শারদ অর্ঘ্য ১৪২৮ । গল্প
পাহাড়ি নদীটির ধার দিয়ে যে সরু রাস্তাটি চলে গেছে, সেটা ধরেই খুব দ্রুত আমি গ্রামের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। ওখানে আজ স্থানীয় দেবীর পুজো আছে। সেই পুজো দেখতেই শহর থেকে এতদূরে আসা। লোকদেবদেবী নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করতে গিয়ে হঠাৎ এই লোকদেবীকে আমি আবিষ্কার করে ফেলি। কিন্তু তারপরই সব অন্ধকার। আর কোনো তথ্যই কেউ দিতে পারলো না। অতএব ব্যাগপত্র নিয়ে নিজেই একদিন বেরিয়ে পড়লাম।
গ্রামের ভেতরে চমৎকার একটি প্যান্ডেল তৈরি হয়েছে। বুঝতে পারলাম, শহরের হাওয়া এখানেও এসে লেগেছে। প্যান্ডেলটিকে বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় যেন একটা তাসের বাড়ি। অর্থাৎ, একটার পর একটা তাস ওপর-নিচে সাজিয়ে যেন প্যান্ডেলটিকে তৈরি করা হয়েছে।
ভেতরে ঢুকে আমি কিন্তু চমকে গেলাম। লোকদেবীর মুখটি আমার চেনা। এই মেয়েটির ছবি আমি দেখেছি। আর তখনই আমার মনে পড়ল বিশেষ একজনের কথা। প্যান্ডেলের বাইরে বেরিয়ে এলাম আমি। কর্তাগোছের একজন বৃদ্ধ ব্যক্তিকে পেয়েও গেলাম। তার কাছেই আমি জানতে চাইলাম, এই মূর্তিটি কি উষ্ণিক সমাদ্দারের করা?
আমার প্রশ্ন শুনে তিনি খুবই অবাক হলেন। তারপর জানতে চাইলেন, উষ্ণিককে আপনি চেনেন?
হ্যাঁ, ও তো আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধু!
বিষণ্ণ চোখ মেলে বৃদ্ধ বললেন, হ্যাঁ, এটি উষ্ণিকেরই করা। ও এই গ্রামেরই ছেলে। আর… একটু থেমে উনি যোগ করলেন, এটাই সম্ভবত ওর শেষ কাজ! ‘সম্ভবত’ শব্দটি ইচ্ছা করেই যেন উনি যোগ করলেন।
শুনে দ্বিতীয়বার চমকে উঠলাম আমি। তারপর বললাম, উষ্ণিক কী আবার নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে?
বৃদ্ধ মাথা নেড়ে সায় দিলেন। তারপর প্রায় ফিসফিসিয়ে বললেন, এ দেবী এই অঞ্চলের খুব প্রাচীন দেবী। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এই দেবীর ব্যাপারে নানা তথ্য পাওয়া গেলেও, কেউ কখনও তাঁর মুখ দেখেনি। প্রায় চারশো বছর আগে এই গ্রামের জমিদার যখন স্বপ্নাদেশ পান, তখনও তিনি দেবীর মুখ দেখতে পাননি। তিনি দেবীর সাজপোশাক, গঠন, গলার স্বর ইত্যাদি নিয়ে অনেক কিছুই বলেন। কিন্তু দেবীকে কেমন দেখতে, সে বিষয়ে কিছুই বলতে পারেননি। উষ্ণিকের বাবা ছিলেন এই অঞ্চলের সেরা মূর্তিশিল্পী। গত পঞ্চাশ বছর ধরে প্রতি বছর তিনিই এই লোকদেবীর মূর্তি বানিয়ে এসেছেন। গত বছর ওঁর মৃত্যুর পর এ বছর সেই দায়িত্ব নেয় উষ্ণিক। মাত্র ছ’মাস হলো ও গ্রামে ফিরে এসেছিল। সবাই ভেবেছিল, এবার বোধহয় একটু থিতু হবে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, কেমন খামখেয়ালি স্বভাবের ছেলে ও। একা একাই নদীর ধারে আর জঙ্গলের নির্জনে ঘুরে বেড়াতো। আর চমৎকার সব মূর্তি তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিতো আমাদের। অনেক মৌলিক আইডিয়া ছিল ওর। আমরা ভেবেছিলাম, ছেলে বোধহয় বাবাকেও ছাপিয়েও যাবে! এবার যে মূর্তিটি ও করেছে, তার মুখ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই ভাবনাচিন্তা করছিল। নদীর ধারে বসে চুপচাপ ভাবতো আর নিজের মনেই বলতো, নাঃ, মাটি আর রং দিয়ে ওই মুখ, হবে না, পারবো না আমি… তারপরই ওর চোখ বুজে যেতো, ও যেন কারও কথা ভাবতো, ওর ঠোঁটের কোণে একটা আবছা হাসি ফুটে উঠত… শেষপর্যন্ত ও যেটা বানিয়েছে, সেটা তো দেখতেই পেলেন… দুনিয়ার সমস্ত সৌন্দর্য যেন ও ঢেলে দিয়েছে দেবীর মুখের মধ্যে…
বললাম, আপনি ওর বাড়িটা আমাকে একটু দেখিয়ে দেবেন?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। বৃদ্ধ আমাকে আঙুল দিয়ে দেখালেন। তারপর বললেন, ওর মা আছেন। তাঁর কাছ থেকে আপনি আরও খবর শুনতে পাবেন।
উষ্ণিকের বাড়ির দিকে যেতে যেতে মনে হলো, এই এক দোষ উষ্ণিকের! যখন-তখন অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। ওর গ্রামের নাম আমার মনে ছিল না। এম.এ পড়ার সময় ওর প্রতিভায় সবাই মুগ্ধ হয়ে গেছিল। ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা ভালোমতোই দিয়েছিল ও। আমার সঙ্গে বেশ বন্ধুত্বও হয়ে গেছিল। কিন্তু সেকেণ্ড ইয়ারে গিয়েই সব কেমন গোলমাল হয়ে গেল। রোজ পরীক্ষা দিতে যেত ঠিকই। কিন্তু কিছুই না লিখে শুধু অদ্ভুত অদ্ভুত সব ছবি এঁকে খাতা ভর্তি করে সেই খাতা জমা দিয়ে চলে আসতো। সেইসব দিনের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। খুব বিষণ্ণ দেখাত ওকে। পরীক্ষার হলে আমার ঠিক পাশেই বসতো ও। চোখের সামনেই ওকে ওইসব করতে দেখতাম। বোঝাতামও অনেক। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। ততোদিনে ও বোধহয় মনস্থির করে ফেলেছে। তারপর হঠাৎ একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। বহুদিন ওর আর কোনও খোঁজ পাইনি…
ওর মাকে দেখে উষ্ণিকের মুখটাই যেন ভেসে উঠল চোখের সামনে। পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই বয়স। মাথার একটাও চুল পাকেনি। মেধা আর লাবণ্য মিলেমিশে গড়ে উঠেছে সেই মুখ। অসম্ভব ঋজু ব্যক্তিত্ব। হাঁটাচলায়, পোশাকে, গলার স্বরে দৃঢ়তা। কিন্তু চোখ দুটো সেই একইরকম বিষণ্ণ ও কোমল। আমার নামটা বলতেই তিনি আমাকে চিনতে পারলেন। তারপর সাদরে অভ্যর্থনা করে নিয়ে গেলেন বসবার ঘরে।
সেদিন রাতে আমি উষ্ণিকদের বাড়িতেই থেকে গেলাম। অসম্ভব নির্জন সেই বাড়ি। গ্রামের প্রান্তে, নদীর ধারে। নদীর ওপাশে জঙ্গল। বাড়ির ছাদ থেকে পাহাড় দেখা যায়। কোনও কোনও বছরে সেই পাহাড়ের গায়ে বরফ জমে। এই পরিবেশেই বড় হয়েছে উষ্ণিক। সে যে সবার চেয়ে অন্যরকম হবে, তাতে আর আশ্চর্যের কী!
