Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

শারদ অর্ঘ্য ১৪২৮ ।  প্রবন্ধ

রূ প ক   ব র্ধ ন  রা য়

ফ্রান্স নিবাসী ম্যাডিকেল আল্ট্রাসাউণ্ডের তরুণ বিজ্ঞানী

rupak_hm

বিজ্ঞান ও কবিতাঃ এক একান্নবর্তী অনুষঙ্গ

“…সকল পথ যেখানে একত্রে মিলিয়াছে সেখানেই পূর্ণ সত্য।…”

ধর্মীয় মৌলবাদ এবং অবৈজ্ঞানিক দক্ষিণপন্থার এই যুগেও বিজ্ঞানের হাত ধরেই যে টুক টুক করে মাঝবয়সের দোড়গোড়ায় এসে দাঁড়াতে পেরেছি সে বড় সুখের কথা। তবে বয়স তো কেবল সুখ উপহার দেয় না, কিছু কষ্টও দানা বাঁধে। সে পীড়ার কিছু নতুন, কিছু বা পুরনো, কিছু ব্যক্তিগত এবং শেষমেশ কিছু বিশ্বজনীন, দার্শনিক ও প্রশান্ত; তারা প্রাগৈতিহাসিক তবু প্রাসঙ্গিক। তেমন দুঃখের কথা চাইলেই বলা চলে না, তা প্রাসঙ্গিক ঠিকই তবে সহজলভ্য নয়। তাকে সময় দিতে হয়, একা ফেলে রাখতে হয় একাধিক জীবন। তবুও তো-

“…সময় দিয়ে আসা, …ছেড়ে আসা নয়-…”

বয়স বাড়লে স্মরণবেদনা দানা বাঁধে। “বয়স যত বাড়ে, … মানুষ তত প্রেমিক হয়।…” । ছোটো ছোটো প্রাসঙ্গিক-নিসঙ্গ-ব্যক্তিগত কষ্টগুলো ধীরের ধীরে দূরে সরিয়ে, সৃজনশীল বৈজ্ঞানিক মনন বলে-

“…এখন পুরনো এই দুঃখকে বসার জায়গা দাও

অনেক বাগান ঘুরে, মানুষের বাড়ি ঘুরে, উড়িয়ে-পুড়িয়ে

ও আমার কাছে এসে বসতে চায়। কিছুদিন থাক।

শান্তি পাক, সঙ্গ পাক। এসো তারপর।

ও নতুন দুঃখ তুমি এসো তারপর।”

দেখছেন তো! কী কথা বলতে বসে বিজ্ঞান ছেড়ে কবিতায় এসে পড়েছি! 

