শারদ অর্ঘ্য ১৪২৮ । বাংলাদেশের গল্প
পৌরসভা অফিসের শিরদাঁড়া সোজা গলির ডানদিকে এগিয়ে, হাতের বামে গেলেই পাড়াটা। হেঁটে না গিয়ে রিক্সা দিয়ে যায় অনেকে। ভাড়া দশ টাকা। পাঁচ টাকায় খালি এক কাপ চা ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়না এ যখন অবস্থা; আলিশান বিল্ডিংগুলোর দেয়ালঘেঁষা রাস্তার নালা ফেঁপে উচ্ছিষ্ট আবর্জনায়, পাতি ও ডুলকাকের অজিরানি কা- কা। নাক দুই আঙুলে, ওড়নাতে চেপে রমণীরা হাঁটে, কালো রোদচশমায় কেউ কেউ ভাব মাড়িয়ে। প্রযুক্তির দিলখোলা আশীর্বাদে প্রাইমারী স্কুলে ঝরে পড়া ছেলেগুলোও ক্রিকইনফো, ক্রিকবাজে নেট গুঁতিয়ে প্রতি বলে ধরছে বাজি। সেখানে কলেজ ডিঙানো মুক্তার আঙুলের ডগায় পুরো পৃথিবী সহজেই অনুমেয়।
ইন্টার পরীক্ষার মাসখানিক আগে বিয়ে হয়েছিল প্রবাসী হান্নানের সঙ্গে! বলা যায়, প্রবাসীরা অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করে। পরীক্ষার সময় একটা মেয়েকে বিয়ে করা, বিছানায় কলবলে রাত কাটানো সব সম্ভব, তদুপরি উপায় ছিলো না। তিনমাসের ছুটি নিয়ে বিয়ে করতে এসেছিল। ছুটির প্রতিটা সেকেণ্ড বউ ছাড়া কাটানো কষ্টকর যেন; পুরো পরিবার গলদঘর্ম হয়ে ওঠে পাত্রীর খোঁজাখুঁজিতে।
বিদেশ থেকে আসার রাতটা কেবল গেছে বিছানায় গড়গড়াতে। পরের দিনের আলো ছড়িয়ে পড়তেই পাত্রী দেখার তোড়জোড়। কখনো ছোট ভাইয়ের, কখনো খালা – ফুপির, কখনো বন্ধুদের এ আত্মীয় সে আত্মীয়ের মেয়ে। এই সেই করতে করতে হান্নান হাঁফিয়ে উঠেছিল। বিয়ের উকিলগুলোর প্যানপ্যানানিতে সপ্তাহ যেতেই আবেগ প্রায় ভোঁতা !
এমন সময়ে ছোট ভাইয়ের বন্ধুর বোন মুক্তাকে প্রথম দিন দেখতে গিয়ে হান্নানের পছন্দের মাত্রা এমন যে, হাতে আংটি পরিয়ে বিয়ের দিন নগদে ধার্যও করেছিল। বেশরম বলা যায় না, জঞ্জালি টেনশন থেকে রেহাই পাবার উপস্থিত বুদ্ধি মাত্র। সবাইকে বুঝাতে চেয়েছে – বিয়ে যখন করতেই হবে, ছাড়-টাড় দিয়ে করে নিলেই হয়। মুক্তাকে এতো ভালোলাগা বুঝতেও দিলো না কাউকে। দারুণ হজমী শক্তি বটে; মুরব্বিদের কথা বলার অতটুক সময়ক্ষেপণও করেনি…! মুরব্বিদের এটা-ওটার দাবি হান্নানের কাছে গরুর হাটে দর কষাকষির মতো ঠেকে। এ প্যাঁচে মুক্তাকে যদি বউ করা হয়ে না ওঠে!
