Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

প্র চ্ছ দ  কা হি নী

বা প্পা দি ত্য  রা য়   বি শ্বা স

bappa

মিথ মিথ্যে ধ্রুব সত্য

অদ্বৈত। অদ্বৈতাচার্য গোস্বামী। জীবত্‍কাল একশ পঁচিশ বছর( ১৪৩৪ – ১৫৫৯)। পূর্বাশ্রমে পরিচিত ছিলেন কমলাক্ষ মিশ্র নামে। ইনিই আধুনিক বাঙালির প্রথম মনীষা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে পুরীর রথযাত্রায় লক্ষ মানুষের সমাবেশে অবতার ঘোষণা করেন।

           অদ্বৈত। জন্ম আনুমানিক ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দের আগে পরে। মৃত্যু ২০০৬ সালে। অর্থাৎ মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল দুশো ছাপ্পান্ন বছর। অথচ কিভাবে যেন পূর্বপাড়ের গাঙ্গেয় বাতাসে পল্লবিত হয়ে আমাদের ছোটবেলার কানে তথ্যটা পৌঁছলো যে আলিপুর চিড়িয়াখানায় যে দৈত্যাকৃতি কূর্মরাজ শীতের পড়ন্ত বেলায় ভেজা পাথরের উপর বসে রোদ পোহান তাঁর বয়স পাঁচটি শতাব্দী পার করেছে। অনেক পরে জেনেছি তাঁর নামটিও অদ্বৈত।

           কী আশ্চর্য! একদিন চিড়িয়াখানা ভ্রমণকালে দুপুর দুপুর আমার এই দ্বিতীয় অদ্বৈত’র চোখে চোখ পড়ে গিয়েছিল। অপেক্ষাকৃত নির্জনতার সুযোগে হঠাৎ দেখেছিলাম নবদ্বীপের রাস্তায় মশাল হাতে জনজোয়ার নেমেছে, যার পুরোভাগে আছেন পাণ্ডিত্য আর সৌন্দর্যে ভাস্বর অনিন্দ্যকান্তি মহাপ্রভু। এই চকিত উল্লম্ফন ক্রিয়ায় যেটা ঘটল তাতে রূপ পেল অনুভবের গভীরতা — অবচেতনের ইমেজারিতে ভর ক’রে মন ব্যস্ত হয়ে উঠল এমন এক সমান্তরালের নির্মাণে যা কোনো উইলফুল সাসপেনশন অফ ডিসবিলিফ নয়, বরং এক সচেতন নির্মাণ যা-তে অজান্তেই গড়িয়ে আসা চোখের জলের মোলাকাত ঘটে যায় মহাসাগরের উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে। ঘটিয়ে দেন সেই অজানা ব্যক্তি যিনি কচ্ছপটির নামকরণ করেছিলেন অদ্বৈত।

           “আমরা তো তোর মত কবি নই।” পরিচিত বন্ধুবৃত্তে এরকম ছদ্ম-অনুযোগ বা নিষ্পাপ শ্লেষের মুখোমুখি হননি এমন কবিতালেখক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এখন প্রশ্ন হল যতই হালকা চালে কথাটা বলা হোক না কেন, আমাদের বুঝতে হবে বোধের কোন শেকড়  থেকে বক্তার মুখে এই শব্দগুলো উঠে আসে। বক্তা কি বলতে চাইছেন তিনি গদ্যকার হলেও হতে পারেন — ছোটগল্প বা প্রবন্ধ তিনি বা তাঁরা  লিখলেও লিখে ফেলতে পারেন, কিন্তু কবিতাটা তার চেনা কাপের চা হয়ে উঠবে না কোনোদিন? আসলে ব্যাপারটা তা নয়। একটু গভীরে ঢুকলেই আমরা বুঝতে পারব যে এই অনুযোগটি যাঁকে কেন্দ্র ক’রে বক্তা মোটেও বলতে চাইছেন না যে তিনি ছন্দ এবং অন্ত্যমিল  সহযোগে লিরিক্যালি বাক্যালাপ করেন! বরং অজান্তেই তিনি তাঁর অনুযোগের পাত্রটিকে একটি শ্রদ্ধামিশ্রিত সম্মানের আসন দিয়ে ফেলেছেন এই ভেবে যে তাঁর বন্ধুটি কথা বলার সময় যে ধরনের শব্দ প্রয়োগ করে বা যে সব শব্দছবির ব্যবহারে তার বক্তব্যটি নান্দনিক উৎকর্ষে ঋদ্ধ হয়ে উঠে সুরে বাজতে থাকে, সে ভাষা দৈনন্দিনের নয়, সে ভাষা প্রাত্যহিকতার বাইরে এবং সেই কায়দাটি সবার পক্ষে আয়ত্ত করাও সহজ নয়। অজান্তেই জন্ম হয় সমান্তরাল এক মিথের — কবি হয়ে ওঠেন সাধারণের থেকে উচ্চতর এক সত্ত্বা, ক্রমে ঋষিতুল্য এবং অবশেষে হাজির হয় সেই অমোঘ বিশেষণ — ক্রান্তদর্শী!

           প্রশ্নটা ওঠেই। এই যে একটু আগে আড়াইশো বছরের কূর্মকে পাঁচশো বছরের বলে চালানো — এর দায় কি আদৌ গঙ্গার পুবপাড়ের হাওয়ার? ভাবের ঘরে রীতিমতো ডাকাতি হয়ে যাবে যদি সেটাকেই মান্যতা দেওয়ার চেষ্টা করি। অবচেতন বলে উঠবে শাস্ত্রে (নাকি বিবর্তনবাদে?) কথিত স্থিতির ধারক দেবতা বিষ্ণুর দশাবতারের দ্বিতীয়জন এই কূর্ম-ই। জীবজগতে মানুষের গড়পড়তা চেনা সদস্যদের মধ্যে  সে অন্যতম অথচ সে-ই একমাত্র বহুলপরিচিত প্রাণী যার একটি শাখার সদ্বংশজাত সদস্যদের আয়ু যেকোনো দীর্ঘায়ু মানুষের ধরাছোঁয়ার অনেকটা বাইরে। যা পরিচিত অথচ নাগালের বাইরে তাকে ঘিরেই বেড়ে ওঠে মানুষের মুগ্ধতা, দানা বাঁধে কল্পনার যা অনায়াসে আড়াইশো বছরকে সম্প্রসারিত করে পাঁচশোয়, তারপর অদ্বৈত নামের বৈতরণীতে সাঁতার কেটে পৌঁছে যায় বাংলার প্রথম নবজাগরণের প্রেক্ষাপটে। এই সম্প্রসারণ মিথ্যে নয়, মিথস্ক্রিয়া। আর মিথের সঙ্গে কবিতার পারানিমুদ্রার নাম, পাঠক মাত্রই জানেন, ইঙ্গিত। এই ইঙ্গিতই ঘটমান আর চিরকালীন সময়ের মধ্যে পারাপার ঘটিয়ে দেয়, হাতের কুপির মিটমিটে আলোটাকে পাল্টে দেয় স্টারি নাইটস-এর হাজার তারায় ঝলমল করে ওঠা ভিনসেন্ট আকাশে। “যে পক্ষের পরাজয় সে পক্ষ ত্যজিতে মোরে কোরো না  আহ্বান। জয়ী হোক রাজা হোক পাণ্ডবসন্তান — আমি রব নিষ্ফলের  হতাশের দলে!” মহাকাব্যের পাতা থেকে নেমে এসে রবীন্দ্রনাথের কর্ণ হঠাৎ যোগ্য অথচ ব্রাত্য প্রতিটি মানুষের কাঁধে হাত রাখেন। কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতির সিঁড়ি, পুরস্কার-উৎসবের মঞ্চ বা ঋদ্ধ সংকলনের সূচি নির্বিশেষে আহত মানুষটিকে বোঝান যে তিনিও তাঁর মতোই rank outsider — গডফাদারহীন, ‘কৌলীন্য’-বর্জিত সূতপুত্র। ঝড়ের তাণ্ডব ক’মে এলে মানুষটি বুঝতে পারেন শত চক্রান্ত সত্বেও কালের কষ্টিপাথরে মহাভারতের শ্রেষ্ঠ বীরের শিরোপাটি রাধেয়’র মাথায়ই উঠেছে। আর বাসুদেব কৃষ্ণের পরেই দ্রৌপদী এবং তদপরবর্তী প্রত্যেক তেজস্বিনী পাঁচ হাজার বছর ধরে যাঁকে প্রার্থনীয় সিংহাসনের বাদবাকি অংশটুকু দিয়ে নিঃস্ব হয়ে থাকেন, তিনি কোনো ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয়সন্তান নন, তিনি এই ‘সূতপুত্র’। সামান্য কুপির মিটমিটে আলোটা আগলে ধরে, হাতের চেটোটা চোখের কোণায় একবার ব্যবহার ক’রে, মানুষটা হাঁটতে থাকেন, ভাবতে থাকেন ওই শব্দগুলোয় আসলে হতাশার উচ্চারণ নেই, রয়েছে এক অন্তর্লীন আত্মবিশ্বাস যা, চূড়ান্ত সাফল্য ও গ্রহণযোগ্যতা মহাকালের ক্যানভাসে নিশ্চিত হয়ে আছে জেনে, আপাত সাফল্যকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে স্পর্ধা যোগায়। বীরগাথার মাইকেল নয়, সার্থক মিথের উৎসারে রবীন্দ্রনাথ জিতে গেলেন। এই মিথ না থাকলে কত কুপির আগুন যে শুধুমাত্র দীর্ঘশ্বাসের বদ্ধবাতাসে নিভে যেত তার ইয়ত্তা নেই।

