শারদ অর্ঘ্য ১৪২৮ । বাংলাদেশের গল্প
‘রঙে মানুষ প্রকাশিত হয়।’
শীতকালের এক সন্ধ্যায় সে বলল।
কেন বলল?
আমি সেই সুলুক সন্ধানে কংক্রিট, পিচ কি জলকাদায় নামলাম না। তার কথার অর্থ ধরার কোনো অপচেষ্টার দিকেও গেলাম না। সে বলেছে রঙে মানুষ প্রকাশিত হয়, আচ্ছা, রঙে মানুষ প্রকাশিত হয়। যে কেউ একজন এখানে বলে দিক, ‘তথাস্তু।’
বলল না কেউ। যে কেউ একজন বলল, ‘জটিলতা পরিহার করে বলা হোক।’
‘তথাস্তু।’
আমি যার কথা বলছি, সে এমন একজন মানুষ যাকে বলা যেতে পারে মিতবাক। তবে বাকসংযমী বলা যাবে না। সে যা বলে সবসময়ই এমন ছাড়া ছাড়া যে, বাকসংযম বিবেচনা করা যায় না সেটাকে।
সে একা। একা থাকে। একা ঘুমায়। মানুষজন পছন্দ করে না বিলকুল। মনে করে উৎপাত। তবে আমি কেন তার কাছে আসি? আমাকে কি মানুষ মনে করে সে? না মনে হয়। উৎপাত মনে করে? না মনে হয়। আমি শুধু তার কাছে আসি। তার কথা শুনি। বসে থাকি। কেন?
আমি তার মুরিদ।
পীর না সে, তাও আমি তার মুরিদ।
একমাত্র মুরিদ।
বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, পরিমার্জিত
সংস্করণ, পৌষ ১৪০৭ বঙ্গাব্দের, ৯৯৩ পৃষ্ঠায় আছে শব্দটা। মুরিদ। গ্রহণযোগ্য অর্থটা হচ্ছে পীরের শিষ্য।
আমি তার শিষ্য।
সে আমার পীর।
শীতকালের আরেক সন্ধ্যায় কিছু হলুদ পাতার কথা সে বলল। হলুদ সেইকিছু পাতা উড়ে দূরের হরিৎ তৃণভূমিতে যায়। সে বলল, আমি শুনলাম আর সেই হলুদ পাতাদের দেখলাম। সেই হরিৎ তৃণভূমি দেখলাম। সে যা বলে আমি দেখি। দেখতে পাই। সংশয় যদিও যায় না। যা দেখলাম ঠিক কি দেখলাম? ভুল দেখলে বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে, তেমন কিছু সে কখনোই বলে না। তবে যেসব হলুদ পাতা দূরের হরিৎ তৃণভূমিতে যায়, তারা ধূসর ট্রাংক বন্দি পান্ডুলিপির কাটাকুটি করা পাতাও হতে পারে। তর্ক সাপেক্ষ হলেও গ্রাহ্য কথাটা।
শীতকালের আরেক সন্ধ্যায় সে বলল, ‘আমি কিছু মুরিদ কিনব।’
‘দরপত্র দিব?’ আমি বললাম।
‘দরপত্র?’
‘মুরিদ সাপ্লাইয়ের। টেন্ডারবাজি ছাড়া আর কিছু হয় না।’
‘বার টেন্ডারবাজি।’
বলে সে হাসল। হা হা হা হা করে হাসল। তার হাসি ইকো হলো দূর নক্ষত্রমালার পাহাড়ে। হলুদ কিছু পাতা যেখানে যায়, সেই হরিৎ তৃণভূমিতে, ঘুণাক্ষর সমেত। শীতকালের আরেক সন্ধ্যায় সে বলল, জরায়ুর গহীন অন্ধকারের স্তোত্র। সৃষ্টির পবিত্রতম অন্ধকারে।
‘যত অন্ধকার তত আলো।’
সে বলল।
আমি বললাম, ‘আলোকিত না?’
