অ নু বা দ | পাবলো নেরুদার একটি সাক্ষাৎকার
রিকার্দো নেফতালি রেইয়েস বাসোআলতো- তাঁর এই আসল নামে কেউই কিন্তু চেনেন না পাবলো নেরুদা-কে। বিংশ শতাব্দীর লাতিন আমেরিকান কবিদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবি পাবলো নেরুদা । তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৯০৪ সালের ১২ই জুলাই ।
স্কুল শিক্ষিকা মা যক্ষ্ণায় মারা যান পাবলো নেরুদার জন্মের এক মাসের মধ্যে। নেরুদার বাবা সেইসময় আবার বিয়ে করেন এবং পরিবারটিকে নিয়ে উঠে আসেন দক্ষিণ চিলির পাররাল নামের একটি ছোট শহর থেকে সীমান্ত শহর তেমুকোয়। খুব কম বয়স থেকেই নেরুদার কবিতা লেখার দিকে ঝোঁক লক্ষ্য করা গেছে , এই নিয়ে তাঁর বাবা উদ্বেগের মধ্যে থাকতেন। কেননা তিনি লেখার পক্ষে কোনও দিনই সায় দিতেন না। সেই কারণে নেরুদার মাধ্যমিক পর্ব শেষ হলে ১৯২১ সালে নেরুদাকে নিয়ে তাঁর বাবা চলে আসেন সান্তিয়াগোয়।
কুড়ি বছর বয়সে নেরুদার প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয় ‘কুড়িটি প্রেমের কবিতা ও হতাশার গান’ ১৯২৪ সালে।
এই সাক্ষাৎকারটি যখন নেওয়া, ১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাসে, তার ঠিক একবছরের মধ্যে ১৯৭১ সালে নেরুদাকে সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়। এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন রিটা গুইব্রেট এবং এটি প্যারিস রিভিউ-এর জন্য অনুবাদ করেন রোনাল্ড ক্রিস্ট। এই অনুবাদটি করতে গিয়ে বিভিন্ন মতামত ও পরামর্শ দিয়ে আমাকে নানাভাবে সাহায্য করেছেন শিবাদিত্য সেন, কবিরুল ইসলাম, অলোকরঞ্জন দাসগুপ্ত, কৃষ্ণ গোপাল মল্লিক ।
আমার ঠিক মনে পড়ছে না। তখন আমার বয়স তের বা চোদ্দ হবে। মনে পড়ছে যে আমি লিখতে চাই এটা আমার বাবাকে অসম্ভব দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। তিনি সেইসময় একটা চূড়ান্ত মানসিকতার দিক থেকে মনে করেছিলেন যে হয়ত আমার লেখালেখি আমার ও আমার পরিবারের উপর ধ্বংস করে দেবে। এবং বিশেষ করে এটা আমাকে আমার জীবনকে শেষ করে দেবে । এরকমটা ভাবার হয়ত কারণ ছিল, কিন্তু সেসব কারণ আমাকে প্রভাবিত করতে পারে নি। আর নিজেকে রক্ষা করবার কৌশল হিসেবে প্রথম যে পদক্ষেপটি আমি নিয়েছিলাম তা হলো আমার নামটা বদলে ফেলা ।
আমি তাঁর একটি ছোটোগল্প পড়েছিলাম। কিন্তু তাঁর কবিতা কখনও পড়িনি, তাঁর একটা বই ছিল ‘মালা স্ট্রনার গল্প’ এরকম একটা নামের, সেখানে প্রাগের নম্র মানুষদের কথা লেখা ছিল। এটা এমনও হতে পারে আমার নতুন নামটা এখান থেকেই আসতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা যেহেতু অনেকদিন আগের, আমার সেভাবে ঠিক মনে নেই। আমি মনে করতে পারছি না। অবশ্য চেকরা মনে করে আমি তাঁদেরই দেশের একজন, আর আমার সঙ্গে ওদের বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগ আছে।
