শারদ অর্ঘ্য ১৪২৮ । অন্য শহরের পুজো
‘আশ্বিনের মাঝামাঝি উঠিল বাজনা বাজি…’! বাংলা ভাষায় লেখা এই শব্দগুলো এত বছর ধরে শুনতে শুনতে বা দেখতে দেখতে যতই ক্লিশে হয়ে যাক না কেন, সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে শুরু হওয়া দিনগুলো ক্যালেন্ডারের পাতায় একবার দেখা দিতে শুরু করলে মনের কোণের কোথাও না কোথাও সেই বাজনার সুর বেজে উঠবেই। সে জন্য আপনাকে শুধু যে পৃথিবীর পুব-প্রান্তের বঙ্গদেশের মানুষই হতে হবে তা কিন্তু নয়; পৃথিবীর আরও তিন-প্রান্তে ছড়িয়েছিটিয়ে বসবাসকারী সেই সুরের ভাষায় কথা বলা মানুষ হলেই চলবে। এই মার্কিন দেশে সেই বাজনার সুরেরই একটা স্পেশাল ভ্যারিয়েশন বহু বছর পার হয়ে আজও বেজে চলেছে…
…প্রতিবছরের মত হয়তো এভাবেই মাঝ-আশ্বিনের মার্কিনি-ভার্সনের বাজনার সুর ধরে, চারপাশের গাছের পাতার রঙিন হতে থাকা ‘ফল’-এর রঙিন এই সময়টাকে নিয়ে সেই আবহমান কবির কবিতার কথা লিখতে পারতাম। কিন্তু কুড়ি-কুড়ি পার হয়ে, কুড়ি-একুশের প্রায় শেষভাগে ঢুকে পড়ে, অতিমারির দিনরাতে সেই সুর-তাল-লয়-ছন্দ কোনওটাই আর সেভাবে মনের কোণে বেজে উঠছে না। তাই প্রতিবছর এই স্পেশাল সময়টা যেভাবে ‘উইকএন্ডার পুজো’ উপহার দিয়ে থাকে আমাদের মত প্রবাসী বঙ্গজদের; সেই উপহারের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেলেও মন সেভাবে সাড়া দিয়ে উঠছে না; অন্তত আমার ক্ষেত্রে তো একেবারেই নয়। তবু খানিকটা স্মৃতির পাতায় নিজেকে দেখার আনন্দেই হয়তো এই কথাগুলো লেখা; আর দেশের বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার এই প্রয়াস।
আসলে দুর্গাপুজো, বা মিথিক্যাল ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পলিটিক্যালি কারেক্ট করে বিবরণ দিলে যাকে বলা যায় ‘অকালবোধন’, অথবা আরও লোকায়ত করে নিয়ে বলা চলে ‘পুজো’; সেই উৎসবের মূল উৎস ধর্মীয় কারণেই হোক অথবা পৌরাণিক গল্পের বিবর্তনের হাত ধরেই হোক, আর সেই গল্প আমাদের জীবনে প্রভাব ফেলুক বা না ফেলুক; উৎসবের অংশটা যে সামাজিক আর সাংস্কৃতিক আচার-আচরণের মধ্যে দিয়ে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মতো শরীর আর মনের সঙ্গে একাকার হয়ে মিশে গেছে; সেকথা আর নতুন করে বলার কিছু নেই। তাই এই অতিমারির দিনে, সমাজ-সংসার-রাজনীতি-বোধ সবকিছুর খোল-নলচে পাল্টে গেলেও, মহালয়া-টু-মহাদশমী’র এই স্পেশাল-প্যাকেজে মোড়া ক’টা দিন, যখন যেখানেই থাকি না কেন, ছোটবেলার পাস্ট-টেন্স থেকে বড়বেলার প্রেসেন্ট-টেন্স হয়ে সিনেমার রঙিন পর্দায় দেখা স্পেশাল-এফেক্টের মত চোখের সামনে একটার পর একটা রঙিন দৃশ্য তৈরি করতে থাকে। সেই দৃশ্যগুলোর প্রক্ষাপটে কখনও ভেসে ওঠে আমার ফেলে আসা শহর কলকাতা, কখনও উড়ে আসে তিন-সমুদ্র-সাতাশ-নদী পার হয়ে আসা আমার আরেক শহর নিউ ইয়র্ক, কখনও বা লং-ড্রাইভে গাড়ি চালিয়ে ছুটে আসে আমার বর্তমান বাসস্থল ম্যাসাচুসেটস্ রাজ্যের বস্টন শহরের শহরতলী।
অবশ্য আজকের এই মার্কিন মুলুকে, সে অর্থে অভিবাসী দেশ-শহর-জীবনের মত, অভিবাসী পুজোগুলোও পাল্টে গেছে। দেশ ছেড়ে এসে এই এলেম-নতুন-দেশে’র কতিপয় বঙ্গসন্তানের তৈরি ঘরের-কাছে-আরশিনগর হয়ে একসময় যে পুজো ছিল খুব ছোট আকারের, তা হয়ে গিয়েছে বিশাল বড়। আবার হয়তো যাকে মনে হয়েছিল বিরাট একটা কিছু, তা পাল্টে ঢুকে পড়েছে খুব ছোট একটা গন্ডির ভেতরে। চারপাশের পরিবেশও বদলে গেছে অনেকটাই বর্তমান রাজ-অর্থ-নীতি’র হালচাল দেখে-শুনে-বুঝে। আর এই বঙ্গসম্মেলনী পুজো, পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশের মানুষের হাতেও পাল্টে গেছে অনেকটা। সেই ওলোট-পালটের কারণ বা ফলাফলের বিচার বা বিশ্লেষণের মধ্যে এই মুহুর্তে আর যাচ্ছি না।
