Hello Testing

4th Year | 2nd Issue

৩১শে বৈশাখ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 15th May, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

ছো ট  গ ল্প

সৌ ম না   দা শ গু প্ত

খাঁচাবাড়ি

হাত দিয়ে কপালের ওপর এসে পড়া রুক্ষ চুলের গুছি সরায় এতোয়ারি। ঘাম মোছে চেটো দিয়ে। তারপর আবার প্রাণপণে শাবল চালায়। মেটে আলুটা তুলতে পারলে কম সে কম একবেলার খাওয়া নিশ্চিন্ত। এই অ্যাত্তো বড় আলু, প্রায় একটা ছোটখাটো ডেকচির সমান। ভাগ্যে কেউ টের পায়নি! মনে মনে ভাবে, নইলে এই আলু নিয়েই এতক্ষণে ভাগাড়ের কুকুরের মতো মারপিট শুরু হয়ে যেত। কাল থেকে কারোর পেটে একদানা খাবারও যায়নি। পরশুদিনের কাউনের জাউ কখন হজম হয়ে এখন মনে হচ্ছে নাড়িভুঁড়িসুদ্ধ চিবিয়ে খেয়ে ফেলে। আজ একমাস হয়ে গেল ভাত খায়নি। এই মেটে আলু, পাতাপুতা, ইঁদুর, বেজি যা পেয়েছে তাই দিয়ে পেটের আগুন নিভিয়েছে। ভাতের গন্ধ কীরকম তাই ভুলে গেছে। ভাতের কথা মনে হতেই মুখের ভেতর জল কাটে। চার ভাইবোন নিয়ে সংসারে ছ-ছ’টা পেট। ওই পাথরভাঙা মজুরির টাকায় আর কী হয়! তাও আবার সবদিন কাজ জোটে না। তার  ওপর ও, ওর বাবা-মা কেউই দু’দিন ধরে কোনও কাজ পাচ্ছে না। ঠিকাদারের লোক ভেতরে ভেতরে টাকাপয়সা নিয়ে নিজের পেয়ারের লোকেদের কোন ফাঁকে কাজ দিয়ে দেয়। টের পেলেও কিচ্ছু বলার নেই। বাগান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এই কাজই একমাত্র ভরসা। ওদের সঙ্গে মুখ লাগিয়ে সেই কাজও খোয়ালে সবসুদ্ধ পথে বসতে হবে। ও তো আজকেও সেই ভোরবেলাতেই কাজের লাইনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে আজকের মতো লোক নেওয়া শেষ। বাগানের লাগোয়া মেইন-রোডের কানা ঘেঁষে বাইপাসের নতুন রাস্তা তৈরি হচ্ছে, চা-বাগানের মেয়ে-মদ্দ সবাই শকুনের মতো মুখিয়ে আছে রোজের কাজের জন্য।  

সেই যে গেল বছর থেকে বাগানে তালা ঝুলল, কবে খুলবে তার কোনও ঠিকঠিকানা নেই। মাঝেমধ্যে শহর থেকে বাবুরা আসে, মিটিং মিছিল হয়, গরম গরম কথা বলে, কিন্তু অবস্থা যে কে সেই। তাও আশায় আশায় ছিল, একদিন না একদিন বাগান খুলবেই। কিন্তু প্রথমেই কোপ পড়ল রেশনের ওপর। তারপর আস্তে আস্তে বিদ্যুতের লাইন কেটে দিল। কোয়ার্টারে যে এখনও থাকতে দিচ্ছে সেই সাতপুরুষের ভাগ্য। এখন সন্ধে হলেই কুলিলাইনে অন্ধকার নেমে আসে। ব্ল্যাকে কেরোসিন পঞ্চাশ ষাট টাকা লিটার। ওই পয়সা হাতে থাকলে তো রোজ রোজই ভাত খেতে পারত। ফলে যতই অন্ধকার হোক না কেন, কুপি জ্বালবার দুঃসাহসও কেউ করে না। খিদে, শুধু বিশাল একটা খিদের গহ্বরে তলিয়ে যেতে যেতে মানুষগুলো এখন নদীর ধারে, জঙ্গলের সীমানায় সারাদিন চরে বেড়ায়, যদি কোথাও একটু মেটে আলু, কচু, পাতাপুতা, ঢেঁকিশাক বা শুশনির শাক জোটে। সেদ্ধ করে খেলে পেটের জ্বালা তো মিটবে। কিন্তু প্রকৃতির সঞ্চয়ও শেষ হতে বসেছে। একদিন এই অঞ্চল ছিল বৃক্ষ, লতা-গুল্মে ভরা। জন্তু-জানোয়ারও ছিল অগুনতি। আর এখন সেই জঙ্গল কেটে সাফ করে চা-বাগান, ফ্যাক্টরি, বাবুদের কোয়ার্টার, কুলিলাইন সব হয়েছে। অনেক ঢুঁড়লেও আর শিকার মেলে না। মেলে না পেট ভরানোর মতো ফল বা কন্দ। এই তো সেদিন সোমরা ওঁরাওয়ের পাঁচ বছরের ছেলেটা খিদের চোটে কী একটা জংলি ফল খেয়ে মরেই গেল। এখন ঘরে ঘরে এরকম হচ্ছে। অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে মানুষ মরছে। অপুষ্টিতে ভুগে ভুগে বাচ্চাগুলোর সব হাড়-জিরজিরে চেহারা, ফোলা পেট, সারা গায়ে ঘা-পাঁচড়া।