উষ্ণিকের ঘরেই আমার শোওয়ার বন্দোবস্ত হয়েছিল। ওর মা আমাকে উষ্ণিকের নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার আগে লেখা শেষ চিঠিটা পড়তে দিয়েছিলেন। সেটা পড়তে পড়তেই মাঝরাত হয়ে গেছিল। সেদিন রাতে আর ঘুম এলো না। ভেতরে ভেতরে অসম্ভব অস্থির লাগছিল। উষ্ণিকের চিঠির মধ্যে আসলে একটা গল্প ছিল। সেই গল্পটাই আমি কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না। সেই নির্জনতায় আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম উষ্ণিকের গলার স্বর। সে যেন আমার কানে নিজের ঠোঁট আলতো ছুঁইয়ে ফিসফিস করে গল্পটা বলে যাচ্ছিল…
‘না, দেবীর মুখটা কেমন হবে তা নিয়ে বড়ই সমস্যায় পড়েছি আমি। আমার সমস্ত মনে ছড়িয়ে আছে একটিই মুখ। সেই মুখটিকে আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না। লোকদেবীর মুখটি ভাবতে গিয়ে সেই মুখটিই বারবার ভেসে উঠছে। কিন্তু ব্যাপারটা কতোটা মানানসই হবে, তা নিয়ে আমার নিজের মনেই সন্দেহ আছে! লোকদেবীর ঘাড়ে উপলব্ধির মুখ বসাতে কিছুতেই আমার মন সায় দিচ্ছে না। লোকদেবীর মুখ অত সুন্দর হতে পারে না। দুনিয়ায় কারও মুখই অত সুন্দর হতে পারে না। কিন্তু উপলব্ধির মুখ ছাড়া অন্য কোনও মুখ বানানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিছুতেই নয়। সেটা আত্ম-প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই হবে না!
হ্যাঁ, ঘটনাটা তাহলে খুলেই বলা যাক। ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষার পর আমরা গ্রামের তিন বন্ধু মিলে একটা মফঃস্বল শহরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তিন বন্ধু মানে আমি, অতলান্ত আর সমিধ। ওই শহরেই ছিল অতলান্তের কাকার বাড়ি। সেখানেই আমরা উঠেছিলাম। সমিধ আগেও এখানে এসেছে। আমার যাওয়া সেই প্রথম।
আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে যে নদীটি বয়ে গেছে, এই শহরের পাশ দিয়েও সেই নদীটিই বয়ে গেছে। কিন্তু এখানে নদীটি আরও চওড়া আর স্রোত অনেক কম। এই ধরনের মফঃস্বল শহরে সবাই সবার মুখ চেনে। কে কোথায় কী করে বেড়াচ্ছে, বিদ্যুতের বেগে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় খবর পৌঁছে যায়। তারপর তা নিয়ে নানা গুজব ও জল্পনা শুরু হয়ে যায়। এখানে শহরের এক প্রান্তে বসে কেউ হাঁচি মারলেও তেমন জোর থাকলে শহরের অন্য প্রান্তে বসে অন্য কেউ সেই আওয়াজ শুনতে পায়। যেন একটা অদৃশ্য ক্যামেরা গোটা শহরের দিকে তাক করা রয়েছে। এই ধরনের শহরে খুব সতর্কভাবে চলাফেরা করতে হয়।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, সতর্কতা আমার স্বভাবে নেই। আর কেউ আমাকে এসব কথা আগে থেকে বলেও দেয়নি। দিলেও অবশ্য তেমন লাভ হতো না।
সেদিন ছিল ফুলের উৎসব। ওই উৎসব দেখব বলেই আমরা গিয়েছিলাম। বিবাহিত মেয়েরা সেদিন ফুল দিয়ে নিজেদের সাজায়। তারপর সন্ধ্যার সময় নদীর ঘাটে গিয়ে সবাই জড়ো হয়। আর যে যার প্রিয় ফুলের মধ্যে মনের ইচ্ছা ভরে দিয়ে রঙিন কাগজের ছোটো ছোটো নৌকোয় সেগুলি নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়। ফুল ছাড়াও সেই কাগজের নৌকোগুলিতে থাকে ছোটো ছোটো প্রদীপ। সেই প্রদীপের আলোয় মনে হয় ফুলগুলি যেন আগুনের শিখার মতোই জ্বলছে।
উপলব্ধি ও তার চার বন্ধুও এসেছিল সেদিন। অতলান্তের ছোটবেলার বন্ধু সে। এই শহরেই কাকার বাড়িতে থেকে মানুষ হয়েছে অতলান্ত। তাকে দেখে ওরা সবাই এগিয়ে এসেছিল। আর সেই মুহূর্তেই আমাদের পরিচয় হয়েছিল। হাসিঠাট্টায় কেটে গিয়েছিল বেশ কিছুক্ষণ। তারপর ওরা চলে গেছিল ফুল আর প্রদীপ ভাসাতে।
নদীর ধারে পরপর বেশ কয়েকটি ঘাট। যে ঘাটটি সবচেয়ে অন্ধকার, তার সিঁড়ির একটি ধাপে গিয়ে আমরা তিনজন বসলাম।
সমিধ হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করল, উপলব্ধির পাশে তোকে আজ বেশ দেখাচ্ছিল!
অতলান্ত হেসে উঠল জোরে। তারপর বলল, হ্যাঁ, তোদের বেশ মানিয়েছে।
ওদের কথায় চমকে উঠলাম আমি। ওই পাঁচটি মেয়ের মধ্যে উপলব্ধিকে নিশ্চয়ই আলাদা করে চেনা যায়। ওর সৌন্দর্য একটু বিশেষ ধরনের। ঠিক মাটি-পৃথিবীর মনে হয় না। সন্ধ্যার আবছায়ায় প্রদীপের আলো ওর মুখে পড়ে যেন বিচ্ছুরণ হচ্ছিলো। অসম্ভব স্নিগ্ধ সেই সৌন্দর্য। আর সেইরকম মায়াবী। স্বভাবটাও তার খুব নম্র ও সংযত।
তাছাড়া কেন জানি উপলব্ধিকে দেখেই আমার মনে হয়েছিল, এই মুখ আমার খুব চেনা। বহুদিন স্বপ্নে দেখেছি। কোনও গান বা কবিতা শুনতে শুনতে, কোনও প্রদর্শনীতে ছবি দেখতে গিয়ে হঠাৎ এই মুখটির কথাই আমার মনে পড়ে গেছে। কিন্তু আগে কখনও এত কাছ থেকে দেখিনি! উপলব্ধিকে দেখেই তাই আমার ভেতরে একটা রোমাঞ্চ হয়েছিল। কিন্তু ভাবনাটাকে বিশেষ আমল দিলাম না।
উপলব্ধি নিশ্চয়ই আমার মনে দাগ কেটে গিয়েছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। খুবই ক্ষীণ সেই দাগ। আমি তখন মজে ছিলাম প্রকৃতির সৌন্দর্যে। কোনও নারীর সৌন্দর্যের দিকে মনোযোগ দেওয়ার অবস্থায় ছিলাম না। নদীর ওপারে জঙ্গল, ঠিক আমাদের গ্রামটির মতো, নদীর বুকে ভেসে যাওয়া শত শত ফুল আর আগুনের ভেলা, জঙ্গলের পিছনে একটু একটু করে আবছা হয়ে আসা পাহাড়, পাহাড়ের দিক থেকে ভেসে আসা শীতল বাতাস, পরিষ্কার-স্বচ্ছ নীল আকাশ, সেই আকাশে ভেসে বেড়ানো খণ্ড খণ্ড সাদা মেঘ, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অগণিত আলোকিত বিন্দু বিন্দু নক্ষত্র, এসবের মধ্যে এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে সম্পূর্ণ আপ্লুত হয়ে বসেছিলাম আমি।
হঠাৎ উপলব্ধির কথা তুলে ওরা আমাকে অবাক হয়ে দিয়েছিল। আমি চুপ করে গেছিলাম। কিন্তু ভেতরে কেমন একটা অস্থিরতা জেগে উঠল। উপলব্ধিকে দেখার জন্য কেমন যেন ব্যাকুল হয়ে উঠল মন। আমার ঔদাসিন্য কেন জানি ওরা গ্রাহ্যের মধ্যেই আনলো না। নিজেদের মধ্যে কথা বলে চলল, মাঝেমাঝে জোরে জোরেও হেসে উঠছিল। আর আমি ঠিক সেটাই চাইছিলাম। আমি ওদের পাশে বসেছিলাম ঠিকই। কিন্তু একা হতেও চাইছিলাম। নিজের ভেতর নিজে ডুবে থাকতে চাইছিলাম।
একটু পরে আমি ওদের পাশ থেকে উঠে গেলাম। ওরা টেরও পেল না। তারপর কিছুটা অন্যমনস্কভাবেই নদীর ধার দিয়ে হেঁটে চললাম। আর ঠিক তখনই কে যেন বলে উঠল, আপনি এখানে?
