শারদ অর্ঘ্য ১৪২৮ । গল্প
১
বারান্দার এদিকটায় গা ছমছম করে সুরতিয়ার। ডালপালাহীন ন্যাড়া গাছ। মাথায় দ্বাদশীর চাঁদ। বেশ অনেকটা দূরে একটা কালো বাদুড় চাঁদ ছুঁয়ে উড়ে গেল। সুরতিয়ার সামনে, পিছনে, দুপাশে জমাট অন্ধকার। মাটি রঙের লুটনো ঘাগরা দু’পাশে অল্প তুলে ছুটতে শুরু করলো সুরতিয়া। দাদুর ঘরটা কোন দিকে? অদ্ভুত! তার নিজের বাড়ির কোন দিকে কোন দরজা নিজেই ভুলে গেছে ও। না, খুঁজে পেতেই হবে। থামল সুরতিয়া। সামনে আবছা কঠিন অখণ্ড উঠে গেছে বরাবর। দেওয়াল? না, দরজা? না, এটাও না। সামনের দিকে কোন একটা দরজা হবে। হঠাৎ বেশ জোরে একটা ধাক্কা পেল সুরতিয়া। একটা কাচের গ্লাস ভাঙার ঝনঝন শব্দ… রেশ রয়ে যাচ্ছে… তীক্ষ্ণ… ডান পায়ে খুব লেগেছে সুরতিয়ার…
২
বেড সুইচ টিপে আলো জ্বালালো জয়দ্রথ। রাতে একটু বেশিই ড্রিঙ্ক করে ফেলেছে। চোখ রগড়ে দেখল খাটের পাশে মেঝের ওপর বসে আছে মন্দিরা।
–“আর কতদিন এরকম চলবে মন্দিরা? কতদিন বলেছি ঘুম না এলে মাঝে মাঝে রাতে একটা করে স্লিপিং পিল খেলে কিচ্ছু হয় না। মাঝরাতে এরকম নাটক করার চেয়ে তো বেটার!” চোখে মুখ কুঁচকে খাট থেকে নেমে স্লিপার গলাতে গলাতে জয়দ্রথ বিড়বিড় করে উঠলো।
–“সরি আমি বুঝতে পারিনি।”
–“কোনদিনই কিছু বুঝতে পারোনা তুমি। ডিসগাস্টিং।”
নাইটড্রেসটা সামলে আস্তে আস্তে ওঠার চেষ্টা করে মন্দিরা। ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের মাথাটা টনটন করছে। হালকা খোঁড়াতে খোঁড়াতে বারান্দার দিকে বাথরুমে ঢোকে মন্দিরা। এই ফ্ল্যাটটায় বাথরুমের সচ্ছলতা খুব একটা নেই। প্রথমদিকে রক্তিম যতদিন এ বাড়িতে ছিল, একটু অসুবিধেই ছিল। রক্তিমের স্টেটসে যাওয়ার পর থেকে এটাতেই মন্দিরার চলে যায়। ভিতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করতেই জেসমিন ফ্রেশনার ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো।
শাওয়ার খুলে নিচে দাঁড়াল মন্দিরা। ঝিরঝির চিন্তাগুলো ঠান্ডা স্রোতে মাথা বয়ে নামছে। ঠান্ডা জলে গুলে যাচ্ছে সব জটপাকানো শিরা। হালকা হতে শুরু করছে মন্দিরা। কিন্তু একটু পরেই ও অনুভব করল চিন্তাগুলো বুকে নেমে কোথাও যেন আটকে যাচ্ছে। দমবন্ধ হয়ে এলো ওর। কি করে এগুলো নামাবে সে? জয়দ্রথকে ডাকবে? না। পাগল বলবে, বিরক্ত হবে জয়দ্রথ। তলপেট ভীষণ ভারী ভারী লাগছে ওর। হালকা করে বাঁ হাতটা তলপেটে রাখল ও। ইস! নাইটড্রেসটা খুলতে ভুলে গেছে ও। নিজের মনেই হেসে উঠল মন্দিরা। ফিতে হালকা টান দিতেই আকাশী নাইটি পড়ে রইল সাদা মার্বেল মেঝেয়। ঊনপঞ্চাশ বর্ষায় ভেজা শরীর চাতকী হয়ে তাকিয়ে রইল শাওয়ারের মুখের দিকে।
৩
উপরের কাচ থেকে শ্যাওলা রঙের আলো এসে পড়ছে সুরতিয়া চোখে, গালে, ঠোঁটে, গলায় আর পায়ের পাতায়। হলুদ চোলি আর গোলাপি ঘাগরা সেঁটে বসেছে সতেরোর শরীরে। উপরে ইতস্তত লেগে আছে লাল গোলাপের পাপড়ি। হাল্কা বাদামী কোমর ছোঁয়া চুল পুরোটা ভেজেনি এখনও। কিছু পাপড়ি আটকে আছে চুলেও। একটা একটা পাপড়ি হাতে ঠেকে… গুনতে শুরু করে সুরতিয়া। এটা ভীষণ প্রিয় খেলা সুরতিয়ার। পাপড়ি গুনতে শুরু করে… কিছুক্ষণ গোনে… আবার ভুলে যায়। গোনা পাপড়ি আবার ছড়িয়ে দেয় জলে। আবার গুনতে শুরু করে প্রথম থেকে…
স্নানের জায়গাটা দাদু তৈরি করে দিয়েছিলেন। মান্দরের এই দিকটায় জনবসতি খুব একটা বেশি নয়, তাই সব কিছুর জন্যেই প্রায়ই যোধপুর যেতে হয় তাদের। তাও নয় নয় করে সুরজমহল থেকে ঘণ্টাখানেকের রাস্তা। তবু আগের জন্মদিনে দাদু যোধপুর থেকে একুশজন লোক নিয়ে মাত্র এক মাসের মধ্যে তৈরি করে দিয়েছিলেন এই স্নানঘর। এত বড় সোলাঙ্কি পরিবারের একমাত্র উত্তরাধিকারের এইটুকু বিলাসিতার জন্য একসঙ্গে কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করার আগে একবারও ভাবেননি শিবেন্দ্রপ্রসাদ। একমাত্র ছেলে সূর্যপ্রসাদ উত্তরের পাহাড়ের শিকারে গিয়ে ফিরে আসেননি আর। সেই রাতের কথা ভাবলে এখনো শিউরে ওঠেন শিবেন্দ্রপ্রসাদ। পুত্রবধূ রূপমতী প্রসব বেদনায় ছটফট করছে। সারা মহলে মাথা বলতে ওই একমাত্র বাহান্ন বছরের বৃদ্ধ। এছাড়া চাকর চাকরানী মিলিয়ে আরও সাতজন। তারাও সবাই প্রায় বার্ধক্যের দরজায়। অস্থির হয়ে শিবেন্দ্রপ্রসাদ ছুটে গিয়েছিলেন ঠাকুর ঘরের দরজায়। দেবীর কাছে নতজানু হয়ে মানত করেছিলেন সুরজমহলের একমাত্র প্রদীপ রক্ষার। প্রণাম সেরে মহলে ফিরে দেখেছিলেন মৃত পুত্রবধূর কোলের কাছে জ্বলজ্বল করছে সুরতিয়া। সেই থেকে অন্ধের যষ্টির মতো তাকে আঁকড়ে ধরে আছেন শিবেন্দ্রপ্রসাদ। এসবই দাদুর মুখ থেকে শোনা। সেই সুরতিয়ার জন্য তৈরি বিলাসী বাথটাবে সুরতিয়া এখন ভাসছে। কতক্ষণ কেটে গেছে… হঠাৎ কানে আসে একটা ডাক। লজ্জা পায় সুরতিয়া। বাথটাব থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তোয়ালেটা হাতে নেয়।
৪
বেশ কিছুক্ষণ টানাটানির পর দরজাটা খুলল। গত তিন চার দিন ধরে দরজার পাল্লায় একটা সমস্যা হচ্ছে। সেটা জয়দ্রথকে জানানোর কথা কিছুতেই মনে থাকছে না। দরজা খুলে মন্দিরা দেখল সারা মুখে বিরক্তির ছাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জয়দ্রথ।
–“এটাতেই যাচ্ছ কেন? দরজায় প্রবলেম আছে। তাড়াতাড়ি খোলা যাচ্ছে না। আজই মিস্ত্রিকে ফোন করো একটা।”
—“না, বেরোলেও পারো! একবার ঢুকলে তো আর হুঁশ থাকেনা।” জয়দ্রথের গলায় শ্লেষ।
–“খুব ক্লান্ত লাগছিল। একটু ফ্রেশ হয়ে নিচ্ছিলাম।” মন্দিরার গলায় উদাস হাওয়া।
–“হুম! অর্ধেক রাত জানলার ধারে আর বাকি অর্ধেক বাথরুমে।গুড ওয়ে টু বি ফ্রেশ।” বাথরুমের দরজা বন্ধ করে জয়দ্রথ।
বেশ কয়েকদিন আগে বারান্দায় আইভি লাগিয়েছিল মন্দিরা। আদরের আইভিলতা। সেটা সারা বারান্দায় ছড়িয়ে পাশের জানলা দিয়ে পাকিয়ে পাকিয়ে নামছে। পাতাগুলোর দিকে তাকায় মন্দিরা। শুকিয়ে জ্বলে গেছে। প্রথমদিকে কি ভীষণ নরম ছিল এই পাতাগুলোই… ছুঁতে ভয় লাগত! এই বুঝি যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাবে! শুকনো পাতায় দুটো আঙুল রাখে মন্দিরা।
–“রক্তিমের ফোন এসেছিল। কেটে গেল লাইনটা।” বাথরুম থেকে বেরোতে বেরোতে বলে ওঠে জয়দ্রথ। “আমাকে আবার এখনই বেরোতে হবে। আজ আবার ফার্স্ট আওয়ারে ডীনের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট।”
হঠাৎ জুতোর র্যাকের দিকে তাকিয়ে খিঁচিয়ে ওঠে জয়দ্রথ।
–“দেখেছো আজও পালিশ করা হয়নি… বিটকেল, অ্যাই বিটকেল!”
–“বিটকেল তো কাল থেকে ছুটি নিয়েছে। ওর দিদির বিয়ে। আজ বরং নতুন সেটটা বের করে নাও। দেখি আজ আর আমি বেরোবো না। টুকটাক কাজগুলো সেরে রাখতে হবে।” এক হাতের আঙুল দিয়ে চুল ছাড়াতে ছাড়াতে বলে মন্দিরা।
আইভিলতা শুকিয়ে গেছে। কিছুই ইচ্ছে করছে না মন্দিরার। শুকনো পাতা শুকনো স্মৃতি। চোখের সামনে কষ্ট বেশি। মন্দিরা টেবিলের কাছে এল। ডাইরির পাতা খুলে মালীর ফোন নম্বর খুঁজে ফোন করল ও। নীচের লনে কাজ করছিল মালী। খুব ক্লান্ত গলায় মন্দিরা বোঝাল কীভাবে পুরো বারান্দা পরিষ্কার করে পুরো আইভির ঝাড় তুলে নিয়ে যেতে হবে। বিজলীদি চা এনে রাখল টেবিলে। কাপে হাত না দিয়ে চেয়ার ঘুরিয়ে দেওয়ালের দিকে মুখ করে বসল মন্দিরা। শুকনো আইভি দেখলে কষ্ট বাড়ে। টেবিলের ওপর প্রিজমের নীচে পতপত উড়ছে মাসিক বাজারের ফর্দ। মন্দিরা আলগা তাকিয়ে রইল প্রিজমের দিকে। ছোটবেলায় জয়পুর বেড়াতে গিয়ে রক্তিম বায়না করে কিনেছিল ওটা। জয়দ্রথ এখন ওটা পেপারওয়েট হিসেবে ব্যবহার করে। প্রিজমের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে সম্মোহনের কথা মনে হয়। কলিংবেল বেজে উঠল।
— “দুর! দুর! গাড়ির চাবিটা আবার কোথায় গেল?” জয়দ্রথ ব্যাগ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। “কে এল আবার?”