          অবাক করা ব্যাপার! সংস্কৃত ভাষায় ইতিহাস শব্দটা কিন্তু আমাদের পরিচিত হিস্ট্রি অর্থে ব্যবহৃত হয় না। তার আত্মীয়তা বেশি ‘কিংবদন্তী’র সঙ্গে, ইতি-হ-আস — ‘এমনই ছিল, এমনই হয়েছিল বলে প্রচলিত।’ এই সংজ্ঞার হাত ধরে যদি একবার আদিকাব্যগুলোর দিকে তাকাই, দেখতে পাবো যে দেশ-বিদেশ নির্বিশেষে তাদের মধ্যে একমাত্র মহাভারত আধুনিক অর্থে ইতিহাস না হলেও, ইতিহাসের এমন এক ভাঁড়ার যাতে তথ্য-উদ্ভাবনা-স্মৃতির কল্পনারঞ্জিত ও উপাখ্যান আশ্রিত মিশেল (যাকে বলা যায় heady concoction) আমাদের সৃষ্টির বোধে প্রায় কামার্ত শিহরণ জাগিয়ে বার করে আনছে ভাস্বর সব চিত্রকল্প যা ইউরোপীয় ডায়লেক্ট-এ পরিচিতি পায় মিথ রূপে আর হিন্দুরা (হিন্দুকুশ পর্বতের দিনের-প্রথম-রোদে-স্নান-সারা ঢাল ও সমতলের অধিবাসী অর্থে বললাম, পাঠকরা দয়া করে অন্য মানে করবেন না) নাম দেন পুরাণ — সাহিত্য ও সংস্কৃতির আদিম অথচ চিরন্তন শস্যভাণ্ডার। কাজী নজরুল ইসলামের আইকনিক ‘বিদ্রোহী’র (যা আবৃত্তিশিল্পীদেরও অত্যন্ত প্রিয় একটি কবিতা) প্রসঙ্গে আসা যাক :

‘ধরি বাসুকির ফণা জাপটি/ ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি!’

আবার

‘আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী/ মহা সিন্ধু উতলা ঘুম-ঘুম ঘুমচুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্ব নিঝ্ঝুম/ মম বাঁশরীর তানে পাশরি/ আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী।’

ইউরোপীয় ও দেশীয় মিথ-উপাদানের সংযুক্ত উচ্চারণে পাঠকের স্মৃতি, মনন ও বীক্ষা জুড়ে ঘটতে থাকে একের পর এক মহাজাগতিক বিস্ফোরণ, কবিতাটিকে চকিতে করে তোলে brighter than a thousand suns.

           মিথাশ্রয়ী কবিতা? নাকি কবিতাও জন্ম দিতে পারে মিথের? চলে আসি পঞ্চাশের দশকে কৃত্তিবাস আন্দোলনের পুরোধা কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কালি ও কলমে:

‘নীরা, তুমি নিরন্নকে মুষ্টিভিক্ষা দিলে এইমাত্র/ আমাকে দেবে না?/ শ্মশানে ঘুমিয়ে থাকি, ছাই-ভস্ম খাই, গায়ে মাখি/ নদী সহবাসে কাটে দিন/ এই নদী গৌতম বুদ্ধকে দেখেছিল/ পরবর্তী বারুদের আস্তরণও গায়ে মেখে ছিল/ এই নদী তুমি!’

