শারদ অর্ঘ্য ১৪২৮ । বিশেষ রচনা
শহর কলকাতার থিম পুজোর ঢক্কানিনাদ, ব্যয়বাহুল্য ও উদ্দীপনা বা হুজুগ যাই বলুন না কেন, তার ক্রমবর্ধমান জৌলুসে যাঁরা যারপরনাই বিরক্ত, যাঁরা বেদবাক্যের মতো মানেন ‘ওল্ড ইজ গোল্ড’, তাঁদের জানিয়ে রাখা ভালো পুরনো কলকাতার পুজোর জৌলুস কিছু কম ছিল না। আমরা যদি আঠারো বা উনিশ শতকের কলকাতায় ফিরে যাই, সেই সময়কার ‘বাবুবাড়ি’গুলোর দুর্গোপুজোর জৌলুস ছিল চমকে ওঠার মতো। বাবুবাড়িগুলোয় পুজো উপলক্ষ্য করে নাচ, গান, আমোদে যে কত টাকা খরচ হত তা এযুগে কল্পনাও করা যাবে না। ঠিক এখনকার মতোই তখনও পুজো নিয়ে প্রতিযোগিতা হত বাবুতে বাবুতে। এখনকার মতোই যানজটে জেরবার হতেন বাবুবাড়িগুলোর সামনের রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করা তখনকার কলকাতার সাধারণ মানুষেরা। এই সব বাবুবাড়ির পুজোগুলোর ভেতর শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোর জৌলুস ছিল তাক লেগে যাওয়ার মতো।
শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গোৎসবকে পলাশীর যুদ্ধের বিজয় উৎসব বলে কেউ কেউ মনে করেন। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধ, বিশ্বাসঘাতকতার কারণে সিরাজদৌলার পরাজয়। নবাবের সৈন্য পলাশী ছেড়ে পলায়ন শুরু করলে, ভোরবেলায় ক্লাইভ সমস্ত কাজ ছেড়ে দিয়ে বিশ্বাসঘাতক রাজদ্রোহী মীরজাফরকে হাতে রাখতে অভিনন্দন জানিয়ে স্ক্রাফটনের হাত দিয়ে ২৪ জুন চিঠি পাঠিয়ে লেখেন, “এই বিজয়ের জন্য আপনার কাছে আহ্লাদ প্রকাশ করছি, এটা আপনার বিজয়— আমার নয়, খুব তাড়াতাড়ি আমার সঙ্গে মিলিত হলে বড়ই সুখী হব।”
মীরজাফরের নজর তখন সিরাজের ধনভান্ডারের দিকে, তিনি পুত্রকে নিয়ে তাড়াহুড়ো করে মুর্শিদাবাদের দিকে রওনা হলেন। ততক্ষণে রায়দুর্লভ দখল নিয়ে নিয়েছেন ওই ধনদৌলতের রত্নভাণ্ডার, ডাক্তার ফোর্ট জানিয়ছেন সিরাজের হীরামুক্তো ছাড়া সোনারূপার যে ধনভাণ্ডার ছিল তার মূল্য ৩৮ কোটি টাকা।
কী করেছিলেন রায়দুর্লভ! সত্যচরণ শাস্ত্রী তাঁর ‘ক্লাইভ চরিত’-এ লিখেছেন, ‘সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে ইংরেজ তাদের রক্ত-উঠা টাকা দুটো মিষ্টি কথায় পিঠ চাপড়ে নিয়ে যাবে, রায়দুর্লভের তা সহ্য হয় নি। তাই আমাদের প্রজার টাকা, তাঁরা ইংরেজকে না দিয়ে নিজেরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন। সব টাকা তাঁরা আপোষে ভাগ করে নিতে পারেন নি, ক্লাইভের মুনশি নবকৃষ্ণ প্রমুখ কয়েকজনকে কিছু ঘুষ দিতে হয়েছিল। যে সকল রাজদ্রোহী ইংরেজদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিল, নবকৃষ্ণ তাদের মধ্যে একজন’ (গ্রন্থাবলী পৃ.২৯৪)। পলাশী যুদ্ধের পর ইংরেজরা ধনাগারে পেল মাত্র ১ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা।
নবকৃষ্ণ কত টাকা ভাগে পেয়েছিলেন জানা যায় না, তবে মুর্শিদাবাদ থেকেই তিনি ঠিক করলেন, পলাশীর যুদ্ধের বিজয়ী সেনানায়কদের নিয়ে তিনি দুর্গোৎসবে আমোদ করবেন। শোভবাজারে দুর্গাদালান তৈরী শুরু হয়ে গেল। কিন্তু তাঁকে ভাবালো একটি বিষয়, হিন্দুবাড়ির পুজোয় বিজাতীয় বিদেশী মানুষদের প্রবেশাধিকার দেশের মানুষ মেনে নেবে কি? সাহেবরা পুজোর প্রসাদ গ্রহণ করবে না— তাহলে পুজোর অনুষ্ঠানে মদ পরিবেশন করা হবে কি?
