ধা রা বা হি ক | পর্ব ১০
“…কণার বিয়ের সময় আমি কলকাতাতেই ছিলাম, তুমি জানতে না! আগে বন্ধুদের পারিবারিক, ব্যক্তিগত বহু ব্যাপারে আমার কিঞ্চিৎ অংশীদারিত্ব ছিলো সেটাও বোধহয় এতদিনে গেছে।…”
ওপরে উল্লিখিত চিঠিটির এই অংশে এক ধরনের অভিমানের বাষ্প বাতাসে ভেসে থাকতে দেখা যায়। স্বাভাবিকভাবেই প্রকৃত কবিদেরই এমন অভিমান মানায়। ১৯৬৫ সালে তারাপদ রায় চিঠিটি লিখেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সুনীলদার বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত না-হওয়ার অভিমান স্পষ্ট ছিল তারাপদদার এই চিঠিতে। হয়তো অনিচ্ছাকৃত এই সামান্য বিচ্যুতি থেকে এক অভিমানের পাহাড় মাথা উঁচু করে উঁকি দিয়েছিল সেদিন। অথচ পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে দু’জনের পারস্পরিক অপরিসীম টান লক্ষ্য করার জন্য কখনোই আমাকে একদেশদর্শীর চশমা পরতে হয়নি।
আসলে এইসব মান-অভিমানের ব্যাপারগুলো ব্যক্তিগত চিঠিপত্রেই স্পষ্ট হয় সাধারণত। মুখোমুখি যদিও বা তর্ক-বিতর্কের আগুন জ্বলতে পারে ঘনঘন, কিন্তু অভিমান গোপন জায়গা থেকে প্রকাশ্যে আসে না সচরাচর। মনে হয়, অভিমান এমনই এক আশ্চর্য বস্তু যে সযত্নে লালন করেই মানসিক তৃপ্তি পাওয়া যায় ঢের। যা কখনো সখনো শুধুমাত্র চিঠির মাধ্যমেই প্রকাশ্যে আসে। অগ্রজ কবি-সাহিত্যিকদের লেখা প্রকাশিত চিঠিপত্রের ঝাঁপি খুললেই স্পষ্ট হয়। কখনো রবীন্দ্রনাথ, কখনো বা জীবনানন্দ, বা আরো পরে শক্তি-সন্দীপন-শরৎকুমার প্রমুখের চিঠিপত্রে বাষ্পায়িত অভিমানের কণা ভাসতে দেখা যায়।
একবার সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় উত্তরপ্রদেশ থেকে ১৯৬৪ সালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে একটা চিঠি লিখেছিলেন। তার শুরুটা ছিল এরকম,
“প্রিয় সুনীল, এখানে এসেই ৯/১০ তারিখে আপনাকে একটা inland দিয়েছিলাম, আশা করছি পাননি। পেয়ে থাকলে এতদিনে আমার একটা উত্তর পাবার কথা। কিংবা আমি মিথ্যা কথা বলছি। আমি মিথ্যাবাদী। বোধহয় ঠিকানা শুধু ৩২ লিখেছিলাম।
৩ সপ্তাহের বেশি এখানে কেটে গেল। কলকাতায় কেউ আমার অনুপস্থিতি feel করে না। যখন আমার টিবি হয়েছিল বলে মনে করা হয়েছিল ও ১ মাস বাড়িতে বসেছিলাম, তারপর মনে আছে কফি হাউসে প্রথম দিন যখন যাই শরৎবাবু বলেছিলেন কী মশাই আমরা তো ভাবছিলাম joint একটা চিঠি দেব সবাই সই করে। শরৎবাবুর কন্ঠস্বর ও বলার ভঙ্গি আজো সেইরকম আছে।…”
আমি শিলঙে থাকাকালীন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় সবচেয়ে বেশি, মোট ৪ বার গিয়েছিলেন। তার মধ্যে একবার রীনা বৌদি ও মেয়ে তৃণাকে নিয়েও৷ তো প্রথমবার, ১৯৭৭ সালের এক শীতকালীন পাহাড়ি সন্ধ্যায় হঠাৎই খুঁজে খুঁজে আমার বাড়ি এসে পৌঁছোলেন সন্দীপনদা। সঙ্গে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি সচিব, কবি পার্থসারথি চৌধুরী। পরদিন সকালে আমার সঙ্গেই আমার অফিসে যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। তখন শিলং থেকে কলকাতায় টেলিফোনে যোগাযোগ করাটা তত সহজসাধ্য ছিল না। তবে আমার অফিসের ঘরে এরকম যোগাযোগের ব্যবস্থা থাকত। সেদিন ওঁরা দু’জন যে যাঁর বাড়ির সঙ্গে জরুরি কথাবার্তা সেরে, সন্দীপনদা বললেন, ‘শংকর, একবার সুনীলের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দাও, কথা বলব।’
