শারদ অর্ঘ্য ১৪২৮ । গল্প
রাত খুব একটা নয়, ন’টায় শুরু হয় সাহিত্যপাঠ। দেবেশচন্দ্রের ঘরে উজ্জীবিত মৃণ্ময় গ্লাসটাস সব কিছুর ব্যবস্থা করে দেয় যথাযথ, চড়চড়াৎ করে বাদাম চিপসের প্যাকেট খোলা হয়। সবাই উল্লাসে হাঁক দেয় চিয়ার্স। এক চুমুকেই শুরু হয় পাঠ। শুরুতেই গল্প পড়ে নন্দিনী, অসমিয়া বাঙালির মিশ্র সংস্কৃতির জনপদ রিহাবাড়ির ভাড়াবাড়িতে বেড়ে ওঠা দেব পরিবারের সদস্য নন্দিনী। গুয়াহাটিতে প্রেম ও বিবাহ অসমিয়া প্রযুক্তিবিদ উদ্ধব কাকতির সঙ্গে। উদ্ধব থাকে ইউএস, নন্দিনী কোচবিহারে মাস্টারির চাকরি নিয়ে একা থাকে, স্ট্যাটাস বিবাহিত।
বাসবীর বরও থাকে দূরে, প্রোষিতভর্তৃকা। বরের কাছে রাঁচি গেলে তার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড যায় শীতঘুমে। বাসবীর চাকরি বাকরি করতে হয় না, বরের অনেক টাকা। বরের নাম মিঠু। মিঠুর কথায় মনে পড়ে যায় দেবেশচন্দ্রের বাসবীর শেষ না হওয়া কথাটা। বাসবীকে বলেন,
— মিঠু কী বলছিল রে?
— না, ও কিছু না।
— বল না।
— ওটা একটা ফেসবুক রসিকতা।
— ইন্টারেস্টিং নিশ্চয়? বল না।
— বলব? আপনিও পড়েছেন নিশ্চয় দেবেশদা, আম কাঁঠালের ছুটিতে দশ-বারোজন নাতি-নাতনি ব্যাঙ্গালোর পুনে চেন্নাই থেকে এসেছে গ্রামের বাড়িতে ঠাকুমার সঙ্গে সময় কাটাবে বলে, গর্বিত ঠাকুমাও আড্ডার মেজাজে মধ্যমণি হয়ে বসেছেন কিন্তু কেউ যে কোনও কথা বলছে না, সব চুপচাপ, পিনড্রপ সাইলেন্স। অবস্থা বেগতিক দেখে ঠাকুমাও উঠে গেলেন কিছু একটা আনতে। এখন বলুন তো দাদা, ঠাকুমা কী নিয়ে ফিরলেন?
কেউ ঠিকঠাক জবাব দিতে পারে না। কেউ বলে চশমা, কেউ বলে দোক্তা, কেউ বলে গানের খাতা। না। বাসবী সবটাতেই বলে, গলত জবাব। শেষ পর্যন্ত মৃন্ময়ের স্ত্রী বলে,
— ঠাকুমাও তার মোবাইল আনতে গেছেন।
— ঠিক।
যথেষ্ট হাসির পর দেবেশচন্দ্র ফরমান জারি করেন সাহিত্যবাসরে কোনো মোবাইল নয়, সুইচ অফ করে দাও সবাই। নন্দিনী শোনায় পুরুষের বয়ানে বহুগামী কামুক পুরুষের গল্প। অনেকটা যেন তার জীবনের কথা। গল্প শেষ করে সবার মতামতের জন্য অপেক্ষা করে। কেউ কিছু বলছে না দেখে দেবেশচন্দ্রকে বলে,
— সবাই চুপ কেন? এরকম গল্প কি হয় না?
— হবে না কেন?
