Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

শারদ অর্ঘ্য ১৪২৮ ।  আমার পুজো

চৈ তা লী   চ ট্টো পা ধ্যা য়

chaitali2

ক্যালাইডোস্কোপে চোখ রেখে

সেই দলে আমি নেই মোটেই, যারা ভুরু কুঁচকে, ঠোঁট উল্টে বলে- ছোটবেলায় সোনা ফলত, এখন ফলে মেকি সোনা। কিংবা বলে, ছোটবেলায় দেখতাম দুর্গাঠাকুরের ত্রিনয়ন কেমন জ্বলজ্বল করছে, আর এখন? ডিজাইনার ঠাকুরের সাজের এমন বহর, তৃতীয় চোখ লোপ পেয়ে গেছে! এসব আড্ডায় আমি সাতেও নেই পাঁচেও নেই গোছের মুখ করে বসে কান চুলকোতে থাকি।

তো, জীবনকে, মোটামুটি, ক্যালাইডোস্কোপে চোখ রেখে নিরীক্ষণ করি। ভাঙা কাঁচের টুকরো, যেই ঘোরাবো, অমনি নতুন নকশাটি ফুটে উঠবে। ক্রমশ, দিন এগোয়, আর আমি চোখ পেতে রেখে দেখতে পাই, কালো ছিঁড়ে আলো আসছে, অথবা আলো কমে কালো হচ্ছে, নতুন নতুন সাজ পরবে জীবন।

ছোটবেলায় আমি ছিলাম হাঁ-করা বাচ্চা। যা দেখি তাতেই আশ্চর্য হই, আনন্দ পাই। শরীরে মায়া লেগে যায়। এখনও অল্পবিস্তর সেই স্বভাব বজায় আছে, তবে দ্রষ্টব্য বারবার বদলে গেছে, এই আর কী!

পুজোর মুখে দিন গুণতাম, শুধু দুর্গাপুজো নয়, মোটাসোটা মাপের পুজোবার্ষিকীর জন্যও! বাড়িতে, আলমারিবন্দী করে রাখা থাকত, কেনার পর। নাহলে লেখাপড়া যেটুকু হয়, তাও লোপ পাবে যে! ছোট উঠোনের ঝুপসি শিউলিগাছটায় ফুল ধরত। গন্ধে, দেবীপক্ষ টের পেতাম। তারপর মহালয়ায় পুজোসংখ্যা বেরোত মা’র গোপন ঝুলি থেকে। হাতে নেওয়া মাত্র, এই তো, আমার পুজো শুরু হয়ে গেল!

তার আগে, ভোরবেলা, ‘জাগো তুমি জাগো’- দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের আর্তিমেশানো গান শুনতে শুনতে আমার মনও ভেবে নেয়, বেলা হলে বই হাতে পাব। দুপুর-দুপুর পুজোবাজারে বেরোনো হবে। সম্ভাব্য জামার সংখ্যা গুনি, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী…। পুজোর বাজার মানে অবধারিতভাবেই সেটা নিউমার্কেটে কেক প্যাটির গন্ধ নিতে নিতে গড়িয়ে যাবে সুখাদ্যের দিকে। রেস্তরাঁয় খাওয়া হত ন’মাসে ছ’মাসে। ফলে অপেক্ষা থাকত রঙবেরঙের দিনগুলোর। আরেকটা কথাও মনে পড়ে গেল। দুর্গাপুজোর সময় গান তৈরি হত। সেগুলোও যেন চাঁদমালা কী ডাকের সাজের মতো পুজোর জমজমাট অনুষঙ্গ। মাইকে কান ফাটিয়ে মান্না-আরতি-বনশ্রী বাজবে, এক পাড়ার গানের সঙ্গে অন্য পাড়ার কাটাকুটি হবে, তবে না দুর্গোৎসব জমে ক্ষীর!

