বি শে ষ র চ না
‘ও মেরী চিন-এ-জঁবি সে গম এ পিন্ হাঁ সমঝা
রাজ-এ-মকতুব বা বেরবতি-এ-উনওঁয়া সমঝা।’
মির্জা গালিবের কবিতার মতোই তাঁর চিঠি ভিন্ন ভিন্ন ইশারায় বিস্তারিত। পাঠকের মনের অন্দরমহলে গিয়ে সেইসব ইশারাই গালিবের মনের দোর গোড়ায় পৌঁছে নিয়ে যায় পাঠককে। আর এমনভাবেই আরও বেশি করে পাঠক খুঁজে পান তার প্রিয় কবিকে।
কিন্তু সত্যি কি তাঁর মনকে স্পর্শ করতে পারি আমরা? খুব চেনা অথচ কোথাও এক নিরুদ্দেশ ভিন্নতার সঙ্গ পায় পাঠকের মন, যখন গালিবের কবিতায় ভিন্ন ভিন্ন চেতনার বোধকে তাঁরা একত্রিত করেন। কাছে এসেও যেন হারিয়ে যান প্রিয় গালিব তাঁর পাঠকের কাছে থেকে। বরং তাঁর চিঠি তাঁকে কিছুটা স্পষ্ট করে। কিন্তু সত্যিই কি তা করে? আমরা কি আদৌ পেরেছি তাঁর কবিতার সামনে হাঁটু মুড়ে বসতে? আমরা কতটা খুঁজে নিতে পেরেছি নিজেকে তাঁর চিঠির সামনে? প্রশ্নগুলো থেকেই যায় কারণ গালিবের কবিতার সঙ্গে তাঁর সময়ের একইরকম ভিন্নতা ছিল। ভিন্নতা ছিল এই কারণে যে তিনি সামগ্রিক বোধের আধারে তাঁর জীবনের প্রবাহকে ধরতে চেয়েছিলেন। আমরা যদি তাঁর কবিতা লেখার সূচনা পর্বের প্রবাহ লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাবো সেখানে এই ভিন্নতা তাঁর ভাষার থেকে জীবনের দিকে নয়, বরং জীবনের দিক থেকে ভাষার দিকে এগিয়ে যাওয়ার একটা বোধ কাজ করত। এই বোধ ছিল অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাওয়ার নয়, বরং আলোর দিক থেকে অন্ধকারের দিকে যাওয়ার। এই অন্ধকার গালিবের নিজস্ব এক অন্ধকার। যে অন্ধকার নির্মাণ থেকে সৃষ্টির দিকে যাওয়ার এক সামগ্রিক বোধ।
‘অ্যাইসা ভী কোই হোগা কেঃ গালিব কো না জানে’
আমাদের মনে পড়বে মৌলানা আলতাফ হুসেন হালির লেখা ‘ইয়াদগার-এ-গালিব’-এর কথা। কিন্তু হালি সেখানে ধরতে চেয়েছিলেন গালিবের বাইরের ভিন্ন ভিন্ন মূর্তিকে আর তাই গালিবের ভেতরের ‘আমি’ আমাদের কাছে অপরিচিতই থেকে গেছে। কিন্তু আমরা যদি তাঁর চিঠিপত্রের দিকে নজর দিই তাহলে গালিবের ভেতরের ‘আমি’-র খুব কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারি হয়তো, আর গালিবের চিঠির ভিন্নতা এখানেই যে তাঁর চিঠিতে আমরা একজন কবির মন চলাচলের প্রবাহকে স্পর্শ করতে পারি। কেননা তাঁর চিঠি কখনও তাঁর ব্যক্তিগত ‘আমি’র তাপে বিস্তার পায়নি, বরং তাতে বিস্তারিত হয়েছে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি।
এখানে রইল গালিবের লেখা দুটি চিঠির অনুবাদ…
(মীর মেহেদী মজরুহকে লেখা একটি চিঠি)
সাহেব,