একা একা সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না কারণ তিনি নিজেই তো সমাজপতি। ভার পড়ল পণ্ডিত মণ্ডলীর উপর, নানান শাস্ত্র ঘেঁটে পাওয়া গেল একটি তথ্য, ‘ভবিষ্যপুরাণ’ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে রঘুনন্দন ‘তিথিতত্ত্বে’-র লেখা সামনে ধরা হল, সেখানে বলা হয়েছে এই মহাপূজাতে যে সাতটি কল্প রয়েছে, তার মধ্যে ভাদ্র পূর্ণিমার পর কৃষ্ণ পক্ষের নবমীতে আরম্ভ করে, শুক্লপক্ষের নবমী পর্যন্ত যে পূজা, তাকে প্রথম কল্প ‘কৃষ্ণনবম্যাদিকল্প’ বলা হয়েছে। ‘হর্ষে মাসস্যিতে পক্ষে কন্যারাশিগতে রবৌ/ নবম্যাং বোধয়ে-দ্দেবী ক্রীড়াকৌতুকমঙ্গঁলৈঃ’ অর্থাৎ আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের সূর্য কন্যারাশিস্থিত হলে নবমী তিথিতে ক্রীড়া, কৌতুক এবং মঙ্গল সহকারে দেবীর বোধন হয়। কৃষ্ণপক্ষের নবমীতে বোধন করা এবং ক্রীড়া কৌতুক সবই করার নির্দেশ শাস্ত্রে রয়েছে, সুতরাং মহালয়া অমাবস্যার আগের নবমী তিথিতেই বোধন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো। ক্রীড়া-কৌতুক বলতে নাচ-গান, শরীর চর্চা প্রভৃতি অনুষ্ঠান করার ভাবনাও যুক্ত হলো। ঠিক হয় সাহেবী হোটেল থেকে খানা ও মদ আনা হবে।
পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ী সেনাদের আগমন হবে, সুতরাং ভয়-ভক্তিতে কেউ প্রতিবাদ জানাবে না, বা কোনো প্রশ্নও তুলবে না। নবকৃষ্ণদেব বিদেশী সাহেবদের কথার সঙ্গে সাধারণ মানুষের জন্যও নাচ-গানকে যুক্ত করে দিলেন। কেমনভাবে দেশী ও সাহেবদের জন্য নাচ-গান দেখার সূচী তৈরি হয়েছিল সে কথা রসরাজ অমৃতলাল বসু স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন এভাবে—
‘স’ বাজারের রাজাদের উত্তর-দক্ষিণ দু’বাড়ীতে এখনও ( ১৮৬৪ খ্রীঃ) পুজো হয়, কিন্তু ধুমধাম যা তা রাস্তায়, ভিতরে ধাম আছে, কিন্তু ধূম নেই, ১২৭১ সালেও পূর্ব্বাপেক্ষা অনেক কমে গিয়েছিল বটে, কিন্তু তবু রাজারা তখনও রাজা কৃষ্ণা নবমীতে এঁদের বাড়ী বোধন বসে, সেই দিন থেকে দু’বাড়ীতেই নাচ আরম্ভ, শেষ মহানবমীতে। পঞ্চমী অবধি উপরের নাচঘরেই মজলিস, ষষ্ঠীর দিন বন্ধ, পূজার তিন দিন প্রকান্ড প্রকান্ড দুই উঠোনে। বোধনের ক’দিন যে ইচ্ছে সে বাইনাচ দেখতে পারে, আর রাজার বাড়ীর একখানি টিকিট পাবার জন্য কত হাঁটাহাঁটি, কত সাধ্যসাধনা। রাজার বাড়ীতে