আমার কাছে লেখাটা হচ্ছে শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো। শ্বাস-প্রশ্বাস ছাড়া আমি বেঁচে থাকতে পারব না, লেখা ছাড়া আমি বেঁচে থাকতে পারবো না।
বলা যায় আমাদের সময়টা শাসক কবির যুগ । মাও সে তুঙ আর হো চি মিন। হো চি মিন ছিলেন ভিন্ন ভিন্ন গুণের অধিকারী, আপনি জানেন যে তিনি কত বড়ো মাপের সাঁতারু ছিলেন, এই ব্যাপারটা আবার আমি পারি না। অন্য একজন বড়ো কবি আছেন লেওপোল্ড সেঙ্গর, যিনি আবার সেনেগালের প্রেসিডেন্ট। আর একজন আইমে সেজেয়ার, তিনি পরাবাস্তবতাবাদী কবি, তিনি মার্টিনিকের অন্তর্গত ফোর্ট দ্য ফ্রান্সের মেয়র হয়েছেন। আমার দেশে কবিরা সবসময়ই রাজনীতির বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছেন, অবশ্য প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে কখনোই কোনো কবিকে আমরা পাইনি। আর অন্যদিকে ল্যাটিন আমেরিকার কোনো কোনো লেখক আছেন যাঁরা প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, যেমন রোমুলো গ্যালগোস ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট।
একটা উঠোন করা আছে। প্রথমে লোকসঙ্গীত এবং তারপর কেউ নির্বাচনী প্রচারে রাজনৈতিক সুবিধা বিষয়ে আলোচনা করেন, যাঁরা এর দায়িত্বে আছেন। এরপর আমি যেটা বলি জনগনের সামনে সেটা খুবই খোলামেলা ব্যাপার, কিছুটা অগোছালো কিন্তু অনেকটাই কাব্যময়। আর শেষ করি সবসময় কবিতা পাঠ করে। কেননা কয়েকটা কবিতা আমি যদি না পড়ি তাহলে লোকজন বিভ্রান্ত হয়ে পড়বে, কিন্তু তাঁরা আমার রাজনৈতিক ভাবনার কথাও শুনতে চায়, আমি কিন্তু রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বিষয়ে খুব বেশি কিছু তৈরি করি না, কারণ জনগন ভিন্ন ভাষা শুনতে চায়।
তারা আমাকে ভালোবাসে, অনেকটা আবেগময়তা জড়িয়ে থাকে, যে কারণে আমি আমার ইচ্ছামতো কোথাও ঢুকে যেতে বা বেরিয়ে আসতে পারি না। আমি যখন যাই ওদের মধ্যে, তখন কিছু মানুষ আমাকে সবার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে নিয়ে যায়, কারণ তারা আমাকে জনতার থেকে রক্ষা করে। লোকজন আমার চারপাশে চাপ সৃষ্টি করে এবং করতেই থাকে, এটা প্রায় সব জায়গায় একইরকম ঘটে।
এই ধরণের উদ্ভট কল্পনার মধ্যে সিদ্ধান্ত নেবার কোনো অর্থই হয় না।
সত্যিই যদি ওঁরা ওই দুটোকে এই টেবিলের ওপর রাখেন তাহলে আমি উঠে দাঁড়াবো এবং পাশের টেবিলে গিয়ে বসব।
হ্যাঁ, ঠিক সিদ্ধান্ত বলেই আমার বিশ্বাস। বেকেট লেখেন কম কিন্তু অসম্ভব লেখেন। নোবেল পুরস্কার যাঁর হাতেই দেওয়া হোক না কেন তা সবসময়ই সাহিত্যের সম্মান । পুরস্কার যোগ্য মানুষের হাতে গেল কি না সেটা নিয়ে তর্ক করার মানসিকতায় আমি বিশ্বাস করি না। এই পুরস্কার বিষয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ, যদি এর কোনো গুরুত্ব থাকে তা হচ্ছে তা লেখকের সেই কাজের প্রতি একটা সম্মান জানানো। এটাই স্বাভাবিক ও গুরুত্বপূর্ণ।
