শারদ অর্ঘ্য ১৪২৮ । বিশেষ রচনা
ভারতবর্ষের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়া ‘ভূম’ অন্ত্যযুক্ত জনপদগুলির মধ্যে মানভূম অন্যতম। সাবেক মানভূম নানা রাজনৈতিক উত্থানপতনের মধ্য দিয়ে আজ পুরুলিয়া নামে পরিচিত। ভৌগোলিক চিহ্ন হারিয়ে গেলেও মানভূম লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্য আজও অম্লান। এখানে প্রতি পদক্ষেপে উৎসব, প্রতি দৃষ্টিতে প্রেম, প্রকৃতির সুন্দরতা থেকে জনজীবনের উৎসব সবই যে কোনো উৎসুক মানুষের হৃদকুঠুরীতে নাড়া দেয়। পাহাড় ডুংরী ঝর্ণাধারার কোলে আদিবাসী গ্রামগুলি চরম দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করেও নিজ নিজ সৃষ্টি কৃষ্টি বাঁচিয়ে রেখেছেন আজও। কোন কৃত্রিমতা নেই তাঁদের ভেতর। ধামসা, মাদল, ডুয়াং, শিঙা, বানাম, চরপটি, করতাল প্রভৃতির বাজনা যে কোন মনপ্রাণকে আন্দোলিত করতে বাধ্য। তাঁদের জনজীবনের বিভিন্ন উৎসবগুলির মধ্যে তাঁদের অন্যতম প্রাণের উৎসব হল ‘দাঁসায়’ বা ‘হুদুড় দুর্গা’-র পুজো।
সারা বাংলায় যখন শারদোৎসব সূচনা হয় ঠিক সেই সময়ই সাবেক মানভূমের আদিবাসী সাঁওতালদের মধ্যে শুরু হয় ‘দাঁসায়’। আদতে এ কোনো আনন্দ উৎসব নয়, আদিবাসী জনজাতির মানুষদের বিষাদের উৎসব হল ‘দাঁসায়’। নবমীর দিন রঙিন পোশাক পরে মাথায় ময়ূরের পালক গুঁজে বাজনার তালে তালে নাচ-গান করেন উপজাতিকুল। দশমীর দিনে সমাপ্ত হয় দাঁসায় নৃত্যগীত। এই কয়দিন নৃত্যগীতের মাধ্যমে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁরা স্মরণ করে থাকেন তাঁদের প্রিয় হুদুড় দুর্গাকে। মজার বিষয় এটাই, শারদোৎসবকে ঘিরে সারা বাংলায় যখন নারীশক্তির বন্দনা চলে তখন এই জনজাতি কিন্তু রত থাকে এক বীরের বন্দনায়।
সাঁওতালী ভাষায় ‘দুর্গা’ হল পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গ হয় ‘দুর্গী’। কালেন্দ্রনাথ মান্ডি রচিত ‘সাঁওতাল পূজা পার্বণ’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ৪৫) এর উল্লেখ পাওয়া যায়। আর ‘দাঁসায়’ শব্দের অর্থ হল অসহায়। হুদুড় দুর্গা পূজা সম্বন্ধে জানতে চাইলে বর্ষীয়ান লেখক ও ‘ঝারনা’ পত্রিকার সম্পাদক শ্রবণ টুডু বলেন, “এ হল আর্য অনার্য-এর লড়াই। আক্ষরিক অর্থে এ হল এক খোঁজ বা খুঁজে বেড়ানো।” নৃত্যগীতের মাধ্যমে আদিবাসী সাঁওতালরা খুঁজে বেড়ান তাঁদের প্রিয় হুদুড় দুর্গাকে। কে এই হুদুড় দুর্গা?
