শারদ অর্ঘ্য ১৪২৮। দীর্ঘ কবিতা
ভোরের হাওয়া এলে ঘুম ভাঙাতে চেয়ে
চুম হেনে খুলে গেলো নয়নভোলানো,
জানলার ওপারের কার্ণিশে গজিয়ে উঠলো আরও একটি অশ্বত্থমূল
বাজারের পৌষালি মৌতাত এবার জাগো–
জাগো নন্দিত সজনে ফুল আর বাসনা বিলাসী পোকার দল,
আজকের ভোরে যেন লেখা থাকে মৎস্যপুরাণ, পুরনো ঢেউ আর প্রথম লোকাল–
বৃন্দগান বুকে নিয়ে এলপি রেকর্ড-সব, করে রব, রাতি পোহাইলো–
এসো উৎসব সার্কাস, তুমি যেন কোন গ্রহ থেকে মেয়েদের নিয়ে এলে?
তোমার তাঁবুতে ওড়ে ছুটির পতাকা,
শহরের প্রান্তে অকস্মাৎ বাঘের গর্জনশিলা চল্লিশে
বড় ছুটি ছুটি লাগে মন, তুমুল ক্রিকেট হোক,
দুপুরের আলো স্বর্গকুচি হয়ে ছড়িয়ে গেল উলের সম্রাট,
ঘোর লাগা তাপমান, অয়নপথ, পরিযায়ী হাওয়া
আমার শহর, আমাদের বনানীঘেরা চড়ুইভাতির সব পদ
একে একে পাঠাবো তোমায়!
দুপুরে জন্ম নেয় যে সব গভীর রাত.
তুমি তার গানটুকু ছেঁকে নিও
তুমি তার আসন্ন বিপদটুকু বুকে নিয়ে
ফেব্রিকে আঁকা বায়ুপরীদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলো,
বাড়ি জেগে উঠলেই, যারা লুকোবে পর্দায়,
যেন সবকিছু একই আছে, প্রতিটি সেলাই আগেকার মতো
কানভাঙা কাঠের ঘোড়া, সোনারুপো রাংতার সেট,
স্প্রিং দেওয়া খরগোশের হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে আসা বুকে।
বাসের টিকিট ভরা বাতিল বাক্সটি দ্যাখো–
ঠাকুমার থানকাপড়ের মতো আকাশ যতদূর দৃষ্টি যায়,
চরাচর জুড়ে কথক শালিক, ঠোঁট দিয়ে খুঁটে তোলে
জন্মমুহুর্ত, কাঠের আসবাব, কাঁসার বনেদি
মায়া এসে পড়ে গ্রিলঘেরা বারান্দায়,
তোমার খেলার ঘরে নকশা কেঁপে ওঠে
জমে ওঠে বালি, প্রথম প্রোমোটার এসেছে শহরে,
কংক্রিটখোর, ইতস্তত পাথরকুচি আর সিমেন্ট প্রতিভায়
সে পাহাড় প্রমাণ, যার সুড়ঙ্গের অন্য মাথায় রয়েছে গুপ্তধন, ডলিদের বাড়ি।
সেই বালি চিকচিক করে বিষণ্ণ জোছনার রাতে
গব্বরের ডেরা ছুঁয়ে ফেরা, ইতিহাস বইয়ের অস্পষ্ট ব্লকে
তার উজ্জ্বলতা, হাতের মুঠো’র থেকে ঝরে যায়
বেপাড়ার হাওয়া দেয় খুব
ম্যাচ শেষ সন্ধ্যায়, মৃত খেলোয়াড়দের নিঃশ্বাস পড়ে
বুলাদিদির ফেরার সময় হয়ে আসে টিউশন বাড়ি থেকে,
ল্যাম্পপোস্টের নিচে জমে থাকা ষড়যন্ত্র, ফিসফাস, তাহাদের কথা।
শীত তো থাকে না চিরকাল, ঘুমও ভেঙে যায়,
ক্রমশ জটিল হয় লাইব্রেরির আটপৌরে ঘর, নুনধরা দেওয়াল
ছানি পরা চোখে ঈশ্বর বসে লাইব্রেরিয়ান সেজে–
অন্ধকার পিছিয়ে যায় আর দেওয়াল ভাঙে বাধার
সাতটি ভাই পাহারা দেয় প্রাচীন দেওয়াল লিখন।
শহরকে ডুবিয়ে দিয়ে গেল যে নদী
তার সর্বনাশা রূপ আমি দেখিয়াছি,
অন্য নাবিক তাই খুঁজিতে যাই না আর!
গঙ্গার ধারে প্রতিদিন ডুবে যায় মানস প্রতিমা,
সূর্যাস্তের মতো স্বাভাবিক এ সব মৃত্যুদৃশ্য, বালকের ঘাটকাজ।
একটি কমলালেবু ঋতু থেকে চলে আসে ন্যাসপাতি সময়
ডাস্টার পতনের শব্দ হয়, কানে বাজে বাঁশি
যেভাবে বেঞ্চ জানে আজন্ম পেনসিলের ঋণ, সাধ আহ্লাদ
কাঠের উপরে তার কারুবাসনা
আজও লজ্জিত হয়ে আছে,
কাটাকুটি ক্ষত নিয়ে পড়ে আছে হৃদয়চিহ্ন, বাসনাবাহিত বেলা,
পর্যটনহীন আকাশের মতো ফিরে আসে গ্রীষ্মের ছুটি
কলে জল আসে, ঘড়ির সময় মিলিয়ে নেয় ছায়াবীথিতল
সেই নবধারাজলে স্নান সেরে নিলে
কলোনীর সিল্ক-সম স্মিতাদের মাঝে বিম্বিত বিশ্বঅক্ষর, এই খেলাঘরে।
ভোরের হাওয়া এলে ঘুম ভাঙাতে চেয়ে বিষাদ সিন্ধু উতরোল
নিভে থাকা মলিন গানের স্কুলগুলো জানে, যেভাবে মরিচা জানে লোহা,
নয়ন সলিলে কীভাবে স্মৃতির কাজল মোছা হয় গানে,
হারমোনিয়াম ছেঁড়া তীব্র প্রলাপ জানে সেই কথা।
টনসিল আক্রান্ত হলে, সেবার মাফলারও বোনা হল একান্নবর্তী শীতে
তবু কোণের দরোজায় রচনাবলী হাতে তুমি
হলুদ পাতায় পাতায় লবণের খেলা দেখো,
দুঃসংবাদে ভরে ওঠো প্রেতের মতন,
ভোরের হাওয়া এসে ঘুম ভাঙাতে চেয়ে
লিখে রাখছে তোমার এইসব জন্ম আর সেইসব মৃত্যু কথাগুলি…