আমি মাথা নিচু করে হাঁটছিলাম। মুখ তুলে দেখলাম, উপলব্ধি। একাই। ফুলে ফুলে ঢাকা। সারা শরীর থেকে সুগন্ধ নির্গত হচ্ছে। আর সেই সুগন্ধে ভারি ও মোহময় হয়ে উঠেছে চারপাশের বাতাস। হাতের নৌকোটি অবশ্য নেই। ফুল আর প্রদীপ একটু আগেই সে ভাসিয়ে দিয়ে এসেছে।
বললাম, হ্যাঁ, একটু হাঁটতে বেরিয়েছি। বসে থাকতে আর ভালো লাগছিল না। আমার সঙ্গে একটু হাঁটবেন নাকি?
উপলব্ধি রাজি হয়ে গেল। ওকে একটু নার্ভাস দেখাচ্ছিল। শীত আসবে আসবে করছে। একটু জোর বাতাসেই ও কেমন যেন কেঁপে কেঁপে উঠছিল। হঠাৎ যেন প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্যই ও বলে উঠল, আপনার অন্য কোনও পাঞ্জাবি নেই?
পোশাক-আশাক নিয়ে আমি চিরকালই উদাসীন। মাথা নেড়ে বললাম, না।
ও বলল, এই পাঞ্জাবিটা বদলান। আপনাকে একটুও মানায়নি।
আমি সরলভাবেই বললাম, কিন্তু আমি তো আর কোনও পাঞ্জাবি আনিনি।
তাতে কী? আপনার বন্ধুদের তো আছে!
হ্যাঁ, তা আছে। আমি সায় দিলাম।
এখন ওকে বেশ স্মার্ট দেখাচ্ছিল।
আমি বললাম, হঠাৎ পাঞ্জাবির কথা মনে হলো কেন?
উপলব্ধি বললো, আমার বন্ধুরা নানারকম কথা বলছিল। আমার একদমই ভালো লাগছিল না। ওদের কী অধিকার আছে ওসব বলার? আপনি অতলান্তের বন্ধু। তাই আমারও বন্ধু। আমি মনে করি, আপনাকে কিছু বলার অধিকার আমার আছে। কিন্তু ওদের নেই। তাই মনে হলো…
আমি অবাক হয়ে উপলব্ধির কথা শুনছিলাম।
সে বলে চলল, তাছাড়া আপনি পুরো সময়টা অমন মাথা নিচু করে ছিলেন কেন? ওরা আপনাকে দেখছিল। আর আপনি নিচের ঘাস-মাটি দেখছিলেন। সামনের দিকে তাকাবেন তো! কথা বলবেন তো! আপনি কথা বলছিলেন না কেন? না, না, ওরকম করবেন না, এসব অবশ্য আমার দেখার কথা নয়, বলারও নয়, তবু…
ওর কথার মধ্যে বৈপরীত্য দেখে আমার বেশ মজা লাগছিল। ও যেন নিজেই ঠিক করে উঠতে পারছিল না, ওর অধিকার আছে কি নেই। থাকলেও সেটা কতটুকু।
আমি এবারও ওর কথায় সায় দিতে যাচ্ছিলাম। বলতে যাচ্ছিলাম, নিজেকে এবার আমি পাল্টে ফেলবো। ও ঠিক যেমনভাবে বলবে, তেমনভাবেই চলবো। কিন্তু মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, আপনি খুব সুন্দর…
কেন যে ওই কথাটা বলে ফেললাম, নিজেই জানি না। আমার জিভ তখন আমার নিয়ন্ত্রণে ছিল না। কথাটা নিশ্চয়ই ও শুনতে পেয়েছে। ওর মুখে কেমন একটা অন্যমনস্কতার ভাব ফুটে উঠল। যেন কিছুই শুনতে পায়নি, এমনভাবে নদীর দিকে তাকালো। আর আমিও এমন ভাব করলাম, যেন কিছুই বলিনি।
ঠিক তখনই অতলান্ত আর সমিধকে দেখতে পেলাম। ঘাট থেকে উঠে এসে ওরা আমাদের দিকেই আসছিল। আমাদের একসঙ্গে দেখে ওদের নিজেদের মধ্যে ইশারাপূর্ণ হাসি বিনিময় করল। উপলব্ধিও যেন হঠাৎ ফিরে যাওয়ার তাড়া অনুভব করল। অতলান্তকে দু-একটা মামুলি কথা বলে সে নিজের বন্ধুদের খুঁজতে চলে গেল।
ফেরার পথে অতলান্ত বলল, উপলব্ধি তোকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে!