অনার্যদের দলনেতা (দেবতা) ছিলেন হুদুড় আর আর্যদের দলনেতা (দেবতা) ছিলেন ইন্দ্র। অনার্যদের দেহের বলশক্তির সাথে কিছুতেই পারছিলেন না দেবরাজ ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতারা। কোনো দেবতারাই রুখে দাঁড়াতে পারছিলেন না হু্দুরের পরাক্রমের সামনে। তাই হুদুড়কে হত্যা করার জন্য কৌশল অবলম্বনের প্রয়োজন হয়। দেবরাজ ইন্দ্র সুকৌশলে সুন্দরী এক নারীকে রণসাজে সজ্জিত পাঠান যুদ্ধক্ষেত্রে। মহিলার সঙ্গে লড়াইয়ে নীতিগত আপত্তি ছিল হুদুড় দুর্গার৷ সেই নারীর ছলনায় পরাহূত হন অনার্যদের বীর দলনেতা (দেবতা) হুদুড়। সেই নারীর হাতেই মৃত্যু হয় তাঁর। আর এরপরই অনার্যদের জীবনে নেমে আসে চরম দুঃখের দিন। আর্যদের অত্যাচারে অনার্য পু্রুষরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন অন্যত্র। তবে একটা বিষয় ছিল আর্যরা নারীদের উপর অত্যাচার করত না। তাই কিছুদিন পর অনার্য পুরুষরা নারীর বেশ ধারণ করে লুকিয়ে ফিরে আসে দেশে। আর সেই থেকেই এখনও সংস্কৃতির আঙ্গিনায় নৃত্য, গীত প্রভৃতির মাধ্যমে তাঁরা খুঁজে চলেছে তাঁদের বীর দলনেতা হুদুড়কে।
আর্য ও অনার্যদের এই লড়াই-এ অনার্য নারীদের ভূমিকা ছিল কিন্তু অপরিসীম। অনার্য বীরাঙ্গনাদের মধ্যে আইনম, কাজল, ছিতৗ, কৗপুরী দাঁনগী, পুঁড়গী, হিসি, ডুমনী প্রভৃতি মহিলাগণ অত্যন্ত বীরত্বের সাথে লড়াই করেছিলেন। আইনম, কাজলকে আর্যরা বন্দী করলেও পরে অনার্যরা তাঁকে উদ্ধার করতে সমর্থ হন। পুরো লড়াইটা ছিল আসলে চম্পাগড়ের এলাকা দখলের লড়াই— অতীতে যা কান্দাহার বা গান্ধার দেশ নামে পরিচিত ছিল। নারীশক্তি সাথে অনার্যদের বিরোধ ছিল না কোনো কালেই।
অরণ্য রক্ষা, শারীরিক পটুতা, সাংস্কৃতিক দক্ষতা আমরা সাঁওতালদের প্রতি পদক্ষেপে দেখতে পাই। যখন উৎসব আসে তখন তাঁরা সারারাত নৃত্যগীত করেন একই ছন্দোবদ্ধ ভাবে। সুর তোলেন তাঁদের ধামসা মাদলে। আসুন, আমরা ছোট্ট পরিসরে চোখ বুলিয়ে নিই যে সুষ্ঠু ব্যবস্থার মাধ্যমে সমস্ত কিছু পরিচালিত হয় এই আদিবাসী গ্রামগুলির, সেই দিকে। প্রতিটি গ্রামেই এই রীতি রেওয়াজ যুগ যুগান্ত ধরে চলে আসছে—
মাঝি— সমস্ত কিছুর প্রধান তিনি, প্রতিটি কাজে তাঁর মতামতই সর্বোচ্চ।
পারনিক— সর্বময় প্রধানের অর্থাৎ মাঝির সহকর্মী।
জগমাঝি— যুব নেতৃত্ব। যাতে গ্রামীন কোনো অশান্তি না হয়। কোন নৃত্য গীত পরিচালনা হোক বা অন্যান্য কোন দুষ্কর্ম কেউ না করে তিনি সেদিকে সর্বদা সচেষ্ট থাকেন।
জগ পারনিক— যুব নেতৃত্বের সহকারী। জগমাঝিকে সর্বদা সাহায্য করেন।