 কে এই নীরা? কে এই আলোকপর্ণা নারী, এই নিম অন্নপূর্ণা যাঁর সামনে নতজানু হয়ে প্রসাদ ভিক্ষা করতে সহজ সত্যব্রত কবি দুবার ভাবেন না? আদৌ কি ইনি কোনো নারী, নাকি বহমানা  সময় — নদীমাতৃক ভারতবর্ষের বুক চিরে বয়ে চলা মহাকাল? সুরঙ্গমা, বনলতা সেন আকাশলীনা, সুলোচনা, অরুণিমা সান্যালের যোগ্য উত্তরসূরী এই নীরা — যেন সবার প্রতিভূ রূপে একা দাঁড়িয়ে মিথে ভর করে নিজেই হয়ে উঠেছে এক অনির্বচনীয় মিথ — যাকে ঘিরে অবিরাম প্রশ্নবাণ ধেয়ে এসেছে কবির দিকে — আজীবন।

          মিথ থেকেই স্পর্ধা সঞ্চয় করে জন্ম হয় দিনবদলের স্বপ্নের। কিন্তু স্বপ্ন ভুল পথে ছুটলে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষের পরেও বর্ষা নামে না, শীতের ঠাণ্ডা হাত গলায় চেপে বসে প্রাণবায়ুর অন্তিম ফুৎকারটুকুও নিংড়ে বের করে নেয়। বাংলা কবিতায় কবি শঙ্খ ঘোষের ক্রান্তদর্শী স্বরটি এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাওয়া বাৎসল্যের হাহাকার ফুটিয়ে তোলে মিথের আশ্রয়ে — ‘বাবরের প্রার্থনা’য় :

এই তো জানু পেতে বসেছি পশ্চিম

 আজ বসন্তের শূন্য হাত —

 ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও

 আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।

 কোথায় গেল ওর স্বচ্ছ যৌবন

 কোথায় কুরে খায় গোপন ক্ষয় !

 চোখের কোণে এই সমূহ পরাভব

 বিষায় ফুসফুস ধমনী শিরা !

 মৃত্যুই (সে অপমৃত্যু বা স্বাভাবিক মৃত্যু যা-ই হোক না কেন) স্বপ্নের নিয়তি। ‘আত্মজীবনীর অংশ’ কবিতায় জয় গোস্বামী সভ্যতা পেরিয়ে সংযোগ ঘটিয়ে ফেলেন নিয়ান্ডার্থালের সঙ্গে :

‘সে যখন আমাকে খাতা দিয়ে পিটোয় আর বের করে দেয় বাড়ি থেকে আর পাথরের অস্ত্র কাঁধে নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে গুহা থেকে আমি শিকার খুঁজতে বেরোই তখন আমার বেরিয়ে যাওয়াটা কোনো পথ হতে পারে না’

মিথ, সময়ের মতোই, থেমে থাকেনি। উত্তরাধুনিকতার হাত ধরে হেঁটে গেছে জাদুবাস্তবতার দিকে। মিথ থেকে কবিতা নয়। মিথ হয়ে যাওয়া কবিতা, মিথ হয়ে ওঠা সার্থক চরিত্র, এমনকি বাঙালির জীবনদেবতা কবির মিথ হয়ে ওঠা জন্মদিনের তারিখসংখ্যাটাও কবির অবচেতন থেকে নেমে কবিতার শরীরে এসে বসে যায়। জয় গোস্বামী ‘এখানে তোমার মাটির দেশ’ কবিতায় লেখেন :

‘কে মেয়েটা? একহাতে টিফিন কৌটো, একহাতে ভাইয়ের হাত ধরে, ঢালু দিয়ে ক্ষেতে নামছে, বাবাকে খাবার পৌঁছে দেবে। এই মেয়ে দুর্গা বুঝি? কোঁচড়ে আমের কুসি নিয়ে সালোয়ার-কামিজ পরা নীলমূর্তি দাওয়ায় দাঁড়াবে? কিংবা এ-ই অন্য মাঠে ময়নাপাড়ার মাঠে গিয়ে আকাশে যুগলভুরু হানলো কিনা, দেখল কিনা চেয়ে সেকথা কবির সঙ্গে মনে-মনে জেনে সেই মেয়ে এতদূর চলে এল? অথবা সে আমাদেরই পাশের বাড়িতে পঁচিশ বছর আগে ভাড়া থাকত’