— গল্পে হয় না জানি, পরম্পরা মিলিয়ে লিখতে হয়, কিন্তু জীবন তো এত মাপজোক লিখে রাখে না। আপনারা বলেন যৌনতা জীবনের অঙ্গ, আমি বলি বিকৃতি।
বলেই ঝরঝর করে এক পশলা কেঁদে নেয় নন্দিনী। কিছু আবেগ আর কিছুটা ভদকার প্রতিক্রিয়া হতে পারে। দেবেশচন্দ্র যে আজ ঢালাও পানের সম্মতি দিয়ে রেখেছেন সবাইকে। তাই নন্দিনীর গল্পের একটা সদর্থক আলোচনা শেষে বলেন- খুব ভালো হয়েছে গল্প। এবার বাসবী বলল মোবাইল দেখে পড়বে। দেবেশ চন্দ্র বললেন,
— না, আইন আইনের পথে চলবে। কাগজে লেখা পাণ্ডুলিপি পড়তে হবে। আর জমা দিতে হবে, প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যার লেখা স্থির হবে আজ।
বাসবী মেনে নেয়, ব্যাগ থেকে বের করে কাগজের তাড়া। দেবেশচন্দ্র বাসবীকে পড়া শুরুর আগে আবার সাবধান করে দেন,
— সাদামাটা পড়বে, তোমার বাচিক শিল্পী সত্তা যেন গল্পকে প্রভাবিত না করে।
এটা ঠিকই বাসবীর কণ্ঠস্বরে এমন একটা জাদু আছে যা ঢাকাই রাঁধুনিকেও হার মানায়। দুব্বো ঘাস কাঁঠাল পাতা ফুলকপির ডাঁটা আলুর খোসা সব কিছুই রান্নার জাদুতে অমৃত পদ হয়ে ওঠে। বাসবী মৃদু হাসিতে সম্মত হয়। বাসবীর গল্পটা সবাইকে নাড়িয়ে দেয়। একেবারে ভিন্ন ধরণের গল্প, এক প্রতিবাদী মানুষের জন্য খোঁড়া হয়েছে কবর, কিন্তু তাঁর দেহ পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। খুনি কিংবা গুণ্ডা একটি লোক প্রতিদিন দেখে যায় খোঁড়া কবর, আর প্রতিদিন সে বদলে যেতে থাকে। একদিন সে নিজেই সেই পূর্ণ দৈর্ঘ্যের কবরে ঢুকে যায়, কি জানি কী খোঁজে, সব শেষে ধুলিধূসরিত যখন বেরিয়ে আসে, তখন তাকে দেখে আর চেনাই যায় না। মানুষ বদলে যাওয়ার গল্প শুনে নন্দিনীই প্রথম বলে- অসাধারণ। নলিনী বলে,
— কী করে লিখলে দিদি। এখন তো কেউ প্রতিবাদী থাকতে পারে না। প্রতিবাদী মানে এখন দেশদ্রোহী হওয়া। আর দেশদ্রোহের শাস্তি মৃত্যু নয় জেল। তবে দি বিশ্বাস হারানোও যে পাপ, ওকে কেন আবার কবরে পাঠিয়ে শুদ্ধ করে নিয়ে এলে। আরও বেশি প্রতিবাদী করে নিয়ে আসা যায় না ? তবে লিখেছ দারুণ, মুন্সিয়ানা আছে।
এর পর, কেউ খেয়াল করেনি কখন এসে হোটেল রুমের এক কোণে বসে পড়েছে নলিনী। কারও কোনও অনুমতি না নিয়েই এক তাড়া কাগজ নিয়ে পড়তে শুরু করে দিয়েছে তার গল্প।
প্রথম পরিচ্ছেদ
— দুঃখিত দেবেশ দা, আজ সারাদিন অনুপস্থিত ছিলাম, দুঃখিত সুমিতাদি, আমার বন্ধু মৃন্ময়ের কাছেও দুঃখ প্রকাশ করছি। চোখ ঢুলুঢুলু জুরি বোন স্যরি, বাসবীদি নন্দিনীদি দুঃখিত, দেবেশদা আর সুমিতাদিকে কষ্ট দেওয়াই তো আমার কাজ তাই ওসব বলে লজ্জা পাব না। স্যরি গঙ্গাধর স্যরি গোলকগঞ্জ।
