইডি আলোয় দারুণ লাগে টার্কোয়েজ ব্লু ! তাই না! শুধু মাথার ডানদিকে থেঁতলে গিয়ে একটু রক্ত চুঁইয়ে যাচ্ছে, গাঢ় কালচে লাল রক্ত! ঠিক আমার শর্মীর মতো!
শর্মীর অবশ্য সাত বছরের জন্মদিন ছিলো। ছাপোষা, পায়েস আর শঙ্খ বাজানো জন্মদিন। আমাদের যেমন হয় আর কি।
যাক, এদিকে কাজ মিটে গেছে। আমি এবার যাবো, মৌমিতার কাছে।
বাচ্চাদের কষ্ট আমি একদম সহ্য করতে পারিনা। টায়রা তোমার জন্য কাঁদবেনা। মৌমিতা এখন একটু সামলেছে। মনিকা ওকে গরম চা খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। ও খাবে না। বমি করবে আমি জানি। বাথরুমে গিয়ে, মোবাইল থেকে প্রেমিকের চ্যাট ডিলিট করবে। পুলিশ মোবাইল চাইতে পারে।
মনিকা আজকাল বেশ সফিস্টিকেটেড। বেশ চোখা। সেদিনের পর, তোমার আদরে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলো ক্রমশ। ওর পারফিউমের গন্ধ আমি তোমার ঘরে পেয়েছি। আর তোমার সিগারেটের গন্ধ, আমার বিছানায়। আমার ঘুমিয়ে পড়া বউ-এর গায়ে ! বিয়েটা ভেঙে যাচ্ছিল… মনিকা, আমাকে দেখেনি। আমি ওর খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছি। ও চোখ মুছতে মুছতে, বৌদির, মানে মৌমিতার আলমারি খুলে লকার থেকে টাকা সরাচ্ছে! এখন লাগবে ওর। তুমি নেই আর টায়রাও…
নিচে, টায়রার ছোট্ট শরীরটা এখনো কেউ দেখেনি। আমি বেরোব এবার। মৌমিতা এখন থাক। ওকে সবাই মিলে তোমার বডি আইডেন্টিফাই করাতে নিয়ে যাবে কিছুক্ষণ পর। পুলিশ তোমার পার্স, মোবাইল সব দিয়ে গেছে । মৌমিতা কার্ড গুনছে।
আমি এবার টোয়েন্টিফোর এ মুর এভিনিউ যাবো। রাজু ভার্গবের ফ্ল্যাট। তোমার রাইভ্যাল। তোমার বউ-এর প্রেমিক। অবাক হচ্ছো !
রাজু, প্রচুর মদ খেয়েছে এখন। আর ঘামছে। প্ল্যানটা ও করেছিলো। ও আর মৌমিতা ! বাচ্চুকে টাকা খাইয়ে, তোমার গাড়ির ব্রেক খারাপ করে রেখেছিল আজ। আমি তো শুধু সামনে দাঁড়িয়ে উইন্ডস্ক্রীনে মুখ চেপে ডেকেছিলাম !
আচ্ছা ! তুমি কখনো ভাবোনি টায়রা এতো ফর্সা হলো কী করে ! তোমাদের দু’জনের রঙ তো শ্যামলা! আসলে ইনফার্টিলিটি ক্লিনিক চালাতে গিয়ে এসব ভুলেই গিয়েছিলে তাই না ! রাজু টায়রাকে নিয়ে মৌমিতাকে চাপ দিয়েছিল। মৌমিতা তোমার লাস্ট প্রমোশনটার দায় মেটাতে, প্রথম ওর কাছে গিয়েছিল। মনে পড়ে? কী যেন বলো তোমরা! ওয়াইফ সোয়াপিং ! রাজুর বউ তোমাদের বসের কেপ্ট। তুমি ঢেঁকি গিললে ! প্রমোশন ! রাজু ভয় পাচ্ছে। বাচ্চু যদি মুখ খোলে! গাড়িটা পুলিশ নিয়ে গেছে। ও বারবার ইনহেলার নিচ্ছে। ডিম লাইটে ওকে অদ্ভুত লাগছে আজ। দরদর করে ঘামছে এই শীতে। মৌমিতার ফোন বাজছে, ধরছে না। রাজু, টলমল করে উঠে বাথরুমে যাবে। আমি ওখানেই… হেড ইনজুরি। কেউ জানতেও পারবে না। মুখটা কমোডে ঢুকে গেছে।
বাইরে বেরোলেই, নির্লিপ্ত কোলকাতা ! ঠিক সেদিনের মতো। বেশ হালকা লাগছে আজ। আগে হলে মদ খেতাম। এখন তো আর…
তোমার ক্লিনিকে, যখন টেকনিশিয়ান কোর্স করে জয়েন করি, তখন কত আর বয়স আমার ! দিনরাত খাটতাম তোমার ব্যবসায়। আগে ধারণা ছিলনা এত লোক ইনফার্টিলিটিতে ভুগছে ! আস্তে আস্তে ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠলো। সঙ্গে তুমিও। তোমার শার্টের ব্র্যাণ্ড, ফ্ল্যাটের ঠিকানা বদলালো। উইকলি গার্লফ্রেন্ডের মতো।
তখনো আমাকে নিয়ে আমাকে মাঝে মাঝে ড্রাইভে যেতে রাতে। বলতে, ইনক্রিমেন্টের গল্প। আমিও, আমার ছাপোষা মূল্যবোধ ট্যাঁকে গুঁজে ঘুরে দাঁড়াতে শিখেছিলাম। হাজার হোক, স্কুলের ক্লাসমেট ! আমাদের স্পার্ম ব্যাঙ্ক, সারোগেসি, আর পুত্র সন্তানের জন্ম নিশ্চিত করার গোপন পদ্ধতি, খেল দেখাচ্ছিল। শহরে আমরা তখন এক নম্বর। ঠিক তখন, তুমি আমাকেই অবিশ্বাস করলে ডাক্তার ! ‘লিটল এঞ্জেল’ আমাকে দ্বিগুণ অফার দিচ্ছিল, তোমার নো হাউ-এর জন্য।
আর তুমি সেটা জানতে পেরে আমাকেই… আমাকে পিষে দিয়ে, তোমার ক্লায়েন্টের ম্যাটাডোর যখন ডায়মন্ডহারবারের রাস্তায় অনেক দূর, সেদিন আমার শর্মীর জন্মদিন ছিল!