–“চাবি তোমাকে দেখছে। ধরো।” মন্দিরা টেবিল থেকে চাবি তুলে জয়দ্রথের হাতে দেয়। “নীচের মালী হবে… শুকনো আইভি পরিষ্কার করে যাক”। বলতে বলতেই দরজা খুলল মন্দিরা।
জয়দ্রথকে পাশ কাটিয়ে মালী ড্রয়িং রুম পেরিয়ে বারান্দার দিকে গেল। হাতে গাড়ির চাবি নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে কয়েক মুহূর্ত বারান্দার আইভির দিকে তাকিয়ে থাকল জয়দ্রথ। তারপর বেশ খানিকটা গতি নিয়েই পায়ে জুতো গলিয়ে দরজার দিকে গেল ও।
–“আরে বয়সটা কি থেমে থাকছে নাকি! নয় নয় করেও বাহান্ন! এরকম ভুল তো একটু-আধটু হবেই।” সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে জয়দ্রথ।
এখনো বাতাসে একটু শিরশিরে ঠান্ডাভাব আছে। ফিরে গিয়ে মাফলারটা আনলে হয়। ধুস, রোদও আছে বেশ। লাগবে না। জয়দ্রথ স্টার্ট দিল গাড়িতে। উপরে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে আইভিলতার কাণ্ডটা বাঁকিয়ে বাইরের দিকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করল মন্দিরা। বেয়াড়া লতা! শুকিয়ে গেছে। তাও বারবার ঘরের দিকে মুখ করে থাকতে চাইছে। নিজের মনেই হেসে উঠলো ও। একবার কিচেনে ঢুকতে হবে আজ। ইস! হঠাৎ মনে পড়লো কাল রাতে ভুলে নাইটড্রেসটা পরে স্নান করে নিয়েছে ও। খুব পছন্দের ওটা মন্দিরার। জয়দ্রথকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে পছন্দ করে ওটা কিনেছিল। ঠিকমতো কাল ধোয়াও হয়নি। কি আর করা যাবে! ‘মাগো’ অস্ফুটে চিৎকার করে উঠল মন্দিরা। পায়ের নিচে একটা চিনচিনে যন্ত্রণা। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত বেরোতে লাগল।
–“বিজলীদি, কাচের টুকরোগুলো একটু পরিষ্কার করে নাও গো… আর দ্যাখো, রক্তিমের ঘরে টেবিলের ড্রয়ারে একটা সাদা রঙের মলম আছে। নিয়ে এসো না।”
দুপুর আর রাতের মেনু একসঙ্গে বুঝিয়ে দিয়ে কিচেন থেকে বেরিয়ে এল মন্দিরা। চুল আঁচড়ানো হয়নি সকাল থেকে। থ্রি-ফোল্ড আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল ও। ব্রাউন শেডের শিফন জড়িয়ে থাকা মন্দিরার কাঁধে ছড়িয়ে আছে স্টেপকাট বার্গান্ডি শেডের চুল। শেপটা অবশ্য একটু নষ্ট হয়ে গেছে। আজকাল পার্লারে ঢুকতে একটু অস্বস্তিই হয়। গঠন যতই সুন্দর হোক, বয়সের হিসেবে তো আর কিছুদিন পরই পঞ্চাশে পা দেবে ও। যদিও তার সমাজটা উচ্চ-মধ্যবিত্তের আওতায় পড়ে। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে হালকা চাপ দিতেই বেরিয়ে পড়ল ক্রিমের সারি। সব ক্রিমগুলোর উপর একবার হাত বুলিয়ে একটা ময়েশ্চারাইজার বের করে আনল মন্দিরা। আয়নার ভেতর দিয়েও আবার তাকাল নিজের দিকে। অপলক দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সামনের আয়নায় ভেসে উঠল বত্রিশ বছর আগের মন্দিরা। একটুও অস্পষ্ট নয়। বিভোর হয়ে দেখতে লাগলো ও। নিজের প্রতিটা অংশকে আদর করে দেখতে লাগলো। সদ্য জন্ম নেওয়া যৌবন পিছলে যাচ্ছে দৃষ্টির খাঁজ পেরিয়ে। বয়ে যাচ্ছে মন্দিরা। বয়ে যাক। আপত্তি নেই। বেলা-অবেলা ভুলে এই নিশ্চিন্ত বয়ে যাওয়াতেই মন্দিরার বেঁচে থাকা। রং পাল্টায়, রূপ পাল্টায়… মন্দিরার লাল-নীল অস্তিত্বের বয়ে যাওয়ার অনন্ত স্রোতে ভেঙে চুরে বারবার জন্ম নেয় অসংখ্য মন্দিরা।
স্নিগ্ধ পালকের মতো দুটো চোখের পাতা একবার বন্ধ করে আবার খোলে মন্দিরা। ওর চোখ আটকে যায় ঠোঁটের পাশে একটা সূক্ষ্ম দাগে। ওটা বলিরেখা। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হয়। বলিরেখার সংখ্যা বাড়তে বাড়তে একটা জালের আকার নিচ্ছে। ছোট ছোট চৌকো ঘর। খুব বড় একটা মহল… তার একটা ঘরে জয়দ্রথ… একটা ঘরে রক্তিম, অন্য ঘরে তার বউ আর একটা ঘরে রক্তিমের ভাবি সন্তান। আর মন্দিরার? মন্দিরার অনেকগুলো ঘর। একটা করে বাঁক, অসংখ্য ঘর… শুধু মন্দিরার। কিন্তু সব দরজায় তালা লাগানো। চাবির গোছাটা মরিয়া হয়ে খুঁজতে লাগল মন্দিরা। নম্বরগুলো… চাবির নম্বরগুলো কিছুতেই মনে করতে পারছে না ও!