দেবেশচন্দ্র ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নলিনীকে থামিয়ে দেন। বলেন,
— সময় কম সরাসরি গল্পে চলে যাও।
— গল্পেই তো আছি দেবেশদা, আপনাদের নাম আছে গোলকগঞ্জ আছে দেখে ভাববেন না বক্তৃতা দিচ্ছি, গল্পই পড়ছি। আপনাদের নাম মানে পাত্র ও স্থান কাল মিলে যাওয়ায় বিভ্রান্তি হতে পারে, আপনার আপত্তি থাকলে নাম পালটে দেব, দেবেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জায়গায় সাধন চট্টোপাধ্যায় করতে পারি স্বপ্নময় চক্রবর্তী হতে পারে, অমর মিত্র কিন্নর রায় নলিনী বেরা কিংবা ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়ও হতে পারে। না, তাই বা কেন, মিত্র রায় বেরা চলবে না। গল্পটা বলা হবে একজন ব্রাহ্মণ সাহিত্যিককে, আর কোচবিহারে আপনার থেকে যোগ্য ব্রাহ্মণ লেখক কে আছে বলুন? যাক পড়ি আবার, হ্যাঁ গঙ্গাধর নদী আর গোলকগঞ্জ ছাড়া কুলেশ্বরী মন্দিরেরও একটা বিশেষ ভূমিকা থাকবে কাল সকাল পর্যন্ত। আজ সারাদিন অনুপস্থিত ছিলাম। আপনাদের এই ছোটো শহরে নিয়ে আসার পিছনে যার উৎসাহ ছিল সবচেয়ে বেশি সে মানুষটাও এখন অনুপস্থিত। তাতে কী হয়েছে, অদম্য নেই তো কী হয়েছে, আমি তো আছি। কাল সকাল নাগাদ সব শেষ হয়ে গেলে, গোলকগঞ্জ দেখাতে নিয়ে যাব আপনাদের । অদম্য বলেছিল তার ছোটো শহরের ছোটো নদীটা দেখাবে আপনাদের, গঙ্গাধরকে কেউ পুংনামে ডাকে না, গঙ্গা নামেই পরিচিত। বলেছিল লখিমারি সীমান্ত দেখাবে, সীমান্তে আছে বর্ডার ট্রেড সেন্টার, এদেশে ওদেশের শাক সব্জি মাছ বিক্রি হয়, এদেশের গ্রামীণ আনাজপাতি কেনে ওদেশের সাধারণ মানুষ। মূলত এই সময় ইলিশ আসে খুব, শুঁটকিমাছও বিক্রি হয় । অদম্য বলেছিল একটা কাজ সেরে আসবে সিঙ্গিমারি থেকে, আমি যেন আপনাদের সঙ্গে থাকি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গে থাকতে পারব কি না জানি না।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
অদম্যকে আমি একা যেতে দিই নি। আসামের অবস্থা তো এখন ভালো নয়। আপনি জানেন আমি আসামের বানপানির কথা বলছি না, বন্যা আসে বন্যা যায় আসামে, এসব নিয়ে কেউ ভাবে না, কিন্তু এই বন্যা পরিস্থিতি সামলে প্রতিবছর আসামের ক্ষেত জমি যাদের ঘাম পরিশ্রমে উর্বর হয়ে ওঠে, তাদের কথা বলছি। যাদের কায়িক পরিশ্রমে আসামের ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় চাউল শাক সবজি গাখির। গাখির মানে দুধ। তারা যখন রংপুর জেলা থেকে ব্রহ্মপুত্রের পারে এসেছিল তখন আসামের বুদ্ধিজীবীরা ওদের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছিলেন। তখন কুশল চাষী ছিল না আসামে। রংপুরের কৃষকরা গড়ে তুলেছিল ‘চিকুনি দেশ, শুওলা, সুফলা মরমর দেশ’। সোনার ফসল ফলানো সেই কারিগরেরা এখন হয়ে গেল বিদেশি, ১৯৮৫র এক উদ্ভট চুক্তির ফলে। দেবেশদা, আপনি একজন সংবেদনশীল লেখক, আর লেখক হলে তো কত কিছুর খবর রাখতে হয়। ভিয়েতনাম আন্দোলন থেকে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ পর্যন্ত। হয়তো কিছুটা জানেন আসামের এনআরসি নিয়েও। হয়তো মিটিং মিছিলও করেছেন বা করবেন আরও। তবু এত কাছাকাছির প্রতিবেশি আমরা, আমিও তো কোচবিহারেই থাকি। আমিই বা কতটুকু বুঝতাম, অদম্য কামতাপুরী আন্দোলন করত বলে ওকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছিলাম। কলেজে বিপরীত রাজনীতি করেছি তখন, উস্কানিও ছিল। তারপর কী জানি কী হল অদম্য ছেড়ে দিল দলীয় রাজনীতি। আসামে তখন বিদেশি খেদা আন্দোলন চলছে, তার অনেক আগে, আমাদের জন্মও হয়নি, আসাম চুক্তি হয়ে গেছে, এক আগ্নেয়গিরির জন্ম হয়েছে, আমাদের দেশ ভাবনার উপর কুঠারের প্রথম আঘাত। এদিকে আমরা ৩৭০ উঠিয়ে দিয়ে একাকার করে দিয়েছি কাশ্মীরে ভারতে, ওদিকে আসামে জারি রয়েছে ভাগের ভোট খেলা। ভাগের এই দেশটা সত্যিই এক প্রমোদ তরণী, হা হা! সকাল থেকে রাত অব্দি এই শহরে থেকে একটা কথা নিশ্চয় বুঝে ফেলেছেন যে, আসামের এই শহরের সত্তর ভাগ মানুষই বাঙালি। ভেবেছেন অদম্য তো ভালোই আছে তাহলে কেন উস্কানি। আপনারা ভাবছেন সুখে থাকতে ভূতে কিলোয় কেন, বাংলাদেশের মতো পশ্চিমবঙ্গের মতোই তো এরা। এখানকার গাছগাছালি ফলমূল শাকসবজি আর গঙ্গাধরের মাছ নিশ্চয় খাইয়েছে লীলাধর চক্রবর্তী, বড়িয়ালির তো তুলনা নেই। লীলার উপাধি চক্রবর্তী হলেও কিন্তু সে বাঙালি নয়, অন্তত আসামে সে গোয়ালপাড়িয়া ভাষাভাষী হিসেবে পরিচিত। অদম্যের মামাতো ভাইটি যখন আপনার সঙ্গে কথা বলবে তখন কিন্তু সে খাঁটি বাঙালি আবার কাগজপত্রে সে নির্ভেজাল অসমিয়া। ভেজাল কিছু থাকলে সে ব্রিটিশরা করে গেছে কোনকালে। আপনার জানার কথা নয়, ১৮২৬ এর ইয়াণ্ডাবু সন্ধির পর আসামের ব্রিটিশ অধিকার কায়েম হওয়ার পর এদিক ওদিক বাংলার অনেক ভূখণ্ড আসামের হয়ে গেছে।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
রাজ্য পুনর্গঠনের সময় দক্ষিণবঙ্গের মানভূম সিংভূমও চলে যায় তৎকালীন বিহার রাজ্যে, দীর্ঘ আন্দোলনের পর পুরুলিয়া ফিরে আসে। উড়িষ্যায়ও চলে যায় বাংলার অংশ। আপনারা বলবেন যাক না, থেকে তো গেল ভারতবর্ষে, চলে তো যায়নি পাকিস্তানে বাংলাদেশে। হয়ে যায়নি বিদেশ। আসলে বিদেশ থেকে কিছু কম নয় দেবেশদা। ঘাটশিলায় গেলে এখন বাংলায় কথা বলতে পারবেন? কিংবা ধানবাদে? ধুবড়ির সবক’টা স্কুলে বাংলা পড়ানো হতো, আর এখন? গঙ্গাধরপারে এই ছোটো শহরে চোখে পড়ল একটা বাংলায় লেখা সাইন বোর্ড? সব পেট কাটা ‘র’ আর ওয়াব্ব মানে ‘ব’য়ের নিচে টান।