মনিকা তখনো তোমার বাড়িতে পার্টি সামলাচ্ছে। ও অবশ্য তার আগেই সরে গিয়েছিল আমাদের কাছ থেকে ! ঠিক এক সপ্তাহ আগে আমি তোমাকে বলতে গিয়েছিলাম ওর ব্যাপারে। ভেবেছিলাম অফারটা নিয়ে, তোমার থাবার থেকে ওকে ছিনিয়ে আনবো আমি। কথাটা ওকে বলতে গিয়ে বুঝলাম, দেরি হয়ে গেছে। তোমাকে চড় মারার দিন ওর পাশে দাঁড়াতে পারিনি, আর্থিক অক্ষমতায়! এখন ও আর আমার পাশে নেই! শর্মী এ সব জানতো না। আমার খবরটা টিভিতে দেখে ও। পাগলের মতো ছুটে বাড়ি থেকে বেরোতে গিয়ে বাসের ধাক্কায়…
ভার্গব আমায় অফারটা দিয়েছিল। ওর প্রোজেক্ট ছিলো। বম্বে থেকে ডক্টর আনতো। অথচ ভার্গবকে কেন মারলাম! জানি না! ভাবতে ভাবতে আবার তোমার ফ্ল্যাটে পৌঁছে গেছি। এতক্ষণে টায়রার বডি নিয়ে গেছে পুলিশ। এবার আমি মনিকার জন্য এসেছি। ঐ তো ও ! একা ফ্ল্যাটের বারান্দায়। মৌমিতাকে সবাই নার্সিং হোমে ভর্তি করাতে নিয়ে গেছে ।
মনিকা, আমি আসছি। আর বেশিক্ষণ নয়। মনিকার পিছনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ কী হলো আমার! ওর উন্মুক্ত কোমরে হাত রাখতে ইচ্ছে করছে আমার! পারছিনা। ও কাঁদছে। আর দেরি নয়। ওর কন্ঠনালীর ওপর আমার আঙুলগুলো চেপে বসার আগে, হঠাৎ মনে হলো- রাজু ভার্গবকে কে মারলো! আমি, না তুমি! তাহলে, মনিকাকে ছোঁয়ার ইচ্ছেটাও কি তোমার! শুনতে পাচ্ছ? তুমি কি আমার মধ্যে প্রবেশ করছো?
পরিশিষ্ট
মিডিয়া হাউসের ব্যস্ততা সত্ত্বেও ব্যাপারটা শানের নজর এড়ায়নি। সুসিকে হাফ টাইমে ফোন করলো ও।
“হাই! আজকের ‘শুভ কালের’ কাভারেজটা দেখেছিস কি !”
“কেন বল তো ?”
“তোদের ফ্ল্যাটের কেসটা। দেখিস !”
ফোনটা কেটে দিল শান ।
রাতে বাড়ি ফিরে শুভ সকালের পাতায় চোখ রাখলো সুসি ।
ওদের ফ্ল্যাটের ডঃ সেনের ঘটনাটা আজ সাতদিন হলো। খুব চাঞ্চল্যকর কাভারেজ দিয়েছে সবাই। আর একই দিনে, ওনার রাইভাল হাউজের সেই লোকটার রহস্যজনক মৃত্যু। আরো চাঞ্চল্যকর খবরটা রয়েছে সেকেন্ড পেজের ডান দিকে। পুলিশ নাকি এই অ্যাকসিডেন্টের অদ্ভুত মিল পেয়েছে দেড় বছর আগে একইভাবে গড়িয়াহাটের মোড়ে পিষে যাওয়া, ডঃ সেনের টেকনোলজিস্ট কাম ডান হাত, ক্লিনিক ম্যানেজার সুনির্মল দত্তের সঙ্গে! আর, ডঃ সেনের মৃত্যুর তিনদিন পর যে মহিলার শরীর ওঁর বারান্দায় পাওয়া যায় নগ্ন অবস্থায়, তাকে মিসেস সেন আইডেনটিফাই করেছেন ওঁর মেয়ের গভর্নেস মনিকা দত্ত বলে। ঘটনাচক্রে এই মনিকা ছিলেন সুনির্মলের স্ত্রী।
শোনা যায় দু’জনের সম্পর্ক ভালো ছিল না।