উ ই ন্ডো সি ট
‘a poet is one who writes verses
and one who does not write verses’
//
অসাড়-অনন্ত সময়; কিছু করবার নেই। কবিতা—চুপ। একটা মেল-ট্রেন, দ্রুতগতিতে ফাঁকা স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। কয়েকটা বাড়ি পরেই আড়ষ্ট শরীর নিয়ে কেশে উঠছে কেউ। খুব মনে হয়, আর যদি নাই লেখা হয়; কোনও ক্ষতি হবে কি? এই লেখা না-জন্মানোর জন্যে কি কোনও মানুষের অসুখী ফুসফুস কেঁপে উঠবে? সরে যাবে নক্ষত্রগুলো একে-অন্যের অবস্থান থেকে? রাতের কুকুরগুলো আশ্চর্য কোলাহল করছে। যেন একে-অপরের মাংস খুবলে নেবে। লেখালিখি তো করতে আসিনি। এসেছিলাম কিছু বন্ধুবান্ধব নিয়ে মাঠে বসে গল্প করতে। যে-মাঠের ধারে একটা নদী থাকবে। কিন্তু এত ভিড় সেই গল্প আর করা হল না! কারণ, মাঠটাই আর রইল না। তামাশার মধ্যে দিয়ে চলতে-চলতে মনে হয়, সেই হাঁটা কবে হবে? আগুনের মধ্যে দিয়ে হাঁটা? এই হাওড়া শহরতলি থেকে জেগে ওঠা উত্ ক্ষেপক আমাকে টেনে এনেছিল অন্য এক জানলার কাছে। সেই জানলা দিয়ে তাকিয়ে আমি, এমনকি হারিয়ে ফেলব আমার অন্যতম প্রিয় মানুষকে, এ-কথাও কি ভেবেছিলাম? কবিতার কাছে যাওয়া মানে সময়ের মেরুদণ্ডে দাঁড়ানো। বিপন্নতার মুখোমুখি দাঁড়ানো। কবিতা-রচনার সততা তার মূল্য দাবি করবে লিখিয়ের কাছে। এই অসাড়-অনন্ত সময়ে; মেরুব্যাপ্ত লক-ডাউনের অন্ধতায়। হতে পারে যে-মাঠে বসে গল্প করা শুরু হয়েছিল, রাতজাগা শুরু হয়েছিল, তার অনুভূতিপ্রবণ ঘাসগুলো একদিন সূর্যালোক পেয়ে পুড়ে গেল। সফল কবিতা-লিখিয়ে তুমি; কিন্তু সেই বিদ্বেষের আগুন তুমি বুঝতে পারোনি। শুধু ওই রাতজাগা পাগল জানে, জেগে থাকবার প্রকৃত আনন্দ হল—একা থাকা। কুকুরের ডাকে অখণ্ড নীরবতায় ছেদ পড়ে। চলমান রূপকল্প নিয়ে ভেসে যায় মধ্যরাত। ভাবি, কবে ওই কুকুরের ল্যাজের মতো অগ্নিজেদ পাব।
কাব্যভাবনা যখন অর্থ হারিয়ে ফেলা জীবনের কোণ থেকে উঠে আসে, তখন তাকে কেমন লাগে পড়তে? কোনও পাঠক কি সংযোগ স্থাপন করতে পারেন তার সঙ্গে? ভিন্ন প্রতিবেশ হলেও কি মনে করতে পারেন একবারও, এ-আমার কথাই লিখেছে? কবিতার ভাবনা-চিন্তার কথা অনেক লেখা হয়ে গেছে। পূর্বজ্ঞানের পাহাড় অতিক্রম করে আত্মসন্দেহকারী কোনও আনকোরা মন ভেতরে-ভেতরে সংকল্প গ্রহণ করেছে। অনুভুতি জন্মাচ্ছে, চেতনাপ্রদেশ থেকে সাড়া পাচ্ছে তার মন। মস্তিষ্ক আর হৃদয়ের নিবিড় স্নায়ুতন্ত্রের গুঞ্জনে, উত্তেজনা-প্রশমনের দ্বন্দ্বে, শৈশবের গ্রন্থি ছুঁয়ে মৌলিকতা খুঁজতে চাইছে তার ভাবনা। কিন্তু কী ভাববে সে? এতদিনের ঐশ্বর্যময় পূর্বজ্ঞানের পরিশীলিত ধারনাকে অতিক্রম করবার মন সে অধিকার করবে কোন কাব্যভাবনার শক্তিতে? কবিতা তো কেমন