কথাটা বোধহয় ঠিক হল না। কলকাতা পত্রিকায় অশোক বাবু কবিতা ও মিছিলের অনুষঙ্গে যাই বলে থাকুন না কেন; বিজ্ঞান থেকে কবিতায় বা কবিতা থেকে বিজ্ঞানে কি সত্যিই সরে আসা যায়? একাধারে গদ্যরাজ এবং অন্যদিকে রসায়ন শাস্ত্রে সমান প্রাজ্ঞ রাজশেখর বসু যখন বলেন; “…প্রত্যক্ষ ছাড়াও যে অনুভূতি আছে, যা মানুষের মূলীভূত, বিজ্ঞান যার আশে পাশে মাথা ঠুকছে,…।”- তখন তিনি বিগত একশো বছর ধরে আমরা যে ফলিত বিজ্ঞান চর্চাটা কেবল করে চলেছি তার কথাই মূলত বলতে চাইছেন, দর্শন সাধনা নয়। কিন্তু শাস্ত্র বা কলা হিসাবে জন্মলগ্ন থেকে বিজ্ঞানের যে দর্শকেন্দ্রিকতা এবং পরবর্তীকালে আধুনিক যুগে এসে এই যে বিজ্ঞানের সর্বক্ষেত্রেই শুধুমাত্র প্রায়োগিক হয়ে ওঠা, সে সংকটের কথা বলতে বসলে কেবলই আমিগডালা-হিপ্পোকাম্পাসের তত্ত্ব কপচালে চলে? ইন্দ্রিয়াতীত সত্য বা সংকটের উৎসে পৌছতে হলে কেবলই ইন্দ্রিয়গম্য রাস্তা বেছে নেওয়া অবোধের মুর্খামি ছাড়া আর কি? প্রয়োগ ও দর্শনের মধ্যেকার পার্থক্যের মূলে এবং ঠিক তেমনই কবিতা ও বিজ্ঞানের মাঝে তুলে দেওয়া কৃত্রিম দেওয়ালটার জৈবিক গাঁথনিটায় মোক্ষম একটা আঘাত করতে না পারলে এই জীবৎকালে সে কষ্ট আমার ঘুচবার নয়। তবে যুগের পর যুগ ধরে পশ্চিমি এ্যালিয়েনেশানকে অনুসরণ করে বেড়ে ওঠা এই বিভাজনের বিনাশ সহজ কথা নয়। এ নিবন্ধ তেমন দাবিও করে না। তার কাজ, বাংলা-ভাষা-চর্চায় কবিতা ও বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক একান্নবর্তী অস্তিত্বকে পাঠকের দরবারে আরো একবার তুলে ধরা। তাই হোক যুদ্ধ প্রস্তুতির প্রথম ধাপ। সেই একান্নবর্তী অনুষঙ্গে এ নিবন্ধকে বারবার কৃতী অগ্রজদের কাছে ফিরে যেতে হয়েছে বৈকি, কারণ এই পোড়াকালে দিনের শেষে তাঁদের কাজের ব্যাপ্তি ও সমন্বয়ের মাঝে ক্ষণিকের যাপনটুকুও যে মনস্তাত্ত্বিক শান্তি এনে দেয়, এ অভাগার কাছে সেই শুদ্ধ, সেই কল্যাণ। কিন্তু পরিসর সীমিত, চরণভূমি সীমিত, তাই যে ক’টা কথা বলতে বসা সে কথাগুলো গুছিয়ে বলতে চাইলে সকলের নাম নেওয়া হয়ত হয়ে উঠবে না, সে আমারই আক্ষেপের বিষয়। চেষ্টা তবু করতেই হয়। তাই এক কথা দু’কথায় ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে নানান উদাহরণের মাধ্যমে বঙ্গসাহিত্যের ইতিহাসে কবির বিজ্ঞান চেতনা এবং একই সঙ্গে বৈজ্ঞানিকের কাব্যিক মননের উপস্থিতিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবার চেষ্টা করবো। 

যে কোনো আলোচনার মূল প্রবেশপথটাই মূলত বন্ধুর, সে পথ একবার কোনোক্রমে পার হয়ে গেলে গাড়ি নিজের রাস্তা নিজেই গড়গড়িয়ে করে নেয়। আলাপের সুর লাগাতে পারলে জোড়ের পথ আপনি তৈরি হয়ে যায় ছন্দের হাত ধরে। তাই শুরুতেই গুরু-স্মরণ সঙ্গীত সাধনার মতোই সাহিত্য ও বিজ্ঞানেরও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। রাজশেখর বসু যেমন বলেন, “…আমাদের প্রথম কর্তব্য- বড় বড় লেখকগণ যা লিখিয়া ফেলিয়াছেন তার একটা গতি করা।…” 

***

“…বৈজ্ঞানিক ও কবি উভয়েরই অনুভূতি অনির্বচনীয় একের সন্ধানে বাহির হইয়াছে…”