ইউসুফ মির্জা আপনাকে কোনো চিঠি লেখেনি বলে আপনি চিন্তিত কেন? তিনি সেখানে ভালো আছেন। অফিসারদের সঙ্গে দেখা করা এবং চাকরির সন্ধান করা তাঁকে পুরোপুরি ব্যস্ত রেখেছে। হোসেন মির্জাও সেখানে আছেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করার জন্য সময় চাইছেন এবং পেনশন মঞ্জুর করার জন্য আবেদন করছেন। আমি প্রতি সপ্তাহে দু’জনের কাছ থেকেই কয়েকটি চিঠি পাই, যার উত্তর আমি যথাযথভাবে দিই। ঠিক আছে, ভাই, লখনউ এমন একটি শান্তি ও শৃঙ্খলার সময় উপভোগ করছে যা ভারতীয় প্রশাসনের অধীনে বা বিদ্রোহের আগে ব্রিটিশ প্রশাসনের অধীনে দেখা যায়নি। দিল্লির আভিজাত্য ও ভদ্রতাকে প্রশাসকরা দয়ার সঙ্গে দেখে, প্রত্যেকের সঙ্গে তার পদমর্যাদা এবং সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ করা হয়, পেনশনগুলি একটি রুটিন নিয়মের হিসাবে দেওয়া হয়, এবং পুনর্বাসনের আদেশ জারি করা হয়। জনগণের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের আচরণ ভদ্র ও সভ্য। এবার আরেকটি মজার ঘটনা শুনুন। প্রধান কমিশনার যখন জানতে পারলেন যে তাঁর বিভাগ প্রধানত হিন্দুদের দ্বারা পরিচালিত হয়, তখন তিনি তাদের কয়েকজনকে বদলি করে অন্য জায়গায় নিয়োগ করেন। মুসলমানরা তাঁদের জায়গায় এলেন। সাম্প্রতিক বিপর্যয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত একমাত্র দিল্লি। লখনউ ব্যতীত অন্য সব জায়গার পরিস্থিতি অশান্তির, আগে যেমন ছিল। প্রবেশের অনুমতিপত্র ছাপা হয়েছে। আমি নিজে এই অনুমতিপত্র দেখেছি যেগুলি ফার্সি ভাষায় এইভাবে লেখা- “জরিমানা পরিশোধের পরে দিল্লি শহরে বসবাসের অনুমতি”। জরিমানার পরিমাণ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা দ্বারা নির্ধারিত হয়। আগামীকাল রবিবার, ছুটির দিন। সোমবার থেকে অনুমতিপত্র বিতরণ শুরু হবে। দেখা যাক কীভাবে চলে এই সব, এ সবই সাধারণত দিল্লি শহরের অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত। এবার আমার নিজের একটি গল্প শুনুন। বাইশ মাস চুপচাপ থাকার পর, কোতোয়াল উচ্চপদস্থদের কাছ থেকে একটি নির্দেশনামা পেয়েছেন, তাঁকে আসাদুল্লাহ খানের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে তথ্য পাঠাতে বলেছেন। আসলে কি খারাপ অবস্থা? কোতোয়াল, নিয়মানুযায়ী, আমাকে তাঁর সামনে চারজন সাক্ষী হাজির করতে বলেছেন, যাতে আমি আমাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারি । সেই অনুযায়ী আগামীকাল চারজন সাক্ষী কোতোয়ালের সামনে হাজিরা দেবেন। এর মানে এই নয় যে এই চারজন সাক্ষীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার পর, আমি বকেয়া পাব, এবং পেনশন আবার নিয়মিত হবে। না সাহেব, এটা সম্ভব নয়। আমার আর্থিক দেউলিয়া হবার প্রমাণ কেবলমাত্র আমাকে ‘আশাবাদীদের’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার অধিকার দেবে, আবেদনকারীরা এক বছর বা ছয় মাসের জন্য পেনশন পাওয়ার যোগ্য৷