আমি ঠিক জানি না। খুব জোরালো স্মৃতি, এটা হয়তো স্পেনে যখন আমি দিনগুলো কাটাচ্ছিলাম…. কবিবন্ধুদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ দিনগুলোর স্মৃতি। আমাদের আমেরিকানদের মধ্যে এইরকম বন্ধুত্বপূর্ণ গোষ্ঠীর বিষয়ে কখনো শুনিনি…. ওই রকম বুয়েনোস ইরিসে যেমন সেইরকম আলাস্ক্রানেত্তস বা প্রচারিত গালগল্প আছে এইটুকুই। তারপর তো ওই বন্ধুদের প্রজাতন্ত্র গৃহযুদ্ধ ভেঙে চুরমার হয়ে গেল, সেটাও ফ্যাসিবাদী নিপীড়নের ভয়ংকর বাস্তবতা। তখন আমার বন্ধুরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল, কাউকে তো ওখানেই শেষ করে দেওয়া হলো…. যেমন গার্সিয়া লোরকা আর মিগুয়েল এরনানদেজ, এবং অন্যরা মারা গেলেন নির্বাসিত হয়ে। আমার জীবনের ওই সময়টা ঘটনাবহুল, গভীর আবেগময় সমৃদ্ধ, এটাই আমার জীবনের বিবর্তনকে সম্পূর্নভাবে বদলে দিয়েছে।
সরকারীভাবে আমার ওখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ নয়। একবার তো চিলির দূতাবাস থেকে কিছু পাঠ করার আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন। হয়ত এটা সম্ভব যে ওঁরা আমাকে প্রবেশের অনুমতি দেবেন। কিন্তু আমি এটা চাই না, এটাই সুযোগ, কারণ সেটা স্প্যানিশ সরকারের পক্ষে অনুকূল। কেননা যে মানুষটা তাঁদেরই বিরুদ্ধে এমন সব জোরালো দাবি তুলছে, লড়ে যাচ্ছে তাকে প্রবেশের অনুমতি দিলে অন্তত গণতান্ত্রিক অনুভূতির বিষয়টি প্রদর্শনের সুযোগ পেয়ে যাওয়া।
অবশ্য এমন অনেক দেশ আছে যেখান থেকে আমাকে সত্যি বার করে দেওয়া হয়েছে, এটা এখন আমার খুবই বিব্রতকর বলে মনে হয়।
হ্যাঁ, এটা ঠিক যে কবিতাটি বিস্ময়কর। এটা বিস্ময়কর এই কারণে যে তিনি ছিলেন একজন সুখী মানুষ, কী যে উৎফুল্ল, ফুর্তিবাজ একজন মানুষ! সত্যি তাঁর মতো মানুষ আমি খুব কম জনকেই জানি। এবং তিনি ছিলেন একজন মূর্ত বিগ্রহ। হ্যাঁ, আমি বলতে চাইছি তাঁর জীবনের প্রতি ভালোবাসা, সেখানে সাফল্যের কথা নেই। এটা ঠিক যে তিনি তাঁর জীবনের অস্তিত্বের প্রতিটি মিনিট উপভোগ করতেন… তিনি ছিলেন সুখের প্রাচুর্যে থাকা একজন। যেটা আমি বলতে চাই যে তাঁকে হত্যা করার অপরাধ ফ্যাসিবাদীদের ক্ষমার অযোগ্যের মতো একটি অপরাধ।
এরনানদেজ ছিল আমার সন্তানের মতো। কবি হিসেবে সে আমার ঘরের ছেলে এইরকম একটা সম্পর্ক তাঁর সঙ্গে। সে জেলে গেলো আর মারা গেল সেখানেই, কারণ সে গার্সিয়ার লোরকার মৃত্যুর সরকারী ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারেনি। যদি এমনটা হত যে তাঁদের ব্যাখ্যা ঠিক, তাহলে কেন ফ্যাসিস্ট সরকার মিগুয়েল এরনানদেজের মৃত্যু পর্যন্ত তাকে রেখে দিল কারাগারে? কেন তাঁরা চিলির দূতাবাস প্রস্তাব করা সত্ত্বেও তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলো না! তারা কেন এটা অস্বীকার করল? এটা সত্যি যে মিগুয়েলের মৃত্যু একটা হত্যাই।