হয়, তার ধাঁচা তৈরি করে গেছে এতদিনে। তার বাইরে গিয়েও লেখবার চেষ্টা হয়েছে। আন্তর্জাতিক কবিতা লেখবার আততি নয়; বরং একটি প্রকৃত-স্থানিক-আত্মবিশ্লেষণধর্মী উচ্চারণই ভবিষ্যতের কবিতা হবার যোগ্য। হতে পারে, নিজের কথা না-বলে লেখায় উঠে এল অন্যের প্রসঙ্গ। তাকেও বুঝতে হবে নিজেরই ভাষ্যে। অনুভুতি, প্রজ্ঞা, ধী-শক্তির প্রয়োগে জন্মাবে আগামীর কাব্যচেতনা। জনমুখী রাজনৈতিক আদর্শের স্বস্তা খাতেও এসে দাঁড়াতে পারে ভাষা। সমাজ-অনুসারী না হলেও কবির প্রখর অনুভূতি সমাজ ও সময়কে বাদ দিয়ে ঘনীভূত হতে পারে না। সময়ের মধ্যেই যদি ফাঁপা দর্শনের প্রমিতি সর্বস্ব হয়ে উঠতে থাকে, যদি মনে হয় চিরায়ত ভাষার থেকে এই আপদকালীন ভাষাতেই উতরে যাবে কাব্যচেতনার গন্ডি, তাহলে সেটা নিজের সঙ্গেই নিজের প্রতারণা। ভাষাটা মুখ্য নয়, চিন্তা, অনুভূতির মর্মন্তুদ অনুশীলন, যা লেখা হবার সময়েও চলতে থাকে। কিংবা যখন লেখা চুপ, সেই মুহূর্তে হাতচক্ষু অন্ধপ্রায়, তখনও অনুভূতির মর্মন্তুদ অনুশীলনের খামতি পড়লে চলে না। দায়বদ্ধতা জরুরি। নিজেকে উত্সর্গ করা জরুরি। কিন্তু কীভাবে সর্বক্ষণের এই প্রস্তুতি গড়ে তুলবে একজন লিখিয়ের প্রতিদিনকে? শুধুমাত্র লেখাকে সম্বল করে জীবন অতিবাহিত করা সম্ভব হয় ক-জনের পক্ষে? পূর্বপুরুষের ধিকিধিকি পুড়তে থাকা মৃতদেহর কাছে সে-শুধু দু-মুঠো নিরবচ্ছিন্ন সময় প্রার্থনা করে। কে দেবে তাকে এই সময়? মহাকালের ইশারা? তার তো দিনানুদিন কেটে যায় চারাপোনা কেনবার দরদামে, ব্যাঙ্কের দাঁড়ানো দীর্ঘ লাইনের ক্লান্তিতে, পারিবারিক অশান্তিতে, বন্ধুর তীক্ষ্ণ অপমানে। আর এইসব আরো-আরো জীবনধারণের পাহাড়ের মধ্যে দিয়েই তাকে জাগিয়ে রাখতে হয় সেই অনুভূতির অনুশীলনকে। বুঝে নিতে হয় তার জন্যে নির্ধারিত বাস্তবকে এবং বহু-আকাঙ্ক্ষিত অ-বাস্তবকে। কী পেয়েছে সে—কী পায়নি…এর সঙ্গেই সংযুক্ত আক্ষেপে, জন্ম নেয় মনের ভেতর দমবন্ধ হয়ে থাকা অন্তর্দীপ্তি। সাধারণ আকাঙ্ক্ষার সঙ্গেই ভাষা নিয়ে হারাকিরি করতে চাওয়া এই মানুষটি তখন চরম বিপন্ন। সে আদ্যন্ত নিয়ন্ত্রিত, নজরবন্দী। কোনও অবস্থাতেই তার শিল্পের স্বেচ্ছাচার সম্পন্ন হবে না। ভাল কবি হতে পারে সে। নরম-শরম লিখিয়ে। বই-মঞ্চ-পুরস্কার-সিঁড়ি তাকে আরো আরো বেশি জননেতা করে তোলে; আরো বেশি সুনিয়ন্ত্রিত। তখন যদি মনের আঁচ না নিভে গিয়ে থাকে, যদি তখনও সত্যের আগ্নেয় বার্তা সেই অন্তর্গত রক্তপাতকে সৃষ্টিশীল রাখে– কবিতা লেখা হয়। সমাজের সংসর্গে, জনমানসের দিকে প্রবল ঝাঁকুনিতে, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রের বেপরোয়া রেলায়—কবিতা লেখা হয়। শান্তভাবে জীবনে ওঠবার পিচ্ছিল সিঁড়িগুলো হাসিমুখে মুছে ফেলতে-ফেলতে—কবিতা লেখা হয়। এবং সেই আততায়ী লেখাগুলো ঘনসংবদ্ধ হতে-হতে তৈরি করে নিজস্ব এক কাব্যচেতনা; তৈরি করে নতুন এক সম্ভাবনার ব-দ্বীপ।