বর্ধমান গেছেন তো, কল্যাণেশ্বরী মন্দির পেরিয়ে মাইথন ড্যাম, উদ্বোধন করেছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। একদিকে পশ্চিমবঙ্গ অন্যপারে ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গের দিকে অনেক দোকানপাট স্থায়ী অস্থায়ী, কিছু বাংলা বেশির ভাগ হিন্দিতে লেখা সাইনবোর্ড। বাঙালি নিজেকে ভাগ করে দিয়ে গেছে হিন্দি হিন্দুস্থানকে, সম্পূর্ণ সমর্পণ এই ভাগের দেশে। এবার ওপারের দৃশ্যটাও দেখেছেন? সব হিন্দি। নিজেকে ছিন্ন শূন্য করে দিয়েও কী সুখে থাকল বাঙালি, আমরা যেমন আছি কোচবিহারে আলিপুরদুয়ারে দার্জিলিংয়ে। তবু আমরা চাইলেই কলকাতা চলে যেতে পারি, পাঁচতলা তেত্রিশতলার একটি খুপরিতে মাথা গুঁজতে পারি নিশ্চিন্তে। তা কলকাতাও তো কলকাতা নয়, কলকাত্তা মে বাংলা চলে না, হিন্দি উর্দুর দাপট। তাও তো পশ্চিম বাংলার রাজধানী, ফ্ল্যাট কিনে থাকতে পারেন আপনি। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র চরের দরিদ্র কৃষিজীবী যে ভয় পেয়ে নাম লিখিয়েছিল অসমিয়া বলে, এখন তো তাদেরও পরীক্ষা দিতে হচ্ছে ডিএনএ, যার নাম এনআরসি, ডি ভোটার, লিগ্যাসি ডেটা, দিতে হবে বন্যাপ্রবণ ব্রহ্মপুত্র আর বরাক পারের বাঙালিকে।
এক দেশে কত আইন, অসমিয়াদের পরীক্ষা দিতে হয় না, ওরা খিলঞ্জিয়া, মানে আদি বাসিন্দা। পরীক্ষা দিতে হবে শুধু বাঙালিকে। কাশ্মীরে পাঞ্জাবে কি তেমন পরীক্ষার চল আছে? সুপ্রিম কোর্ট বলেছে যখন তখন মানতেই হবে আসামের খিলঞ্জিয়া ভূমিপুত্র তখন প্রধান বিচারপতি।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
এই নন্দিনীদি তোমার কাছে ভিক্স আছে গো? দাওনা একটু, আজ সারাদিন ভিজেছি বৃষ্টিতে। জুরি বারবার তাকাচ্ছে দেখুন আমার কাঁধের দিকে। না না, গোলাগুলির মুখে পড়িনি কিংবা কোন সন্ত্রাসী হামলা করেনি কোথাও। হাইওয়ের পাশে নয়ানজুলিতে বাস উল্টে যায়। মরেনি কেউ, তবে আহত হয়েছে সবাই কিছু না কিছু। অদম্য ছাড়া কেউই হাসপাতালে ভর্তি হতে চায় নি। তাই আমরা বিভিন্ন বাহনে হিচহাইক করে ফিরেছি। কিছু রয়েছে গোলকগঞ্জ স্টেশনে কিছু অন্য এক জায়গায়। সব সন্দেহজনক বিদেশি। ভাগ্য ভালো থাকলে কালকেই পৌঁছে যাবে নিরাপদ স্থানে রাজ্যান্তরে। ভয় পাবেন না, অদম্যর নেটওয়ার্ক নিশ্ছিদ্র, কেউ ধরতে পারেনি, ধরলেও আর রক্ষে ছিল না। লীলাময় থেকে আপনাদের নিয়েও টানাটানি হতো। বাইরে শুনেছেন কেমন মেঘের ডাকাডাকি, বৃষ্টিও হচ্ছে লাগাতার। এই মাঝারাতে একটা গান গাই দেবেশদা? শুনবেন?
‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল বান
বানের জলে ভাসল পুকুর ভাসল আমার গান
বন্ধু আইসোরে… কোলেতে বসতে দেব, মুখে দেব পান
ইস্টিকুটুম বৃষ্টি এলো সৃষ্টি হল সুর।’
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
সিঙ্গিমারি গ্রামে আজ সারাদিন বৃষ্টি, দু’দিন ধরেই চলছে লাগাতার। কী সুন্দর এই গ্রাম সিঙ্গিমারি, গ্রামের সবাই আজ কর্মহীন, নির্বাক, শুধু হাঁসের প্যাঁকপ্যাঁক ধ্বনি পথে ঘাটে। ওদের মহোৎসব আজ সর্বত্র। বিলাসীপাড়ার পথের উপর দেড়শ গ্রাম ওজনের কইমাছ উজানে চলেছে কানে হেঁটে, বাঁচার তাগিদে উজানে যাচ্ছে, বোকারা ভাবতেও পারছে না কোন পথে বিপদ আর কোন পথে নিরাপদ। পথ মাছের জন্য যে নিরাপদ নয় সে তাদের বোঝাবে কে? কিন্তু আজ কোনও বিপদ হল না তাদের, নিরাপদ উজানের পুকুরে চলে গেল নির্বিবাদে। বেঁচে গেল, বাঁচ গিয়া শালা।
তরণী মালাকারের বাড়িতে তখন অন্য আতঙ্ক। জড়ো হয়েছে জনা তিরিশেক মানুষ উজানে যাওয়ার জন্য, সন্দেহের হাত থেকে বাঁচতে বিদেশি তকমা পরে যাতে বন্দীশিবিরে জীবন কাটাতে না হয়। ওরা সবাই শুধুমাত্র একটি পুঁটলি সঙ্গে নিয়ে এসেছে, থাকল পড়ে শন বাঁশ বেতের তৈরি বাড়ি ঘর। ওরা যাবে আসাম সীমান্ত পেরিয়ে যেদিকে দু’চোখ যায়। কী ভাবছেন আপনারা, ওরা যাবে গঙ্গাধর পেরিয়ে বাংলাদেশে? লখিমারির ওপারে? বাংলাদেশে কে নেবে ওদের, সীমান্তের আশেপাশে থাকলে বিএসএফ করবে গুলি, ওপারে চলে গেলে বিডিআরের গুলি খেয়ে মরতে হবে। ওই বিদেশকে চেনে না ওরা, জন্ম থেকে আছে এদেশে। পঞ্চাশ ষাটের ভিতর বয়স তাদের। একজন পদ্মবিবির বয়স শুধু সত্তরের দু’তিন বছর বেশি হবে, মানে দেশ ভাগের বয়সী। ওরা এপারের বিদেশি। কয়েকজনের আদিবাড়ি গোলকগঞ্জে, ওরা কেউ ধানের, সবজির চাষি, কেউ মাছচাষি। কারোরই কাছে কোনো কাগজপত্র নেই, এককালে হয়তো ছিল, বানপানি খেয়ে ফেলেছে। বানপানি মানে বন্যা। তবু এনআরসি পাশ করে গেছে ত্রিশজনের ত্রিশজনই। ভাবছেন এনআরসি পাশটা আবার কী, আসলে এটা একটা কথার কথা। মানে এদের নাম নথিভুক্ত হয়ে গেছে আসামবাসী ভারতীয় হিসেবে। এনআরসি নিয়ে কি কিছু বলেছি আপনাকে? এনআরসি মানে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি, ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন্স বা সোনার পাথরবাটি। জাতীয় কোনও ব্যাপারই নয়, পুরোটাই উগ্র জাতীয়তাবাদ। ভারতে কোথাও নেই, আসামে থাকতে হলে ওটা চাই।