হান্নান প্রথম দৃষ্টিতে মুক্তাকে ভালোবাসে। ভালোবাসা এমন করেও হয়। ভালোবাসা বড়ই বিচিত্র, ভালোবাসা বুঝি এক ধাঁধাঁ। কেননা ভালোবাসাবাসি করবে সেই সময়ে হান্নানকে বিদেশে চলে যেতে হয়। পরিবারের হাল ধরে। ভালোবাসাবাসির ক্ষোভ তো আছেই। ভালোবাসার ক্ষোভ আগুনের চেয়ে বেশি পোড়ায় সবার অলক্ষ্যে;
বৈঠকে থাকা মুরব্বিদের হান্নান সাহসী স্বরে বলেই দিলো চাচাতো দুলাভাইকে চোখ টিপ্পনী দিয়ে – বউ তো আমার হবে, নাকি ? আমার পছন্দ না হলে ! ঘুমাতে তো আর কেউ যাবে না… সবাইতো থ’। মুরব্বিরা না শোনার ভান ধরলো। কেউ কেউ তাল মিলিয়ে হেসে উঠলো। হতে পারে হাসির কারণটাও না জেনে; বিয়ের পরবর্তী তিনমাস পেরুতেই যথারীতি হান্নান বিদেশ চলে যায়। অথচ কেমন জানি দূরে থাকা নয়। হৃদয় সংযোগ তো আছে, তদুপরি দিনের প্রায় সময়টা মোবাইলের চওড়া স্ক্রিনে তাকিয়ে আনমনা ও একগুঁয়েমির মুহূর্ত কলবলিয়ে কাটে। দুপুরবেলার খাবারের পর পাকঘরটা গুছিয়ে শোবার ঘরে আসতে আসতে বিকেলের উদ্দামতা ফুরোয়। বিদেশে তখন হান্নানের লাঞ্চ ব্রেক। প্রায় চার ঘন্টার মতো সময়ের ব্যবধান।
সেদিন শোবার ঘরে শিমুল তুলোর বালিশে উপুড় হয়ে, জোড়া পায়ের গোড়ালি দোলাতে দোলাতে শূন্যে, ভিডিও কলে পরস্পরের মুখ চেয়ে কথা হচ্ছিলো…
এই বুঝি সেই এশকের ঠেলা। অজিরানি রিংটোন বেজেই যাচ্ছে। কল রিসিভ করার জন্য পাকঘর থেকে একরকম দৌড়ে, শাড়ির আঁচলায় তুলতুলা হাত মোছতে মোছতে ; সাদা হেডফোনটি কানে লাগিয়ে যে কথা বলা শুরু, রুমের দরোজাটা আটকাবে সেটার হুঁশও থাকলো না। তবে, ঘরে পুরুষ মানুষ বলতে একমাত্র দেবরটিও পড়াশোনার জন্য বাইরে। জরুরি সত্য কথা এই, হেডফোন কানে লাগালে বাইরের দুনিয়াটার খবর কি আর থাকে! কথার টানে কথায় এশকের লা-মক্বামে গলার স্বরটা এমনি এমনি পৌঁছে, ভলিউম বাড়ে নিজেদের অজান্তে। মুক্তাও জানে না তার শাশুড়ি মায়মুনা দরোজার আড়ালে এসে পা টিপে দাঁড়িয়েছে… !
মায়মুনা মানে মুক্তার শাশুড়ি। এখনও বয়স তেমন হয়নি। খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে আর বিয়ের বছরটাও না যেতে কোলজুড়ে হান্নানের হাত-পায়ের ছোঁড়াছুঁড়ি। এখন চলতি বয়স বললে বিয়াল্লিশটা বসন্ত পেরোলো মাত্র…!
এই পড়ন্ত বিকেলে মোবাইলে উচ্চস্বরে কথা বলায় মনে আসা কৌতূহলে, আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতে এসে মায়মুনা নিজের শরীরে খুব চেনা চেনা অতীতের টান অনুভূত হলো; ঐদিকে মুক্তা মোবাইলের স্ক্রিনে চুমুর পর চুমুর বন্যা বয়েই দিচ্ছে। যেন জল ঠুস্ ঠুস্ শব্দ করে পড়ছে জলে, জলের গায়ে। মুক্তা ঝলমলে চোখেমুখে বলছে – হলো? সোনা, হলো…এবার তুমি শান্ত হলে?
শান্তদিঘির কালো জলের মতো চোখের মণি দুটো মোবাইলের স্ক্রিনে নিবিড়তায় ঝলমলাচ্ছে। মন আর শরীরের দ্বৈত তৃষ্ণায় দেদারসে চুমু দেওয়ার পর মুক্তা হাঁ-মুখে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বলছে – অ্যাঁ….. দাও, গরাস খাওয়ায়ে দাও…
হান্নান হয়তো খাবারের প্লেট থেকে গরাস তুলে দিচ্ছে। কী অত্যাধুনিক জলজ্যান্ত আধ্যাত্মিক কাজ কারবার!