তবু এখনও এই মার্কিন মুলুকের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে থাকা বঙ্গজজনেরা ক্যালেন্ডারের তারিখের লাল রং মিলিয়ে তার দু’এক সপ্তাহ আগেকার অথবা পরের উইকএন্ডের শনি-রবিবারের দিকে তাকিয়ে তাদের দৈনন্দিন অফিসিয়াল শার্ট-স্ল্যাক্স-প্যান্ট-স্কার্ট ছেড়ে ক্লোসেটের এক কোণায় ভাঁজ করে রাখা শাড়ি-পাঞ্জাবির পাট ভাঙতে থাকেন ও থাকবেন। কলকাতা বা বঙ্গদেশের আদি-অকৃত্রিম চারদিনের লং-টার্ম ‘অকালবোধন’ উৎসব, এই মার্কিনমুলুকে বসবাসকারী কর্মযোগী বঙ্গসন্তানদের হাতে যে উইকএন্ডের দুদিনের একটা শর্টহ্যান্ড ভার্সানে পরিণত হয়; সেটা কিন্তু সত্যিই একটা উল্লেখ করার মত ব্যাপার! ধরুন, বঙ্গদেশে ক্যালেন্ডারে দাগ দেওয়া লাল-রঙা কম্বিনেশন নিয়ে সপ্তাহ-শুরুর পর মঙ্গলের মহা-সপ্তমী হয়ে শুক্রবারের রাতে যখন বিজয়া-দশমীর বিসর্জনের ঢাকের আওয়াজ বাজনার তালেতালে বেড়েই চলেছে; তখন সেই শুক্রবারের রাতে সারা সপ্তাহ অফিসে কাটিয়ে বঙ্গজ বাবু-বিবিরা জড় হচ্ছেন পাড়াতুতো এক স্কুলের অডিটোরিয়ামের চত্তরে; মা-দুর্গা আর তার ছেলেপুলেকে বাড়ির বেসমেন্ট থেকে বের করে ধুলো ঝেড়ে পরের দু’দিনের সকাল-দুপুর-বিকেল-সন্ধে আর-রাত-জুড়ে চলতে থাকা বোধন-টু-বিসর্জনের প্রস্তুতি নেবার জন্য। আবার যদি কোনও এক শহরের পুজো কলকাতার ভাসান-শেষের রাত থেকে শুরু হয়, তাহলে হয়তো অন্য আরেক শহরতলীর পুজো কলকাতায় মহালয়ার স্তোত্রপাঠের সঙ্গেসঙ্গে এক হপ্তা আগের উইকএন্ডেই শুরু হয়ে শেষও হয়ে গেছে। এভাবেই বাবু-বিবি’র পুজো-পরিক্রমা দেশের ক্যালেন্ডারে আশ্বিনের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়ে কালীপুজোর কাছাকাছি পৌঁছে তবে শেষ হয়। তারপর মা দুর্গা আর তার পরিবার আবার স্কুলের ক্লাস শেষ করে বেসমেন্টে ঢুকে পড়েন, আরও একবছর সেখানে প্যাকিং-বাক্সের ভেতর লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে কাটিয়ে দেবেন বলে। এই ‘উইকএন্ডার পুজো’ কিন্তু সংখ্যায় নেহাত কম নয়। এই হট্টমেলার হট্টগোলের মধ্যে দিয়ে আমাদের দিনরাত কাটে প্রতিবছর, আসছে-বছর-আবার-হবে ভাবতে ভাবতে।
দিনরাতের সেই স্মৃতিই এই লেখাটার মধ্যে দিয়ে আজ অল্প খানিকটা তুলে ধরলাম। আজকের তুমুল ধর্মান্ধ অসহনীয় দিন কাটাতে কাটাতে, আর অতিমারির ভয়াবহ অবস্থা পার হতে হতে সেই উৎসবের সহজ সরল আবহমান সুরের বোধই হয়তো আমাদের সবাইকে বেঁধে রাখবে এক বিনি সুতোর মালায়। যাকে ঠিক শব্দ বা অক্ষরে প্রকাশ করা যায় না। যাকে অনুভব করতে হয়। শব্দ আর অক্ষরের বর্ণমালা হয়ে যায় ছবির মতো বর্ণময়। অক্ষরগুলো হাতের আঙুল আর কীবোর্ডের পাতা থেকে মনের গভীরে রং-তুলি নিয়ে ছবি এঁকে যায় কাগজের ওপর ক্রেয়নে, অথবা ক্যানভাসে তেল-রং দিয়ে; অথবা আইফোনের টাচবাটনে লেখা হরফের ক্যালিগ্রাফি হয়ে।
এই প্যান্ডেমিক আক্রান্ত পৃথিবীর ভয়ঙ্কর সময়েও যখন আত্মবিস্মৃত মানুষ তার স্যোশিও-পলিটিকাল নির্বাচনের মাপকাঠিগুলো পাল্টে ফেলেছে, তখনও পুজোর আনন্দের ভালোবাসার মাপে কোনও ঘাটতি পড়বে না এই আশাতেই থাকছি। ভালোবাসার উৎসবের দিনগুলোতে সবাই যেন ভালো থাকে।