সমিধ সায় দিয়ে বলল, হ্যাঁ, ও তোকে খুব ভালোবাসে।
ওরা কেন ওভাবে বলল, আমি কিছুই বুঝলাম না। ওরা ঠিক কী বোঝাতে চাইল, সেটাও আমার বোধগম্য হলো না। আমি তাই চুপ করেই রইলাম। কিন্তু ‘ভালোবাসা’ শব্দটা আমার কানে খুব মধুর শোনালো। সেই মুহূর্ত থেকেই আমিও বোধহয় উপলব্ধিকে ভালোবেসে ফেললাম।
তিনদিন ধরে উৎসব চলবে। আর তারপরই আমরা ফিরে যাবো।
পরদিন ভোরবেলায় আমরা তিন বন্ধু নদীর ধারে এসে পৌঁছলাম। আর তারপরই উঠে বসলাম স্পিড বোটে। আমরা যাবো, কয়েক মাইল দূরে একটি বৌদ্ধ মঠে। নদীর ধারেই সেই মঠ। তার শান্ত, নির্জন, সৌন্দর্যময় পরিবেশ পর্যটকদের কয়েকশো বছর ধরে সম্মোহন করে চলেছে।
শান্ত হয়ে স্পিড বোটের একটা কোণে গিয়ে বসেছি, হঠাৎ পেছন থেকে হইচইয়ের আওয়াজ পেলাম। তাকিয়ে দেখি, আরেকটা স্পিড বোট। সেই বোটে উপলব্ধি ও তার চার বন্ধু। ওরাও চলেছে সেই বৌদ্ধ মঠ দেখতে।
হঠাৎ উপলব্ধির পাশ থেকে একটি মেয়ে, গতকালই জেনেছি তার নাম চৈতালি, চেঁচিয়ে উঠল, তোরা পারবি না, আমরাই জিতবো।
সকাল সকালই এরকম একটা প্রতিযোগিতার পরিবেশ গড়ে উঠবে ভাবতেই পারিনি। আমার কোনও তাপ-উত্তাপ না হলেও সমিধ চেঁচিয়ে উঠলো, ঠিক আছে, দেখাই যাক।
দুটো স্পিড বোট পাশাপাশি চলতে শুরু করল। দু’দিক থেকেই নানা উত্তেজক মন্তব্য ভেসে আসছিল। কিন্তু পাঁচ-সাত মিনিট পরেই আমরা এগোতে শুরু করলাম। আর উপলব্ধিদের স্পিড বোট পিছোতে পিছোতে হঠাৎ একসময় থেমে গেল। বুঝতে পারলাম, কিছু একটা যান্ত্রিক গোলোযোগ ঘটেছে।
আমরা এগিয়ে চলেছি, উপলব্ধিদের বোটটা আর দেখা যাচ্ছে না! দূরে ছোটো হতে হতে বিন্দু হয়ে মিলিয়ে গেছে। আরও একটু এগোনোর পর আমরা দেখলাম, একটা শাখানদী পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। অতলান্ত সেই দিকে তাকিয়ে বলল, এই খালটা দিয়ে বেশ কিছুটা গেলে আমার এক বন্ধুর বাড়ি। সায়ন। চমৎকার ছেলে সে। আর কতদিন তাকে দেখিনি!
হঠাৎ আমি নড়েচড়ে বসলাম। কেমন যেন একটা ঝিমুনি ভাব এসেছিল আমার। নিমেষের মধ্যে সেই ভাবটা কেটে গেল। মনের মধ্যে একটা মধুর শব্দ কেবলই গুঞ্জন করে চলেছে। ‘ভালোবাসা’। এর চেয়ে মধুর শব্দ কি দুনিয়ায় হয়?
আমি অতলান্তের দিকে তাকিয়ে বললাম, তোর সেই বন্ধুটিকে সঙ্গে নিলে কেমন হয়? অতলান্তকে খুব উৎসাহী দেখাল। সে বলল, খুবই ভালো হয় তাহলে। সায়নকে নিশ্চয়ই এখন বাড়িতে পাবো।
সমিধ বলল, কিন্তু তাতে অনেকটাই দেরি হয়ে যাবে না কি?
আমি বললাম, হলেই বা! ওদের বোটটাই তো খারাপ হয়ে গিয়েছে। অন্য কোনও বোটে এতক্ষণে ওরা হয়তো ফিরেও গেছে।
আর যদি উল্টোটা হয়? সমিধ কিছুটা নারাজের মতোই বলল, হয়তো ওদের বোটটা এতক্ষণে ঠিক হয়ে গেছে। আর ওরা অনেকটা এগিয়েও এসেছে?
অতলান্ত একটু বিরক্ত হয়ে বলল, তোর মাথায় শুধু প্রতিযোগিতা! বন্ধুত্বের চেয়েও কি প্রতিযোগিতা বেশি বড় হতে পারে?
সমিধ দেখলো, ব্যাপারটা অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। তাকে রাজি হতেই হলো। আমাদের স্পিড বোটটা সেই শাখানদীর মধ্যে ঢুকে গেল।
অনেকটা দূর থেকেই টিলার ওপরে সেই অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত বৌদ্ধ মঠটি দেখা যাচ্ছিল। কাছে যেতেই ঘাটের গায়ে উপলব্ধিদের ফাঁকা স্পিড বোটটা চোখে পড়ল। অনেক আগেই ওরা পৌঁছে গেছে। উত্তেজনায় আমি হাঁপাচ্ছিলাম। লাফ দিয়ে স্পিড বোট থেকে নেমে মঠের দিকে ছুটে গেলাম। মার্বেল পাথরের সিঁড়ি দিয়ে উপলব্ধি নেমে আসছিল।
আমাকে দেখে খুব শান্তভাবে জানতে চাইল, আপনারা কোথায় ছিলেন?
আমি সবিস্তারে গোটা ঘটনাটা বললাম। উপলব্ধি শান্ত হয়ে পুরোটাই শুনলো। তারপর ছোট্ট একটা শ্বাস ছেড়ে বলল, তাহলে এই ব্যাপার!
আমি খেয়াল করিনি কখন পিছনে অতলান্ত আর সমিধ এসে দাঁড়িয়েছে। ওদের দেখেই উপলব্ধির দিকে তাকিয়ে আমি বললাম, তাহলে বুঝতেই পারছেন, একেই বলে বন্ধুত্বের মাহাত্ম্য।
সমিধ মুচকি হেসে বলে উঠল, বন্ধুত্ব?
অতলান্ত হঠাৎ খুব জোরে হেসে উঠল। তারপর বলল, বন্ধুত্ব নয়, ভালোবাসা! বলেই সায়নের মুঠোর মধ্যে নিজের হাত গলিয়ে দিল। আর জোরে জোরে চেঁচিয়ে উঠলো, তোকে আমি খুব ভালোবাসি রে, সায়ন!