মুক্তা হাঁ বন্ধ করে বললো – হুম, খেলাম। আচ্ছা, আজ শুধু ডাল ভর্তা দিয়ে ভাত খাচ্ছো কেন!
মুক্তা কিছুক্ষণ চুপ করে হান্নানের কথা শুনে বলে — ওহ্ হো সোনা, কী কষ্ট না? জানো সোনা, রান্না শেষ করে খাবারগুলো মুখেই যায় না। প্লেটের ভাতগুলোতে তোমার মুখ ভাসে। গরুর গোশতের ভুনা রান্না করলে তো, সেদিন খেতেই পারি না চোখের জলে…
দরোজার আড়ালেই মায়মুনার হঠাৎ মনে পড়ে গেল গর্ভছেঁড়া হান্নানকে। ছোটোকালে ভাত খাওয়ায়ে দেওয়ার সে ঝলমলে সাদাকালোর দৃশ্য। এই তো, হান্নান হাই স্কুলে উঠেও ভুগিয়েছে। শত কাজে ঢলে পড়া দেহই হোক, গরাস খাওয়ায়ে না দিলেই খেতো না। এসব ভাবতে নিজের অজান্তে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। গাল বেয়ে পড়তে থাকা অশ্রু মুছে যে তাকালো, মুক্তা মোবাইলটি কমলার কোয়ার ঠোঁট ছুঁয়ায়ে বুক থেকে, ঘামে নেয়ে ওঠা আপেলের মতো গর্তের নাভি থেকে আরো নিচে, আরো নিচে…ধীরে ধীরে এলোমেলো শাড়ির কুঁচি গলিয়ে জ্বরমাপক স্টেথোস্কোপ যেন হাতড়াচ্ছে সব উষ্ণতা ; মুক্তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো জানালার পর্দা মৃদু বাতাসে তিরতিরে উল্টে-পাল্টে, বিড়বিড়ে আলোর ছটকে স্বর্ণালী হয়ে চকমকাচ্ছে। জানালার কাছে কামিনী গাছে ছোট্ট ছোট্ট সাদা ফুলের ম-ম গন্ধে ঘুচঘুচে কালো ভিমরুলের দৌড়াদৌড়ি ঘরের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ। মুক্তার সারা শরীর ঝাঁকিয়ে যাচ্ছে। হোমিওপ্যাথির শিশি’র মতো এক পায়ের নূপুর ঝনঝনায়ে, সাপের তলপেটের মতো বেঁকে, অতঃপর ঘামের বিন্দু দরদরিয়ে ঝরে পড়লো বালিশে, বিছানার চাদরে…
নিঃশ্বাসের বাড়াবাড়িতে বুকটার ঘন ঘন উঠা-নামা। ঘামে ভরা গাল ও কপালে মোবাইলটি ঠেকিয়ে হিসহিস শব্দে বলতে লাগলো — ইস্ সোনা, আমাকে শেষ করলে তুমি, আমি আর পারছি না…
এতক্ষণে মায়মুনার শরীরে আচমকা কে যেন বৈদ্যুতিক হিটার বসাল। বুকটা ভারী হয়ে এলো হঠাৎ, সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসার মতো। সে হাতড়াতে থাকলো নিজেকে আর নিজের জীবনের সে দিনগুলি…
২
তখন হেমন্তের পাকা ধানের মওসুম। পুরাতন বাড়ির ঘরে – বাইরে ধানের ফুঁঝা। গলাকাটা ধানের গোড়া বাইরে আর ধানেরচড়া ভেতরে এভাবে উঠোনের পুরোটাতে ফুঁঝাগুলো টিলার ন্যায় ‘তারা’য় সাজানো। মাগরিবের আজানের পর থেকে শীতের ধোঁয়াশা ভেদ করে চাঁদের আলোকে মজজুবি চিকমিকি।
সন্ধ্যা পর্যন্তই ফুঁঝাগুলোর উপর লাফিয়ে লাফিয়ে খেলেছে হান্নান ও তার বন্ধুরা। ধানপাতার আঁলে কচি গায়ের অনেক জায়গায় কেটেছে মালুমও নেই। সন্ধ্যার পরে হাত মুখ ধুতে যখন কাটা স্থানে পানি লাগছে, শূলিয়ে ওঠছে বিষম। অথচ মায়ের সামনে ‘অহু’ শব্দ করলেই ঝাড়ি – বকাবকি, চোখরাঙানি। তাই ভেতরে দাঁত খিচে চুপচাপ…
