শারদ অর্ঘ্য ১৪২৮ । বিশেষ রচনা
হিন্দু দেবদেবীদের মধ্যে দেবী দুর্গা এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। প্রাচীন কাল থেকেই ভারতীয়দের মধ্যে এই দুর্গার আরাধনা প্রচলিত। প্রাচীন হরপ্পা সভ্যতার কালিবঙ্গান অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত শিলমোহরে দেবীর মূর্তি খোদিত আছে। হিন্দুদের বিশ্বাস, দেবীদুর্গা মাতৃরূপে আমাদের সবরকম আপদ-বিপদ থেকে রক্ষা করে থাকেন। তিনি দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে অসুর বধ করে তিনি ধরাধাম অসুর মুক্ত করেছেন। বিপদে আমরা বিপত্তারিণী মা দুর্গাকেই স্মরণ করে থাকি। বাড়ি থেকে কোথাও বেরনোর সময় দুর্গা নাম স্মরণ আমাদের একটি অতি প্রাচীন ঐতিহ্য। আসলে দেবী দুর্গা হলেন পজিটিভ শক্তির আধার (Prime Energy)। তিনিই আদ্যাশক্তি। মাতৃরূপে তিনি রক্ষা করেন আর কালীরূপে তিনি ধ্বংস করেন। তাঁকে ঘিরেই আমাদের শক্তির কল্পনা।
‘দেবী মাহাত্ম্য’ ও ‘দেবী ভগবত পুরাণ’–এর মূল চরিত্র এই দেবী দুর্গা। যদিও বৈষ্ণব ও শৈব ধর্মেও তাঁর উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে। এই ‘দুর্গা’ শব্দটির উৎপত্তি ‘দুর্গ’ আর ‘গম’ থেকে। অর্থাৎ দুর্গম— মানে যাকে পেরিয়ে যাওয়া কঠিন। দুর্গাকে কখনও জয় করা যায় না। তিনি অজেয় শক্তির অধিকারিণী।
দেবী দুর্গার আবির্ভাব ষষ্ঠ শতাব্দীতে। হরপ্পা সভ্যতায় কালিবঙ্গান অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত শিলমোহরে যেমন এই মূর্তির নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে, ঠিক সেইরকমই তৈত্তিরীয় আরণ্যকে দেবী দুর্গাকে ‘দুর্গি’ নামে সম্বোধন করা হয়েছে। মার্কন্ডেয় পুরাণে মহিষাসুরকে বধ করার জন্য তাঁকে মহিষাসুরমর্দিনী বলা হয়েছে। অসুর বধের জন্যই দেবীর সৃষ্টি। দেবতারা তাঁকে বিভিন্ন অস্ত্রে ও সজ্জায় সজ্জিত করে অসুর বধের নিমিত্ত যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণ করেছিলেন। যুদ্ধের নবম দিনে অসুর বধ হয়। এই সময় দেবী নয়টি রূপ ধারণ করেছিলেন। দেবীর এই নয় রূপ হল যথাক্রমে – শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘণ্টা, কুষ্মাণ্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রি, মহাগৌরী এবং সিদ্ধিদাত্রী। একত্রে নবদুর্গা।
ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে নবরাত্রি পালন করা হয়ে থাকে। দেবীপক্ষে ষষ্ঠীর দিন দেবীর বোধন হয়। সপ্তমীতে নবপত্রিকাকে স্নান করিয়ে মন্ডপে স্থাপন করা হয় ও মূলপুজো শুরু হয়। দেবীর পুজো মূলত তান্ত্রিক মতে হয়, তবে অনেক জায়গায় বৈষ্ণব মতেও পুজো হয়ে থাকে। এখানে ‘নবপত্রিকা’র একটা ব্যাখ্যা রইল স্বল্প পরিসরে। ভালো ফসল এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় বর্ষণ, জমির উর্বরতা, সব কিছুই নবপত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে এই ফসল পুজো লক্ষ্য করা যায়। যজ্ঞ হবে, অগ্নির ধোঁয়ায় মেঘের সৃষ্টি হবে। বারিবর্ষণ হবে। এরপর জমি তৈরী হবে এবং উত্তম ফসল ফলবে। মাতৃপুজোর সঙ্গে এই বিশ্বাস বহু যুগ ধরে চলে আসছে। ন’টি গাছকে একত্রে শ্বেত অপরাজিতার ডাল আর হলুদ সুতোয় বাঁধা হয় কলাগাছের সঙ্গে। নয় রকম গাছ এখানে মায়ের বিভিন্ন রূপ ও অন্য দেবদেবীদের প্রতীক। প্রথমেই বলতে হয় বেল পাতার কথা— এই গাছ শিবের প্রতীক। অশোকের ডাল— শোকহরিতা, ধান গাছ— লক্ষ্মীদেবী, কলাগাছ— দেবী ব্রাহ্মণী, কচু গাছ— দেবী চামুন্ডা, হলুদ গাছ— দেবী দুর্গা, বেদানা— দেবী রক্তদন্ডিকা, জয়ন্তি— কার্তিকি এবং মান কচু— দেবী কালিকার প্রতীক। এই নবপত্রিকাকে নতুন কাপড় পরিয়ে দেবীর দক্ষিণ দিকে গণেশের পাশে বসানো হয়।