মনে আছে, সেদিন কোনো অভিমানের কথা নয়, বলেছিলেন, ‘সুনীল, আজ ভোরে শংকরের বাড়ির জানলা দিয়ে পাহাড়ের গায়ে সূর্যের অমায়িক আলো ছড়িয়ে পড়তে দেখলাম। তারপর, এক সুন্দরী পাহাড়ি কন্যা এলো শংকরের বাড়ির কাজ করতে। আপনি সঙ্গে থাকলে খুব ভালো হতো। খুব মিস্ করছি আপনাকে।’
পরে সুনীলদা আমার সঙ্গেও কথা বলতে চাইলেন। আমাকে বললেন, ‘তোমার তো নিশ্চয়ই মন খারাপ থাকবে না, বেশ মজা এখন। ক’দিন তোমার হইহুল্লোড় করে কাটবে।’ তাঁদের সম্পর্কের মধ্যে মলিনতা খুঁজে পাইনি সেদিন। অথচ কবিদের অভিমান মলিন জামা গায়েই ঘুরে বেড়ায় সর্বত্র।
১৯৮৪ সালের ৫ নভেম্বর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় আমাকে যে দীর্ঘ চিঠিটি লিখেছিলেন, তার প্রথমাংশটা এরকম-
“প্রিয় শংকর,
তুমি, কৃষ্ণা ও তুতান আমার উষ্ণ ভালোবাসা নেবে। শিলঙে গেলে তোমাদের জন্য যাই এবং আবার ঐ জন্যই যাব। তোমাদের সৌন্দর্য দেখতে। তুতানকে খুব মনে পড়ে। আজকাল-এর গল্পটি তোমার ও অভীকের ভাল লেগেছে জেনে সুখী হলাম। তোমাদের মত গুণগ্রাহী আছে, তাই আজও লেখা। কৃষ্ণার কেমন লাগল? ‘তবে, জয়ন্তী সম্পর্কে এত গল্প বলার প্রয়োজন ছিল কি?’ তুমি লিখেছ। জানি না, কী বলতে চেয়েছ। আসলে, উপন্যাসটি তত ভালো লাগেনি, এই তো? আমি কিন্তু জানি উপন্যাসটা ভালো হয়েছে। আমি বলতে আমার হাড়, মাংস ও যৎসামান্য পেশী। সামর্থ্যের বেশি ওজন ঐখানে আমি তাদের তুলে ধরতে বাধ্য করি। যাই হোক। লেখবার ছিল, লিখেছি। লেখাও শেষ হয়েছে, হাতটাত ধুয়ে নিয়েছি। মনে হয় আর কখনো লিখব না। আর মানে হয় না লেখার। যদি কিছু লেখার ছিল, এতদিনে নিশ্চয়ই লিখেছি। নইলে ও আর হবার নয়।…”
লেখালেখি নিয়ে এরকম তর্কবিতর্ক সন্দীপনদার সঙ্গে এর আগেও হয়েছে। আমার সৌভাগ্য যে, সেই সুযোগ ও স্পেসটুকু তিনি দিতেন আমাকে। আর তাঁকে অভিমানাহত হতেও দেখেছি বিভিন্ন সময়ে।
১৯৮৫ সালে এপ্রিলের ৩ তারিখ সন্দীপনদা আরেকটি চিঠির শেষভাগে আমাকে লেখেন, “… কলকাতায় সেই এলে, আমাদের বাড়ি এলে না। থাকলে না। আসলে কলকাতাতেই আমরা সকলে সকলের চেয়ে দূরে থাকি।
তোমাদের বাড়ি থেকে দেখা যেত পাহাড়ের গায়ে একটি পরিত্যক্ত প্রতিমা, খুব মনে পড়ে। যখনই চিঠি লিখি কারুকে, মনে হয় এই বুঝি শেষ চিঠি। তাই কদাচিৎ লিখি। অশেষ প্রীতিসহ সন্দীপনদা।”
সুতরাং পুরনো চিঠির ঝাঁপি খুললে শুধু ইতিহাসের স্পর্শই পাওয়া যায় না, এখনো কোথাও কোথাও মান-অভিমানের হাল্কা আবেশও টের পাওয়া যায়। ফলে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ওঁদের আরো কাছাকাছি আমি পৌঁছতে পারি।
* ক্রমশ