মায়মুনার স্বামী সবেমাত্র বিদেশে গিয়েছে। চাষের জমিগুলোতে চাষবাস দেবর দুটোই করে। ট্র্যাক্টর দিয়ে, কখনো ঘরের মেয়েমানুষরা মিলে কোমরে আঁচলা গুজিয়ে টুলে – টেবিলে, কেউ কেউ মরিচের পাঁডায় ধোপার কাপড় আছাড় মারার মতো ধানগাছ থেকে ছড়ানো ধানগুলোর ঘরময় স্তূপ। শীত তেমন নেই বললেই চলে স্তূপাকার ধানের ভাপসা গরমে। দলিফড়িং, ছোট ছোট কালো – সোনালি পোকাগুলি আঁধারে মায়মুনার রুমেও ঢুকে যাচ্ছে। রাতের খাবার খাওয়ার আগ পর্যন্ত এই খাটুনির পরেও মায়মুনার অবসর নেই। কেননা স্বামীকে ক্যাসেট পাঠাতে হবে। আরেক গ্রামের একজন বিদেশ যাচ্ছে আগামীকাল…
রেডিও-র সামনে বসলো। ঠিক রেডিও জকির মতো। জোরে কাশি দিয়ে গলা ঝাড়ল কয়েকবার। থু থু গিলল পরপর। রেডিও-র রেকর্ডের ঘরটি চাপতে প্লে এর ঘরটি চেপে যায়। মানে দুটো ঘর চাপে আর ঘুটঘুটে লাল মরিচরঙা ছোট একটা বাতি জ্বলতে থাকে। ‘আসসালামু আলায়কুম, আসসালামু আলায়কুম’ বলে বলে রেকর্ড করছে। তারপর রেকর্ড পিছনে টেনে শুনছে। এমন কয়েকবার টেস্টিং করে গলার স্বরটা ভালো বোঝাচ্ছে কিনা পরখ করে।
আহা, ক্যাসেটটি অনেক আগেকার জারি গানের। মায়মুনা এটি প্রায়ই শুনে। সুখে – দুঃখে আর অবসরের একমাত্র সাথী। মা ফাতেমা – কুলসুমার জারি। কাজ-টাজ থেকে একটু রেহাই পেলেই শুনতে শুনতে, নাক টেনে টেনে চোখের জল ঝরায়। একমাত্র মরা বোনটির কথাও খুব মনে পড়ে। আর কোনো ক্যাসেট নেই বলে রোদে দিনভর শুকালো, যেন ফিতে ফুলিতে না আটকায়। এতো শখের জারির ক্যাসেটটির জন্য রেকর্ড করতে বসার আগে মৃদু আফসোসও করল।
ঠিক নিশুতি রাত। ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ বা মাঝে মধ্যে কেবল খেঁকশিয়ালের ডাক শুনা যাচ্ছে। চূড়ান্তভাবে কথা বলার প্রস্তুতি নিয়েও দরোজাটা খুলে অন্য রুমগুলো দেখে। দেবর দুটোই পাশের বাড়ির ছেমা মাহফিলে গেছে। ভোরের আলো ফোটার আগ পর্যন্ত জোড়খাই – তবলা, হারমোনিয়াম ও জুঁরির ঝুমঝাম ঝংকারে ভাণ্ডারী আর কাওয়ালি গানের জিকির আসকার চলবে। খুব দূর থেকে এ গভীর রাতে মাইকের আওয়াজ আসছে একটু একটু —
তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো
আজ আমার কালাসোনা আসিতে পারে
মনে চায়, দিলে চাঁই যারে…
মায়মুনা বুক ধড়পড় ধড়পড় করা রাতে কানখাড়া করে গানটি বুঝতে ও শুনতে চেষ্টা করে। মনের পশম ধরে টানাটানিতে, গুনগুনিয়ে গলাও মেলায় মাইকে শুনা গানের তালে তালে।