একথা সর্বতো সত্য যে বাঙলা গদ্য সাহিত্যের বয়স খুব বেশি হলে দু’শো বছরও অতিক্রম করেনি। অন্যদিকে আমাদের পদ্য সাহিত্যের বয়স নয় নয় করে ছ’শো। আধুনিক বাঙালী মননের প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায় ও শ্রীরামপুরের উইলিয়াম কেরীর মতো কিছু মিশনারীদের সাহায্যে ইংরেজদের হাত ধরেই বাংলা ভাষায় গদ্যের প্রবেশ। তার আগে যা গদ্য লেখা হয়েছে সেগুলোকে গদ্য না বলে গদ্য নামধারী গদ্য-পদ্য-সংশ্লেষ বলাই ভালো। আর কেবল বাঙলা ভাষার কথাই বা বলি কেন? অখণ্ড পৃথিবীর এমন অনেক ভাষাতেই গদ্য সাহিত্যের প্রবেশ এমনই বিলম্বিত। একদিকে সংস্কৃতের ক্ষেত্রে, প্রাচীন পণ্ডিতদের পুথিতে ‘পদ্য আকারে রচিত ইতিহাস ও বিজ্ঞান’ উভয়েরই উল্লেখ যেমন পাওয়া যায়, অন্যদিকে  গ্যেটে অথবা ওমর খৈয়াম সাহেবের কথা বলতে বসলে দিন কেটে যাবে। আসলে ওমর সাহেবকে তাঁর জীবদ্দশাতেই বিজ্ঞানের অবক্ষয় ও ধর্মীয় মৌলবাদীদের উত্থান দেখে যেতে হয়েছিল। বাগদাদের ইসলামি খলিফাদের হাত ধরে আটের শতকে গোটা মধ্যপূর্ব ও  দক্ষিণ ইউরোপীয় দেশগুলিতে যে মুক্তচিন্তা ও শিক্ষা-সূর্যের উদয় ঘটেছিল, খলিফা মুতাওক্কিলের মৃত্যুর পর তা ধীরে ধীরে অস্তমিত হয়। তার নিজের থিওলজি, দর্শনকেন্দ্রিক পড়াশোনা ইত্যাদি নিয়ে একা হাতে যে ক্ষমতা শক্তির সঙ্গে লড়াই করা যাবে না তা বিজ্ঞান-গণিতজ্ঞ খৈয়াম বুঝতেন বলেই নিজের মতো করে তাঁর রুবায়েতের মাধ্যমে সমকালীন বিজ্ঞানমনস্কতাকে নিরাপদে সংরক্ষিত করে রেখে গেছেন। সাজ্জাদ নেকোয়ে ও সেজ্জেদ গোহরাবের  আধুনিক অনুবাদে ওমর সাহেবের এই রুবায়েত দু’টি তার আক্ষরিক প্রমাণ-

“Good and evil, our moral prison,

Joy and sorrow passing like treason.

Fate in the way of logic and reason

Is the victim of far worse treason.”

“I saw a wise man who did not had no regard 

For caste or creed, for faith or worldly greed; 

And free from truth and quest, from path and goal, 

He sat at ease, from earth and heaven freed.”

রুবায়েত লেখনির পর সহস্রাব্দ পেরিয়ে এসেছি আমরা এবং সেই অনুষঙ্গেই বাঙলা সাহিত্যের কবিতায় বিজ্ঞানের জায়গা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। সে পথে ফিরতে গিয়ে প্রথমেই বিস্মিত হতে হয়! যে বালক মাত্র বারো বছর বয়সে “গ্রহগণ জীবের আবাসভূমি” নামক প্রবন্ধ রচনার পর জীবনের শেষ পর্বে এসে পুনর্বার “বিশ্বপরিচয়” নামক বিজ্ঞান সাহিত্য লেখার কথা ভাবতে পারেন, আধুনিক বঙ্গীয় পাঠককে অবশ্যই তাঁর বিজ্ঞান প্রীতির কথা মনে করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আইনস্টাইন, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর, এবং পরবর্তীকালে রাজশেখর বসুর মত তাবড় বিজ্ঞান সাধকদের সঙ্গে কবিগুরুর আলোচনায় কেবলই সাহিত্য, সমাজ চেতনা নয় বিজ্ঞানের নানান কথাও মুহুর্মুহু উঠে এসেছে। 

নৃত্যের বলে সুন্দর হল

বিদ্রোহী পরমাণু,

পদযুগ ঘিরে জ্যোতি-মঞ্জীরে

বাজিল চন্দ্রভানু।

কোয়ান্টাম তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত ওয়েভ-পার্টিকেল ডুয়ালিটির নব্য ছাত্রটি অবধি একঝলকেই কবিগুরুর এই পঙক্তি ক’টির ভাবার্থ দিব্যি ঠাওর করতে পারবে। এছাড়া বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সম্বন্ধে তাঁর উচ্চ ও সশ্রদ্ধ ধারণার কথা আমরা ‘প্রশ্ন’ কবিতায় স্পষ্ট খুঁজে পাই যেখানে কবি লেখেনঃ

চতুর্দিকে বহ্নিবাষ্প শূন্যাকাশে ধায় বহুদূরে,

কেন্দ্রে তার তারাপুঞ্জ মহাকাল চক্রপথ ঘুরে।

কত বেগ, কত তাপ, কত ভার, কত আয়তন,

সূক্ষ্ম অঙ্কে করেছে গণন

পণ্ডিতেরা লক্ষ কোটি ক্রোশ দূর হতে

দুর্লক্ষ্য-আলোতে।

এমনই নানান গান ও কবিতায় নিজের বিজ্ঞান বিষয়ক জ্ঞান ও দার্শনিক মননকে ব্যবহার করেছেন কবি। শুধু দর্শনই বা বলি কীভাবে?