বৌদ্ধ মঠটিকে ঘিরে আছে চমৎকার একটি পার্ক! সবাই যে যার মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। আমিও নিজের মতো ঘুরছিলাম। অন্যমনস্কভাবেই। হঠাৎ দেখতে পেলাম, একটা বড় গাছের নিচে উপলব্ধির চার বন্ধু গোল হয়ে বসে আছে। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। ওদের নাম আমি জেনে গেছিলাম। অহনা, চৈতালি, নবনীতা আর সুলগ্না। ওরা আমাকে দেখতে পায়নি। আমি একটা ঝোপের আড়ালে ছিলাম। যদিও ওদের কথাবার্তা স্পষ্টই আমার কানে ভেসে আসছিল।
চৈতালি বেশ ঝাঁঝিয়েই বলল, ওই যে নতুন ছেলেটি, কী যেন নাম, অতলান্তের নতুন আমদানি…
সুলগ্না একটু বাঁকা সুরে বলল, উষ্ণিক…
চৈতালি বলল, হ্যাঁ, সে-ই, সারাক্ষণ উপলব্ধির পিছনে ঘুরঘুর করছে, চোখ দিয়ে যেন গিলে খাচ্ছে, অসহ্য ছেলে একটা, কোনও আত্মসম্মানবোধ নেই, মেয়েদেরও সম্মান দিতে জানে না…
অহনা একটু শ্লেষের স্বরে বলল, তুই এতো রেগে রয়েছিস কেন? ছেলেটা আসলে একটা বোকা, আস্ত হাঁদারাম কোথাকার, আর একটু ভাবুক প্রকৃতির, এদের গ্রাহ্যের মধ্যেই আনতে নেই…
এবার কথা বলল নবনীতা, মুখে ঔদাসিন্যের ভাব ফুটিয়ে সে বলল, আমি অহনার সঙ্গে একমত। এদের মোটেই গ্রাহ্য করতে নেই। বেশি পাত্তা পেলে এইসব ছেলে মাথায় ওঠে। আর তাছাড়া… একটু থেমে সে যোগ করল, মেয়েদের অমন অনেক কিছু সহ্য করতে হয়। সবকিছু আমল দিলে চলে না। আমি তো ওর সঙ্গে কথাই বলি না। ওকে দেখলেই মুখটা সাদা পৃষ্ঠার মতো করে নিই। এইসব ছেলেকে দেখে কখনও রাগ বা বিরক্তি প্রকাশ করতে নেই। সবসময় এমন ভাব করে থাকতে হয়, যেন ওর কোনও অস্তিত্বই নেই! দেখিস না, ও সামনে পড়ে গেলে আমি কেমন একটা ‘ভ্যাকেন্ট লুক’ দিই? তখনই ও সবচেয়ে অস্বস্তিতে পড়ে যায়। আমার সামনে থেকে যেন পালাতে পারলে বাঁচে।
কথাটা শেষ করে একটা সংযত হাসি ফুটিয়ে তোলে সে। আর তারপরই সেই হাসি মুছে গিয়ে ফুটে ওঠে একটা উন্নাসিকতার ভাব। এটা ওর বৈশিষ্ট্য। মুখ থেকে এই ভাবটা কখনই ও মুছে ফেলতে পারে না। একজন সবজান্তার মতো দুনিয়ার সমস্ত সমস্যার কথা ও জানে এবং তাই নিয়ে খুব চিন্তিত থাকে। অথচ ফুৎকারে সেসব সমাধানের উপায়ও ওর জানা আছে, এমনই একটা নিশ্চিন্ত ও আলগা ভাব।
অহনা যেন লুফে নিল নবনীতার শেষটা। শ্লেষ ছাড়া যেন সে কথা বলতেই পারে না। সে বলে ওঠে, আমি অবশ্য ওর সঙ্গে কিছুটা যেচে যেচেই কথা বলি। নানাভাবে ওকে বাজিয়ে দেখি। খোঁচা দিতে থাকি। ওর ভেতরের আগুনটাকে উসকে দিয়ে যাই। তারপর ও যখন বাধ্য হয় সাড়া দিতে, তখন ওকে দেখে আমার প্রচণ্ড হাসি পায়। নিছকই একটা করুণার পাত্র। ওকে নিয়ে স্রেফ উপহাস করা যায়। ঠাট্টা-তামাসা করা যায়। এর বেশি কিছুরই ও যোগ্য নয়। একদম ওয়র্থলেস। ননসেন্স। ফুলিশ।
একটু থেমে সে যোগ করে, আমি অবশ্য উপলব্ধিকেও ঠিক বুঝতে পারি না। আমার মনে হয়, ছেলেটিকে নিয়ে স্রেফ ও খেলা করছে। মাঝেমাঝে মেয়েদের এরকম বোকা ছেলেদের লাগে। ওদের বোকামিতে মেয়েরা বেশ মজা পায়। বিশেষ করে, সুন্দরী মেয়েরা। এটা ওদের প্রকৃতির মধ্যেই মিশে আছে। আমি অবশ্য ওকে বেশ কয়েকবার সাবধান করে দিয়েছি…
অহনার ভেতরে কেমন একটা নিরাপত্তাবোধের অভাব আছে। সে যেন সবসময়ই আলগা মাটির ওপর দিয়ে হাঁটছে। আর তাই অনায়াসে সে অন্যকে ছোট করতে পারে। এতে বোধহয় ওর নিরাপত্তাবোধ একটু জোরদার হয়। তাছাড়া এই অভাব থেকেই সবসময় ও অন্যকে সন্দেহ করে। কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। ওর মধ্যে খাঁটি অনুভূতি বলে কিছু নেই। সবসময় নানা সম্ভাবনার মধ্যে থাকতেই সে স্বস্তি বোধ করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওর মধ্যে একটা স্নেহপ্রবণ মন রয়েছে। উপলব্ধিকে তাই সাবধান করতেও সে ভোলেনি…
এবার কথা বলে ওঠে সুলগ্না। এই মেয়েটির মধ্যে কেমন যেন একটা ছাড়া ছাড়া ভাব। ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ গোছের মানসিকতা। স্রেফ মজা লুটতেই যেন সে এদের সঙ্গে এসে জুটেছে। সে বলে ওঠে, একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিস চৈতালি? উপলব্ধি বিবাহিত। ওর স্বামী মোটা মাইনে পায়। ওদের দু’জনের সুখের সংসার। দু’জনে প্রায়ই একসঙ্গে শপিং বা আউটিং-এ যায়। এরকম একটা মেয়ের জীবনে হঠাৎ এরকম একটা উটকো ঝামেলা এসে পড়লে, সেটা তার পক্ষে কতটা অস্বস্তির কারণ হয়?
আমি বুঝতে পারলাম, চৈতালিকে উসকে দিতেই কথাটা ও বলল। এই মেয়েটি একটু মাথা-গরম প্রকৃতির। নম্র, মার্জিতভাবে কথা বলতেই জানে না। নিজের রাগ ও বিরক্তিকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে ফেলে। কথায় কথায় ঝাঁঝিয়ে ওঠে। এবারও ঝাঁঝিয়ে উঠে সে বলে, আমি হলে তো স্রেফ একটা চড় কষিয়ে দিতাম। একটা বাউণ্ডুলে, চালচুলোহীন ছেলে। সারাক্ষণ ছ্যাবলামি করে বেরাচ্ছে। চক্ষুলজ্জা বলেও কিছু নেই। বুদ্ধিশুদ্ধিতেও একদম লবডঙ্কা। গোটা দুনিয়া ওকে হাঁ করে দেখছে। আর ওর নিজের কোনও বোধভাষ্যিই নেই! একটা বিবাহিত মেয়েকে দেখে মোমের মতো গলে গলে যাচ্ছে…
নবনীতা আবারও কথা বলার সুযোগ পেয়ে যায়। সে বলে ওঠে, আমি তো গত কয়েক ঘন্টা ধরেই লক্ষ্য করে যাচ্ছি। ও নিজের থেকেই গিয়ে যেচে যেচে কথা বলতে চাইছে। উপলব্ধি যত ওকে এড়াতে চাইছে, ততো ও উপলব্ধির ঘাড়ে গিয়ে পড়ছে। উপলব্ধি নিজে থেকে ওর সঙ্গে ক’টা কথা বলেছে বল দেখি? নিজের আত্মসম্মানবোধ নিয়ে দিব্যি আছে। আর ও ভাঁড়ের মতো ওর ওপর হামলে পড়ে স্রেফ ওর মন যুগিয়ে চলেছে, আমোদ বিলিয়ে চলেছে, আর উপলব্ধি সামান্য একটু হেসে উঠলে বা সাড়া দিলেই, ওই যে বললি, মোমের মতো গলে গলে… জোরে হেসে উঠল সে।
অহনা এবার বলে উঠল, আসলে ছেলেটা একদমই চতুর নয়। নিজেকে লুকোতে জানে না। ওর আচরণগুলোর অর্থ সবাই বুঝছে। দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট সেগুলো। তাই বলে, ও কিন্তু সরলও নয়। না, ওকে মোটেই সরল বলা যায় না! মেয়েদের ব্যাপারে ও বেশ হুঁশিয়ার। আর সূক্ষ্মভাবে মিশতেও জানে। ও কী চায়, আমরা কি তা বুঝি না? ও নিজেও তো বোঝাতে ছাড়ছে না। বেশ দক্ষতার সঙ্গেই সব করছে। কিন্তু, এসব ক্ষেত্রে যেমন হয়, ব্যাপারগুলো ঘটছে একটু অন্যভাবে। নিজেকে ও লুকোতে পারছে না। না কি চাইছে না? ওর মধ্যে কোনও গোপনীয়তাই নেই! সবই কেমন জানি বড় বেশি প্রকাশ্য, স্পষ্ট, আর সেই কারণেই এত বেশি সন্দেহজনক…
ওদের কথা শুনতে শুনতে আমি একটু অবাকই হলাম। মাত্র দু’ঘন্টা কয়েক মিনিট। ওরা বেশ মন দিয়েই লক্ষ্য করেছে আমাকে। নিজেকে নিয়ে আগে কখনও আমার এত ভাবনা হয়নি!
