শারদ অর্ঘ্য ১৪২৮ । অন্য শহরের পুজো
সালটা ১৯৭৫। প্রবাস জীবনে বাংলা সংস্কৃতির চর্চা ও পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে তার মেলবন্ধন ঘটানোর জন্য নিউ জার্সি শহরে তৈরি হল একটি বাঙালি সাংস্কৃতিক ক্লাব। এরপর ১৯৭৭ সালে রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কট হলে প্রথম বারোয়ারি দুর্গাপুজো শুরু হয়। সে বছর দুর্গা প্রতিমা আনা হল ক্যানাডা থেকে। ক্যানাডার মন্ট্রিয়ল শহরের এক বাঙালি শিল্পীর হাতে তৈরি হল মায়ের প্রতিমা। এরপর ধীরে ধীরে ক্লাবের জনবল, অর্থবল বাড়তে থাকে। আসে কলকাতার মৃৎশিল্পী অনন্ত মালাকারের তৈরি শোলার নতুন প্রতিমা। ক্রমশ পাঁচ বছর অন্তর জাহাজে করে কুমারটুলি থেকে বিশাল প্রতিমা নিয়ে আসা হয়। নিউ জার্সির প্রথম দুর্গাপুজো কিছুদিনের মধ্যেই রাটগার্সের স্কট হল থেকে স্থানান্তরিত হল সমারসেট শহরের ভাড়া করা ইউক্রেনিয়ান হলে। পুজোর প্রতিটি দিনে প্রায় বারোশো দর্শনার্থী ভিড় জমান এখানে।
শুরুতে অল্পবয়েসি ছেলেরা পুজো দেখতে আসতেন। তাঁদের বিয়ে হল। সঙ্গে আসতে লাগল তাঁদের স্ত্রী, ছেলেমেয়েরা। এখন নাতিনাতনির হাত ধরে পুজো দেখতে আসেন তাঁরা।
আশ্বিনের গোড়া থেকেই আস্তে আস্তে আমেরিকায় ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করে। গাছের পাতার রং বদলে যায়। চারপাশ কমলা লাল আভায় ছেয়ে থাকে। তবে পুজোর ছুটির দিন এখানে নেই, নেই প্যান্ডেলে বাঁশ পড়তে থাকা। কিন্তু এখানে বাঙালির পুজো কল্পনা শুরু হয়ে যায় এই সময় থেকেই। নতুন শাড়ি, এই ক’টা দিনের ছোটদের বিশেষ হালফ্যাশনের বিভিন্ন পোশাক, যে-কোনও বয়েসিই হোন না কেন, প্রত্যেকের কাছে পুজো, মাতৃমূর্তির ডাকের সাজ, ঢাকের বাদ্যি, প্রবাসে সমান আকর্ষণীয়। ঢাকে কাঠি পড়লে, ধুনুচির ধোঁয়ায় হাজার হাজার দর্শনার্থীর ভিড়ে মায়ের মাতৃরূপ জেগে ওঠে। শুধু নিউ জার্সি নয়, বিভিন্ন রাজ্য থেকে বাঙালি তাঁদের সেরা সাজে হাজির হন পুজোমণ্ডপে। তখন ইউক্রেনিয়ান হলের অন্দরের সঙ্গে বাইরের চলমান আমেরিকার কোনও বাস্তব যোগাযোগ থাকে না।
১৯৭৭ সাল থেকে এখানের পুজোয় স্থানীয় বাঙালি পুরোহিত পুজো করতেন। তিনদিনব্যাপী এই পুজোয় কলকাতা এবং মুম্বাই-এর শিল্পীরা আমন্ত্রিত থাকেন। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন। ক্লাবের সদস্যদের ছেলেমেয়েরাও বিভিন্ন নাটক, নৃত্যনাট্য, গীতিনাট্যে অংশগ্রহণ করে। পুজোমণ্ডপের দায়িত্বে যাঁরা থাকেন, তাঁদের নিষ্ঠা ও পরিশ্রমে যথাসম্ভব আচার বিধি মেনে তিনদিনেই ষষ্ঠীর বোধন থেকে দশমীর বিসর্জন সম্পন্ন হয়।