“নমো যন্ত্র, নমো যন্ত্র, নমো যন্ত্র, নমো যন্ত্র!

তুমি চক্রমুখরমন্দ্রিত, তুমি বজ্রবহ্নিবন্দিত …”

লাইন দু’টিতে যন্ত্র তথা ব্যবহারিক বিজ্ঞানের প্রতি কবির আসক্তির সত্যতাও প্রমাণিত হয়! কবিতায় জ্যোতির্বিদ্যা এবং বিজ্ঞান প্রসঙ্গে রবীন্দ্র সমসাময়িক আরো এক বাঙালী কবির উল্লেখ এখানে না করলেই নয়। অক্ষয়কুমার বড়ালের লেখনী সর্বত অর্থেই ‘ইন্টারস্টেলার’। সতেরো বছর বয়সী অক্ষয়কুমারের কিশোর কবিতাগুলিতেই বিজ্ঞানমনস্কতা ও কসমিক স্পিরিচুয়ালিটির স্পষ্ট ছাপ পাওয়া যায়, যেমন ‘প্রদীপ’ কাব্যগ্রন্থের ‘গীতি-কবিতা’র লাইন ক’টিঃ

“ক্ষুদ্র-বৃষ্টিকণা-বলে

সপ্ত পারাবার চলে;

ক্ষুদ্র বালুকায় গড়ে নিত্য মহাদেশ;”

ভাবতে অবাক লাগে মাত্র সপ্তদশ বছরের মননে স্রষ্টা ও সৃষ্টির একান্নবর্তী ব্রহ্মতত্ত্ব কি সহজেই ধরা পড়ে যায়! একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে যৌবন উত্তীর্ণ অক্ষয়কুমারের কলম পরবর্তীকালে এমনই বহু বিজ্ঞানমনস্ক লেখনী বঙ্গসাহিত্যকে উপহার দিয়েছে। সে লেখায় যেমন জৈবিক বিবর্তনবাদ, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের একান্নবর্তী অস্তিত্ব ইত্যাদির মতো বৃহৎ দর্শনের জায়গা হয়েছে, তেমনই স্থান পেয়েছে মহাশূন্যের নীহারিকার কথাঃ

“তারকা ছুটিছে দশদিকে!

মহাশূন্য পূর্ণ আজি

সুকোমল তরল কিরণে!

ঘুরে গ্রহ-উপগ্রহরাজি”

অথবা বৈজ্ঞানিক অণুবীক্ষণ পদ্ধতির প্রতি তার গভীর প্রণয়ের বার্তাঃ

“মনে হয়, -বসিয়া গম্ভীরে,

জগতের প্রতি শিরে শিরে

চালাইতে ছুরী;

ছিন্ন-ভিন্ন তন্ন-তন্ন করি’

প্রতি অণু-পরমাণু ধরি’

দেখি কি চাতুরী!”

এতো গেল গম্ভীর দর্শনের কথা। কিন্তু বিজ্ঞান তো কেবলই গুরুগম্ভীর চর্বিতচর্বন নয়, তাতে মজা আছে, আনন্দ আছে আর আছে একরাশ ঝকঝকে কল্পনার সংমিশ্রণ। আর কল্পজগতের আবর্তে যেমন বিজ্ঞান আসে, তেমনই আসে ছড়া ও কবিতা। হে সর্বজ্ঞ পাঠক, আপনি ঠিকই ধরেছেন, সুকুমার প্রসঙ্গের কথা আমি মোটেই এড়িয়ে যাইনি, আপনাকে কেবল একটু ধৈর্য ধরে বসিয়ে রেখেছি মাত্র। সুকুমার রায়ের লেখায় বিজ্ঞান, বিজ্ঞানমনস্কতা ও কল্পবিজ্ঞানের অনুষঙ্গ নিয়ে কথা বলতে বসলে অকুল পাথারে পড়ে যেতে হয় বৈকি! আমাদের নিতান্ত সৌভাগ্য এই স্বল্পপরিসরে আমরা কেবলই কবিতার কথা বলতে বসেছি। “হাতুড়ে” কবিতাটা মনে পড়ে?