অনতিবিলম্বে আমরা আশ্চর্য হয়ে দেখি সচেতনভাবে কবি এই মিথের বিনির্মাণ ঘটাচ্ছেন একই কবিতায় — ঘনিয়ে তুলেছেন ডিসটোপিয়া:

‘রাস্তার দুধারে এত কাশফুল দাঁড় করালো কে? বন থেকে উঁকি দিচ্ছে একটি বালক, অপু নয়।…. রামায়ণ যাত্রা নয়, রাত রাত জেগে A মার্কা  ভিডিও দেখছে গ্রামে গ্রামে অপুদের পাড়া! ‘

 মিথ, জাদু আর বাস্তবতা একাকার হয়ে যায় কবি শ্যামলকান্তি দাশের কলমে :

‘যিনি কুঠার লিখতে গিয়ে লেখেন কূর্ম এবং কূর্ম কেটে অনায়াসে বসিয়ে দেন পরশুরাম

স্ত্রী ঐশ্বর্যের উপমা দিতে গিয়ে যিনি কবিতায় টেনে আনেন দ্বৈপায়ন হ্রদের ছায়া

 চিরজীবী শব্দটির ভিতর-বাহির বোঝাতে যাকে আঁকতে হয় কখনো কৃপ কখনো ব্যাস কখনো মার্কণ্ডেয়

 তাঁকে আজ একী অদ্ভুত শব্দজব্দের ছল্লিবল্লিতে  পেয়ে বসেছে!

 এই তিনি জলপথ কাঁপিয়ে দিলেন, তো উনি ছিঁড়ে খামচে তছনছ করে দিলেন স্থলভাগ

 এই তিনি লেলিয়ে দিলেন টর্নেডো, তো অন্য দিক থেকে ধেয়ে এল মিগ-টোয়েন্টি নাইন

 এই তিনি স্কাড নিক্ষেপ করলেন তো অন্যপক্ষ ছুড়ে মারলেন পেট্রিয়ট।’

 শ্যামলকান্তির গড়ে তোলা আইকনিক ‘রাক্ষস’ হয়ত বাংলা কবিতার পথ হাঁটবে বহুকাল :

‘এমন দিন যদি আসে কখনো

 তুমি এই দাঁত দিয়েই ছিঁড়ে কামড়ে

 ভেঙে ফেলতে পারবে পাথর!

 নাকে হাওয়া নেই বুকে বাতাস নেই

 শরীরে মনে নেই মলয়পবন

 রেগে কাঁই হয়ে যাচ্ছ, তেতে আঙরা হয়ে যাচ্ছে মাথা,

 তবু কেউ তোমাকে সাজাতে ভোলেনি

 যার যেমন আছে বল্লম টাঙ্গি সাঁড়াশি

 সে ঠিক সেইভাবেই তোমাকে নিবেদন করছে তার উপচার!

           সুবোধ সরকারের মেধা-ই পারে mythical elements গুলোকে juxtapose করতে ঘোর নাগরিকতায়। মিথকে ব্লু ডেনিমস আর লেদার জ্যাকেটে সজ্জিত ক’রে, imparting a heady whiff of musk around 5 o’clock shades, কবি ‘দোয়েল’কে সঙ্গ দেন কল্লোলিনী তিলোত্তমার  হ্যাপেনিং প্রাণকেন্দ্রে :

“ক্যালিফোর্নিয়া থেকে যখন এল দোয়েল

 আমি তখনও জানতাম না তার বাবার নাম রবিনসন।

 মায়ের নাম বনলতা সেন।

 তুমি বনলতা সেনের মেয়ে ? ভাবা যায়,

 আমি কার সঙ্গে বসে বিয়ার খাচ্ছি?

……

 পার্ক স্ট্রিটের ফ্লোরিয়ানা থেকে আমরা চললাম কলেজ স্ট্রিটের দিকে

 পিঠ উপচে নেমেছে তার খোলা চুল

 আমি বললাম, এই, তোমার বিদিশায়  একটু হাত দেব?