৫
লাল, হলুদ, নীল, সবুজ… এরকমই কয়েকটা রং বাদ দিয়ে কোন রঙেরই নাম জানেনা সুরতিয়া। কিন্তু রংগুলো কোনটাই অচেনা নয় ওর। অসংখ্য রঙের ওপাশ থেকে মোহরবাঈয়ের মাথাটা অল্প অল্প নড়ছে। এক একটা পোশাক নামিয়ে সাজিয়ে রাখছে মোহরবাঈ। জলসার কোন রাতে সুরতিয়াকে কোন রং বেশি ভালো মানাবে, সে চিন্তা যেন মোহরেরই বেশি। সারা পরগণার মেহমানরা আসবেন। সঙ্গে অজস্র লোকজন। সোলাঙ্কি পরিবারের রাজকন্যা আঠারো বছরে পা দেবে, এ তো আর যা তা কথা নয়! দশদিন ধরে জলসা। শিবেন্দ্রপ্রসাদের ভুতুড়ে মহলের প্রাণভোমরা যেন লুকিয়ে থাকে দশটা দিনে। সুরজমহলের প্রতিটা কোণে জেগে ওঠে আলোর রোশনাই। মহলের প্রতিটা ইট ভাসতে থাকে আলোর বন্যায় আর ওস্তাদজীর নেশা লাগানো সুরের জাদুতে। বেলজিয়াম কাচের সামনে দাঁড়িয়ে সুরতিয়ার শরীরের প্রতিটা অঙ্গ এক ঠান্ডা লড়াইয়ের মেতে ওঠে। সমস্ত রঙ আর রত্নের আকর হয়ে ওঠে সুরতিয়া। ছটফট করে ওঠে নিজের প্রাচুর্যে। এ এক অদ্ভুত খেলা! প্রতিটা বিভঙ্গ যত্নে ঢেকে রাখে, লজ্জা পায়, আবার উদ্ধত হবার ইচ্ছেয় মেতে ওঠে। সবুজ পান্না চুল থেকে খুলে ছুঁড়ে দেয় আয়নার কাচে। চিরফাট ধরা কাচে ধরা দেয় অসংখ্য সুরতিয়া। সুরতিয়ারা একে অন্যের হাত ধরে। ওদের হাতগুলো ডানা হয়ে যায় তখন। রূপকথা মাড়িয়ে সুরতিয়ার দল উড়ে যায়। স্বপ্নে বড় জ্বালা!
৬
–“হেই মন্দিরা! আই হ্যাভ গন ক্রেজি! হা হা হা… আই হ্যাভ গন ক্রে এ এ এ এ এ এ এ এ জি ই ই ই ই ই ই… ও মাই সুইটি গার্ল… হো হো হো… অ্যাম গন ফর এভার।”
বিচ ধরে দুই হাত আকাশের দিকে ছুঁড়ে ছুটে আসছে জয়দ্রথ। ট্রিম করা দাড়ি, আকাশী গেঞ্জি আর কালো বারমুডা… সকাল সাতটার সব রোদ্দুর গায়ে মেখে ছুটে আসছে ও… কিছু ভাঙা, কিছু গোটা ঝিনুক পায়ে মাড়িয়ে ছুটে আসছে জয়দ্রথ। বাঁ হাতের অনামিকা আলতো ঠেকিয়ে আছে মন্দিরা। তার কেনা ক্যামেরার প্রথম ছবি। এটাই বোধহয় জয়ের উড়তে চাওয়ার শেষ ছবি। মন্দিরা মনে করার চেষ্টা করে, ওড়া থামিয়ে ঠিক কোনদিন জয় হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছে মাটিতে আর একমনে দু’হাতে মাটি খুঁড়ে খুঁজতে লেগেছে একটা বাসা। না, জয় স্বার্থপর নয়। সেখানে মন্দিরারও জায়গা ছিল একটা। জায়গাটা আজও আছে। তবু মাটি ফুঁড়ে যখন-তখন উড়ে যায় মন্দিরা। এই উনপঞ্চাশেও। সে খবর জয়দ্রথের কানে পৌঁছয় না। অথবা পৌঁছলেও জয়দ্রথ যেন সেই মৌনী তপস্বী যে চোখ বুঝেও বুঝতে পারে মন্দিরার ডানার জোর কতটুকু!
–“বৌদিমণি, তোমার ফোন গো… দেখো দেখি, কখন থেকে ডাকছি” – বিজলীদির প্যানপেনে গলা।
মন্দিরার চোখ দরজার দিকে যায় আর সঙ্গে সঙ্গে একটা চিড়বিড়ে বিরক্তি আসে।
–“তোমাকে না কতদিন বলেছি বিজলীদি, এরকম ময়লা শাড়ি পড়ে থাকবে না — তুমি যাও, আমি ধরছি।”
বিজলীদি ব্যাজার মুখে কিচেনের দিকে পা বাড়াতেই মন্দিরা বলে ওঠে, “সন্ধেবেলা দাদাবাবু ফিরলে একটু গাজরের হালুয়া কোরো। চিনি কম আছে বোধহয়। আনিয়ে নিও।– হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো …”
কেটে গেল লাইনটা। রক্তিমের গলা মনে হলো। ছেলের ফোন নম্বরটা খুঁজতে লাগল মন্দিরা। এত বড় বড় নম্বর কিছুতেই মনে থাকে না আর। লাল ডায়েরির প্রথম পাতা উল্টোতেই হঠাৎ ফিক করে হেসে ফেললো মন্দিরা। জয়দ্রথ এখনো এতো ছেলেমানুষ! ছেলের ফোন নম্বরটাও এমনভাবে লিখেছে! রক্তিম সিদ্ধান্ত। কার্ডিওলজিস্ট, নিউ জার্সি। জীবনে নিজের নামটা কখনো টাইটেল ছাড়া বলেছে কিনা মনে পড়ে না। সিদ্ধান্ত পদবীটার ওপর একটা অসম্ভব গর্ব আছে ওর। ছেলের কোন কৃতিত্বের কথা বলার সময় সব সময় রক্তিম সিদ্ধান্ত বলেই উল্লেখ করে জয়। ফোন নম্বরটা নিয়ে মন্দিরা টেলিফোনের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। মাঝে মাঝেই একটা ঝাপসা দুশ্চিন্তা গ্রাস করে। সন্তানসম্ভবা মেমবউ। লুসির প্রেগন্যান্সি একটু বেশিই কমপ্লিকেটেড। রক্তিমটাও গোছালো নয় ঠিকঠাক। কী যে করবে ওই অজানা বিভুঁই দেশে!