সিঙ্গিমারি গ্রামের একটা এনজিওর সঙ্গে আমি যুক্ত, শুধু মেয়েদের নিয়ে সংগঠন, অসমীয়া মেয়েরা আছে, বাঙালিও আছে, মেয়েরা কাপড় বোনে, নিজেরাই বিপণন করে, অদম্যর কাণ্ড আর কি। দেবেশদা আপনি তো অনেক জানেন, হয়তো ভাবছেন সিঙ্গিমারি তো বরপেটা জেলায় আর আমি নিয়ে এসেছি ধুবড়িতে, নিশ্চয়ই কিছু লুকোতে চাইছি। না দেবেশদা ন্যাংটোর নেই বাটপাড়ের ভয়। আসামে এখন যে কত কিছু হচ্ছে, এক এক সময় মনে হয় সুপ্রিম কোর্টও কি চাইছে যেন তেন প্রকারেন নাম কাটা পড়ুক বাঙালির, তাই আর একটি আদেশ দেওয়া হয়েছে, যারা নাগরিক পঞ্জিতে নথিভুক্ত হয়ে গেছে তাদের দেশি হওয়ার বিপক্ষে যে কেউ আপত্তি জানাতে পারে, আপত্তিকারীর কোনও দায় নেই প্রমাণ করার, যার বিরুদ্ধে করা হয়েছে তাকেই নিতে হবে প্রমাণের দায়। মানে পাশ করিয়ে আবার ফেল করানোর কল। শাসকের তৎপরতায় আসাম রাজনীতির শিশুনায়ক ছাত্র সংগঠন এখন আপত্তি জানানোর বিশাল বাহিনী গড়ে তুলেছে। এমতাবস্থায় অনেক ঘোষিত নাগরিককে আবার অগ্নিপরীক্ষায় বসতে হচ্ছে। গ্রামের মানুষের পক্ষে দূরদূরান্তের এনআরসি সেবা কেন্দ্রে যাওয়াও কষ্টকর। কেউ কেউ গেছে কষ্ট করে, হয়নি প্রমাণ। গেছে বিদেশি ট্রাইব্যুন্যালেও, সেখানেও ফেল হওয়ায় পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে বন্দী শিবিরে। কেউ কেউ হতাশ হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
হারান মণ্ডলের মেয়ের বিয়ে ছিল গতকাল, মেয়েটি আমার এনজিওর সভ্য। বিয়ের দিনই হারান আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যাকে আমি কাপুরুষতা মনে করতাম, পালিয়ে যাওয়া ভাবতাম। কোনও দয়ামায়া ছিল না। হারানের আত্মহত্যায় আমার আজন্মলালিত বিশ্বাসের ভিত টলিয়ে দিয়েছে। আমি বুঝে গেছি, হারান হাজার চেষ্টা করলেও অসম লড়াই জিততে পারত না, বাঁচতে পারত না। অজগরের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হওয়া তার একার পক্ষে সম্ভব নয়, বাইরের সব শক্তি দূর থেকে তার তিলে তিলে মৃত্যু প্রত্যক্ষ করতে পারে, কিন্তু ফিরিয়ে দিতে পারে না তার নাগরিক অধিকার।
তবু দেবেশদা এটাও সত্যি, হারানের মৃত্যু আরো অনেক সম্ভাব্য মৃত্যুর বিরুদ্ধে যে এক প্রতিরোধ হয়ে দাঁড়াবে তারও কোনও আভাস নেই কোথাও। শোষকের বধির কর্ণে এসব মৃত্যু মিছিলের কোনও মূল্য নেই, তবু প্রতিবাদ তো জানাতেই হবে। হারানের হবু মেয়েজামাই বিল্বমঙ্গল আমার চোখ খুলে দিয়েছে দেবেশদা। সে বলেছে দায়িত্ব নিয়ে সে শ্বশুরের দাহকার্য করতে চায়, বলেছে ওকে যেন