হঠাৎ গানের ঝোঁকটা বাদ দিয়ে রেডিও-র সামনে চূড়ান্তভাবে গলা ঝাড়ল। টিনের চালে পাকনা বরই পড়ার শব্দে শিশির ঝরছে। এমন সময় বৃদ্ধা শাশুড়ি বিছানায় পড়লে দুনিয়ার খবরও থাকে না, তবুও মনে খটকা। দরোজা আবারও খুলে আর বন্ধ করে। এমনকি জানালাটিও খুলে দেখে ফকফকা জোছনায়, বেঁড়ার ফাঁকে কেউ তাকিয়ে বা শুনে আছে কিনা। অতঃপর রেডিও-র সামনে বসে। গলা ঝাড়ে, থু থু গিলে। মাথার ঘনকালো লম্বা চুলের বেণী কোমলতায় মোচড়ে মোচড়ে কথা বলা শুরু করে –
আসসালামু আলায়কুম, আশা গঁরি অঁনে ভালা আঁছন। আঁইয়্যও আল্লাহর রহমতত্ আর অঁনর দোআঁয় হঁনো রহঁম আঁছি। আঁই ন জানি রফিক ভাই হাঁলিয়ে যেবো গোঁয় বিদেশত্। আঁজিয়ে হইয়্যিঁদে তোঁয়ার ভাই। অঁনে জানোন ঘরে বাইরে এঁহন ধান। এতল্লাই রেতঁর নিশিত হঁতা হদ্দি। অঁনেত্যে পেট ন পুড়ের না শাঁমী…? আঁই নিজও ন জানি, কেঁনে রেঁত হাঁডায়। বালিশে জানে আঁর দো নয়নঁর জঁলে জানে। দোচোঁখোর ভূঁর পুঁচি যাবু এগদিন। অঁনে হাঁছা গঁরি হঁনতো হত্তে দেশত্ আঁইবেন…? আঁই পতিবার আলমারি খুঁলিলি অঁনর শাটর্ত্তুন অঁনর গন্ধ লঁই আর হাঁদি…
দপ্ করে রেডিও-র পজ ঘরটি চাপ দিয়ে রেকর্ড বন্ধ করে। ইচ্ছেমতোন কাঁদে মায়মুনা। বুকের পাঁজরের হাড়গুলো কাঁচি দিয়ে কাটছে যেন কেউ। হান্নানকে ঘুম থেকে তুলে প্রস্রাব করায়। সে সবে দশ বছরের বালক। হান্নানের চোখে পানি ছিটিয়ে ঘুম তাড়ানোর চেষ্টা করে। রেডিও-র সামনে হাঁটু মুড়ে বসিয়ে দিয়ে বলে – হঁ না হঁতা ওপুত্ তুঁর বাপঁল্লেই, হাঁলিয়ে ক্যাসেট দিঁইয়্যুমদে…
হান্নান ঘুমের ঘোরে সালাম দিয়ে বলতে থাকে – আব্বু ভালা আঁছন্না…? আঁই এঁহন স্কুলুত্ যাঁই। আঁল্লেই গাড়ি এন্নোন, আঁর জ্যাম্পার ছিঁড়ি গিঁইয়্যিঁ…
মায়মুনা হান্নানের গালটা টেনে দেয় এমন পাকনা কথাবার্তার জন্য। হান্নানের ছোট মন্নান এক বছরের। ঘুমের মধ্যে নেড়েচেড়ে কান্না করায় উচ্চস্বরে। এ কান্নাও রেকর্ড করে। এ যেন কান্না নয় শুধু, অনেক বড় পাওনা মায়মুনার স্বামীর কাছে… বুকের ঢেউ, আকুতি….
এ ক্যাসেটটি মায়মুনার স্বামীর প্রবাসে পৌঁছলেও, হয়তো শুনতে পারেনি। রফিক যাওয়ার ঠিক দু’দিন পর খবর এলো স্বামী আরবের রাস্তায় গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা যায়। লাশও দেখা হয়নি শেষবারের মতো। অনেকে ফতোয়া দিলো – আরবের মাটিতে দাফন হওয়া পরম সৌভাগ্যের…
হঠাৎ এসব ভাবতে ভাবতে মায়মুনার দু’টি চোখ চাপিয়ে অশ্রুতে অশ্রুজলসা। রুমের আড়াল থেকে নিজের রুমে দৌড়ে গেল আঁচলা মুখে চেপে আর পাওয়ারি চশমার সম্মুখে জমে উঠেছে হেমন্তের আবছা কুয়াশা…