Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

বি শে ষ  র চ না  | পর্ব ৮

শং ক র   চ ক্র ব র্তী

বাংলা কবিতার আলো আঁধারি 

বিদ্বিষ্ট কবি

আমার লেখালেখির প্রথম দিকে, ৪০-৫০ বছর আগের কথা। পঞ্চাশের এক প্রয়াত কবি-সম্পাদকের চিঠি পেতাম প্রায়ই। প্রবাস– জীবনে সেইসব চিঠি বিদ্যুৎচমকের মতো এক ঝলক উন্মুক্ত বাতাস বয়ে নিয়ে আসত যেন। চিঠিগুলো পড়তে পড়তে শেষ লাইনের অমোঘ বাক্যটির জন্য অপেক্ষায় থাকতাম তখন। তাতে সাধারণত লেখা থাকত, ‘অনেকদিন লেখা পাঠাওনি। ৩-৪টি কবিতা পাঠিয়ে দিও দ্রুত।’ হ্যাঁ, যথেষ্ট আন্তরিকভাবেই লেখা সেইসব বাক্য। এত ব্যস্ততার মধ্যেও কীভাবে যে মনে রাখতেন এসব- এখনও ভেবে অবাক হই। আমার মতন যাঁরা কলকাতা থেকে বহু দূরে অভিমান জমিয়ে পর্বত বানাতেন- তাঁদের কাছে এরকম চিঠির মূল্য অপরিসীম। আবার এও জানি, অনেক কবিই এরকম সুখের ভাগীদার হতে পারেননি। বঞ্চিত হতেন। তাঁদের সেই তরুণ বয়সের দুঃখ, মান-অভিমানকেও ছুঁতে পারতাম তখন। এখনও পারি। তবে কি এখনও সেই ধারা অব্যাহত?

যাঁরা কোনো সম্মেলন বা উৎসবের আয়োজক বা পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের কাছে এইসব দায়িত্ব যেন যুগপৎ আনন্দ ও শোকের কারণ হয়। স্বাভাবিকভাবেই এই ধরনের কাজ সার্বিকভাবে কাউকেই খুশি করতে পারে না। না করার কারণও যথেষ্ট। যেমন মনে আছে, একবার দুই গুরুত্বপূর্ণ কবিবন্ধুর মধ্যে একজন কোনো এক কবিতা উৎসবে আমন্ত্রিত হওয়ার পর, অন্যজন সে সুযোগ না পেয়ে তাঁর কাছে ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গমের সহায়ক হল না। ন্যায্য কারণেই তিনি দুঃখিত। এবং পরে তিনি জানতে পেরে নিশ্চিন্ত হন যে, আমন্ত্রণ পাওয়া তাঁর বন্ধুটি ওই উৎসবের অন্যতম উদ্যোক্তার অত্যন্ত স্নেহভাজন। ফলে এই ধরনের সম্মেলন দুই বন্ধুকে একইসঙ্গে খুশি করতে পারল না। আর যাঁরা শহরাঞ্চল থেকে বেশ দূরে, আলোকিত মহল্লার ছায়ায় নিশ্চুপে একান্তে লিখে যাচ্ছেন– তাঁদেরও ক্ষুব্ধ হওয়ার যথেষ্ট কারণ থেকে যায়। আশেপাশে ছড়ানো গ্ল্যামারের বর্ণচ্ছটায় ওঁরা বরাবরই আড়ালে থাকেন। তবে হ্যাঁ, ইদানীং দূরের কিছু মধ্যমেধার সাধারণ কবিও কীভাবে যেন ওইসব গ্ল্যামারদের তালিকায় নিজেদের নিজের নামটি অন্তর্ভুক্ত করে নিতে পারছেন। কীভাবে তা সত্যিই জানা নেই। হয়তো কোনো প্রভাবশালী কবি-সম্পাদক তাঁর স্নেহসিক্ত হাতটি সজ্ঞানে রেখেছেন ওই হঠাৎ-ই উত্থান হওয়া কবির মাথায়। আসলে, বহুযুগ থেকেই কবিদের মধ্যে কেউ কেউ প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। ব্যতিক্রমও আছে। কেউ কেউ নিজের যোগ্যতায় নিজেকে ওই স্তরে উত্তীর্ণ করতে পারেন। তবে নিছক এইসব কারণে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কবি বঞ্চিত হলে মনখারাপ হয়ে যায়। যদিও এটা এমন কিছু নতুন ব্যাপারও না। প্রতিটি উৎসবেই বঞ্চিতের সংখ্যা নেহাত নগণ্য থাকে না। তবে শুধুমাত্র উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার দরুন যদি আমন্ত্রিতদের তালিকায় নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়– তাহলে বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে তা খুব একটা ভালো উদাহরণ হতে পারে না। 

একজন পত্রিকা-সম্পাদকের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমাদের যৌবনে তুখোড় দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সম্পাদক হিসেবে সাগরময় ঘোষেকে জানতাম। বাংলা সাহিত্যে বহু সুযোগ্য কবি-লেখকের উত্থান আমরা দেখেছিলাম সেই সময়। এমন ধীর-স্থির ব্যক্তিত্বের অধিকারী সম্পাদককে ফোন তো দূরের কথা, কাছাকাছি যেতেই বুক কাঁপত। আর তাছাড়া সেই সময় কোনো সম্পাদকের সঙ্গে ফোনে কথা বলার রেওয়াজই ছিল না। বরং ওই সম্পাদক প্রকৃত মেধাবী লেখককে খুঁজে নিজেই ফোন করতেন। লেখার জন্য আমন্ত্রণ জানাতেন। সময় পাল্টেছে। এখন আর সেভাবে হয় না। অনেক নবীন লেখকই ভাবেন যে একবার অন্তত সম্পাদক বা কোনো উৎসবের উদ্যোক্তাদের ফোন না করলে হয়তো আড়ালে চলে যেতে হবে। অথচ আমি বিশ্বাস করি, একজন কবির উদাসীন থাকাটাই নিশ্চিতভাবে কবি হয়ে ওঠার প্রাথমিক যোগ্যতা। আবার এখনকার বহু সম্পাদকের হৃদয়ও বড্ড নড়বড়ে। ফলে, বারবার ফোনাঘাতে অনেক অযোগ্য লেখকও প্রচারের আলোয় চলে আসতে পারেন সহজেই।

যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, যাঁরা বঞ্চিত তাঁদের অভিমানী বরফ-পাহাড়কে গলানো সহজসাধ্য নয়। তাঁরা শুধু নিভৃতেই লিখে যান। আর, কোনো পত্রিকা-সম্পাদক বা উদ্যোক্তাদের ওইসব যোগ্য লেখকের দিকে তাঁদের বিশ্বস্ত হাত এগিয়ে দেওয়াটাই কর্তব্য হোক এখন।

আরও পড়ুন...