–“হ্যালো, রক্তিম? হ্যাঁ, ভালো আছিস বাবা? সকালে তো তোর সঙ্গে কথাই হল না।… ওই চলে যাচ্ছে – লুসির কি খবর? না না… ডাক্তার কি বলছে বল না… তাই? ওকে ইনটেনসিভ কেয়ারে অ্যাডমিট করেছিস? এতক্ষণ জানাসনি? হ্যাঁ, সেটা বুঝতে পারছি। কাল সকালেই? ওহ… আচ্ছা… চিন্তা করিস না বাবা। সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস… হ্যাঁ… হ্যালো, হ্যাঁ… তোর বাবা এলেই আমি বলবো। না, না, চিন্তা করিস না। ঠিক আছে। তুই সাবধানে থাকিস — আর শোন, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করিস। আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে। ওকে।”
ফোনটা রেখে মন্দিরার মনে পড়ল রক্তিমের এই পৃথিবীতে আসার ঠিক আগের দিনগুলোর কথা। টানটান উত্তেজনা আর উদ্বেগের রাত্রিগুলোর কথা। জয়দ্রথের অল্পবয়সি দুষ্টু দুষ্টু মুখটা কেমন যেন করুণ হয়ে থাকত সবসময়। দিনের মধ্যে অসংখ্যবার জ্বালাতন করত ডাক্তারদের। মন্দিরা তখন বারবার বলেও বোঝাতে পারতোনা যে সময় হলে ডাক্তার নিজেই ব্যবস্থা নেবেন। এখনকার জয়দ্রথ অনেক বেশি শান্ত, সমঝদার। শরীর নিজেকে বাঁচাতে বয়সের সঙ্গে মনকেও থামতে শেখায়। না হলে, আজকের জয়দ্রথের কি অতটা উত্তেজনা সইতো? অথচ একটা অদ্ভুত উত্তেজনা বোধ করছে মন্দিরা। আরো একটা প্রজন্মের সাক্ষী হতে চলেছে সে। ছাব্বিশ বছর আগে রক্তিমকে জন্ম দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক প্রজন্মকে নিজের জায়গা ছেড়ে দিয়ে অন্য জায়গায় ঘাঁটি গেড়ে ছিল সে। আজ আবার সেই জায়গায় মেয়াদ শেষ হতে চলেছে তার। এবার এখানে তাঁবু ফেলবে রক্তিম। স্রোতের তাড়া খেয়ে এগোতে এগোতে এ কোন সীমারেখায় দাঁড়িয়ে সে? এ উত্তেজনা কিসের? আনন্দের? না, কষ্টের? একটা চোরা স্রোত বয়ে যাচ্ছে মন্দিরার শিরদাঁড়া বেয়ে। এ অনুভূতি কিসের সে জানেনা!
৭
দু’হাতের দুই দুই চার আঙুলে গোলাপি ঘাগরার দুপাশটা ধরে তিরতিরে সোঁতার মতো ছুটে চলেছে সুরতিয়া — তিনতলা থেকে দু’তলা, দু’তলা থেকে তিনতলা। একতলায় খুব একটা যায় না ও। একতলায় মহলের দারোয়ান থেকে রাঁধুনিদের ভিড় একদিকে। আর একদিকে মোহরবাঈয়ের কামরা। দাদুর সঙ্গে সঙ্গে এ মহলের হাল ধরে আছে মোহরবাঈ। বেনারসের গন্ধ ওর রক্তে। সুরতিয়ার যখন পাঁচ বছর, তখন ওকে নিয়ে বেনারস গিয়েছিলেন শিবেন্দ্রপ্রসাদ। চৈত্রের হাওয়া নেশা হয়ে জড়িয়েছিল শিবেন্দ্রপ্রসাদের শরীর। সেইসঙ্গে সুরতিয়াকে ধরেছিল বসন্ত, মারাত্মক গুটির আকার নিয়ে। যমে-মানুষে লড়াইয়ে রাতের পর রাত চোখের পাতা এক করেনি মোহরবাঈ। অদৃশ্য এক মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছিল অজানা এক নাচনেওয়ালির জীবন এক রাজস্থানী বৃদ্ধ আর শিশুর সঙ্গে। ফেরার পথে সুরজমহলের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলো তিনজনেই।
তিনতলায় এসে থামল সুরতিয়া। অবাক লাগে ওর! এতগুলো সাজানো ঘর, এত বিপুল বিলাসিতার অধিপতি সে! এই প্রতিটা ঘরের মালিকানায় শুধু তার অস্তিত্ব! কিন্তু কোথা থেকে শুরু করবে সে তার আধিপত্য? ডান দিকের এই লাল মখমলের পর্দা থেকে? হাতির দাঁতের হাতল ঘুরিয়ে দরজা খুললো সে। উপরে, ছাদের নিচের দেওয়াল থেকে নীলরঙা ঝাড়বাতির টুংটাং শব্দ। সুরতিয়া জানে না, এরা কি তাকে নিজেদের ভাষায় স্বাগত জানাচ্ছে? চারদিকের দেওয়ালে অসংখ্য কাচ, অনেক সুরতিয়া… শুধু সুরতিয়া আর সুরতিয়া। কিন্তু ও কি? কে ও? কাচে তার পাশে ওটা কার ছবি? পিছনে তাকাল সুরতিয়া। পিছনের দেয়ালে এক যুবতীর ছবি। হলুদ চোলি আর গোলাপি ঘাগরা। ছবিটার খুব কাছে গিয়ে দেখল সুরতিয়া। নিচে কাঁচা হাতের লেখা। ঝিমলি। দাদুর মুখে অনেক শুনেছি এ মহলের পূর্বপুরুষদের কথা। চারপাশের বাতাসে ঝিমলির গন্ধ পেল সুরতিয়া। ঝিমলির মুখের আদল সুরতিয়ার মুখের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে না? শিউরে উঠলো সুরতিয়া! ও কে আসলে? কে তবে এই সুরতিয়া সোলাঙ্কি? কে দাঁড়িয়ে আছে ছবির সামনে? কার ঘর এটা? দমবন্ধ হয়ে এল সুরতিয়ার। দরজা থেকে বেরিয়ে সবকটা পর্দার দিকে তাকাতেই বুক হিম হয়ে এলো ওর। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ রাস্তা হারিয়ে ফেলল সুরতিয়া। সামনে জমাট অন্ধকার। গলার কাছে দলাপাকানো কষ্ট। মোহরবাঈয়ের এর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে অন্ধকার ঠেলে ছুটতে লাগলো সুরতিয়া। হঠাৎ সামনে একটা প্রচণ্ড ধাক্কা। মাথাটা ধরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল সুরতিয়া।
৮
–“কী ব্যাপার… ঘুমিয়ে গেলে নাকি সবাই? আর এই এক হয়েছে। প্রত্যেক সন্ধেয় লোডশেডিং! তাহলে মধ্য কলকাতা আর ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরের তফাতটা কি রইলো রে বাবা!” বিরক্তিমেশানো ক্লান্তি ঝরে পড়ে জয়দ্রথের গলা থেকে।
–“বিজলীদি তো রোজই এসময় বাজারে যায়। আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম। আর এই লোডশেডিং।”
–“হ্যাঁ, মন তো তোমার ফানুস! হাওয়া পেলেই হলো, বয়স বাড়লে শুনেছি মানুষ শান্ত হয়, সংসারে মন আসে। অথচ — !”