“শুয়ে কেরে? ঠ্যাং ভাঙা? ধরে আন্ এখেনে-

স্ক্রুপ দিয়ে এঁটে দেব কিরকম দেখেনে,-”

একমাত্র এক বিদগ্ধ বিজ্ঞান-রসিকই দু লাইনে মজার ছলে ডাক্তারি ও ইঞ্জিনিয়ারিং-কে মিলিয়ে দিতে পারেন। একই ভাবে “বিজ্ঞান শিক্ষা” কবিতায় দুই লাইনের মশকরায় ভেক্টর-অ্যানালিসিস, নিউটোনিয়ান মেকানিক্স, অপ্টিক্স ও ম্যাগ্নেটিজমের মত প্রায়োগিক ফিজিক্সের দিকগুলোও উঠে আসে তাঁর লেখায়ঃ

“মুণ্ডুতে ‘ম্যাগনেট্’ ফেলে, বাঁশ দিয়ে ‘রিফ্লেক্ট’ ক’রে

ইট্ দিয়ে ‘ভেলসিটি’ ক’ষে দেখি মাথা ঘোরে কি না ঘোরে।”

অন্যদিকে কল্পবিজ্ঞানে আবোল তাবোলের জুড়ি মেলা ভার। ‘কিম্ভুত’, ‘ট্যাঁশগরু’র মতো তেমন অদ্ভুত জৈবিক এ্যামালগ্যামেশান টলকিয়েনের সিলম্যারিলিওন বা এক্কেবারে হালের গেম অফ থ্রোনজেও পাওয়া যাবে কিনা খুঁজে দেখতে হয়। কিন্তু এত কিছুর পরেও যে কথাগুলো সুকুমার বিরচিত কবিতার ক্ষেত্রে এক বিজ্ঞানী মননকে নাড়িয়ে দিয়ে যায় তা হল সে কবিতার বিজ্ঞানমনস্কতা বা সায়েন্টিফিক টেম্পার। ‘হাত গণনা’ ও ‘গন্ধবিচার’ কবিতাদু’টি এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘হাত গণনা’য় “ও পাড়ার নন্দ গোঁসাই, আমাদের নন্দ খুড়ো”কে ঠিকই “দেখা যেত সদাই তারে হুঁকো হাতে হাস্যমুখে”, তবে যেদিনই হাত গণনার মতো অবৈজ্ঞানিক অন্ধবিশ্বাসের দৌলতে তিনি জানতে পেলেন- “…ঘাড়ে আছেন শনি, ফাঁড়ায় ভরা আয়ুর রেখা”, সেদিন থেকেই আমরা দেখলাম “বুড়ো আছে নেইকো হাসি, হাতে তার নেইকো হুঁকো।” এছাড়াও যে কবিতা দিয়ে সুকুমার প্রসঙ্গ শুরু করেছিলাম সেই ‘হাতুড়ে’ কবিতায় কবি যখন লেখেন,

“ছেলে হও, বুড়ো হও, অন্ধ কি পঙ্গু,

মোর কাছে ভেদ নাই, কলেরা কি ডেঙ্গু”

তখন চিকিৎসা বিজ্ঞানের হাত ধরে জাত-পাত-ধর্ম অতিক্রম করে মানুষের যাপন হয়ে ওঠে একান্নবর্তী। এই লাইন দু’টির তুলনায় বিজ্ঞানমনস্ক সমাজবাদের বৃহত্তর উদাহরণ সমগ্র কাব্য ইতিহাসে পাওয়া যাবে কিনা সে বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

