Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

শারদ অর্ঘ্য ১৪২৮ ।  গল্প

রি প ন   হা ল দা র

বন্ধুর গল্প

pic1

-আমন! আমাকে বাঁচা ভাই! এরা আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছি না! সপ্তাহখানেক আগে কোনো এক বন্দর থেকে নামার পর সেই যে গাড়িতে ওঠাল আর থামার নাম নেই। গাড়িতে যখন প্রথম উঠি চারদিক কালো কাঁচে ঢাকা ছিল। বাইরের দৃশ্য তাই কিছুই সেভাবে দেখতে পারিনি। আমি যখন ওদের জিজ্ঞাসা করলাম আমাকে আপনারা কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? প্রথমে কেউ কিছু বলেনি। পরে একজন বলল, হেড অফিসে। আমি বললাম, আপনারা বলেছিলেন হেড অফিস মুম্বাইয়ে। এখানে কেন আনলেন? তারপর কেউ আর কোনো উত্তর দেয়নি। গাড়ি চলছে তো চলছেই। কিছুক্ষণ পর পিছন থেকে কেউ এসে আমার মুখ চেপে ধরল। মুখের উপর আটকে দিল তীব্র আঠাযুক্ত সেলোটেপ। গাড়িটা তখন শহর ছাড়িয়ে বালির এলাকায় ঢুকল। এটুকুই দেখতে পেরেছিলাম। তারপর কেউ পিছমোড়া করে আমার হাতদুটো বেঁধে ফেলল। মুখে তো আগেই সেলোটেপ লাগানো ছিল। শেষ পর্যন্ত মাথার উপর দিয়ে টুপির মত কিছু একটা গলা পর্যন্ত নামিয়ে দিল। কিছুই বুঝতে পারছি না আমন আমার কী হবে! মেরে ফেলবে না তো আমাকে!

-কোন বন্দর নামটা বলতে পারবি? না পারলেও কোনো অসুবিধা নেই। কিচ্ছু ভাবিস না তুই। আমরা ঠিক তোকে ট্রেস করতে পারব। আমি চেষ্টা করছি পুলিশকে বোঝাতে। খুব তাড়াতাড়ি তোকে আমরা ছাড়িয়ে আনব।

 

(তিন মাস আগে)

 

-অপু, জানি মনের মতো চাকরি পাসনি। কী আর করবি! আমারও তো একই অবস্থা! মানিয়ে নেওয়া ছাড়া আর কীই বা করার আছে! এই পৃথিবীতে নেই কোনো উৎকৃষ্ট চাকুরি।

-লাইনটা শোনা শোনা লাগছে!

-হবে হয়ত জীবনানন্দ বা অন্য কেউ!    

-আজ ব্যাঙ্গালোর, কাল দিল্লি। সেলস এক্সিকিউটিভ। হা হা… খারাপ হবে না খুব বল? খুব ঘোরাঘুরি করা যাবে!

-এই দিক দিয়ে তুই কিন্তু লাকি!

-বলতে পারিস।

-আপাতত হাজার তিরিশের মত দেবে। পরে বাড়বে আরো।

-ভালো করেছিস! টাকাপয়সারও দরকার আছে জীবনে। এদিকে এখানে কী হয়েছে জানিস? এরপর যখন আমাদের বাড়ি আসবি আমরা ঝিলপাড়ে রাত কাটাব। আমাদের বাড়ির পাশের সেই প্রিয় মথুরা ঝিল! ওখানে ওভার ব্রিজ হয়েছে, জানিস তো! পুরো জায়গাটাই পালটে গেছে। দেখলে চিনতে পারবি না। ওখানে এখন একটা পার্কও হয়েছে! কোলকাতার একটা কম্পানি পুরো ঝিলপাড় জুড়ে পিকনিক স্পট, রিসর্ট বানিয়ে ভরতি করে ফেলেছে।

-বাহ্‌! চমৎকার ব্যাপার স্যাপার! অল ফর সেল!

-ঠিকই ধরেছিস! মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ল বলে!