–“বয়স বাড়লে কোন একদিন সংসারী হব, এই আশাতেই আমাকে নিয়ে সংসার পেতেছিলে, না?”
— “উফ! শুরু হলো এই কম্প্লেক্সিটি! কাজ না থাকলে যা হয়! সব বউরাই কি এরকম কঠিন কঠিন চিন্তা করে!” সামান্য কৌতুক মেশানো গলায় বলে চলে জয়দ্রথ। “ট্যুরটা বোধহয় জুনের ফার্স্ট উইকেই হবে। তার আগে কলেজের পরীক্ষাগুলো আছে। দেড়মাসের প্যাকেজ। ইউরোপের প্রায় সবটাই ছুঁয়ে যাবে। মান্নাবাবু তো আজই কনফার্মেশন চাইছিলেন। কিন্তু আমি কী করে বলব? তোমার ছুটির ব্যবস্থা তো আগে করতে হবে।” বেসিনের দিকে যায় জয়দ্রথ।
–“ফ্রিজে তোমার গাজরের হালুয়া রাখা আছে, এখনই দেবো কি?” মন্দিরার নিস্পৃহ গলা।
–“না, একটু পরেই খাব। এইমাত্র টিফিন করে আসছি। বিশ্বাস আজ প্রমোশনের জন্য সবাইকে খাওয়ালো।”
–“তাহলে একটু নিয়ে নিও প্লিজ। এখনই টেস্টের খাতাগুলো নিয়ে বসতে হবে আমাকে।” পাশের ঘরে যেতে যেতে বলে মন্দিরা।
খাতার বান্ডিলটা টেবিল থেকে তুলতে গিয়ে মন্দিরার হঠাৎ মনে হল সম্পর্কের কুঠুরিগুলো কত তাড়াতাড়ি ছোট হতে হতে বিন্দুতে এসে পৌঁছায়। সেখান থেকে অস্তিত্বের সংকটও আর অনুভব করা যায় না বোধহয়। উনিশ বছরের ছটফটে মন্দিরা কৌতুক করে সেদিন বলেছিল, “আমি তোমার কে হই বলোতো?” বাইকের হ্যান্ডেলে হাত রেখে জয়দ্রথ আত্মবিশ্বাসী গলায় বলেছিল, “এই সম্পর্কের কি নাম দেওয়া যায়? যেটা ছাড়া অস্তিত্বের আর কিছু থাকে না, সেটাকে আলাদা করে একটা নাম দিই কী করে বলতো?” অথচ সেই জয়দ্রথ আস্তে আস্তে কিভাবে মন্দিরাকে চিনিয়ে দিয়েছে তার জন্য একখণ্ড জায়গা। মন্দিরার চারপাশে কালো পর্দা টেনে তাকে ছাঁচের আড়ালে রেখে কানে কানে বলে চলেছে, “মন্দিরা, পোর ইয়োরসেল্ফ ইনটু দিস মডেল এন্ড…”
–“লুসিকে নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়েছে। ডাক্তার তো প্রথমেই বলেছিল খুব রিস্কি কেস।” জয়দ্রথের প্লেটে ভাত দিতে দিতে মন্দিরা বলে ওঠে, “ডক্টর জেন-এর আন্ডারেই আছে লুসি। কি যে হবে! লুসি যেন ঠিক থাকে…”
–“কী আর হবে! এসব ক্ষেত্রে জেনারেলি যা হয় – ফার্স্ট ইস্যু! টেনশন একটু থাকবে।” চিকেনের টুকরোটা মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে বলে জয়দ্রথ।
–“কী বলছো তুমি? কিছু সমস্যা হলে শুধু লুসি নয়, রক্তিমও আঘাত পাবে। ভীষণ সেনসিটিভ।”
— “হ্যাঁ, কম বয়সে ওরকম একটু আধটু ইমোশন থাকে। কিন্তু তাই বলে তো আর পরিস্থিতি বদলে যাবে না।” জয়দ্রথের চোখ সামনের দেওয়ালে।
–“বিজলীদি, আয়োডিন মলমটা একটু বাঁদিকের কপালে লাগিয়ে দাও না। একদম ভুলে গিয়েছিলাম। ব্যথাটা এবার বাড়ছে মনে হচ্ছে।”
–“ওখানে আবার কী হলো?” জয়দ্রথ জিজ্ঞেস করে।
–“সেরকম কিছু না। অন্ধকারে দরজা খুলতে গিয়ে দেওয়ালে একটু ধাক্কা লেগেছে।” হালকা গলায় বলে মন্দিরা। “ডালটা আর একটু নিয়ে নাও। খেয়ে উঠে একটা ফোন করো ওখানে। আমি রক্তিমকে বলেছি। একটা কর্তব্যও তো আছে তোমার।” একটু যেন ঝাঁঝ দেখা গেল মন্দিরার গলায়।
–“কর্তব্য-টর্তব্য নয় — চিন্তাটা আমারও আছে।” সন্দেশ চামচে কাটতে কাটতে জয়দ্রথ বলে, “তাই বলে ছোটাছুটি করে কি এখন কিছু করতে পারবে? লেটস ওয়েট ফর দ্য মোমেন্ট।” চেয়ার থেকে উঠে পড়ে জয়দ্রথ।
–“একটাও ফোন করোনি গত সপ্তাহ থেকে।”
আর কথা বলতে ইচ্ছে করলো না মন্দিরার। ছাব্বিশ বছর আগে জয়দ্রথ যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, আজ রক্তিম ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে একথা মনে করাতে ইচ্ছে হলোনা ওর।
উত্তেজনা, আবেগ-অনুভূতি কি শুধু সময়ের খেলা? ব্যক্তিসত্তার কোন মালিকানা নেই তাতে? রক্তিমের অস্থিরতা একটুও কি স্পর্শ করছে না জয়দ্রথকে? ওই তো দুধ সাদা ডিভানে এলিয়ে আছে জয়দ্রথের শরীর। শান্ত বুকের লোমে লেগেছে সাদা রঙ। আর সমস্ত রং অদৃশ্য হয়ে গেছে ওখান থেকে। কোথায় গেলো সব রং? রক্তিমদের কাছে? জয়দ্রথ কি একটুও রাখতে পারিনি নিজের করে?