ওখানকার ঘটনার বিষয়ে আমি কখনওই প্রস্তুত ছিলাম না। একটা অপরিচিত মহাদেশের বিস্ময়কর সবকিছু আমাকে অভিভূত করেছিল, এবং আমি প্রায় মরিয়া বোধ করছিলাম কারণ আমার জীবন এবং নির্জনতা সেখানে দীর্ঘ ছিল। কখনও কখনও আমি আকর্ষিত হতাম বর্ণময় সিনেমায়, অসম্ভব , দারুণ সব চলচ্চিত্র, কিন্তু আমি সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারতাম না, অনুমতি পেতাম না। আমার এমন কখনও হয়নি যা ভারতবর্ষের মতো একটা দেশে দক্ষিণ আমেরিকান বা অন্যান্য বিদেশিরা মিস্টিসিজম নিয়ে যেসব অভিজ্ঞতা অর্জন করত। তাঁরা তাঁদের চিন্তাধারার জন্য এক ধর্মীয় উত্তরের সন্ধানে বিষয়গুলো ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে দেখার চেষ্টা করত। অন্তত আমার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছিল সেটা হল, সমাজতাত্ত্বিক পরিস্থিতি বিষয়ে আমার মধ্যে একটা গভীর বিচলিত বোধ জন্ম নিয়েছিল। ওইরকম একটা নিরস্ত্র দেশ, এত আরক্ষণহীন, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে আবদ্ধ। এমনকি ইংরেজি সংস্কৃতি, যার প্রতি আমার অসম্ভব পক্ষপাত, মনে হয়েছিল ঘৃণ্য কারণে সেইসময় অনেক হিন্দু বৌদ্ধিক ক্ষেত্রে যান্ত্রিকভাবে এই সংস্কৃতিতে নিজেদের সঁপে দিয়েছেন। ওখানকার বিদ্রোহী তরুণদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল, মিশতাম তাঁদের সঙ্গে, আমার রাষ্ট্রদূত থাকা সত্ত্বেও আমি ওদের জানতে চাইতাম ওইসব বিপ্লবীদের কথা যাঁরা স্বাধীনতার আন্দোলনের অংশ ।
হ্যাঁ, এটা ঠিকই। তবে ভারতবর্ষ আমার কবিতায় খুবই সামান্য প্রভাব ফেলেছে।
হ্যাঁ, এটা ঠিক যে ওই চিঠিগুলো আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ওঁর মতো একজন লেখককে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম না, তিনি নিজেই একজন উদার মানুষের মতো, দায়িত্বশীল মানুষের মতো আমাকে সংবাদ ও পত্র-পত্রিকা পাঠাতেন, ওঁর মধ্যে এটাই বড়ো একটা দিক যে তিনি আমাকে নির্জনতার মধ্যেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। আমার নিজের ভাষার সঙ্গে সম্পর্ক হারিয়ে যাবার ভয় হচ্ছিল বছরের পর বছর। আমার এমন কারও সঙ্গে দেখা হয়নি যাঁর সঙ্গে স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলা যেতে পারত।
আলবর্তিকে আমি একটা চিঠিতে স্প্যানিশ অভিধান চেয়ে পাঠিয়েছিলাম। আমাকে তখন রাষ্ট্রদূত পদে নিযুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু সেটা ছিল নিম্নমানের পদ আর এ পদে কোনো বৃত্তি ছিল না। আমি সময়টা কাটাতাম সর্বোচ্চ দারিদ্র্য আর সর্বোচ্চ নির্জনতায়। সপ্তাহের পর সপ্তাহ কাউকে দেখা যেত না ।
হ্যাঁ, জোসি ব্লিস ছিলেন এমন একজন নারী যাঁর প্রভাব আমার কবিতায় বেশ গভীর।