সে বলল, ‘বিউপনিবেশায়ন।’
আর হাসল। হা হা হা হা।
আমার পীর। বাস্তবতা থেকে বহু দূরের সে একজন। আমি তার একমাত্র মুরিদ। ছাড়া ছাড়া ভাবে বলা তার যত কথা আমি শুনি। প্যানডোরার বাক্সের কথা বলে সে কখনো। বোকার স্বর্গ কী বলে কখনো। কখনো সাড়ে তিন হাত ভূমির কথা শুধু। কখনো সোনার পাথরবাটির। আমি তার কথা শুনে যাই কেবল। অ-মনোযোগী এক কাকপক্ষীর মনোযোগ দিয়ে, যে কাকপক্ষী মাত্র সনাক্ত করেছে এবং উৎখাত করেছে তার সংসারের অনুপ্রবেশকারী আরেক কালো পক্ষীসন্তানকে। রঙে কি পাখিও প্রকাশিত হয়?
বর্ণবাদ নিপাত যাক।
সব শ্লোগান কবে নিপাত গেছে।
তবুও ফিরি সেই শীতকালের সন্ধ্যায়।
তবুও আমার পীর এতদিনে রঙের কথা বলল।
রং।
আমি ওত পেতে থাকলাম, আমার পীর কী বলে আর। শীত যাই যাই করেও যাচ্ছে না। হাওয়া এবং সন্ধ্যাজাত পাঁশুটে অন্ধকার জানান দিচ্ছে। আমার পীরের ঘরের বারান্দায় এক বটগাছ শিশু আছে। বার-তেরটা পাতা হবে। কিয়দংশ হলুদ কিছু পাতার। বারান্দা থেকে রোদ চলে গিয়েছিল রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের ক্ষীয়মান আলোয় তাদের রাজনীতিরুগ্ন দেখাচ্ছে। অন্য দৃশ্য ছিল সামান্য আগেও। রোদ ছিল। তবে আমার পীরের ঘরের বারান্দায় ছিল না, চলে গেছে উত্তরের কিছু বারান্দায়। বহুতল মানুষের গুহা উত্তরে। বারান্দার গ্রিলে তারা শীতের কাপড় চোপড় শুকাতে দিয়েছে। বড়দের, বাচ্চাদের। রোদ পড়েছিল সেই সব কাপড় চোপড়ে।
আকাশের রং ইন্ডিগো বস্নু। রাজনীতিরুগ্ন।
‘এত কাপড় শুকাতে দিয়েছে বারান্দায়। লাল সাদা ছাড়া কাপড় কেউ পরে না। শুধু লাল রং। শুধু সাদা রং।’
বলেছিল সে।
আফসোসহীন পর্যবেক্ষণ।
আর কিছু?
‘কেউ রঙিন কাপড় পরে না। হিমালয়ের বরফে যেমন দেখা যায়, নিশানের রং, মানুষের রং।’
এতক্ষণ পর, সন্ধ্যার অন্ধকারে বসে সে বলল।
হিমালয়ের বরফে কী রঙের নিশান, কী রঙের মানুষ দেখা যায়?
না শুধু নিশান, না শুধু মানুষ দেখা যায়?
না নিশানরা মানুষ এবং মানুষরা নিশান হয়ে যায়?
কী রঙের?
ফয়সালা দিল না সে। কখনো দেয় না। না দিল। আমার পীর সে। তবে আরো শীতকাল এবং আরো এমন সন্ধ্যা মজুদ আছে হয়ত, রং-ফং বাদ দিয়ে সে কথা বলবে জন্মনিরোধক নিয়ে।
রঙে জন্মনিরোধক প্রকাশিত হয়।
‘অপ্রকাশিত থাক রংহীন অনাগতরা এই পৃথিবীতে।’
আরেক শীতকালের সন্ধ্যায় সে হয়ত বলবে।
আমার পীর সে।