হঠাৎ টের পেলাম, আমার ঘাড়ে কে হাত রেখেছে। পিছন ফিরে দেখি, অতলান্ত আর সমিধ।
মৃদু হেসে অতলান্ত বলল, ঈর্ষা।
মানে? আমি অবাক হয়েই জানতে চাইলাম।
সব মেয়েই আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে চায় বন্ধু। আর তুই যে একজনকেই বেছে নিয়েছিস। ও মিশে ছিল সবার মধ্যে। তুই ওকে আলাদা করে দিয়েছিস। ওরা তোকে ছাড়বে কেন?
ও আলাদাই ছিল। আমি মৃদুস্বরে বললাম।
তোর মতো করে কেউ শনাক্ত করেনি যে! অতলান্ত বলে উঠল।
এবার সমিধ কেশে উঠল। তারপর নাটুকে ভঙ্গিতে বলল, রবীন্দ্রনাথের ‘চতুরঙ্গ’! শচীশকে তোর মনে পড়ে না? সেই যে গোড়াতেই শ্রীবিলাস লিখেছে, ‘আসল কথা, যাহারা দশের মতো, বিনা কারণে দশের সঙ্গে তাহাদের বিরোধ বাধে না। কিন্তু মানুষের ভিতরকার দীপ্যমান সত্যপুরুষটি স্থূলতা ভেদ করিয়া যখন দেখা দেয় তখন অকারণে কেহ-বা তাহাকে প্রাণপণে পূজা করে, আবার অকারণে কেহ-বা তাহাকে প্রাণপণে অপমান করিয়া থাকে।’ তুই পুজো করার লোক দু-একজনকে দেখেছিস। কিন্তু ঢের দেখেছিস অপমান করার লোক। তোর তো অবাক হওয়ার কথা নয়!
ফিরে যাওয়ার সময় একটা ঘটনা ঘটলো। উপলব্ধিদের স্পিড বোটে আবার যান্ত্রিক গোলোযোগ দেখা দিলো। একটা স্পিড বোটেই সবাই ঠাসাঠাসি করে উঠতে গেল। কিন্তু একজনের জায়গা হবে না।
আমি বললাম, আমার ফেরার কোনও তাড়া নেই। আমি থেকে যাচ্ছি। তোরা পৌঁছে আমার জন্য একটা কিছু পাঠিয়ে দিস। আর ঘন্টাখানেক পরেই এই মঠের লাইব্রেরিটা খুলে যাবে। আমার সময় কাটাতে অসুবিধে হবে না।
ওরা সবাই চলে গেল। প্রায় আধ ঘন্টা পরে একটা এস এম এস এলো। উপলব্ধি লিখেছে, আমি একটা ফাঁকা স্পিড বোট পেয়েছি। সেটা নিয়েই আসছি। আপনি কোথায়?
উপলব্ধির সঙ্গে যখন দেখা হলো, তখন সে রীতিমতো উত্তেজিত।
আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনি? একা?
সে বলল, আমার ক্যামেরাটা ফেলে গেছি। তাই আমাকেই আসতে হলো…
দু’জনে একসঙ্গে ফিরে এলাম। পাশাপাশি বসে। কেন জানি মনে হচ্ছিলো, উপলব্ধি ইচ্ছা করেই ক্যামেরাটা ফেলে গেছিল! ও আমাকে একা পেতে চাইছিল। মেয়েরা অনেক সময় এরকম বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তখন অদ্ভুত অদ্ভুত সব পরিকল্পনা খেলে যায় ওদের মাথায়। ছেলেরা সে-সব কিছু আগে থেকে টেরই পায় না!
শহরে ফিরে উপলব্ধিকে বললাম, আজ রাতের দিকে, এই ন’টা নাগাদ, একবার ঘাটে আসবেন। আপনাকে একটা জিনিস দেখানোর আছে…
কিন্তু সেদিন রাতে উপলব্ধি এলো না। বুঝতে পারলাম, ওইভাবে আমার সঙ্গে আসার জন্য বন্ধুদের কাছে ওকে যথেষ্ট ভৎর্সনা শুনতে হয়েছে।
সেদিন রাতে আমি একটি কবিতা লিখে ফেললাম। কবিতাটি এইরকম:
কতদিন পরে দেখা, মনে হয় গতকাল ছিল
তোমাকে দেখেছি শেষ, সময় নিমেষে মুছে গেছে
তুমি ঠিক এরকমই, প্রাণবন্ত, সুন্দর, সজীব
আয়ুর বিস্তার তুমি, বাতিদানে একা উষ্ণ শিখা
তোমার চাহনি দেখে সময় খেলনা হয়ে যায়
তোমার হাসির কাছে পুতুলের মতো সব লাগে
মনে হয়, একা তুমি বেঁচে আছো, জাগিয়ে রেখেছো
যা কিছু মৃতের মতো ঘুমিয়ে রয়েছে চারপাশে
মনে হয় শব্দগুলো তোমার ঠোঁটের কাছে এসে
একমাত্র অর্থ পায়, তুচ্ছতাকে অতিক্রম করে
কখনও তোমাকে ঠিক গাছের মতোই মনে হয়
যেখানে দাঁড়ালে ছায়া, নিবিড় আশ্রয় ঠিক মেলে
তুমি যদি রাগ করো, তখনও সুন্দর লাগে খুব
তুমি এতো খাঁটি, তাই তুচ্ছ লাগে অধিকারবোধ
মনে হয় তুমি শুধু তোমার মতোই হয়ে থাকো
এ দুনিয়া তাহলেই ভরে যাবে আলোয়, বাতাসে…
পরদিন ছিল উৎসবের শেষ দিন। ভোরবেলা আমাকে দেখেই উপলব্ধি এগিয়ে এলো। তারপর সবার সামনেই বলে উঠল, কালকের জন্য ক্ষমা চাইছি, আমি সত্যিই দুঃখিত, প্লিজ…
আমি ওর এই ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গি দেখে একদম আশ্চর্য হয়ে গেলাম।
সবার সামনেই ও আবার জানতে চাইল, কিন্তু আমাকে আপনি ডেকেছিলেন কেন? বুঝতে পারলাম, সবার সামনে ও আমাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চাইছে। আমিও সত্যি কথাই বললাম। ব্যাপারটা গুরুতর কিছু নয়। পাহাড়ের গায়ে রোজ রাতে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। নিশ্চয়ই ওখানে কেউ থাকে। সেই আগুন দেখিয়ে এই কথাটাই আমি জিগ্যেস করতে চেয়েছিলাম।
সেদিন অতলান্ত আর সমিধকে একটু অন্যরকম লাগছিল। এক রাতের মধ্যেই ওরা কেমন জানি বদলে গেছে। আমাকে একটু এড়িয়ে এড়িয়েই চলছিল। হঠাৎ উপলব্ধির হাত ধরে টান মেরে অতলান্ত ওকে নিজেদের বোটে টেনে নিয়েছিল। ওই বোটে আর জায়গা ছিল না। অতলান্ত আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিল কয়েকটি শব্দ, পরের বোটে আসিস। আমরা তোর জন্য অপেক্ষা করবো।
উপলব্ধির চার বন্ধু আজ আর আসেনি। ওরা যে যার মতো ঘরে ফেরায় ব্যস্ত। বছরের এই তিনটি উৎসবের দিন ওদের দেখা হয় নিজেদের বাপের বাড়ি এসে।
আমি পরের বোটে উঠে বসলাম। সেদিন আমাদের বহু প্রাচীন একটি গির্জা দেখতে যাওয়ার কথা। এবারের যাত্রা গতকালের ঠিক উল্টো দিকে। অতলান্তের ব্যবহার আমাকে আহত করেছিল। কিন্তু হাসিও পাচ্ছিলো খুব। হয়তো হঠাৎ ওর মনে পড়ে গেছে, উপলব্ধির বর ওর ছোটবেলার বন্ধু। হয়তো সমিধই ওকে বলেছে, সব মিলিয়ে একটু বাড়াবাড়িই হয়ে যাচ্ছে। এবার একটু রাশ টেনে ধরা দরকার। ওরা কী ভেবেছে, আমি কিছুই বুঝতে পারবো না? নাকি আমার বোঝা না-বোঝায় ওদের কিছু যায় আসে না?