লেগে যেত সাহেব-মেম দর্শকের ভিড়। … তখনকার সাহেবরা পুজোয় আমোদ করত, আমাদের সঙ্গে একটু বেশী মেশামেশিও করত; অনেক বড় বড় সাহেবও রাজার বাড়ীতে সস্ত্রীক নিমন্ত্রণ পত্র পাবার জন্য পরিচিত অন্য সাহেবদের বা বিশ্বস্ত বাবুদের সুপারি ধরতেন। সাদা মুখের শোভায় রাজবাড়ীর উঠানে পদ্মফুলের মালা ফুটে উঠ, আর আমরা কালো কালো অলিরা আগে পাশে ঘেঁষে ঘুঁষে গুঞ্জন করতুম। সাহেবদের জন্য একটু শেরি শ্যাম্পেন ব্র্যান্ডি বিস্কুট থাকত বটে, ভাগ্যবান দু’দশ জন বাঙালী প্রসাদও পেতেন।’
শোভাবাজার রাজবাড়ীতে যে পনের দিন ধরে দুর্গাপুজোর আমোদ চলতো তা সেকালের সংবাদপত্র থেকেও জানা যায়। ১৮৩২ সনের ১৩ অক্টোবরের ‘সমাচার দর্পণ’-এ প্রকাশিত খবরে পাওয়া যায়, ‘শোভাবাজারের মহারাজ বাহাদুরের উভয় বাটিতে ধারাবাহিক বোধন (কৃষ্ণ) নবমী অবধি মহানবমী পর্য্যন্ত নাচ তামাশা হইয়াছে তদ্দর্শনে এতদ্দেশীয় ও নানা দিগ্দেশীয় এবং উচ্চাপদাভিষিক্ত সাহেব লোক গমন করিয়াছিলেন।’ পুজো বাড়ির নাচের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি পর্বের একটি সুন্দর বর্ণনা রয়েছে হুতোম প্যাঁচার নকশায়— “এদিকে দেখতে দেখতে গুড়ুম করে [রাত] নটার তোপ পড়ে গেল; ছেলেরা ‘বোমকালী’ ‘কলকাত্তাওয়ালী’ বলে চেঁচিয়ে উঠল। বাবুর বাড়ী নাচ, সুতরাং বাবু আর অধিক্ষণ দালানে বোসতে পাল্লেন না, বৈঠকখানায় কাপড় ছাড়তে গেলেন, এদিকে উঠোনের সমস্ত গ্যাস জ্বেলে দিয়ে মজলিশের উদ্যোগ হতে লাগল, ভাগ্নেরা ট্যাসল দেওয়া টুপি ও পেটী পোরে ফোপলদালালী কত্তে লাগলেন। এদিকে দুই একজন নাচের মজলিসি নেমন্তন্নে আসতে লাগলেন। মজলিশে তরজা নামিয়ে দেওয়া হল। বাবু জরি ও কালাবৎ এবং নানাবিধ জড়ওয়া গহনায় ভূষিত হয়ে ঠিক একটি ‘ইজিপসন মমি’ সেজে মজলিশে বার দিলেন— বাই সারঙ্গের সঙ্গে গান করে, সভাস্থ সমস্তকে মোহিত কত্তে লাগলেন’।
১৮২৩ সনে ফ্যানি পার্কস বাবু বাড়ির পুজোতে নাচ দেখেছেন, তার রসাস্বাদন গ্রহণ করেছেন কীভাবে তা নিয়ে লিখে রেখেছেন এভাবে— ‘পূজামণ্ডপের পাশের একটি বড় ঘরে নানারকমের উপাদেয় সব খাদ্যদ্রব্য প্রচুর পরিমাণে সাজানো ছিল। সবই বাবুর ইয়োরোপীয় অতিথিদের জন্য বিদেশী পরিবেশক ‘মেসার্স গান্টার অ্যান্ড হুপার’ সরবরাহ করেছিলেন । খাদ্যের সঙ্গে বরফ ও ফরাসী মদ্যও ছিল প্রচুর। মণ্ডপের অন্যদিকে বড় একটি হলঘরে সুন্দরী সব পশ্চিমা বাইজীদের নাচগান হচ্ছিল এবং ইয়োরোপীয় ও এদেশী ভদ্রলোকেরা সোফায় হেলান দিয়ে, চেয়ারে বসে সুরা-সহযোগে সেই দৃশ্য উপভোগ করছিল। বাইরেও বহু সাধারণ লোকের ভিড় হয়েহিল বাইজীদের গান শোনার জন্য। গানের হিন্দুস্থানী সুর মন্ডপে সমাগত লোকজনদের মাতিয়ে তুলেছিল আনন্দে।’