আলুটা হয়েছেও বেয়াড়া জায়গায়। ভালো করে দাঁড়াতেই পারছে না, থকথকে কাদামাটি। পা গেঁথে যাচ্ছে। এতোয়ারি এবার প্রাণপণে টান দেয়, হড়হড়িয়ে উঠে আসে। আনন্দে চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে এতোয়ারির। আরিব্বাপ, কত্ত বড়! শীর্ণ শরীরে দু’হাত দিয়ে আলুটা আঁকড়ে ধরে শুকনো ডাঙায় উঠে আসে, যেন সাত রাজার ধন এক মাণিক। এদিক ওদিক পোড়া পোড়া ঘাস। ঘাসের ওপর বসে বসে হাঁফায় এতোয়ারি। ঘসঘস করে পায়ের দাদটা চুলকায়। পাশ দিয়ে ফোসকা ফোসকা মতো আবার কী একটা যেন বেরোচ্ছে। নখ লেগে কষ গড়ায়। জামাটা টেনে নিয়ে ভালো করে মোছে। একটু জ্বালা জ্বালা করে। হাতের তালুটাও জ্বালা করছে। তবে এখন আর অত কষ্ট হয় না। যে হাত একসময় দুটো পাতা একটি কুঁড়ি তুলে জমা করত নিপুণ কৌশলে, পাথর ভেঙে ভেঙে সেই হাতে এখন কড়া পড়েছে। নিছক শাবল চালিয়ে একটা আলু তুলতে আর গায়ে লাগে না। এতোয়ারি আকাশের দিকে তাকায়, ক’দিন ধরে নাগাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। আজকের সকালটাই যা শুকনো ছিল। ওদের এদিকে একবার বৃষ্টি শুরু হলে আর থামতেই চায় না। আবার মেঘ করে এসেছে। এই নামল বলে। ও তাড়াতাড়ি হাত চালায়। কাপড়ের পোঁটলায় বেঁধে নিতে হবে আলুটা, নইলে ঘর অব্দি আর নিয়ে যাওয়া যাবে না। সামনে একটা বুনো ঝোপ মরে শুকিয়ে আছে, এতোয়ারি ডালপালাগুলো ভেঙে জড়ো করে, জ্বালানিও একটা সমস্যা বটে। কোমরের থেকে রশিটা খুলে আচ্ছাসে শুকনো ডালপালাগুলো বেঁধে নেয়, মাথায় তুলে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। আজ ওর মুখে রাজ্য জয়ের আনন্দ। ভাইবোনগুলোও খুব খুশি হবে। আজ দু’দিন বাদে পেটভরে খাওয়া!