বোটের এক কোণে আমি জায়গা করে নিয়েছিলাম। উপলব্ধিদের বোট অনেক আগেই মিলিয়ে গেছে। আমি পকেট থেকে ছোট্ট একটা ডায়েরি বার করলাম। গতকাল সারা রাত প্রায় ঘুমোইনি বললেই চলে। গি দ্য মোপাসাঁ’র ছোটগল্প পড়ে কাটিয়ে দিয়েছি। অসামান্য সম্মোহন সেইসব গল্পে। আর কী অন্তর্ভেদী দৃষ্টি! মানুষের আত্মার একেবারে আনাচে-কানাচে দেখতে পান মোপাসাঁ। জীবন নিয়ে আশ্চর্য গভীর সব উপলব্ধির কথা বলেন!
গতকালই মোপাসাঁর লেখা থেকে কয়েকটা জায়গা আমি নোট করেছিলাম। সেইসব জায়গাগুলোই নতুন করে আবার পড়ছিলাম। যতোবার পড়ছিলাম, ততোবারই মনে হচ্ছিলো আবার পড়ি। মাঝেমাঝে ডায়েরি থেকে মুখ তুলে নদীর স্বচ্ছ জলের দিকে তাকাচ্ছিলাম। ছোট ছোট ঢেউ সেখানে। মোপাসাঁর লেখাতেও সেই স্বচ্ছতাই যেন রয়েছে, জীবন নিয়ে অনেক প্রশ্ন, সংশয় আর জটিলতাকে ধুয়েমুছে সাফ করে দিয়েছেন তিনি।
…একজন মানুষ জীবনে বহুবার প্রেমে পড়তে পারে এবং প্রতিবারই তার প্রেম সমান গভীর ও অকৃত্রিম হতে পারে। প্রেম হচ্ছে এক ধরনের ঝোঁক বা প্রবৃত্তি, যে একবার তার স্বাদ পেয়েছে, সে নিত্য নতুনের দিকে হাত বাড়াবেই…
…তারা জানে না, জীবনে যে কোনও আনন্দ উপভোগের মধ্যেই কিছুটা নীতিবিচ্যুতি আছে। কোনও না কোনও কর্তব্য বা নৈতিক দায়িত্ব থেকে কিছুটা বিচ্যুত না হলে পরিপূর্ণভাবে কোনও আনন্দের আস্বাদ গ্রহণ করা সম্ভব হয় না…
…বিবাহের অর্থ কী এই যে দম্পতিরা পরস্পরের কাছে নিজেদের বিলোপ করে দেবে, জলাঞ্জলি দেবে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে?…
…আমরা বিয়ে করি জীবনে একবারই। সংসার তাই চায়! কিন্তু জীবনে আমরা বিশবার ভালোবাসতে পারি। কারণ প্রকৃতি চায় তা-ই। বিয়েটা হচ্ছে আইন। ভালোবাসা হচ্ছে প্রবৃত্তি। এই ভালোবাসার জন্য কখনও আমরা সোজা পথে যাই, কখনও যাই বাঁকা পথে। সমাজকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিয়ের প্রয়োজন। কিন্তু মানুষ প্রকৃতিগতভাবে এর বিরোধী। বুঝেছ? জীবনে একটিমাত্র জিনিসই কাম্য। ভালোবাসা। তোমাদের বিদূষকদের সমাজ, ভিক্ষুকদের সমাজ, যাকে কোনওদিনই বুঝতে পারে না…
মোপাসাঁর লেখা এই লাইনগুলো উপলব্ধিকে খুব শোনাতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু উপলব্ধি হয়তো আগের থেকেই সব জানে! একজন বুদ্ধিমতী, সংবেদনশীল ও গভীর মনের মেয়ে খুব সহজভাবে আর নিজের জীবন দিয়েই এসব কথা জেনে যায়! কিন্তু ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না। সমাজের কথা ভেবে, শালীনতার দোহাই দিয়ে, ব্যক্তিমানুষকে তো এইসব আত্মত্যাগ করতেই হয়। বিশেষ করে মেয়েদের।
ফেরার পথে আমি আগে থেকেই আন্দাজ করেছিলাম অতলান্ত আর সমিধ কী করতে পারে! ওরা এখন আমাদের বিচ্ছেদের পক্ষে। হয়তো উপলব্ধিও এটা বুঝতে পেরেছে। অতলান্তের না হয় বন্ধুপ্রেম জেগে উঠেছে। সমিধের কী হয়েছে? ওর মনে কি জেগে উঠেছে? ঈর্ষা? তবে দু’জনেই হঠাৎ করে উপলব্ধির খুব হিতাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠেছে। আর পরোক্ষভাবে আমারও। ওরা ভেবেছে, দু’জনকে দুটো আলাদা বোটে ঠেলে দিলেই সব সমস্যা মিটে যাবে। কী সরল ওরা!
অতলান্ত আর সমিধকে আমি আগের থেকেই অনুসরণ করছিলাম। তারপর ওদের পেছনে উপলব্ধিকে উঠতে দেখে আমিও বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে ওই বোটেই উঠে বসলাম। কিন্তু উপলব্ধির পাশে বসতে পারলাম না। আমি বসার আগেই সমিধ গিয়ে ওর পাশে বসে পড়ল। আমার আর ওই বোটে যাওয়ার ইচ্ছাই রইলো না। আমি নদীর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওদের ভুরু কুঁচকে রইলো।
কিন্তু হঠাৎ-ই ভাগ্য আমার প্রতি সদয় হয়ে উঠলো। সায়নের হঠাৎ পেটে ব্যথা উঠলো। প্রচণ্ড কাতরাতে শুরু করলো সে। বাধ্য হয়েই অতলান্তকে বলতে হলো, তুই একটু উপলব্ধিকে পৌঁছে দিবি? উপলব্ধি আজই ফিরে যাবে। দু’টো স্টেশন পরে ওর শ্বশুরবাড়ি। ওর পক্ষে অপেক্ষা করা সম্ভব নয়।
সায়নকে নিয়ে ওরা অন্য একটি স্পিড বোটে উঠলো। সমিধ শুধু একবার অতলান্তকে বলল, তুই বরং উষ্ণিককে সঙ্গে নে। আমি উপলব্ধিকে পৌঁছে দিচ্ছি।
কী ভেবে অতলান্ত বলল, না, না, সে হয় না। সায়নের বাড়িতে তোকে সবাই চেনে। উষ্ণিক এখানে সম্পূর্ণ অপরিচিত।
তাছাড়া… এবার আমি কথা বলে উঠলাম।
ওরা দু’জনেই আমাকে চেনে। তাই কিছুটা চমকেই আমার দিকে তাকালো।
সমিধ বলল, কিছু বলবি?
