ব ই ক থা
একলা খেলা অন্ধকারে
তারা ভট্টাচার্য
প্রকাশক । মানবজমিন
প্রচ্ছদ । সুদীপ্ত ভট্টাচার্য
১৩০ টাকা
আমরা কেন কবিতার সঙ্গে এতো একাত্ম হয়ে থাকি? কেন আমরা এভাবে কবিতার ঘরে বাস করি? এসব অনেক প্রশ্ন আমাদের মাথায় নিরন্তর ঘুরে বেরায়। সন্ধান চলে সেইসব প্রশ্নের।সম্প্রতি মানবজমিন প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত বই ‘একলা থাকা অন্ধকারে’।কবি তারা ভট্টাচার্য। চার ফর্মার বইয়ের পেছনে লুকিয়ে রয়েছে তাঁর যাপন কথা। একজন কবির যে কোন বয়স থাকে না, তা যেন তাঁর সৃষ্টির মধ্যেই ধরা পড়ে অর্থাৎ চোখে দেখা যায়,বোঝা যায়। ধরা পড়ে চির যৌবনের কথা। বইটার প্রথম কবিতায় আমাদের বাকি কবিতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। কবিতার নামই ‘কবিতা’, নীচে কবিতাটা একটু উল্লেখ করি—
কবিতা
‘সব পথ বন্ধ হলে কবিতা দুয়ার খুলে দেয়
সর্বহারার জন্য অন্নজল সযত্নে সাজায়
শয্যা পাতে দুঃখের গভীরে
প্রেমের জাজিম বোনে নিরাময় এনে দেবে বলে’
কি অদ্ভুত একটা ঘোর।কি অদ্ভুত নেশা এই কবিতার মধ্যে দিয়ে।কবি কবিতার পথ দিয়ে মুক্তি আনার পক্ষপাতী।ঠিকই,এই বই পড়তে পড়তে আমার বার বার মনে হয়েছে, কবিতা দিয়ে যাঁরা অস্ত্র বা ঢাল নির্মাণ করেছেন,ঠিক তাঁদের থেকে একটু অন্য পথে হেঁটে তারা ভট্টাচার্য লিখছেন,মুক্তি।আসলে এই মুক্তি কী?সত্যিই এই মুক্তির স্বাদ আমি নিজেও অনেকটা বুঝে উঠতে পারি।এ প্রসঙ্গে,জয় গোস্বামীর একটা বহু পঠিত বই,’জয়ের সুভাষ’বইটির কথা মনে পরছে।দেজ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত।সারা বইয়ে কবি জয় তাঁর সঙ্গে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জানা-অজানা,চেনা-অচেনা নানা কাহিনি বর্ণনা করছেন।সারা বইয়ের আলোচনায় কবি সুভাষে’র অনেক গুলো কবিতার কথা উল্লেখ করেছেন।এমনকি এই কবি সুভাষের উদ্দেশ্যে তিনি বইয়ের শুরুতেই একটা ‘কাশফুল’ নিয়ে কবিতা লিখেছেন –
কাশফুল
রেললাইনের ধারে মানুষের পিঠসমান কাশফুলের বন
টাইপরাইটার নিয়ে তার মধ্যে একজন বসে
একটা শালিক নামল টাইপরাইটারে
পুজোর আকাশ থেকে সাদা রং এক ঝাঁক মেঘও
নেমে এল তাঁর মাথায়।
দূর দিয়ে চলে গেল ট্রেন…
ট্রেনে যেতে যেতে আমি স্বচক্ষে দেখলাম
কাশবনের মধ্যে বসে সুভাষদা কবিতা লিখছেন।
কেন এই আলোচনায় এই কবিতার কথা বা এই আলোচনার কথা তুলে আনলাম,তার কারণ-কবি সুভাষকে তাঁর উত্তরসূরি কবি জয় দেখছেন কাশবনে কবিতা লিখছেন।এটাই কি একজন কবির সবচেয়ে বড় সীমাহীন মুক্তির পরিচয় নয় ?পথের পাঁচালি’ সেই কালজয়ী চিত্রনাট্য,মাঠের দূরের প্রান্তে ইঞ্জিনের ধোঁয়া উড়িয়ে ঝিক ঝিক শব্দে যাচ্ছে রেল,আর অপু দিদি দুর্গাকে নিয়ে অনাবিল আনন্দে আত্মহারা হয়ে সেই লাইনের দিকে রুদ্ধশ্বাসে ছুটছে।এই ছোটায় আমাদের সবার আনন্দ।ঠিক যেমন করে এইরকম এক কাশবন।যেখানে ইচ্ছা করলেই এদিক ওদিক ছুটে যাওয়া যায়।মন সব সীমানা ছাড়িয়ে সীমারেখা পেরিয়ে যেতে চায়।সেই সীমাহীন কাশবনে এক আনন্দ উপভোগ করছেন কবি সুভাষ কবিতা লিখে।
আসলে আনন্দ একরকমের সুন্দর।এই সুন্দর অনুভব করার।উপলব্ধি করার।আনন্দ উপভোগ করতে আমাদের জৈবিক ও শারীরিক উপাদানের গুরুত্ব থাকলেও,অনেক অংশে সেটা সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে আমাদের দৃশ্য উপভোগের নির্দেশ করে।আসলে এই সুন্দর আমাদের চোখ দিয়ে দৃশ্যমান হয়।আর আমরা মন দিয়ে উপভোগ করি।অর্থাৎ মন আমাদের এই পঞ্চইন্দ্রিয়র মধ্যে চোখকে দৃশ্য ধরে রাখার নির্দেশ দেয়।চোখ সে কাজ করে মহানন্দে।এই আনন্দ উপভোগের জন্যই কবি জয় ওইরকম একটা কাশবনের পরিবেশ তৈরি করেছেন।