গ ল্প
সুখদেব বাউড়ি বগলে একটা লাঠি আর হাতে একটা হেঁসো নিয়ে ঘোরে রাতদিন। ধারালো হেঁসো দিয়ে শুকনো ডালপালা কাটতে কাটতে বলে- এই হেঁসো তোর গলায় যেদিন বসিয়ে দোবো, সেদিন আমার শান্তি হবে। জঙ্গলে তার পাশেই ছিপ হাতে বসেছিল নাড়ু বাউড়ি। সুখদেবের একথা শুনে ভয় পেয়ে বলে ওঠে- কেনে কী করলাম আমি! সুখদেব ওকে দেখেনি, এখন তাকে দেখে লাঠি বগলে হেঁসো আর জঙ্গলের শুকনো ডালপালা নিয়ে হনহন করে হাঁটা লাগাল।
সুখদেব এই শুকনো ডালপালা বাড়ির উঠোনে রাখে। তারপর তার ছেলের বউ রান্নাশালে বসে উনুনে গোঁজে শুকনো ডালপালা।
বাউড়ি হল হিন্দু জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। এই বাউড়িরা ভারতের কোনো বহিরাগত জাতি নয়। এরা আমাদের দেশের আদিম অধিবাসী। বাঁকুড়া জেলায় বর্তমানে আনুমানিক বাউড়ি জাতির সংখ্যা প্রায় চার লক্ষের কাছাকাছি। পূর্ব বর্ধমান জেলার নবগ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েতে বংশক্রমে বাউড়িদের বাস আছে।
গ্রামের প্রধান সাহেব বলেন- সমগ্র জেলাব্যাপী প্রত্যেক থানাতেই এদের বসবাস রয়েছে। তবুও একটা জিনিস বিশেষভাবে লক্ষ্য করবার বিষয় এই যে, পুরুলিয়া জেলার পূর্বাংশ ও বাঁকুড়া জেলার পশ্চিমাংশের যে এলাকাটিকে পশ্চিম রাঢ়ের কেন্দ্রভূমি বলা যেতে পারে, সেই এলাকাতেই বাউড়িদের ঘনবসতি গড়ে উঠেছে।
নবগ্রামে বাউড়িদের প্রাধান্য বেশি। প্রধান সাহেব তাদের খোঁজখবর নেন। এবার বন্যায় বাড়ি ভেঙে গেলে সুখদেব পাকা বাড়ি পায়।
সুখদেব নিজের মনে বিড়বিড় করে আর বলে- দোবো শালাকে গলায় হেঁসো বসিয়ে। পাশে কেউ থাকলে জিজ্ঞেস করে- কাকে বসাবি রে, সুখদেব?
সুখদেব উত্তর দেয় না। একবার মুখ তুলে তাকিয়ে হাঁটা লাগায়। তার এই পাগলামির জন্য অনেকে তাকে এড়িয়ে চলে। বলা তো যায় না, কখন বেটার বিগার চাপে, একথা বলে তার পাশের বাড়ির মাধু।
সুখদেব বসে থাকার লোক নয়। সারাদিন সে টো টো করে ঘোরে। বাড়িতে সে খালি হাতে ঢোকে না। কখনও গামছায় বাঁধা চুনোমাছ বা কখনও শুকনো ডালপালা নিয়ে ঢোকে বাড়ি।
তার ছেলে আর ছেলের বউ রোজগার করে। সুখদেবের বউটা বড় বন্যায় ভেসে গিয়েছে জলে। এখন ওরা তিনজন।
সুখদেবের মনে পড়ে, সেবার বানে ঘরবাড়ি ভেঙে গেলে বটগাছের ডালে তারা ওঠে সবাই। একই ডালে সবাই থাকায় ডালটা মট করে ভেঙে পড়ে জলে। সুখদেব ছেলেকে বাঁচায় ভীষণ স্রোত থেকে, কিন্তু বউটাকে বাঁচাতে পারেনি। সেই থেকে সুখদেবের মাথাটা কেমন পাক খেয়ে শুধু বানের জলের স্রোতের মতো ঘুরপাক খায়। কোনও কিছু সাজাতে পারে না। ঘুমোবার সময় বলে ওঠে- দোবো শালার গলায় পেঁচিয়ে।
আসলে বাড়ি ভাঙার কারণ অতিরিক্ত ছাড়া জল। পঞ্চায়েতের বড়বাবু বলেন- ম্যানমেড ফ্লাড। বুঝিয়ে বলাতে সুখদেব বুঝতে পারে। সে বড়বাবুকে বলে- লিয়ে আসতে পারেন ওকে আমার সামনে। একটা লাঠির ঘা ওর পিঠে বসালে বউ মরার দুঃখটা কমত একটুখানি।
বড়বাবু বলে- ওসব বলতে নাই সুখদেব। তোমার দুঃখ গ্রামের সবাই বোঝে।
সুখদেব ভাবে, কই বাউড়িদের ছেলেমেয়েগোলা নেকাপড়া শেখে না কেনে। সারা জেবন শালা আমাদের মতো হয়ে থাকলে হবে! মাধু বলে ছেলেমেয়েরা তার কথা শুনে গ্রামের স্কুলে পড়ে। সকলে সুখদেবকে বুঝতে লারে। ওর মনে একটা সোনার পাথর আছে।
মাধুর কথা শুনে বড়বাবু বলে- তুই তো সুখদেবকে বিয়ে করতে পারিস। তু তো বাঁজা বলে শ্বশুরঘর থেকে চলে এলি। এখন ওকে বিয়ে করে সুখে থাক।
মাধু বলে- এ কথাটা মনে আসে নাই ত লয়, তবে পাগলাটা যদি মারে?