-মানুষ তো পৃথিবীকে ধ্বংস করার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে! স্বর্গ থেকে যেদিন পৃথিবীতে নির্বাসিত হয়ে এল তারপর থেকেই তো শুরু হয়েছে পৃথিবীর পতন। আচ্ছা, মোশাররফ সাহেবের নাটক এখনো দেখিস? তুই আমি মোবাইল ইয়ারফোন ভাগাভাগি করে দ্যাখা। আহা, সেইসব দিন!

-চাকরি পাবার পর সেভাবে তো সময় পাই না। তবে ট্রেনে যাওয়া আসার সময় মাঝেমাঝে দেখি। তুই ছবি আর আঁকিস না, না?

-কবে চুকেবুকে গেছে! কলেজ পাস করেই তো ঢুকে গেলাম এই কাজে! জানিসই তো সব। রঙতুলি আর আমায় টানে না। ওরা আমাকে ত্যাজ্য করেছে। তোর কাছে যে ছবিগুলো আছে পারলে পুড়িয়ে ফেলিস!

-পাগল! ম্যাক্স ব্রড হবার সুযোগটা ছাড়ি!

-কাফকার সঙ্গে তুলনা করলি! ভালো ব্যাজস্তুতি। ভাবছি ওঁর সমাধিতে গিয়ে কিছুটা ধুলো এনে কাছে রাখব।

-হুম্‌! মূর্তিপূজা? তুই না এর বিরোধী?

-তা ঠিক! কিন্তু মাঝেমাঝে কাউকে ইচ্ছা করে মূর্তির চেয়েও বেশি কিছু বানিয়ে মনের মধ্যে পুরে রাখি। বাদ দে আমার কথা। তোর কথা বল!  

    

(ছয় মাস আগে )

 

-অপু! তুই কোথায় এখন?

-মুম্বাইয়ে। গত সপ্তাহে এখানে এসেছি।

-কেমন লাগছে?

-এককথায় দারুণ! যতই ধারাবি ধারাবি করি, জায়গাটায় প্রাণ আছে।

-কিন্তু ভাব একটা শ্রেণি নির্লজ্জ ভাবে সম্পদ গুছিয়ে নিচ্ছে, আর একটা শ্রেণি…

-বাদ দে তো তোর কমিউনিজম!

-ঠিক। মার্ক্স তো বাদ এখন!

 

(এক বছর আগে)

 

-আচ্ছা আমন! আমরা যেভাবে কথা বলি তা কীভাবে আমাদের কানে আসে?

-কেন বায়ুর ইথার তরঙ্গের মাধ্যমে!

– কিন্তু যখন দূরে যাই তখন কীভাবে?

-তখনও ইথার তরঙ্গের মাধ্যমেই কাজ হয়।

-দূরে বলতে অনেক দূরের কথা বলছি। ধর অন্য শহর বা রাজ্য!

-তখন তো সরাসরি কথা বলা সম্ভব না! কোনো যন্ত্রের প্রয়োজন হবে।

-ভাব তো যন্ত্রেরও প্রয়োজন হল না!

-সেটা কী করে সম্ভব?

-দ্যাখ, শেষ পর্যন্ত শব্দগুলো আমাদের মস্তিষ্কেই তো পোঁছায়, তাই তো? সেদিন একজায়গায় পড়লাম আমাদের মস্তিষ্কের হাজার হাজার নিউরোন নাকি অন্য মস্তিষ্কের নিউরোনের সঙ্গে নিজে থেকেই যোগাযোগ তৈরি করে। সেই কারণেই নাকি আমরা একে অন্যের কথা অনেক সময় না বললেও বুঝতে পারি! মানুষের ক্রিয়েটিভ থট নাকি এই কারণেই একে অন্যের সঙ্গে মিলে যায়। তাদের মধ্যে কোনোরূপ যোগাযোগ ছাড়াই! ধর, এমন এক ন্যাচারাল উপায় বের করা গেল যাতে কোনো যন্ত্র ছাড়াই আমরা পরস্পরের কথা বুঝতে পারলাম!