ঘরের সামনে এসে বাইকটা দেখে একটু খটকা লাগে। ওদের এখানে বাইক নিয়ে আবার কে এলো! ঝপ করে একটা গন্ধ নাকে এসে লাগে। ভাত! ভাত ফোটার গন্ধ। ওদের ঘরে ভাত! তাহলে বাবা কি অন্য কোনও কাজ পেয়েছে আজকে! হতেই পারে না। সকালেই কাজ না পেয়ে মাকে ধরে পেটাচ্ছিল। বড় ভাইটা বাধা দিতে গিয়ে চড় থাপ্পড় খেয়ে একছুটে পালিয়েছে। মাথার থেকে বোঝাটা নামায়, বারান্দায় বসে পুরো ব্যাপারটা একটু আঁচ করে নিতে চায়। হুঁ, বাবাটা ঠিক আবার হাঁড়িয়া খেয়ে চুর হয়ে আছে। কথা জড়িয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে নতুন একটা গলার স্বর। বাবু একটা। এতোয়ারি জানলার কাছে হাঁটু মুড়ে বসে চুপিচুপি উঁকি দেয়। ঠিক ধরেছে। একটা টাউনের বাবু ঘরে বসে আছে। ওদের একমাত্র চেয়ারটায় বসে বাবার সঙ্গে কথা বলছে। আড়ি পেতে শুনতে শুনতে রীতিমতো রোমাঞ্চ বোধ করে এতোয়ারি। ওকে নিয়েই কথা হচ্ছে। বাবুটাই বেশি কথা বলছে। বলছে,  ওকে কলকাতায় নিয়ে যাবে। কাজ দেবে। কলকাতা! ভাবতেই সারা গায়ে জাড়কাটা। বড় ম্যানেজারের বউ কলকাতার মেয়ে, ও শুনেছে। কয়েকদিন দেখেওছে। কী তার চেহারা, যেন ক্যাটরিনা ক্যায়ফ। কী গায়ের রং, চামড়ার কী জৌলুশ, যেন সদ্য গজানো চায়ের পাতা! আর কাপড়চোপড়, সে কেবল ও টিভিতেই দেখেছে। আগে কি আর এরকম হাঘরে অবস্থা ছিল বাগানের! কুলিসর্দারের বাড়িতে রঙিন টিভি ছিল, এখন না হয় বেচেবুচে দিয়েছে। কিন্তু তখন ওরা সন্ধে হলেই দল বেঁধে টিভি দেখতে যেত। শনিবার রোববার করে ডান্স বাংলা ডান্স, সে-ও তো কলকাতাতেই হয়। আহা, দেবের বই, সে-ও কলকাতায়। সেই কলকাতায় যাবে!

এতোয়ারি উঠোনের একপাশের রান্নাঘরে ঢোকে। মা ভাত রান্না করছে। কতদিন পর মায়ের মুখ উজ্জ্বল। উনুনের আগুনের আঁচে মা’র মুখ দেখে ওর বাবুদের পুজোর দুগগাঠাকুরের কথা মনে হয়। সুড়ুৎ করে জিভের জলটা টেনে গিলে ফেলে। বাবুটা ওকে কাজ দেবে, মাইনে দেবে, মাসে মাসে পাঁচ’শ করে টাকা! উরি বাবা, পাঁচ’শ টাকা একসঙ্গে জীবনে চোখেই দেখেনি এতোয়ারি! টিভিতে একদিন কলকাতার রাস্তা দেখাচ্ছিল, কত্ত গাড়ি, কী ভিড়! কিলবিল করছে মানুষ। ওদের চা-বাগানের মিটিন-এও এত লোক লোক হয় না। সেই কলকাতা! কলকাতায় গেলে নিশ্চয়ই ওর সব ঘা-পাঁচড়া সেরে যাবে। ওখানকার মানুষের গায়ের রং কী ফর্সা! ঠিক ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির মেয়েটার মতো। ও জানে। ওকে বুধারুচাচার বউ বলেছে। সেই যে সেবার ওর ছোট ভাইটা হল, সেবারেই তো বুধারুচাচা আর ওর বউ পার্টির মিটিনে কলকাতা ঘুরে এল। এতোয়ারি রান্নাঘরের দাওয়ায় রাখা বালতি থেকে জল নিয়ে ঘষে ঘষে মুখ ধোয়, কি জানি, যদি এই নোংরা চেহারা দেখলে বাবুটা নিতে রাজি না হয়! কলকাতায় গেলে ও রোজ সাবান মাখবে, বাবুদের বাড়ির মেয়েদের মতো চুড়িদার, জিন্সপ্যান্ট পরবে। বুকের ভেতরটা ধকধক করতে থাকে এতোয়ারির।