—গালিব
ফেব্রুয়ারি ১৮৫৯
গালিবের চিঠির সামনে দাঁড়ালে মনে হবে গালিব মুখোমুখি বসে কথা বলছেন। কেননা গালিব নিজেই সে কথা একদিন মুনশি তফতাকে লিখলেন: ‘ভাই আমার তোমার মধ্যে চিঠি লেখা কোথায়, এ তো হলো নিজেদের মধ্যে কথা বলা।’ গালিবের আগে এমন করে কেউ চিঠি লেখার আঙ্গিক ব্যবহার করেননি। আসলে গালিব নিজেই চেয়েছিলেন তাঁর সমগ্র লেখার একটা আলাদা ধারা তৈরি করতে। আর তাই তাঁকে একটি চিঠিতে মুনশি শিউনারায়নকে লিখতে হয়েছিল— ‘ভাই আমি আমার মেজাজের কাছে অসহায়’। কেননা তিনি জানতেন তাঁর কবিতা ভিন্ন ঐতিহ্যের প্রবাহ। যখন উর্দুতে চিঠি লেখা শুরু করলেন সেই চিঠিও আগের সমস্ত বিশ্বাস ও আঙ্গিক তিনি বদলে দিলেন।
গালিবের চিঠি তাই কথা বলবার একটা ধরণ যা নিবিড় হয়ে গালিবের ভিন্নতাকে প্রকাশ করে। আরও একটি চিঠিতে প্রায় একই কথা মুনশি মন্ডলকিশোরকে লিখলেন: ‘আমি একটা সহজ পথ বেছে নিয়েছি। যা কিছু লিখি উর্দুতে লিখি। না কবিতা, না আত্মদর্শন। চিঠিকে কথাবার্তায় পরিণত করে নিয়েছি।’ যেমন লিখলেন…
(মুনশি নবী বখশ হকীরকে লেখা একটি চিঠি)
ভাই সাহেব,
বলুন কেমন গরম পড়েছে, আর কীভাবে যে কেটে যাচ্ছে দিন। খুব ভালো করেছেন বেগমকে রোজা করতে দেননি, ঈশ্বর করুন জ্বর যেন আর না আসে। আমাকে খবর পাঠাবেন, মুনশি আব্দুল লতিফ সাহেব-এর খেয়াল রাখবেন, আর রোজা রাখবেন না, তাহলে ঈশ্বরই জানেন শরীরের অবস্থা কেমন হবে। এটা সত্যিই যে মিঞা তফতা কাব্য সংকলনের নকল করছেন এবং তা লাহোরে পাঠাবেন। আমার উপর প্রচন্ড রেগে আছেন, কেননা নির্দেশ ছিল এই কাব্যসংকলনের ভূমিকা যেন আমি লিখে দিই। আমি বলেছি সাহেব তুমি প্রতিবছর একটি করে কাব্য সংকলন করবে আর আমি কতবার ভূমিকা লিখব? এরপর তিনি আর চিঠি লেখেননি। আমিও তাঁকে চিঠি লিখব না, দেখি কতদিন আমাকে না মনে রাখতে পারেন। ভূমিকা লেখা কি খুব সহজ? হৃদয় খুঁড়ে লিখতে হয়, কোনো কবিতার থেকে কম কিছু নয়, এই গরমে কোথায় আর লিখব, কী যে লিখব? একবার ওঁর সম্মানে একটি ভূমিকা লিখে দিয়েছি এবং তখনও এর জন্য উপহার স্বরূপ আমি এটাই শুনেছিলাম যে ‘আপনি খুশি হতে পারেননি’ আর আমাকে লিখেছিলেন ‘তুমি আমার ক্ষতিই করেছ’। যখন আমি লিখলাম- ভাই তুমি আমার প্রতিপক্ষ নও, বন্ধু তুমি, শিষ্য মনে কর, ঘৃণা সেই বন্ধুত্বকে যে বন্ধুর ক্ষতি করে, আরও ঘৃণা সেই গুরুর প্রতি যে নিজের শিষ্যের চোখে পর্দা দিয়ে রাখে আর তার ক্ষতি করে, তখন সে লজ্জা পেয়ে সেসময় চুপ করে। তোমার দিব্বি দিয়ে বলছি ভূমিকা লেখার ব্যাপারে এই একমাত্র বিষয় নয়, বরং আমার এখন আর সে ক্ষমতা নেই, ঈশ্বরই জানেন আমি কেমনভাবে বেঁচে আছি।
—আসাদুল্লাহ