-তুই কি টেলিপ্যাথির কথা বলছিস?

-হতে পারে। কিন্তু আমরা এটা সম্পূর্ণ আমাদের মতো করব। এমন ভাবে যেন এটা সবাই নিজেদের জীবনে ইউজ করতে পারে। অনেকটা অদৃশ্য অ্যাপের মত। কিন্তু এখনি কাউকে কিছু বলবি না!

-পাগলামিটা বেশি হয়ে যাচ্ছে না, অপু?

-এই পৃথিবীর রহস্যকে নতুন করে জানতে হলে কিছু পাগলেরই দরকার আমন!

-দেখিস আবার কোনো বিপদ ঘটাস না!

-আরে একবার শুনেই দেখ না!

-আচ্ছা বল্‌!

-শোন তাহলে। এখন এই মুহূর্তে তুই কী ভাবছিস বল তো?

-আমি ভাবছি কীভাবে ব্যাপারটা সম্ভব?

-এক্স্যাক্টলি! আমি এটাই অনুমান করছিলাম যে তুই এটাই ভাবছিস! এই ব্যাপারটাকেই আরো এক্সপ্যান্ড করা যায় না?

-খোলসা করে বল তো আমাকে তুই ঠিক কী বলতে চাইছিস?

-চোখ বোজার পর আমাদের মধ্যে ভাবনা বেশি কাজ করে, এটা তো বুঝিস?

-ঠিক।

-তাহলে চোখ বোজার পর যখন তন্দ্রার মত ভাব আসবে তখন কিন্তু ভাবনার অন্য স্তর সৃষ্টি হয়! তখন আরো গভীর ভাবে ভাবতে সক্ষম হয় আমাদের মন-মস্তিষ্ক। আমরা এই অবস্থাটাতেই কাজ করব।

-কী বলছিস তুই এসব?

-আমরা নতুন কিছু আবিষ্কার করতে যাচ্ছি!

-সত্যিই কি বাস্তবে সম্ভব এটা?

-দেখাই যাক! আচ্ছা, তুই এমন কিছু ভাব তো চোখ বুজে যা আমার পক্ষে এই মুহূর্তে অনুমান করা অসম্ভব?

-উমম্‌। ভেবেছি। বল এবার!

-ওয়েট এ মিনিট ব্রাদার! লেটস ফিল দ্যা মিরাকল্‌।

মিনিট দুই তিন অপু চোখ বুজে মাথা নিচু করে থাকল।

আমি অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম- কী হল বৈজ্ঞানিক?

-ডিসটার্ব করিস না! ভাবতে দে! তুই এখনো চোখ বুজে আছিস তো?

-অবশ্যই!

-ডান্‌! তুই ভেবেছিলি সুমনার কথা!

-ধুর! এটা যে কেউ বলতে পারত! খুব সহজ ছিল।

-তুই আমার পরিশ্রমের কোনো মূল্যই দিলি না! ঠিক আছে। এবার আরেকটা বিষয় ভাব! কঠিন কিছু।

-ওক্কে।… ভেবে ফেলেছি! বল এবার!

-দাঁড়া! একটু সময় দে! চোখ খুলবি না কিন্তু! পারলে ঘুমিয়ে পড়! আবার নাক ডাকা শুরু করিস না!

-কী যে শুরু করেছিস!

-প্লিজ আমন!

-ওকে! জ্বালাতেও পারিস তুই! উদ্ভট ব্যাপার যতসব! এই শুয়ে পড়লাম। পারলে তুইও টান হ! এসেছি সমুদ্রে বেড়াতে। আর তুই কী শুরু করলি!

-কথা বলিস না বেশি।

-ওকে! তুই শুবি না?

-তার প্রয়োজন হবে না! আমি চেয়ারেই কমফোর্ট ফিল করছি। তুই আর কথা বলিস না! ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা কর! যতক্ষণ না আমি বলি চোখ খুলবি না বা বিছানা থেকে উঠবি না!