খাটের বাজু ধরে দাঁড়িয়ে মন্দিরার চোখ যায় টেবিলের কম্পিউটারের উপর। আজ মোছা হয়নি ওটা। কভারের ওপর একটা ক্যাকটাসের ছবি। মন্দিরার হঠাৎ মনে হল ক্যাকটাসের কাঁটাগুলোর অঙ্গজ জনন হতে পারে। শত শত কাঁটা থেকে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ কাঁটা ছড়িয়ে যাচ্ছে এ ঘর থেকে ও-ঘরে, সারা বাড়িতে। মন্দিরার সারা শরীরে কাটা বেঁধার অসহ্য যন্ত্রণা! ভয়ে, যন্ত্রণায় চোখ বন্ধ করলো মন্দিরা।
ধীরে ধীরে চোখ মেলল সুরতিয়া। প্রথমে ঝাপসা, তারপর আবছা দেখতে পেল চিন্তায় কুঁকড়ে যাওয়া দাদুর মুখ। তারপর মোহরবাঈয়ের নিশ্চিন্ত হাসি। মাথায় একটা টনটনে ব্যথা টের পেল । চারটে সেলাই পড়েছে মাথায়। হঠাৎ ডান হাতটা শিউরে উঠলো সুরতিয়ার। এক অদ্ভুত গরম তরল রোমাঞ্চ। শিহরণ মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল সুরতিয়া শিরায় শিরায় — আচমকা সঘন তাগিদে চমকে উঠল ওর দৃষ্টি। ফিরে পাওয়া সেই হাজার বিদ্যুতের ঝলকানিতে ও নতুন করে দেখলো এক উনসত্তর বছরের বৃদ্ধের ভেজা দুটো চোখ। খানিকটা ঘোরের মধ্যেই নিজের ক্ষীণ ডানহাতটা তুলে দাদুর বাঁ হাতটা ধরল সুরতিয়া। শিবেন্দ্রপ্রসাদের হাত কাঁপছে থর থর করে। শিরাবহুল সেই আলগা হয়ে পড়া চামড়ার কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ছে সুরতিয়ার শিরায় শিরায়। ছিঁড়ে দিচ্ছে সুরজমহলের সব পর্দা, ভেঙে দিচ্ছে মালিকানার গন্ধমাখা সব দেওয়াল। বড় বড় দুটো অবাক চোখ মেলে সুরতিয়া দেখল দীর্ঘ মহলের দুইপ্রান্তে দাঁড়িয়ে শিবেন্দ্রপ্রসাদ আর সুরতিয়া। সময়ের বিস্তীর্ণ জালে রং-বেরঙের সুতোয় বাঁধা দুটো জ্বলন্ত স্বাক্ষর। আগে-পরে কোথাও কোন চেনা পায়ের ছাপ নেই আর। কোনো ইতিহাসের পাতা বেঁচে নেই এখানে। অপেক্ষায় নেই কোন সুপ্ত বীজ। স্নেহ, ভালবাসায় আবছা হয় সময়ের অনিশ্চয়তা। হঠাৎ সুতোয় টান পড়ে অকারণে। নাড়ির প্রবল টানে কাছাকাছি আসে দুই মূর্ত অবয়ব। অচ্ছেদ্য বন্ধনে ঝনঝন করে ওঠে সুরতিয়ার শিকড়। সতেরোটা জন্মদিনের সব প্রদীপ জ্বলে ওঠে একসঙ্গে। মহলের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে শিবেন্দ্রপ্রসাদের জরাগ্রস্ত মুখে ফুটে ওঠে সদ্যোজাতের হাসি। হাসি ছুটে এসে ছুঁয়ে যায় সুরতিয়ার রক্তিম ঠোঁট। বিহ্বল হয়ে পড়ে সুরতিয়া। এ কীসের আবেশ? নেশালাগা সেই ঘোরের মধ্যে কখন জানেইনা সুরতিয়া… দু’হাত আকাশে তুলে ঘুরতে শুরু করে দাদুর চারপাশে। এ এক অপূর্ব ঘোর! দাদুর সামনে, পিছনে, চারপাশে, সারা মহল জুড়ে ছুটে বেড়াচ্ছে, নেচে বেড়াচ্ছে সুরতিয়া। তার আকাশী ঘাগরায় অসংখ্য ঝুমুর লাগানো… নাচের সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টি আওয়াজ হচ্ছে টুংটাং। সুরতিয়া নেচে বেড়াচ্ছে … ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশ জুড়ে…
৯
ঘুমের ঘোর কাটতে কাটতে একটা হালকা মিষ্টি আওয়াজ শুনতে পেল মন্দিরা। আস্তে আস্তে চোখ খুলে দেখল সিলিং থেকে ঝুলছে হালকা বেগুনি রঙের উইন্ডচাইম। কনুইয়ে ভর দিয়ে আধশোয়া হয়ে চোখের চশমাটা লাগালো মন্দিরা। কম্পিউটারের সামনে বসে একমনে টাইপ করে যাচ্ছে জয়দ্রথ। পিছন থেকে জয়কে এভাবে দেখতে ভীষণ ভালো লাগে মন্দিরার। মনে পড়ে কলেজের লাইব্রেরির দিনগুলোয় পিছন থেকে গিয়ে প্রায়ই চমকে দিত মন্দিরা। কম্পিউটার বন্ধ করে উঠে দাঁড়ায় জয়দ্রথ।
–“ওহ! তুমি উঠে পড়েছ? রক্তিমের ফোন এসেছিল। আনফরচুনেটলি, দে হ্যাভ লস্ট দেয়ার ফার্স্ট চান্স। পুওর ইয়ং কাপল!” দু’পকেটে হাত ঢোকায় জয়দ্রথ। “এনিওয়ে, আজ আমার এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। তুমি একবার কথা বলো। একবার এখানে আসার কথা বলে দেখতে পারো।” গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে যায় জয়দ্রথ।