*

এ তো গেল কবির মননে বিজ্ঞান চেতনার কথা। 

বৈজ্ঞানিকরাই বা কাব্যচেতনায় কম যান কীসে? সে কথা অবশ্যি এ নিবন্ধের বাঁকে মাঝেসাঝে উঁকি মেরেছে ঠিকই, তবে সুকুমার প্রসঙ্গ উত্থিত হওয়ার পর গদ্যরাজ, রসরাজ এবং রসায়ন-আচার্য রাজশেখর বসুর দু-একখানা কবিতার কয়েক লাইন এখানে উদ্ধৃত করতেই হয়। 

“অনন্তের কোলে রহিগো আমরা, অনন্ত হইতে এসেছি চলে।

অনন্তে আবার ফিরে যাব মোরা, বারেক হেরিয়া সুনীল জলে।”

(নাবিক)

অথবা,

“রচিনু যতনে কুসুমের হার

বসি নদীতীরে বিপটীতলে

ফুলহার লয়ে ফিরিনু আবার

পরাতে সে মালা কাহার গলে।।”

(শেলীর The Question হইতে অনুকৃত)

কবিতাংশগুলোতে এক বৈজ্ঞানিক মনের মানব-অস্তিত্ব-দর্শন এবং প্রেম- উভয়ই সমান দৃশ্যমান। এছাড়া পরশুরামের কবিতায় যে হাস্যরসের উপস্থিতি সমপরিমাণে থাকবে তা তো বলাই বাহুল্য। ‘জামাইবাবু ও বউমা’ নামক  কবিতার নীচে কবির নামের জায়গায় একমাত্র পরশুরামই লিখতে পারেন ‘By a Veteran’, এবং জামাই যাদু বাছাধনের নিজের কথায় তাঁর বিজ্ঞান বিমুখতার পরিচয়ে জানানঃ

“কোথাকার এক বাঁকা প্যারাবোলা

ফোকাস্ কোথায় জানে কোন শালা?

হাইপার বোলা খাক্ কাঁচকলা

মরুক এলিপ্স ঘোড়ার ডিম্।

BaCl2+K2SO4

এ সকল পড়ে কিবা লাভ মোর

ফিজিক্স্ কেমিস্ট্রী পড়ে গুলি খোর

ফিজিক্স্ তেঁতুল কেমিস্ট্রী নিম।“

***

“…বৈজ্ঞানিকের পন্থা স্বতন্ত্র হইতে পারে কিন্তু কবিত্ব সাধনার সহিত তাহার সাধনার ঐক্য আছে।…”

এখন প্রশ্ন ওঠে যে কাব্য সাহিত্যে বিজ্ঞানের এমনই প্রোজ্জ্বল উপস্থিতি, এই উত্তরাধুনিক সময়ে আমরা তবে কবিতায় তাকে এড়িয়ে চলি কেন? কবি; প্রেম, জীবন বোধ, রাজনীতি, ইত্যাদি যেমন আমাদের দৈনন্দিন অঙ্গ হিসাবে আপনার কবিতার সর্বত্র আনাগোনা করে, তেমনই বিজ্ঞান ছাড়াও কি আমাদের এই আধুনিক যাপন কি একেবারেই সম্ভব? এ কথা সত্য যে কবিতা ও বিজ্ঞানে মানব অস্তিত্ব অবোলকনের পদ্ধতিগত পার্থক্য রয়েছে। কবি ঢেউয়ের তোয়াক্কা না করেই সত্য অবলোকনের দার্শনিক মানসের আকুল পাথারে নিমজ্জিত হন, তাঁর নিজের মতো করে সত্য-দুর্গ নির্মাণের সুযোগ থাকে বটে, কিন্তু সে নির্মাণে মিথ্যাচারের সুযোগ নেই; “…-এজন্য তিনি সত্যদ্রষ্টা”। সে যজ্ঞবেদীর আঁচ তাঁর দেহ, মনন পোড়াবেই; দৈনন্দিন হিসেব নিকেশ পেরিয়ে এই ক্ষতচিহ্নই তাঁর জন্মদাগ হয়ে ওঠে।  অন্যদিকে বিজ্ঞানী তাঁর সুনিপুণ অণুবীক্ষণ ক্ষমতাকে হাতিয়ার করে প্রত্যকটি ঢেউয়ের চুলচেরা বিচারের মাধ্যমে সত্যের দরবারে পৌঁছতে চান- কখনও সখনও হয়তো খুব কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারেনও, তবে বাকি “ইনফিনিটেসিমাল” দূরত্বটুকু মেটানোর বন্ধুর কঠিন পথটাই তার একাকিত্বের একমাত্র সাথি। সে পথের হদিশ জনমানসের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ ভাষার জাদুমন্ত্র তার জানা নেই। “…যজ্ঞবেদী ছাড়িয়া বিজ্ঞানীরা মন্দির স্থাপন করিয়াছেন তাঁহাদের গবেষণাগারে।…”। কাজেই দু’জনেই অখণ্ড সত্যের খোঁজে পথ চলেছেন- কবি সত্য-স্বপ্নে বিভোর হয়েছেন পথের কথা ভুলেছেন, বিজ্ঞানী পথের নেশায় পথ ভুলেছেন; গন্তব্য একই। আমাদের প্রাচ্য দর্শনে সে সত্যের বহু নাম, তাকে ছুঁতে চাওয়ার রাস্তাও বহু। তাল-তমাল বলা হোক বা ঘাস-বাঁশ বলা-ই হোক, বৃক্ষ সত্য; নাম নয়। আদি কবি যেমন বলেন-