গাড়ৎ— খবরা খবর তিনি করে থাকেন। কোন বিষয়ে সভা ডাকা। বিভিন্ন বিষয়ে গ্রামের মানুষকে জানানো। এককথায় বার্তাসংযোগকারী।
নায়কে— পূজারী। গ্রামীন সমস্ত কিছুর তিনি পূজার্চনা করেন।
কূডৌমনায়কে— পূজারীর সহকারী। তিনি নায়কেকে সাহায্য করে থাকেন।
দেশমাঝি— যিনি পারগানার* বিচার ব্যাবস্থার সঙ্গে থাকেন।
*কয়েকটি গ্রাম মিলে তৈরী হয় পারগানা।
আবার ফিরে আসি ‘দাঁসায়’ অথবা হুদুড় দুর্গা পুজোর প্রসঙ্গে। দাঁসায়ের প্রধান বাদ্যযন্ত্র হল ভূয়াং— লাউয়ের তৈরী এই বাদ্যযন্ত্র থেকে ভূং ভূং আওয়াজে খুব সুন্দর সুর নির্গত হয়। সঙ্গে করতাল। পুরুত গুরুদেবদের উদ্দেশ্যে মন্ত্রপাঠ করেন। এই উৎসবে যে সমস্ত গানগুলি গীত হয়… তার একটি ‘হায়রে হায়রে—দিবিবে দুর্গা দকিন ওডোকেনারে / আয়নম কাজল দকিন বাহের এনারে…’। তাছাড়া রয়েছে গুরু শিষ্যের কথোপকথনের করুন গানগুলি যা হৃদয়ের অন্তস্থলে রয়ে যায়। দাঁসায় নাচের সাথে যে গানগুলি গীত হয় সেই গানগুলিতেও হা-হুতাশ আছে৷ তাতে বলা হয়, ‘দুর্গা অন্যায় সমরে মহিষাসুরকে বধ করেছেন৷ হে বীর, তোমার পরিণামে আমরা দুঃখিত৷ তুমি আমাদের পূর্বপুরুষ৷ প্রণাম নাও …৷’ দাঁসায়ের গানগুলি আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতি তথা ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ।
বর্তমান পুরুলিয়ার কাশিপুর ব্লকের ভালাগোড়া গ্রাম সহ বিভিন্ন জায়গায় হুদুড় দুর্গার পুজো হয়ে থাকে। দেবী দুর্গার আগমন বা বিদায়ে আজও আবেগহীন এই জনপদে বীর বন্দনার পালা ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে৷ ক্রমশ প্রসার ঘটেছে এই পুজোর ৷ হুদুড় দুর্গা পুজোকে নিজেদের সমগ্র জাতিচেতনার অহংকার হিসেবে দেখেন এই জনজাতির সকলেই।
তথ্যসূত্র
১। সাঁওতাল পুজো পার্বণ – কলেন্দ্রনাথ মান্ডি
২। ধরমগুরু, কামরুগুরু, মারাংগুরু, গান্ডোগুরু, রহড়াগুরু, সিদোগুরু, ডানাগুরু, পরান গুরু
শুভেন্দু শেখর ভট্টাচার্য – Bulletin of Cultural Research
সুহৃদ কুমার ভৌমিক – সাঁওতালী গান ও কবিতা সংকলন
অজিত হেম্ব্রম – ভালাগোড়া হুদুড় দুর্গা পুজো কমিটির অন্যতম উদ্যোক্তা
ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার – শ্রবণ কুমার টুডু, সদানন্দ হাঁসদা, তারাপদ মুরমু, সুহৃদ কুমার ভৌমিক
পত্র পত্রিকা
লাথন্ডি – স্বপন কুমার পরামাণ্ডি
তেতরে – মহাদেব হাঁসদা
সিলি – কলেন্দ্রনাথ মান্ডি
ঝারনা – শ্রবণ কুমার টুডু
আমার পুরুলিয়া – ১৬ই অক্টোবর, ২০১৯ (সম্পাদক – সঞ্জিৎ গোস্বামী)