মাথাটা অস্বাভাবিক ফাঁকা লাগে মন্দিরার। “দে হ্যাভ লস্ট দেয়ার ফাস্ট চান্স!” — এই একই গলায় জয়দ্রথ মাঝে মাঝেই বলে, “বারান্দার গোলাপচারাগুলোয় আর ফুল ধরবে না বোধহয়!” এত নিস্তব্ধ একটা মানুষের ভিতর! মন্দিরার যদি খারাপ কিছু একটা হয়ে যায় আজ সন্ধেবেলা, বাড়ি ফিরে হয়তো এই একই গলায় জয়দ্রথ ফোন করবে ছেলেকে, “উই হ্যাভ আনফরচুনেটলি লস্ট ইওর মাদার।” কম্পিউটারের সামনে দাঁড়ায় মন্দিরা। কোন মেইল পাঠায়নি রক্তিম? আনমনা হয়ে মাউস ক্লিক করতে থাকে ও। জয়দ্রথের আইডি খোলা আছে এখনো। সোজা হয়ে বসে মন্দিরা। ক্লিক করে রক্তিমকে সদ্য পাঠানো জয়দ্রথের মেসেজ। প্রায় এক নিঃশ্বাসে চারটি লাইন পড়ে নেয় মন্দিরা।
বারান্দা অদ্ভুত সবুজ… এ প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে জ্বলজ্বল করছে নতুন আইভি। আইভির একদিকে একটা ছোট্ট কার্ডে একটা ইমোজি স্মাইল আর সাধারণ নীল কালিতে লেখা “শুভ জন্মদিন”। বাঁ হাতটা চুলের ভিতর হালকা করে চালিয়ে পিছন দিকে কাত হয়ে পড়ে মন্দিরা। জয়দ্রথ আইভিলতা এনেছে ওর জন্মদিনে। আজ মন্দিরার জন্মদিন। মাথার মধ্যে গেঁথে গেছে পাঁচটা লাইন। বারবার নিজের মনে উচ্চারণ করে মন্দিরা — “স্বপ্নেরা বেওয়ারিশ, রক্তিম — স্বপ্ন অসহায়। চিন্তা করো না। ওদের নিজেদের বাঁচতে গেলে তোমাকে ভীষণ দরকার। একটা ভ্রুণের রক্ত মাটিতে পড়লে কষ্ট পেওনা। রক্তবীজের দল পরের মুহূর্তে ঝাড় ঝাড় স্বপ্নের আগাছা মাটি ফুঁড়ে ঘিরে ধরবে তোমাকে — অনুভব কোরো শুধু।”
আইভির পাতায় হালকা ছুঁয়ে চশমাটা চোখ থেকে খুলে মন্দিরা এসে বসল টেবিলের পাশে। সহজ চোখে তাকিয়ে থাকলো সিলিঙের দিকে। সারা জীবন তো স্বপ্নের সঙ্গে ছুটেছে সে। জয়দ্রথ যখন প্রথম এলো জীবনে, তখন তো স্বপ্নের তাগিদেই জয়কে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিয়েছিল সে। আবার বছরের পর বছর ধরে অভ্যস্ত হয়ে পড়া মুহূর্তে একটু একটু করে যখন মন্দিরার মনে হয়েছে, আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে জয়দ্রথ — তখন বাইরে থেকে মুখ ফিরিয়ে সেই কোণে স্বপ্নের আশ্রয়েই ফিরে এসেছে সে। কিন্তু কোনদিন কি এত নির্ভরতা পেয়েছে স্বপ্নের অতলে? এতটা বিশ্বাস কি কখনো রাখতে পেরেছে স্বপ্নের উপর? এত বিশ্বাস, এত নির্ভরতা কোথায় লুকিয়ে রাখে জয়দ্রথ? নাকি এতদিন নিজের ঘোরে কিছুই দেখতে পায়নি মন্দিরা?
চেয়ারের হাতলে হালকা চাপ দিয়ে আবার সোজা হয়ে বসে মন্দিরা। তীব্র ভালোলাগার একটা সহজাত ক্ষমতা আছে বিবশ করে দেওয়ার, থামিয়ে দেওয়ার। তীক্ষ্ণ ভালোলাগার আতস নিতে নিতে টেবিলে মাথা ঠেকিয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে মন্দিরা। হঠাৎ ঝাঁঝালো একটা আলো এসে পড়ে চোখে। চোখ ঝলসে যায়। উপচে পড়া আলোর সামনে মন্দিরা দেখে কম্পিউটারের পাশে পড়ে আছে সাদা প্রিজম। জানলা দিয়ে সকাল সাড়ে আটটার রোদ পড়েছে প্রিজমটার গায়ে। সাদা রঙের ভিতরে ছোটাছুটি করে খেলা করছে রামধনু রঙ — আরো অনেক রং। রংগুলো পাক খেতে খেতে তৈরি হচ্ছে একটা রঙিন পাগড়ি। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মন্দিরা। রঙিন পাগড়ি মাথায় হেঁটে যাচ্ছে এক রাজস্থানী বৃদ্ধ। ঝিলমিলে রাস্তাটা ধাপে ধাপে উঠে গেছে আকাশের দিকে। এক একটা তারাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে এক একটা সিঁড়ি। সব তারাদের সে চেনে না। অথচ ওদের কেউই অচেনা নয় ওর। সিঁড়ির ধাপে ধাপে টুংটাং মিষ্টি সুর তুলে নেচে বেড়াচ্ছে… ভেসে বেড়াচ্ছে… উড়ে বেড়াচ্ছে একটা রংবাহারি ঘাগরা। অনেক চেনা অচেনা রং… লাল, হলু্দ, নীল, সবুজ এরকম কয়েকটা রং ছাড়া বাকিগুলোর নাম জানেনা মন্দিরা। অথচ রংগুলো একটাও অচেনা নয় ওর …