বড়বাবু বলেন- ও মারবে না। মুখে বড়াই করে।
তারপর মাধু ঝাঁট দিয়ে বড়বাবুর ঘর পরিষ্কার করে। বড়বাবু পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আদর করে। তারপর পাঁচশ টাকা গুঁজে দেয় মাধুর গতরে।
সুখদেব বাড়িতে ভাত থেকে মদ তৈরি করে। বাউড়িপাড়ার পাশ দিয়ে গেলে এই পচাভাতের গন্ধ ভুরভুর করে।
মাধু বলে- কী করে হয় গো মদ?
সুখদেব বলে- তোর কী দরকার! তবে জানতে যখন চাইছিস, শোন। ভাত পচে গেলে একটা বড় হাঁড়িতে বসিয়ে তা ফের ফোটানো হয় উনুনে। ওই হাঁড়ির উপরে বসানো হয় আরও একটি হাঁড়ি। পচা ভাতের বাষ্প পাইপের মাধ্যমে ফোঁটা ফোঁটা করে জমা হয় জারিকেনে বা বোতলে।
মাধু বলে- এটাই হচ্ছে চোলাই মদ বা ইথাইল অ্যালকোহল।
সুখদেব বলে- তু তো একটু নেকাপড়া জানিস। তুই বলতি পারবি, আমি বুঝি না। ভালো লাগে খাই, বউটার মায়া গুলে খাই, ব্যস।
মদ খেয়ে নেশার চোখে, মাধুকে আড়চোখে দেখে সুখদেব। সে বলে- আমার কাছে চালাকি লয়, দোবো শালা গলায় পেঁচিয়ে।
মাধু ধরা পড়ার ভয়ে ঘরে ঢোকে আর ঘরের ফুটো দিয়ে দেখে মাধু, সুখদেব ওর বউকে খোঁজে তার বাড়ির চারপাশে। বড় মায়া হয় মাধুর। আকার ধোঁয়ার মত ভালোবাসটা গভীরে গিয়ে জলে ভেজে। সুখদেবের মনটা কখন যে মাধু ধরে ফেলে, সে জানে না।
বাউড়ি পাড়ায় উনুনকে আকা বলে। ওদের কিছু কিছু ভাষা নিজস্ব। তাদের সমাজে প্রচলিত ভাষা। আর তাদের কথায় কথা বলে আনন্দ পায় মাধুর মতো মেয়েরা। বন্যাকে ওরা বান বলে, কেন কে বলে কেনে।
একদিন রাতে মাধু স্বপ্ন দেখে, সুখদেব তার ওপরে চেপে সুখের বানে ভেসে চলেছে দেহবানের জলে। মাধু ধড়ফড় করে উঠে দেখে না স্বপ্ন নয়, তার পাশে সুখদেব হাঁপাইছে। তার ঘরের চাল খড়ের। খড়ের চাল ফুটো করে সুখদেব ঢুকে তাকে সুখের বানে ভাসিয়েছে। মাধু মনের আনন্দে সুখদেবকে জড়িয়ে ধরে। ভোরবেলায় আবার সুখদেব ঘর থেকে বেরিয়ে জঙ্গলে যায়, তালপাতার খোঁজে। সে ভাবে, ঘরের চালটা ফুটো হইছে, তালপাতা দিয়ে বেঁধে দিলেই হবে। তা না হলি বর্ষার জল ঢুকে মাধুকে ভেজাবে। বড়বাবুকে অফিসে যেতে দেখে, বানের জলের মতো সাহসে সে বলে ওঠে- দোবো শালাকে গলায় পেঁচিয়ে।
বড়বাবু ভয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বিন্দু হয়ে মিলিয়ে যায়।