এই তিনদিনের এলাহি রান্নার ভার দেওয়া হয় পেশাদার রাঁধুনিদের হাতে। বলাই বাহুল্য, খাওয়ার ব্যাপারে কল্লোল পুজোর বেশ নামডাক আছে। এঁদের শারদীয় সাহিত্য পত্রিকাও বহুবছর ধরে প্রকাশিত হয়ে চলেছে।
নিউ জার্সিতে এখন প্রায় দশটি দুর্গাপুজো হয়। পুজোর জাঁকজমক হোক অথবা সান্ধ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, এই পুজোগুলি প্রত্যেকেই প্রত্যেকের প্রতিদ্বন্দ্বী। ইদানীং বিদেশে প্রতি বছর সফটওয়্যার প্রযুক্তি কোম্পানির কারণে বাড়ছে বাঙালির সংখ্যা। ক্রমে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে দুর্গাপুজোর সংখ্যা।
নিউ জার্সির আরও কিছু বাঙালি তরুণদের একটি দল যাঁরা সম্প্রতি কর্মসূত্রে এখানে এসেছেন, তাঁরা GSPC বলে একটি সংস্থা স্থাপন করেন। GSPC এক যুব সংস্থা যা অল্পবয়েসি বাঙালিদের নিয়ে সে-বছর ছোট্ট পাড়ার সরস্বতী পুজো শুরু করে। ১৯৮১ সালে এঁরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং দুর্গাপুজোর আয়োজন শুরু করেন। এরপর কয়েক বছরের মধ্যেই GSPC এক অন্যতম বৃহৎ দুর্গোৎসব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। কলকাতার পুজোর মতো নিউ জার্সির পুজো কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি তৈরি হওয়া বেশ স্বাভাবিক ঘটনা। ১৯৯২ সালে GSPC পুজোর কিছু সদস্য আলাদা হয়ে GSCA নামে তাঁদের নতুন পুজো স্থাপন করে প্লেনফিল্ড হাই স্কুলে। এখানেও তিনদিনের উৎসবে মেতে ওঠে আর-এক দল বাঙালি। তাঁদের উৎসাহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে পুজোর ছোটবড় আনন্দ, বিভিন্ন ধরণের মুখরোচক কলকাতার খাবার। এখানেও মুম্বাই ও কলকাতার তারকারা আসতে শুরু করেন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণে। পাশাপাশি চলে স্থানীয় শিল্পীদের আয়োজিত বিভিন্ন ধরণের অনুষ্ঠান। পুজোর ক’টা দিন প্রায় হাজারেরও বেশি মানুষ এখানে একত্রিত হন পুষ্পাঞ্জলি দিতে ও দারুণ সুস্বাদু ভোগ খেতে। প্রসাদের জন্যও বেশ লম্বা লাইন পড়ে।
বিগত বেশ কিছু বছর ধরে ‘উৎসব’ নামে একটি তরুণ সঙ্ঘ আয়োজন করে আরও একটি দুর্গাপুজো। এখানে এলে দেখতে পাবেন মায়ের ডাকের সাজ। ভোগও বেশ লোভনীয়। এছাড়া ধুনুচি নাচ এবং আরতি দেখতেও এই পুজোয় বেশ ভিড় জমে। নিষ্ঠা ও আচার মেনে দুর্গাপুজো হয় নিউ জার্সির উত্তর আমেরিকার ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘে। সপ্তাহান্ত নয়, এখানে ভারতীয় তিথি এবং দিনক্ষণ মেনেই পুজো হয়। অষ্টমীর অঞ্জলির দিন এই পুজোয় রেকর্ড পরিমাণ ভিড় জমে। পুজোর কয়েকটা দিন প্রতিদিনই পুজোর পর খিচুড়ি ভোগের ব্যবস্থা থাকে। সঙ্গে পাঁচমেশালি সবজি, চাটনি এবং পাঁপড়।