হ্যাঁ, আমি কথা বাড়ালাম না, কিন্তু দৃঢ়স্বরে বললাম, তোরা এবার যেতে পারিস। আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে…
আমি আর উপলব্ধি আবার একা। উপলব্ধি দরদর করে ঘামছিল। ওকে আমি খুব বেশি ঘর্মাক্ত অবস্থায় দেখিনি। কিন্তু ওকে ঘেমে যেতে দেখে, আমার ওকে খুব চুমু খেতে ইচ্ছা করছিল।
মনে মনে আমি বললাম, দুনিয়ায় আমার মতো চুমু খেতে কেউ পারে না। আর তুমি বৃথাই নিজেকে বঞ্চিত করছে। আমি যেভাবে চুমু খেতে পারি, জীবনে কখনও তুমি তেমন চুমু পাওনি। বাজি ফেলে একথা আমি বলতে পারি!
হঠাৎ গার্সিয়া মার্কেসের লেখা একটি বাক্যের কথা আমার মনে পড়ল। প্রায়ই পড়ে। যৌনতা একটা মেধার ব্যাপার। কথাটা আমার মজ্জায় ঢুকে গেছে। মেধাই যৌনতার আয়ু বাড়ায়। অনুভূতির বিচিত্র পথ খুলে দিতে পারে। অর্থ দিয়ে আমোদ করা যায়। কিন্তু যৌনতাকে বর্ণময় করে তোলা যায় না। একসময় তা একঘেয়ে হয়ে ওঠে।
হঠাৎ উপলব্ধি জানতে চাইল, আপনি কতদূর যাবেন?
বললাম, চলুন না, দেখাই যাক।
ঘাটে পৌঁছে উপলব্ধি আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠল। ও বলল, আপনি একটু দাঁড়ান। আমি এক দৌড়ে আমার ব্যাগটা নিয়ে আসি। বাবা-মা’র সঙ্গেও একবার দেখা করে আসি।
বললাম, আমিও যাই, চলুন।
আপনি কতদূর যাবেন? আবার জানতে চাইল উপলব্ধি।
আপনাকে স্টেশনে পৌঁছে দিলে হবে?
উপলব্ধি রাজি হয়ে গেল।
ওর বাড়িতে পৌঁছে দেখলাম, অনেক কিছুই গুছোনো বাকি। ও আমার দিকে তাকিয়ে একটু রূঢ়ভাবেই বলল, আমার কিন্তু একটুও হাতে সময় নেই। বাবা-মার বয়স হয়েছে। আপনি শুধু আমার হাতে হাতে একটু এগিয়ে দিন।
ও ভেবেছিল, আমি যেমন ভাবুক প্রকৃতির, কাজেকর্মে নিশ্চয়ই খুব অপটু, ওর দেরি করিয়ে দিতে পারি। হয়তো ওর বন্ধুরাই ওকে সতর্ক করে দিয়েছিল।
আমি ওকে সাহায্য করতে লাগলাম। আর খুব তাড়াতাড়িই গুছোনোর কাজটা হয়ে গেল। মাঝেমাঝে ওর দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম, কেমন অবাক হয়ে ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
ওর মা হঠাৎ এসে পড়েছিলেন। মা’র দিকে তাকিয়ে নরম গলায় ও বলে উঠলো, দ্যাখো না, আমি চাইছি, অথচ উনি কিছুতেই আমাকে কোনও কাজ করতে দেবেন না! হাত লাগাতে দেবেন না। নিজেই সব করবেন।
এটা অবশ্য ওর অতিরিক্ত বিনয় বলেই আমার মনে হলো। ও নিজেও যথেষ্ট পরিশ্রম করছিল। ব্যাগপত্র গুছিয়ে আমরা একটা ট্যাক্সিতে চেপে বসলাম।
ট্রেনে উঠে ও কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল।
অনেকক্ষণ ধরেই ওকে একটা কথা বলবো বলে ভাবছিলাম। কিন্তু আর তো সময় নেই।
ফিসফিস করে আমি বলে উঠলাম, উপলব্ধি, মানুষ একভাবে ভালোবাসে না। অনেক ভাবেই ভালোবাসা যায়। হ্যাঁ, ভালোবাসা নিছক এক রকমের হয় না। ভালোবাসার মধ্যে অনেক রকম ভালোবাসার সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে। তাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই উপলব্ধি। ভালোবাসার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। শুধু সম্ভাবনা আছে। অনেকগুলো পথ লুকিয়ে আছে। তারা একে অপরের সঙ্গে জট পাকিয়ে থাকে। তাদের শুধু খুঁজে নিতে হয়। আর নিপুণ হাতে আলাদা করে নিতে জানতে হয়। যে খুঁজতে জানে, সে ঠিক খুঁজে পায়। যে আলাদা করতে জানে, সে সহস্র পথে নিজের ভালোবাসাকে বইয়ে দিতে জানে…
আমাকে বিড়বিড় করতে দেখে ও এমনভাবে মুখ ফেরালো, যার অর্থ হলো, তুমি কেউ নয়, তুমি কখনও ছিলে না, তোমার অস্তিত্বই নেই, আসলে তুমি একটা অলীক স্বপ্ন, অথবা…
হঠাৎ আমার হাসি পেয়ে গেল। মনে হলো উপলব্ধি যেন বিড়বিড় করে বলছে, আসলে তুমি একটি উটকো ঝামেলা…
এটা অবশ্য আমার চোখের ভুলও হতে পারে।
তখন অবশ্য সত্যিই আমার চোখের ঠিক ছিল না। উপলব্ধির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সামনেটা ঝাপসা হয়ে গেছে। শুধু একটা মাটির প্রদীপ ভাসতে ভাসতে চলেছে। সেই আগুনের শিখায় ফুলের সুগন্ধ। সুগন্ধে ভরে উঠেছে চারপাশ। আমি আর কিছু দেখার চেষ্টা করলাম না। শুধু টেনে টেনে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে লাগলাম। আমার ভেতরটা ভরে তুলতে চাইছিলাম সেই সুগন্ধে।
এরপর বেশ কিছুটা জায়গা ফাঁকা। তারপর পরিশিষ্ট শিরোনামে লেখা:
আমার গল্প শেষ হয়ে গেছে। কালই আমি চলে যাচ্ছি। আসলে আমার মূর্তিটি এইমাত্র শেষ হলো। লোকদেবীর ঘাড়ের ওপর উপলব্ধির মুখ। আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। এই আমার প্রমাণ। আর কখনও ও আমাকে বলতে পারবে না, আমি কখনও ছিলাম না, আমি একটা অলীক স্বপ্ন, আমি আসলে একটা… উটকো ঝামেলা…
এই মূর্তিটি কাল প্যান্ডেলে চলে যাবে। গ্রামের কেউ আর কখনও বলতে পারবে না, এখানে আমি আসিনি, আমার কোনও অস্তিত্বই ছিল না, আমি ছিলাম না কখনও, আসলে, আমি একটা উটকো ঝামেলা…
আমি আমার প্রমাণ রেখে গেলাম…
উষ্ণিকের চিঠিটা শেষ করে আমি সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কিন্তু কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল। শুধু লোকদেবীর মুখ। একজন মানুষ ছিল, একজন প্রেমিক ছিল, তার প্রমাণ…