বাবুবাড়ির নাচ-গানের আমোদে কত খরচ হত তা এযুগে কল্পনাও করা যাবে না। ১৮৩২ সনের নর্তকীদের মধ্যে যিনি প্রধানা বলে সম্মানিত তার নাম নিকী বা নেক্কী, তিনি দেবেদের বাড়িতে পুজোয় নেচেছিলেন। ১৩ অক্টোবরে সেই সংবাদ দিয়ে সমাচার দর্পণে লেখা হয়েছিল— ‘শ্রীযুত বাবু আশুতোষ দেবের বাটীতে প্রতিপদবধি নবমী পর্য্যন্ত নাচ হয়। তথায় নেক্কী প্রভৃতি নর্তকী নিযুক্তা ছিল। ইহাতেই সকলে বিবেচনা করিতে পারিবেন তদ্বিষয়ে কি প্রকার আমোদ হইয়াছে।’
এই অনুষ্ঠানের ১৩ বছর আগে নিকী বাই কী পরিমান অর্থ আয় করতেন তা ১৮১৯ সনের ২৬ অক্টোবরের ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ থেকে জানা যায়—‘শহর কলিকাতায় নিকী নামে এক প্রধান নর্তকী ছিল। কোন ভাগ্যবান লোক তাহার গান শুনিয়া ও নৃত্য দেখিয়া অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়া এক হাজার টাকা মাসিক বেতন দিয়া তাহাকে চাকর রাখিয়াছে’। মাস মাইনেতে চাকরি করাতে তাকে ‘চাকর’ বলা হয়েছে। টাকার অঙ্কে এক হাজার টাকা কিন্তু অনেক ছিল। আপনি ভাবুন একজন কেরাণীর তখনকার মাস মাইনে ছিল চার টাকা ছয় আনা, দারোগা পুলিশের মাইনে চার টাকা, কনস্টেবল এক টাকা আট আনা, পিওন দু টাকা এক আনা। এই টাকাতে তখন প্রত্যেকেই একান্নবর্তী সংসার চালাতেন । বাজার দর একটু শুনিয়ে রাখি, ভালো চাল এক টাকায় দু’মণ, মোটা চাল এক টাকায় চার/পাঁচ মণ, তেল এক টাকা বারো আনা মণ ইত্যাদি। এরপর নিশ্চয়ই পুজো বাড়ির আমোদে বাই নাচাতে খরচটা খানিকটা আন্দাজ করে নিতে পারা যাচ্ছে।
আঠারো শতকে দুর্গোৎসবের আমোদে বাইনাচ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেননি ঠিকই, তবে উনিশ শতকের প্রথমার্ধেই কিন্তু এ নিয়ে প্রশ্ন তুলে একজন বিভিন্ন পত্রিকায় চিঠি পাঠিয়েছিলেন। ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ এবং ‘ক্যালকাটা কুরিয়্যার’ পত্রিকায় সেই চিঠি ছাপাও হয়েছিল। ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকা না ছেপে ১৮৩৫ সনে ১০ অক্টোবর তারিখে ঐ পত্রের উল্লেখ করে যে মন্তব্য করেছেন তা হল—