 সে বলল শিট, আবার বনলতা সেন?

 কবির আন্তর্জাতিকতা তাঁকে মিথ আহরণ করিয়েছে ভূমধ্যসাগরের বেলাভূমি থেকেও। তাঁর ‘ক্রীতদাস’ কবিতার উচ্চারণ :

 আমার দুই দাদা

হেক্টর আর অ্যাকিলিস

 কোন কাশবনের ভেতর এখনও মারামারি করছে 

 প্রতিবছর কাশ আরও লম্বা হচ্ছে লোকে যাতে দেখতে না পায়

 একজনের হাতে শাবল একজনের হাতে বল্লম

 ওরা কি কোনোদিন থামবে না? কেউ ওদের থামাতে পারবে না?

           ওঁরা কোথায়? পাঠক হয়তো লক্ষ্য করেছেন দুটি নাম — জীবনানন্দ দাশ এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায় এই প্রবন্ধে  আলোচিত হয়নি। কারণ একটাই — এই দুই কবি নিজেরাই সশরীরে মিথ হয়ে উঠেছেন। প্রথমজন শুধু বনলতা সেন বা অরুণিমা সান্যালকে নয়, কলকাতায় ঢিমেতালে ছুটে চলা একটি পরিবহন মাধ্যমকেও মিথে পর্যবসিত করেছেন। বেশকিছু সাহিত্যপত্রিকার ট্রাম সংখ্যা তার সতেজ উদাহরণ। দ্বিতীয়জন মিথ হয়ে উঠেছেন তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিভায় এবং বোহেমিয়ান যাপনে — দেয়ালে দেয়ালে কার্নিশে কার্নিশে। এঁদের জন্য মিথ প্রসঙ্গটির আলোচনা এই প্রবন্ধকারের মননে আলাদা পরিসরের দাবি রাখে। পরে নিশ্চয়ই করে ওঠা যাবে। লিখতে লিখতে মনে পড়ে গেল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কলমে এক টুকরো মিথযাপন, তাঁর পরম সুহৃদকে নিয়ে লেখা ‘শক্তি’ কবিতায় :

“দুনিয়ার সমস্ত পুলিশ তাকে কুর্নিশ করে,

 রিকশাওয়ালারা ঠুং ঠুং শব্দে হুল্লোড় তোলে

 গ্যারাজমুখী ফাঁকা দোতলা বাসের ড্রাইভার তার সঙ্গে এক বোতল থেকে চুমুক দেয়।”

           এই মিথ প্রসঙ্গে আপাতত কলমটা নামিয়ে রাখার আগে লোভ সামলাতে পারছিনা কবি সুবোধ সরকারের কাছে আর একবার ফিরে যাওয়ার :

“কবিতা যেহেতু ইতিহাসের বেসমেন্ট

 সেই তলভূমি পৌঁছনোর আগে এবং পরে একটা হাহাকার লাগে

 আমি সেই হাহাকারের জন্য দারুণ একটা জর্জেট কিনি

 গলায়, কানে, কব্জিতে পড়াই নীল কারুবাসনা”

 মিথ আমাদের সেই কারুবাসনা। আমাদের mundane dreariness যখন ইথারীয় largesse এর কৃপাদৃষ্টি পায়, বেঁচে থাকাটাই উদযাপন হয়ে ওঠে। নয় বা বারো নিদেনপক্ষে আঠেরো ওয়াটের এলইডি দিয়ে জীবনযাপন চলে যায়। কিন্তু দীপাবলি উদযাপনের সময় কারো কারো প্রয়োজন হয় তেলের প্রদীপের, সুগন্ধি মোমবাতির। পরমপুরুষধন্য গঙ্গাতীরের বিখ্যাত কালীমন্দিরের আলোকসজ্জা এমনভাবে করা হয়, যেন সেই কিংবদন্তি চাতাল জুড়ে নেমে এসেছে গ্যাসবাতির পেলবতা! ঋতবান মাত্রই জানেন এই পেলবতা মিথ বটে, তবে মিথ্যে নয়, ধ্রুব। আর যাহা ধ্রুব, পোয়েট্রি আভাসে ইঙ্গিতে তাহারই স্বীকারমূর্চ্ছনা…

আরও পড়ুন...