“…সেই সত্য যা রচিবে তুমি

ঘটে যা তা সব সত্য নয়।”

কাজেই এই যে বিজ্ঞান ও কবিতাকে আলাদা করে ভেঙে দু’টুকরো করে দেখার মানসিকতা এ সমস্যা আমাদের মজ্জাগত নয়, এ অ্যালিয়েনেশান আমরা স্বেচ্ছায় আধুনিকতার নামে আমদানি করেছি। এমন দেওয়াল ভাঙার প্রয়োজনীয়তা এ নিবন্ধের বিদগ্ধ পাঠক নিতান্তই বোঝেন, কাজেই সে দায়িত্ব কবি ও বিজ্ঞানীদের উপর বর্তায়। অজয় রায় অবশ্য সে কাজটি বিগত দশক ধরে চেষ্টা করে চলেছেন, তবে তেমন নাম আর বিশেষ পাওয়া যায় কই? শুনতে পাই বঙ্গদেশে “বিজ্ঞান কবিতা” নামক এক আন্দোলনের উদ্ভব হয়েছে। সে বড় সুখের কথা বটে, তবে বিজ্ঞান কবিতা অর্থে কি বিজ্ঞান বিষয়ক কবিতা? নাকি কবিতা বিজ্ঞানের মাধ্যমে বিজ্ঞানমনস্কতাকে দেখার চেষ্টা- তা জানতে বড় ইচ্ছা করে। কবি, বিজ্ঞানী উভয়কেই বলি- আসুন না বরং তাকে খুজে দেখার চেষ্টা করি, যদি আরো কোনো রাস্তা তৈরি হয়? বঙ্গসাহিত্যে কবিতার “সর্বভুক পাঠক হাঁ করিয়া আছেন…”, বিজ্ঞানমনস্কতায় আধুনিক কবি ও বিজ্ঞানীরা একবার মিলে মিশে গেলেই হল, কবি যে সত্য-অট্টালিকা অবলোকন করবেন, বিজ্ঞানী তাঁর পর্যবেক্ষণে সে অট্টালিকার ভিত গড়ে দেবেন অল্প অল্প করে, আর “…সেই অনির্বচনীয় অনুভূতি কবি ভাষার ইন্দ্রজালে পাঠক মনে সঞ্চারিত…” করবেন। এই পৃথক পৃথক দেওয়াল তুলে একই সত্যকে বিভক্ত করায় কী বা লাভ? 

“…অসহ্য এই মানুষের অপূর্ণতা…”

***

বিঃ দ্রঃ প্রত্যেকটি পরিচ্ছেদের শুরুর কোটেশানগুলো আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর “কবিতা ও বিজ্ঞান” প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া রাজশেখর বসুর “ঘনীকৃত তৈল”, এবং বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার “কাব্য ও বিজ্ঞান” প্রবন্ধ দুটি থেকেও বেশ কিছু কোটেশান এই নিবন্ধে ব্যবহৃত হয়েছে। নিবন্ধের শেষের উদ্ধৃতিটি জগদীশচন্দ্র বসুর লেখা “বিজ্ঞানে সাহিত্য অদৃশ্য আলোক” প্রবন্ধ থেকে গৃহীত।

আরও পড়ুন...