‘শ্রীযুত মহারাজ কালীকৃষ্ণ বাহাদুরের অট্টালিকাতে দুর্গোৎসবের নৃত্যগীত বিষয়ক যে পত্র ‘চন্দ্রিকা’ ও ‘কলিকাতা কুরিয়র’ পত্রে প্রকাশিত হইয়াছে তাহার এক প্রতিলিপি আমরাও প্রাপ্ত হইলাম কিন্তু অস্মুদাদির বোধে তাহা আর প্রকাশে কিছু ফলোদয় নাই।হইতে পারে যে উক্ত মহারাজা অন্য কোন কার্য্যাপলক্ষে স্বীয় ধন অধিক জ্ঞান পূর্ব্বেক পরহিতার্থ বিতরণ করিতে পারিতেন। কিন্তু তামসিক নর্ত্তক গায়ক ব্যক্তিদের পোষণার্থ এবং সর্ব্ব-সাধারণ অতি নীচ লোকেদের কারণ স্বীয় অট্টালিকা পানশালা করনে অনেকার্থ অপব্যায়করণ প্রযুক্ত তাঁহাকে কিম্বা তাদৃশ ব্যক্তিকে প্রশংসা করিতে অসুদাদি মানস সঙ্কুচিত হয়’।
নবকৃষ্ণ দেববাহাদুর সমাজের সকল ধর্মের, বর্ণের মানুষদের আমন্ত্রণ জানাতেন। তাঁর অধস্তন পুরুষেরাও যে সেই ধারা বজায় রেখেছিলেন, তা ১৮৩৭ সালের ১৮ অক্টোবরের ‘সমাচার দর্পণ’-এর একটি সংবাদ সূত্র থেকে জানা যায়— ‘শারদীয়া পূজা উপলক্ষে গত মাসের ২২ তারিখ অবধি বর্তমান মাসে ৫ পর্য্যন্ত যথারীতি শোভাবাজারস্থ শ্রীযুত মহারাজ শিবকৃষ্ণ বাহাদুর এবং তদ্ভ্রাতৃগণের বাটীতে নৃত্য গীতাদির আমোদ প্রমোদ হইয়াছিল। এবঞ্চ শেষ দিন হয় অর্থাৎ ৬ তারিখ অবধি ৮পর্যন্ত বিশেষরূপে হইয়ছিল। ঐ রাত্রে বিবিধ প্রধান বিবি ও সাহেব ও হিন্দু এবং মোসলমান মহান জন উক্ত পর্বে একত্রিত হইয়াছিলেন এবং তাবতেই শ্রীযুত মহারাজ কালীকৃষ্ণ বাহাদুরের সৌজন্যতায় পরমানন্দপুরঃসর তার নাচ ইত্যাদি শ্রবণাবলোকন করিয়া… অত্যন্ত তুষ্ট হইয়া প্রত্যাগমন করিলেন।’
১৮২৯ সনেও শোভাবাজার রাজবাড়ীতে পুজোয় বড়লাট সহ অন্যান্য বিশিষ্ট জন পুজোর আমোদে যোগ দিতে হাজির হয়েছিলেন। ১০ অক্টোবর তারিখের ‘বঙ্গদূত’ পত্রিকার সংবাদ থেকে জানা যায়—‘মহারাজ নবকৃষ্ণ বাহাদুরের দুই বাটীতে নবমীর রাত্রে শ্রী শ্রীযুত গবরনর জেনারেল লর্ড বেন্টিংক বাহাদুর ও প্রধান সেনাপতি শ্রীশ্রীযুত লর্ড কম্বরীর ও প্রধান সাহেব লোক আগমন করিয়াছিলেন। পরে দুই দণ্ড পর্য্যন্ত নানা আমোদ ও নৃত্যগীতাদি দর্শন ও শ্রবণকরত অবস্থিতি করিয়া প্রীত হইয়া গমন করিলেন’।