আনন্দ মন্দির এবং আদ্যাপীঠ মন্দিরের পুজোও পঞ্জিকা মতে হয়। সাড়ে সাত একর বিস্তৃত এলাকা জুড়ে সিডার গ্রোভ, সমারসেটে আনন্দ মন্দিরের নির্ঘণ্ট মেনে পুজোর পরিবেশ কলকাতার চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। ১৯৯৯ সালে আনন্দ মন্দিরের ট্রাস্ট গঠন হয়। এখানে মন্দির সংলগ্ন অংশ হলো টেগোর হল। ২০১৬ সালে টেরাকোটার কাজ করা এই মন্দিরের উদ্বোধন করা হয়। টেগোর হলের লাউঞ্জে মহিলা উদ্যমীদের বিভিন্ন শাড়ি গয়নার স্টল দেখতে পাবেন। সেখানে বিক্রি হচ্ছে বাংলার তাঁত, সিল্ক ও বিভিন্ন ধারার অলঙ্কারের অত্যাধুনিক ফ্যাশন স্টেটমেন্ট।
বিখ্যাত শিল্পী নন্দলাল বসুর পরিবারের সদস্য, বর্ষীয়ান চিত্রশিল্পী টুলু ভঞ্জের আঁকা ছবি চিত্র প্রদর্শনীতে বিক্রি হয় এই টেগোর হলে। সপ্তাহের মধ্যে পুজো হওয়ার ফলে সকালে লোক কিছু কম হলেও সন্ধ্যা আরতি, সন্ধিপুজো দেখতে প্রচুর মানুষের ভিড় হয়। আদ্যাপীঠ মন্দিরে দেখা যায় অঞ্জলির পর ভোগপ্রসাদ রাঁধছেন বহু স্বেচ্ছাসেবীরা। এঁদের মধ্যে আছেন চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, গবেষক, অধ্যাপক, আইটি বিশেষজ্ঞ, গৃহবধূ ও আরো অনেকেই। তাঁদের সকলের এই বিপুল পরিমাণ স্বেচ্ছাশ্রম অকল্পনীয়। দু’বেলা রান্না হচ্ছে খিচুড়ি, ফ্রায়েড রাইস, নিরামিষ তরকারি, চাটনি, মিষ্টি।
গত বছর নিউ জার্সির সমস্ত দুর্গাপুজো অনলাইন আয়োজিত হয়েছিল। এবছর সিডিসির নিয়ম মেনে আবার শুরু হচ্ছে পুজোর উদ্যোগ। তবে প্রতিটি মন্দির ও ক্লাবে দর্শনার্থীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা হবে। মুখোশ ও স্যানিটাইজার আবশ্যিক।
এভাবেই আমরা ভুলে থাকি কলকাতার পুজো। অথবা এভাবেই পুজোর দিনগুলো উদযাপন করি অন্য আনন্দে। অন্য দেশে। অন্য উদ্দীপনায়। আমেরিকার স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা সংক্রান্ত আইনকানুন প্রতিমা বিসর্জনের অনুমতি দেয় না। পরের বছর আবার সাজানো হয় প্রতিমা। উৎসব ফিরে আসে আনন্দধারায়।
২০২০ এবং ২০২১ সালের সবক’টি দিন-রাত পালটে গেছে মানুষের জীবনে। হতাশা, অবসাদ, স্বজনবিয়োগ, আমাদের মনের মধ্যে রেখে গেল এক অদ্ভুত কঠিন জীবনের সহজপাঠ। মুখোশ পরা মানুষের হাসি কান্না পড়তে শিখছি মানুষের চোখের ভাষায়। এও কি নতুন জীবনের শুভ আগমন নয়?
মা প্রতি বছর এমন অনেক ছন্দ নিয়ে আসেন, বিরাজ করেন প্রতি ঘরের উমার চোখে। দেশ কিংবা বিদেশের আকাশ ছাপিয়ে উমা সর্বত্র কাশফুলে ফুটে ওঠেন। শরৎ মেঘের ভেলা তার চালচিত্র এঁকে রাখে এই প্রবাসের প্রাত্যহিকতায়। বলে, ‘উমা তুমি থাকো, উমা তুমি আছ, উমা যেন আসে বারে বারে।’