তারপর সত্যি সত্যিই একদিন জীবনে প্রথম রেলগাড়ি চড়ে কলকাতা রওনা দেয় এতোয়ারি। ধুপগুড়ি স্টেশন থেকে তিস্তা-তোর্সা এক্সপ্রেস যখন ভোঁ বাজিয়ে চলতে শুরু করে, ও টের পায় নোনতা জলে ওর গাল ভিজে গেছে। অথচ বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় মা যখন কাঁদতে শুরু করেছিল, ও হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে। জামা-কাপড়ের পোঁটলাটা বুকে চেপে ধরে হাত দিয়ে জল মোছে। বাবুটা ওকে ব্যাগ থেকে বিস্কুট বের করে খেতে দেয়। তারপর আরও কত ভালো ভালো খাবার। বাবুটা বলে এটার নাম  এগ-ফ্রায়েড-রাইস। আহা, কী স্বাদ! এমন খাবার জীবনে চোখেই দেখেনি এতোয়ারি। সাবধানে খুঁটে খুঁটে সবটা খাবার খায়, তারপর জিভ দিয়ে ফয়েলের বাটিটা একটানে চেটে নেয়, খেয়ালও করে না ওর দিকে ট্রেনের লোকেরা সব হাঁ করে তাকিয়ে আছে। ট্রেনের দুলুনিতে কখন যে ঘুম এসে গেছে মনে নেই।

বাবুটার ডাকে ঘুম থেকে উঠে দেখে জোরে ট্রেন ছুটে যাচ্ছে। ও জানলার ঝাপসা কাচের ভেতর দিয়ে দেখে চারপাশের দৃশ্য সম্পূর্ণ বদলে গেছে। ট্রেনটা ছুটছে, নাকি দু’দিকের বাড়িঘর গাছপালা সব ছুটে যাচ্ছে, ও থই পায় না। বাবুটা ওকে ট্রেনের টয়লেটে নিয়ে যায়। দরজা বন্ধ করে সাবধানে সব সেরে নিতে বলে। কিন্তু এই ঝাঁকুনির চোটে নাকি এমন অনভ্যস্ত পরিবেশের কারণে কে জানে, এতোয়ারির পেচ্ছাপ পায়খানা সব আটকে গেছে। ও কোনোমতে চোখে একটু জল ছিটিয়েই ধরে ধরে আবার সিটে এসে বসে। অবশেষে কলকাতা। শিয়ালদা স্টেশন। এবার ভীষণ ভয় পেয়ে যায় এতোয়ারি। উই বাপ, কত্ত মানুষ! সব ছুটছে। একজন আরেকজনকে ধাক্কা মেরে ছুটছে। ও বাবুটার হাত চেপে ধরে। শক্ত হাতে ওকে ধরে ট্রেন থেকে নামায় বাবুটা।

কলকাতায় বেশ কয়েকমাস হয়ে গেছে এতোয়ারির। বাবুর বাড়িতে বেশি লোক নেই। বউ আর একটা ছেলে। সবাই সকাল হলেই বেরিয়ে যায়। সারা বাড়িতে তখন এতোয়ারি একাই। ও এখন গ্যাস জ্বালিয়ে রান্না করতে পারে। এখানে কল খুললেই জল। এতোয়ারি মনের সুখে সাবান মাখে, তেল মাখে। বউদি, বাবুর বউকে এই নামেই ডাকতে বলেছে ওরা, আর বাবুকে এখন দাদা বলে। তো বউদি মানুষটা ভালোই। আসার পরেই ওকে নিজের দুটো ম্যাক্সি দিয়েছে। একটা চুড়িদার। দু’বেলা পেট পুরে খেতে পায়। শুধু ভাত না, সঙ্গে মাছ, মাংস, যেদিন যেমন হয়। শুধু এই বাড়িটায় কোনও উঠোন নেই। বারন্দায় টবে দু’চারটে গাছ। এতোয়ারি রোজ টিভি দেখে। বউদির সঙ্গে বসে সারাটা সন্ধে সিরিয়াল দেখে। কত বড় টিভি। কত সিনেমা দেখা যায়! ওরা বলে এস্মাট টিভি। যে বই দেখতে চাও দেখতে পার। শুধু এতোয়ারি ভাবে, এই বাড়িটায় কোনও উঠোন নেই, এই বাড়িটায় কোনও চা-বাগান নেই, এই বাড়িটায় কোনও মাটির গন্ধ নেই, নেই চা-ফলের পেকে ওঠার বাস, নেই হাঁড়িয়ার নেশায় চুর হয়ে মাদলের তালে তালে নাচ। এই বাড়িটার বারান্দায় দাঁড়ালে শুধু গাড়ি আর মানুষ, মানুষ আর গাড়ি। শুধু চোখ-ধাঁধানো আলো। এত এত আলোর নিচে একা হতে হতে এতোয়ারি কেবল অন্ধকার খোঁজে, তার চিরপরিচিত আদিম অন্ধকার।   

আরও পড়ুন...