এখনকার ছেলেমেয়েরা অবশ্য জন্মেই ঘটোৎকচ। বেচারাদের অপাপবিদ্ধ মুখে আশ্চর্য ফোটার আগেই গুগলদাদা তাদের সঙ্গী। ‘অ গুগল’, বলে হাঁক পাড়লে তিনি প্রাঞ্জলভাবে বুঝিয়ে দেন সবকিছু। ফলে অবাক হওয়ার অবকাশ কই! বড় হতে হতে, ছোটবেলাটা যখন ক্রমশ শিশিরে ধুয়ে যাচ্ছে, তখন দেখছি সবকিছুই হাতের মুঠোয়। প্যারিসের পারফিউম থেকে শুরু করে লেবাননের খাবার পর্যন্ত। ফলশ্রুতি, পুজোর বাজার বলে আলাদা কোনো চমক নেই আর। সারাবছরই নতুন জামাকাপড় আর জুতোর গন্ধে শপিং মল ম ম করে। তাই কেনাকাটা বারোমাস। ইটিং-আউট বারোমাস। আসলে দুর্গাপুজো হল গে’ রিল্যাক্স করার ছুটি। ছোট-বড় সকলের। এই টানা ছুটিটায় দফায় দফায় আড্ডা তখনও ছিল। এখনও আছে। বড়জোর নামধাম বদলে এখন হয়তো বলা হয়- চল, জ্যাম সেশনে যাই, কিংবা নাইট-আউট করি।

কয়েকবছর আগে, পাড়ার মণ্ডপে ঠাকুর দেখছি, পাশে প্রতিবেশিনী কনুইয়ের গুঁতো মেরে এক টিনএজারের দিকে দৃষ্টি ফেরাল।

দেখ দেখ, অষ্টমীর দিন এসব পরার কথা আমরা ভাবতেই পারতাম না। চেয়ে দেখি, মেয়েটি অফ শোল্ডার ড্রেস পরে, অপলক, ঠাকুর দেখছে। কিন্তু পুজোর সুর তো কাটছে না কোথাও। আমাদের জন্য হাঁটুর নীচ অবধি জামা বরাদ্দ হত বটে, তবে, মা দুর্গার মুখের অভয়-দেওয়া হাসিতে এতটুকু কম পড়ছে না ওই কিশোরীর স্বল্পবাস লক্ষ করে।  বস্তুত, পুজোর ফুর্তি যখন যেমন, তেমনই রঙচঙে আর মাপসই টুপি গোঁজা থাকে দিনগুলোর মুকুটে।

আমাদের পেটুক বাড়িতে দুর্গাপুজোর পাঁচ দিন, সমান্তরাল পথে পেটপুজোরও রকমারি আয়োজনের ফর্দ হত। পোলাও, মাংস, মাছের কালিয়া, ফ্রাই, কাটলেট বানাতে বানাতে মা কাকিমাদের দেবীপক্ষ মলিন হয়ে যেত। গ্যাস ছিল না। মস্ত উনুন জ্বলত। মিথ্যে বলব না, রান্নাঘরের বিরাট হাঁ-মুখের মধ্যে বসে থাকা, ধোঁয়া হয়ে থাকা ওদের কষ্ট তখন আমাকে বিচলিত করেনি, বিশেষ। অথচ, চালচিত্র বদলাবে। এই আমিই শিউলি, পদ্মফুল আর চণ্ডিপাঠের আবহ পেরিয়ে গনগনে আগুনের মধ্যে ঢুকে পড়ব একদিন। লিখব-

রামলাল বাজারের দিক থেকে পুবমুখো হেঁটে গেল/তুমি নয়, তোমার প্রতিমা,/আধাকিলো আলু ও পেঁয়াজ ব্যাগে নিয়ে।/বাড়ি যাবে, কিন্তু তার আগে চপ্পল সারাবে।/ এখনও রান্না বাকি, খোকাকে খাওয়ানো বাকি,/ওবেলায় আবার বেরোনো, টুকিটাকি।/ একখানা শরতের মেঘ আকাশ উজ্জ্বল করে উড়ে এল–/ সেসব দেখলে না,/উবু হয়ে, টাটকা টমেটো, শাক বেছে নিচ্ছ/ ঘরের জন্য ‌/আলগোছে একবার, শাড়ি ছুঁয়ে বুঝে নিলে/পিরিয়ড শুরু হল কিনা!/ কেমন প্রতিমা হে তুমি,/ঘামতেল চিকচিক করছে মুখে,/ রোবটের মতো সারা শরীর নড়ছে,/ শুধু, তোমার সামনে, হাত পেতে আছে যারা/ আজও জানল না,/ চক্ষুদান বাকি রয়ে গেছে

আরও পড়ুন...