বাংলায় দেবীর যোদ্ধৃরূপ ছাড়াও আরও একটি রূপ আছে— তা হল কন্যারূপ। দুর্গা এখানে মেনকা ও হিমালয়ের কন্যা পার্বতী বা আমাদের আদরের উমা। আশ্বিন মাসে উমা তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসেন পিত্রালয়ে । তাঁর চার ছেলেমেয়ে হলেন লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক আর গণেশ। দশভূজার মূর্তির সঙ্গে এখানে থাকে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশের মূর্তিও। মহালয়ার দিন থেকে দেবীপক্ষের সূচনা হয় আগমনী গানের মাধ্যমে। বিজয়া দশমীতে মাকে সিঁদুর পরিয়ে, মুখে মিষ্টি ও পান সুপারী দিয়ে বিদায় জানানো হয়। ঐ দিন অনেকে মায়ের ভোগে কচুর শাক, ইলিশমাছ, পান্তাভাতও দিয়ে থাকেন। ঘরের মেয়েকে হৃদয় উজাড় করে ভালোবাসা জানানোর প্রতীকী ব্যাপার আর কি! আর এই উৎসবকে কেন্দ্র করে পারিবারিক মিলনের ঘটনাও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। দেশ বিদেশ থেকে প্রত্যেকেই এই ক’টা দিনের জন্য ফিরে আসার চেষ্টা করেন তাঁর পরিবারের কাছে।
মা দুর্গার এই রূপের পুজো হয় বাংলা, ওড়িষা, ঝাড়খন্ড, বিহার, নেপাল, ভুটান, সিকিম সহ পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। এই উৎসবকে আমরা যেমন বলি ‘শারদীয়া’। নেপালে তেমন পরিচিত ‘ডাশেন’ নামে। আবার ‘দশেরা’ হিসাবে পালিত হয় কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ুতে। রাজস্থানে এই উপলক্ষে অস্ত্র ও অশ্বের পুজো হয়ে থাকে। দেবী দুর্গার মাতৃমূর্তি আমাদের বহু কঠিন কাজের প্রেরণা দিয়ে থাকে। যেমন— ভারতমাতার মূর্তি। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আরাধ্যা ছিলেন তিনি। ভারতমাতার মূর্তি দেবী দুর্গারই অন্য এক রূপ। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম’ গানটির অনুপ্রেরণাও ছিল এই মাতৃরূপ। দুর্গার একটি আদিমরূপেরও সন্ধান পাওয়া গিয়েছে কিছু আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে বিশেষ করে হিমালয় ও বিন্ধ্য পর্বতের পার্বত্য অঞ্চলে। এই অঞ্চলের ‘আভির’ উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষেরা যুদ্ধের দেবী হিসাবে যে দেবীর পুজো করে থাকেন তিনি দেবী দুর্গা ছাড়া আর কেউ নন। ষষ্ঠ শতাব্দীর মৌখরি যুগের (Maukhari) শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে নাগার্জুন পাহাড়ের একটি গুহায়। সেখানে সিদ্ধমাত্রিকা লেখনীতে দেবীর মহিষাসুর জয়ের বর্ণনা আছে। পর্তুগীজ নাবিকেরা মালাবার উপকূলে, বিশেষ করে কালিকটের হিন্দু রাজা জামোরিন-এর প্রাসাদের অভ্যন্তরে অবস্থিত মন্দিরে দেবী দুর্গার মূর্তির অধিষ্ঠান দেখেছিলেন বলেও উল্লেখ পাওয়া যায়।
ভারতবর্ষের বাইরে ইন্দোনেশিয়ায় বিশেষ করে জাভাতে প্রায় ১৩৫টি দুর্গামূর্তির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, যা ওখানে লোরো জনগ্রাং (Loro Jonggrang) নামে পরিচিত। আবার কম্বোডিয়ার হিন্দু রাজার আমলে দুর্গার মূর্তিকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল মহিষের কাটা মাথার উপর। ভিয়েতনামেও কিছু প্রাচীন পাথরের মন্দিরে দুর্গার প্রাচীন মূর্তির নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে যা চাম রাজ্যের সময় পূজিত হত।
এককথায় দেশ ও কালের গণ্ডি ছাড়িয়ে দেবী দুর্গা হলেন এক চিরন্তন পজিটিভ শক্তির উৎস। তিনি যুদ্ধের প্রতীক। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন তাঁর ধর্ম। একদিকে তাঁর যোদ্ধৃরূপ, অন্যদিকে তিনি শান্ত, সমাহিত, রক্ষাকর্ত্রী এবং মা— দশহাতে অস্ত্রধারণ করে সন্তানকে সমস্ত অশুভ’র থেকে আগলে রেখেছেন যুগ যুগ ধরে। দুর্গা শুধুমাত্র একজন যোদ্ধানারী নন। তিনি নারীশক্তির জাগরণেরও প্রতীক। এখানে একটি সামাজিক বার্তার ইঙ্গিতও রয়েছে। বলতে পারা যায় ‘Faminine Social Balance in Hinduism.’ আসুন আমরা সকলে বীজমন্ত্রে আহ্বান জানাই তাঁকে— ‘ওঁ দুং দুগায়ৈ দিব্যহ নমঃ’।