ঐ সময় দুর্গাপুজো আমোদ আহ্লাদ, নাচ গানে জমজমাট ছিল। প্রতিযোগিতা হত বাবুতে বাবুতে। ১৮২৯ সনেই শোভাবাজার রাজবাড়িতে যখন বড়লাটদের নিয়ে ব্যস্ত তখন জোড়াসাঁকোর সিংহ বাড়ির দরজা খুলে গেল আমজনতার আমোদের জন্য। ঐ একই পত্রিকা একদিনে সেই সংবাদ দিয়ে লিখলেন—‘দেওয়ান শান্তিরাম সিংহের বাটীতে পূজার চিহ্ন জোড়াসাঁকোর চতুরস্ত্র পথে এক গেট নির্ম্মিত হইয়া তদবধি বাটীর দ্বার পর্য্যন্ত পথের উভরপার্শ্বে আলোক হইয়াছিল। তাহাতে যাঁহারা ঐ বাটীর পূজার বার্ত্তা জানেন না তাঁহারাও ঐ গেট অবলোকন করিয়া সমারোহ দর্শেনেচ্ছুক হইয়া ঐ অবারিত দ্বার ভবনে গমন করিলেন। আপামর সাধারণ কোন লোকের বারণ ছিল না। উপরে নীচে যাঁহারা যেখানে ইচ্ছা আসনে উপবিষ্ট হইয় গীতাদি স্বচ্ছন্দে দর্শন শ্রবণ করিলেন তাহাতে কোন হতাদরের বিষয় নাই’।
‘চিরদিন সমান কাহারো নাহি যায়’—সত্য কথা। বাবুবাড়ির হাজার নাচ-গান আমোদ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা শুরু হলো ১৮২৯ সন থেকে। ইংরেজি-বাংলা সমস্ত পত্রিকা মারফৎ নানান রকম আওয়াজ উঠলো, এর মধ্যে দু’টি বিষয় প্রাধান্য পেল— এক, দুর্গাপূজায় সাহেবদের নিমন্ত্রণ করা বন্ধ হোক। দুই, দুর্গাপূজায় শুদ্ধাচার ধরে রাখতে ‘নাচ’ বন্ধ হোক। ঐ সালেই ১৭ অক্টোবর তারিখের ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকা গতবারের ঘটনা পর্যন্ত দৃষ্টি আকর্ষণ করায় এভাবে—‘গত বৎসরাবধি অতিশয় লজ্জাকর ব্যাপার হইত এবং যে ইংলণ্ডীয়েরা সে স্থানে [দুর্গাদালানে] একত্রিত হইতেন তাঁহারা সাধারন এবং মদ্যপানকরণে আপনাদের ইন্দ্রিয় দমনে অক্ষম’। পরের বছর ঐ কাগজে লেখা হলো- ‘দুর্গোৎসব, রাসযাত্রা প্রভৃতিতে রমণীর নৃত্যগীতাদি এবং ইঙ্গরেজের মদ্যমাংস ভোজনাদিতে কোন দোষ দৃষ্টি করেন না বরঞ্চ তৎপাকে চক্ষু মুদ্রিত করিয়া মনের দ্বারা কল্পনা করেন যে উর্ব্বশী প্রভৃতির নৃত্যাদি এবং মদ্যমাংসকে পুষ্পদান বোধ করেন।’ দুর্গোৎসবে সাহেবদের হিন্দুবাড়িতে এসে আমোদ করার বিষয় বিলেতে পৌঁছে গেল। সেখান থেকে খবর এলো উৎসবে যোগদান কমাতে হবে। ১৮২৯ সনেই বলা হয়েছে— ‘পূর্ব্বে এই দুর্গোৎসবে যেরূপ সমারোহপূর্ব্বক নৃত্যগীত ইত্যাদি হইত এক্ষণে বৎসর দুই ক্রমে ঐ সমারোহ ইত্যাদির হ্রাস হইয়া আসিতেছে। এই বৎসরে এই দুর্গোৎসবে নৃত্যগীতাদিতে যে প্রকার সমারোহ হইয়াছে ইহার পূর্বে ইহার পাঁচগুণ ঘটা হইত এমত আমাদের স্মরণে আইসে’।