সেই সামাজিক অধিকার দেওয়া হয়। তাই আজ সকালে গোলকগঞ্জ হাসপাতাল থেকে ময়নাতদন্ত করে শবদেহ দেওয়া হবে। আপনি বলবেন বেশ তো সৎকার করে নাও গঙ্গাধরের পারে। তারামনি মুখাগ্নি করে নিক। না, দেবেশদা তারামনি বলেছে ওর বাবা হারান মণ্ডল বিল্বকে তার মুখাগ্নি শ্রাদ্ধশান্তির অধিকার দিয়ে গেছে। বিল্বমঙ্গল বলেছে কোন অধিকারে? আমি অসহায় হয়ে সামাজিক সমাধান বের করার উপায় পাইনি। বলেছি,
— তারামনি দাহসংস্কার করুক না, তুমি সঙ্গে থেকো।
তার কোনও আপত্তি নেই, কিন্তু তারামনির যে এক গোঁ, পিতৃবাক্য রক্ষা করবে। তারামনিই বলল,
— দিদি তুমি আমাদের বিয়ে দিয়ে দাও।
— সে হয় নাকি? বাবার মৃতদেহের সামনে এসব হয় না। পিতৃদশা চলবে এক বছর, এক বছরে কোনও শুভকার্য হয় না।
— সব কাজই শুভকাজ দিদি। তুমি পারবে। চেষ্টা করলেই পারবে।
— কোনো ব্রাহ্মণই রাজি হবে না। তবে রেজিস্ট্রি একটা করিয়ে দিতে পারি সুমিতাদিকে বলে।
— তাই করো দিদি।
— না রে, হবে না, সুমিতাদি অন্য রাজ্যের রেজিস্ট্রার, যদি না হয়, তার উপর নোটিশ টোটিস দেওয়ার ব্যাপার আছে।
আমি জানি সুমিতাদি খুব রাগ করবে, তুমি তো এসেছিলে দিদি আমাদের বিয়ে দিতে। জানি না, এ আবদার রাখার কোনও আইন আছে কিনা। না থাকুক। দেবেশদা আপনি তো পারেন। মৃণ্ময়ের বিয়েতে দেখেছি বিয়ের মন্ত্র পড়িয়েছেন শাস্ত্রমতে। কবিতার মতো করে সাহিত্য বাসরেও শুনিয়েছেন বাংলায়। কুলেশ্বরী মন্দিরে ওদের বিবাহমন্ত্র পাঠ করিয়ে দিন না। মন্দিরের যদি বাধা থাকে অশৌচকালীন বিবাহে, তাহলে গঙ্গাধর নদীকে সাক্ষী করে ওদের বিয়ে দিন। তারপর দেহ আসবে, দাহ হবে। আমি না হয় ওদের নিয়ে চলে যাব রাজ্য ছেড়ে। আপনারাও অদম্যকে টাটা করে চলে আসবেন কাল বাদ পরশু। এক ফাঁকে লখিমারি সীমান্ত বাজারও ঘুরে আসুন। আমাদের তো আর বিয়ে হল না এ জীবনে।
উর্দ্ধশ্বাসে পড়ে কিংবা বলে থামে নলিনী। কাগজের তাড়াও রাখে চেয়ারে। দেবেশচন্দ্র অবাক হয়ে দেখেন নলিনীকে। দেখেন তার শাড়ি ব্লাউজের ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। এ তো এক বেলার ঘটনা, নলিনী লিখল কবে। অবাক বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেন মূর্তিমতী প্রতিবাদকে। বলেন,
— কী নাম দেবে গল্পের?
নলিনী বলে,
— আপনি দিয়ে দিন কিছু।
— ‘উজানের কই’ নামটা কেমন?
সবাই বলে একবাক্যে,
— ঠিক।
কিন্তু দেবেশচন্দ্র লিখবেন কোথায়! সবই তো সাদা কাগজের তাড়া। নীরবে অন্য দু’টি গল্পের নিচে রেখে দেন শূন্য পত্রাবলী।