যার কিছু নেই তার মৃত্যু আছে। কিংবা যার মৃত্যু আছে, তার আর কিছুর প্রয়োজন নেই। চোখের সামনে দিয়ে অনবরত একশো-দুই অ্যাম্বুলেন্স চলতে দেখে মৃত্যুকে অভ্যেস করে ফেলেছে মানুষ। তাহলে কি পৃথিবী ছেড়ে যাবার অনুভূতি, আশঙ্কা তাকে আর নাড়া দেয় না! যে মৃত্যুভয়ের চেতনা তার মনোজগতকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, ভালবাসতে শিখিয়েছিল নিকটজনকে, পরিপার্শ্বকে; সেই ভালবাসা নিদারুণ অভ্যেসে করুণ, অসহায়? পৃথিবীর নিঃস্বতম মানুষের কাছেও মৃত্যুকে গ্রহণ করবার ঐশ্বর্য থাকে। জীবনের এক-একটা ঘটনা এক-একটা পাহাড়। তাকে পেরিয়ে যেতে হয় হাসিমুখে। প্রাত্যহিকতার আবর্ত আসে; কখনো সামান্য দেয়, কখনো সামান্য কেড়ে নেয়। বাস্তবতা তৈরি করে, আবার কত সহজেই ভেঙে দেয়। এর সম্মুখে দাঁড়িয়ে হতশ্রী, দ্বিধাবিভক্ত, নাছোড়বান্দা, জেদ শব্দ খুঁজে ফেরে। যে অগ্নিজেদ প্রতিদিনে ক্ষয় হয়ে যায়, তার ওমে আবার শব্দগুলোকে জড়ো করে। উপহাস-উপেক্ষার পাহাড় সরিয়ে সে-তখন অন্য কোনও সমভূমির সন্ধানে। কোন পর্যায়ে পৌঁছে কবিতা আর জীবন এক হয়ে যায়? যখন বিস্তর কবিতা ভিড় করে, মনে জেগে ওঠে আপোশের অনুভূতি। এইভাবে কিংবা অইভাবে লিখতে হবে। তবেই ছাপা, তবেই শৌখিন হাততালি। প্রশংসার অবিচল অর্ধসত্য নিয়ে পথ হাঁটি। মৃত্যুকে ভয় পাই। মুহূর্তের আশঙ্কা আমাকে সরিয়ে নেয়—জীবনের থেকে। গভীর শব্দবীজ তখন অন্য কোনও গ্রহ; যাকে রাতজাগা চোখে আমি আর চিনতে পারি না। পিতৃপুরুষের দিকে, ঐতিহ্যের দিকে তাকিয়ে বলি: শৈশবে যে-একাগ্রতা শিখিয়েছ, তাকে কখনো না ভুলি। বালকের বিস্ময়বোধ যেন প্রৌঢ়-দার্শনিকতায় আছন্ন না-হয়ে যায়। হতে পারে, এইমাত্র আমি যে কবিতাটি লিখে ফেললাম, এর জন্যে আমাকে একা হয়ে যেতে হবে। তখনও সেই নিঃসীম শূন্যতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যেন প্রাণ খুলে হেসে-উঠতে পারি। জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে যে অপমানিত, পর্যুদস্ত, তার একরোখা, জেদি; অনিশ্চিতের দিকে তার ধাবমানতাই তো মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা। তাকে বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করা জীবনের তাগিদেই। সেই দুঃসহ স্পর্ধাকে ছুঁতে চাওয়ার তাড়না, যাকে সহজে পাওয়া যায় না। যাকে পেতে গেলে জীবনকে উত্সর্গ করতে হয়। কবিতা তো তেমনই সম্ভাবনার শুঁড়িপথ, যার পরিশেষে সত্যের আগুন চিরঅপেক্ষায় পুড়ে যেতে থাকে।