১৮৩৭ সনে ইংরেজ কোম্পানি আইন করে উচ্চপদস্থ সাহেবদের হিন্দুর পুজোয় আমোদ অনুষ্ঠানে হাজিরা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ঐ সালেরই ১৪ অক্টোবরের ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় সেই সংবাদ দিয়ে লিখেছেন— ‘এই ব্যাপারে কলিকাতার মধ্যে কেবল দুই স্থানে বিশেষতঃ শ্রীযুক্ত রাজা কালীকৃষ্ণ বাহাদুরের বাটী ও শ্রীযুত বাবু মতিলাল শীলের বাটীতে নাচ হইয়াছিল। এতদ্ভিন্ন প্রায় পঞ্চাশ ঘর ধনাঢ্য ব্যাক্তিদের বাটীতে ইউরোপীয় সাহেবদিগকে আহ্বানার্থ নাচ হইত সে সকল স্থানে হয় নাই। ইহাতে বোধ করি যে আগামি বৎসরে নাচ একেবারেই রহিত হইতে পারে’। সংবাদ শেষে আরো একটি লাইনে লেখা হয়েছে- ‘যেহেতুক সম্প্রতি কয়েক বৎসরাবধি কোনো ইউরোপীয় সামান্য ব্যাক্তিরা ঐ উৎসবে যাইতেছেন’।
‘সামান্য সাহেব’ ব্যক্তিরাই পরবর্তীকালে দুর্গোৎসবে নাচ-গানের আমোদের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিলেন। ১৮৫৪ সনের অক্টোবরের ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকা জানিয়েছে— ‘শোভাবাজারস্থ নৃপতিদিগের উভয় নিকেতনে নৃত্যগীতাদির মহাধূম হইয়াছিল, সাহেবরা নিমন্ত্রিত হইয়া সেই নাচের সভা উজ্জ্বল করিয়া ছিলেন, লোভের দেবের প্রিয় শিষ্য শ্বেতাঙ্গ ও আন্দ্র, পিন্দ্র, গোমিস গনসেলবস প্রভৃতি কৃষ্ণাঙ্গগণ যাঁহারা মোদের বিলাত মোদের কুইন বলিয়া গর্ব্ব পর্ব্ব বৃদ্ধি করেন তাঁহারা এই পুজোপলক্ষে উপস্থিত হইয়া বিলক্ষণ রূপে উদর পূরণ করিয়াছেন’। অনেক বছর পর ‘জোড়াসাঁকো নিবাসী রূপনারায়ণ মল্লিক মহাশয়ের পুত্রেরা… সিংহবাহিনী দেবীর পূজার পালা পাইয়াছেন। শ্রীযুত বাবু নবকৃষ্ণ মল্লিক ও তাঁহার অনুজ শ্রীযুত বাবু শ্যামাচাঁদ মল্লিক এই দুই ভ্রাতা জীবিত আছেন, প্রাণকৃষ্ণ মল্লিক হঠাৎ পরোলোক গত হওয়াতে তাঁহারা ভ্রাতৃশোকে অতিশয় কাতর আছেন’।
ভ্রাতৃশোক থাকা সত্ত্বেও কিন্তু ‘বাবুদিগের মনোহর নিকেতন সুরম্য সুসজ্জিভূত হইয়াছে’, আর শোকের মধ্যেও এতদিন পর দেবী সিংহবাহিনীর পূজা হচ্ছে তাই ‘অদ্য নাচ আরম্ভ হইবেক’ বলে সোমপ্রকাশ পত্রিকার সংবাদদাতা ৯ অক্টোবরে জানিয়েছেন। দুর্গোৎসবে নাচগানের আমোদ কিন্তু রাজবাড়ির ভিতরে সীমাবদ্ধ ছিল না, তা রাস্তা পর্যন্ত নেমে আসত। আমোদ দেখতে আসা মানুষ বাবু বাড়ির সামনে ভিড় করায় রাস্তার কী অবস্থা হতো তা সেকালের পত্রিকা থেকে জানা যাবে— বাবুরা ‘পূজার সময়ে নাচ তামাশাদির অত্যন্ত বাহুল্য করিয়া ছিলেন। তাহাতে তাঁহাদিগের বাটীর সম্মুখ রাস্তায় প্রায় পূজার তিন রাত্রিতে পদব্রজে লোকের শকটাদির ও যানবাহনের বহুলবাহুল্যে পথরোধ হইত’ (সমাচার দর্পণ, ১৩-১০-১৮৩২)।