তানাহলে,আনুষঙ্গিক উপাদান বেমেনান হলে,প্রকৃত মূর্তটা যথা যোগ্যতা পায়না।তাই কবির মতোই আরও পরবর্তী কবিদের সেই পরিবেশ তৈরি।এ প্রসঙ্গে কবি তারা ভট্টাচার্য’এর ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে কিছুটা মৌখিক পরিচয় আমার হয়েছে।শুনেছি আজকের দিনে তিনি আমাদের মতো অত্যাধুনিক স্মার্ট ফোন ব্যবহার করেন না।চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ।প্রায় দেখতে পাননা বললেই চলে।আমাদের আদিমকালের ছোট্ট ডিসপ্লে ওয়ালা ফোনের মধ্যেই তিনি কবিতা লেখেন।কবিতার বীজ বপন করেন দিন-রাত।মনের মধ্যে আসা একের পর এক ছবি কবি নিজের অন্তর দিয়ে উপলদ্ধি করেন।তারপর যেন এক অদ্ভুত ভাবেই আমাদের দেখান।বিরাট অন্ধকারে আলো দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে যান।
আরও একটা বইয়ের কথা এই আলোচনায় মনে পড়ছে।’প্রসঙ্গ শিল্প, সাহিত্য’।পূর্ণেন্দু পত্রী।বইটির প্রকাশনা ‘প্রতিক্ষণ’।সেখানে নানা প্রসঙ্গে নানা সাহিত্য ও শিল্পের কথা উঠে এসেছে।’মার্ক স্যাগল স্বপ্ন-বাস্তবের চিত্রকর’ শীর্ষক প্রবন্ধে এক জাগায় লিখছেন,’স্যাগলের জগৎ হল আসলে সেটাই,যা তিনি আঁকেন; বর্ণবিন্যাসের,শরীরবিন্যাসের,মাধ্যাকর্ষনের,আনাটমির প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম-নির্দেশককে ভ্রুকুটি হেনে,এবং সর্বোপরি, শিল্পের জগতে থেকে থেকে দুন্দুভির মতো বেজে ওঠা সর্বপ্রকার’ইজম’কে উপেক্ষা করে।পৃথিবীর যা কিছু,টা হতে পারে বস্তু,অথবা দৃশ্য, অথবা অনুভব, অথবা দর্শন; সবই রয়েছে তার ছবিতে কিন্তু পৃথিবীর নিয়ম নেই,আছে শিল্পীর নিজস্ব নিয়মে।’…তারা ভট্টাচার্য এর বেশ কিছু কবিতা আগে বলা কথা গুলোর সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে খুব সহজেই দেখা যায়।এখানে আরও একটা কবিতার কথা বলি,’অবেলায়’-
‘একলা মানুষ, একলা থাকো
ঘরের মধ্যে ঘর–
হলুদ শাড়ি বলল কথা
কী হল তারপর!
ঘরের মধ্যে ঘর খুলেছে
পুরোনো ধূলিজাল–
হলুদ শাড়ি, কালকে এসো,
কালকে এসো, কাল।’…
আলোচনার শুরুতেই একটা কথা বলেছিলাম,তা হল বিরাট একটা চিন্তা।অবেলার এই সন্ধিক্ষনেই এই ‘একলা মানুষ, একলা থাকো’ এই কবিতার মধ্যে দিয়েই জীবনের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন।’অভিলাষ’ নামক একটা কবিতায় –
‘আমার নিজস্ব কোনো অরণ্য ছিল না,
ছিল না নদী;
প্রেমিকের নিজস্ব চোখের মুকুর দেখিনি আমি,
তবে কার বা কীসের জন্য প্রবাহমান প্রতীক্ষা!
অস্তগামী সোনালি আলোর গাথা
রাত-পরী ডানায় মেখেছে–
গল্প তার রূপকথা।’
কবিতায় কবি বলছেন প্রেমিকের মুখ দেখেননি।অথচ সবটুকু স্মৃতি তাঁর চোখে ভাসে।সেই ভাসা ভাসা স্মৃতি নিয়েই কবি অন্তরের ছবি নির্মাণ করেন।কবিতার আঙিনায় তাঁর কবিতার স্বতন্ত্র দিক খুব সহজেই চোখে পড়ে।তাছাড়াও আরও বেশ কিছু কবিতা,যেমন -‘মৃত্যু-১’, ‘মৃত্যু-২’, ‘গাছ-১/২/৩’, – ‘গাছ-৩’ কবিতায় লিখছেন–
‘যে সব গাছেরা একা,
হীম শীতে শূন্য প্রান্তরে নিরুপায় কাল গোনে;
প্রিয় পাখিদের আনাগোনা নেই আর রিক্ততার দিনে;’-এভাবেই কবিতার বার বার জন্ম হয়।কত কাল ও সময় পেরিয়ে কবি তাঁর নিজের অন্তর দিয়ে সবটা উপলব্ধি করা যায়।আসলে তারা ভট্টাচার্য’নিজেই তার সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী।তিনি নিজেই কবিতার রূপক আড়ালে কোথাও সৌন্দর্য, কোথাও মূর্ততাকে আঁকার চেষ্টা করেছেন,যা কবিতার পাঠক হয়ে খুব সহজেই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে।কবি তারা ভট্টাচার্য’এর এই বইয়ের ভেতরের প্রবাহ যেন সবাই একই সুরে কথা বলে।একজন কবিতার পাঠক হয়ে এর থেকে পাওয়ার আর কি আছে?