উনিশ শতকের মধ্যভাগে বাবু বাড়িতে সারা রাত নাচ-গানের যে আমোদ হতো, সেই নাচ-গানের সঙ্গে যে মায়ের পুজোর কোন সম্পর্ক নেই তা সর্বজন বিদিত ছিল এবং তা নিয়ে সাধারণ মানুষের ভেতর ক্ষোভও কম ছিল না। তেমনই এক পত্র লেখকের পত্র থেকে জানা যায়- ‘বর্ত্তমান মাসের ১৪ তারিখে শোভাবাজারের রাজবাটীতে শ্রীযুত মহারাজ শিবকৃষ্ণ বাহাদুরের ও তদ্ভ্রাতৃগণের দ্বারা এক বিশেষামোদজনিত সভা হওয়ানানন্তর রাত্রি ৯ ঘন্টার সময় আরম্ভ হইয়া শেষ প্রহর যামিনী পর্য্যন্ত ছিল। এতদুপলক্ষে প্রধান ২ সাহেব ও বিবি লোক ও এতদ্দেশস্থ মান্য বংশ্য মহাশয়চয় এবং হিন্দুস্থানী রাজ ও নবাব দরবারের উকীল সকল আগমন করিয়াছিলেন। নৃত্যশালা ইংরেজদিগের তুল্য সুশোভিতা ছিল। এবঞ্চ সাহেবলোকের আহার্য্য সামগ্রী উত্তম সুস্বাদুযুক্ত প্রস্তুত ছিল…। উক্ত নৃত্যগীত কোন দেবোদ্দেশে হয় নাই’। ১৮৩৭ সনের ২১ অক্টোবর ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় এটি ছাপা হয়। ওই বছরই আইন করে উচ্চপদের সাহেবদের দুর্গোৎসবের আমোদে যোগদান নিষিদ্ধ হয়।
কিন্তু আমোদ কখনো শেষ হয় না, নতুন চেহারায় তা বার বার ফিরে আসে। কলকাতা হুজুগের শহর, হুজুগ ছাড়া কলকাতা নাকি বাঁচতে পারেনা। বাঁচার জন্য তার নিত্য নতুন হুজুগ চাই। নবকৃষ্ণ দেববাহাদুর দুর্গোৎসবে নাচ-গানের যে হুজুগ কলকাতায় শুরু করেছিলেন, তা নতুন চেহারায় আজও বর্তমান। তিনি সকলকে নিয়ে আমোদ করতেন ১৫ দিন, এখন এই যুগে সেই হুজুগ শুরু হয় ‘খুঁটিপুজো’ থেকে। আষাঢ় মাসে রথযাত্রার দিন বনেদী বাড়িতে মা দুর্গার কাঠামো পুজো করা হতো, সেই রীতি আজও চলে আসছে। বারোয়ারী বা সর্বজনীন পুজো কমিটির অনেকেই ঐ রথযাত্রাতেই খুঁটিপুজো শুরু করেছেন। আষাঢ় থেকে আশ্বিন এখন খুঁটিপুজোর ধুম পড়ে যায়। সঙ্গে থাকে অবশ্যই নবকৃষ্ণর দেখানো সেলিব্রেটি, নাচগান-ফুর্তি-আমোদের আসর।
প্রাচীনকালের মতো আজও উৎসব প্রাঙ্গণে ‘দুলিতেছে চন্দ্রাতপ শোভা মনোহর’, ‘পেতেছে গালিচা বড় ঢাকিয়া প্রাঙ্গণ/ বিহারে চেয়ার শ্রেণী সংখ্যা অগনন/ বসিয়াছে বাবুগণ করি রম্য বেশ’। আমাদের কলকাতা রয়ে গেছে সেই কলকাতাতেই।