এক দুই তিন চার পাঁচ… সাত মিনিট পেরিয়ে গেল। আমি মনে হয় সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছি। চারপাশটা আগের থেকে অদ্ভুত ভাবে বদলে যাচ্ছে। নীরব ঝুম নীরবতা আমাকে আরাম দিচ্ছে। যদিও আমার ধারণা নিশ্চয় আমি কোনো স্বপ্ন দেখছি না! আবার গভীরভাবে ঘুমিয়েও পড়িনি। সম্ভবত ঘুম আর জাগরণের মাঝামাঝি কোনো স্তরে আছি। আর আমার মধ্যে ঘটে যাচ্ছে অদ্ভুত সব ব্যাপার। এটা কী হচ্ছে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। এটা হিপনোটিজম না অন্য কিছু! অপু আমাকে এ কোথায় নিয়ে আসল! আমার খুব ভালো লাগছে। খুব খুব ভালো লাগছে এই অনুভূতিটা। মনে হচ্ছে আমি এখানে এই ঘরেই নেই! দূর নক্ষত্রলোকে হয়ত আমি চলে গেছি।

-ওঠ!

কেউ মনে হয় ডাকল আমায়। কিন্তু শব্দটার কোনো অর্থ আমার মস্তিষ্কে প্রবেশ করল না। আমি শুধু একটা শব্দের কম্পন অনুভব করলাম। অনুমান করলাম যে অপুরই মুখ থেকে ওটা বেরিয়েছে। কিন্তু আমার এখন উঠতে ইচ্ছা করছে না। এইভাবে শুয়ে থাকতে খুব খুব ভালো লাগছে।

-কী রে আমন, ওঠ!

আমন ডাক দেবার পনেরো কুড়ি মিনিট পর সম্ভবত আমি ঐ অদ্ভুত ঘুম থেকে জেগে উঠেছিলাম। ঘড়িতে তখন রাত বারোটা পঁচিশ।

বিছানা থেকে ওঠার সময় নিজেকে আমার আর ঠিক আগের আমির মত মনে হচ্ছে না। আমি যেন ঠিক আমন নই, হয়ত অন্য কেউ। কে সে!

বাথরুমে গেলাম। ফিরে এসে অপুকে কোথাও না দেখে ডাক দিলাম। কিন্তু কোনো সাড়া পেলাম না! আমাকে উঠতে বলে ও আবার কোথায় গেল! আরো কয়েকবার ডাকলাম। কোনো উত্তর নেই। দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম রুম থেকে। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম সমুদ্রের পাড়ে। হয়ত এখানে থাকতে পারে ও।

সমুদ্রে এত রাতে আসা নিষেধ। তাও ঝুঁকি নিয়ে এলাম আমি। অপুর নাম ধরে ডাক দিলাম কয়েক বার। নাহ্‌! কোনো সাড়া নেই ওর। কোথায় গেল ছেলেটা!

অনেকক্ষণ পাড় ধরে হাঁটাহাঁটি করলাম ওর নাম ধরে ডেকে ডেকে। শুধু সমুদ্র স্রোতের গর্জন কানে ভেসে এল।

চলে এলাম হোটেলে। নিজের রুমে ঢুকে খুব নিঃসঙ্গ লাগল। এভাবে হঠাৎ গায়েব হয়ে যেতে পারে কেউ! ও তো আমার সামনেই ছিল! মাত্র কুড়ি মিনিটে কী এমন ঘটল!

সকালে আবার গেলাম সমুদ্রের পাড়ে। বালির উপর হাঁটলাম অনেকটা । ভালো লাগছিল না। কিছুক্ষণ বসে থাকলাম উঁচুমত পাথরের উপর। সুর্যের তাপ অসহ্য মনে হলে ফেরার রাস্তা ধরলাম।   

রিসেপসনে এসে ব্রেকফাস্টের অর্ডার দিলাম। প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। মনে হচ্ছে কতদিন খাইনি! পাশ থেকে একজন জানালেন- স্যার আপনি তিন দিনের জন্য রুম বুক করেছিলেন, গতকাল তা শেষ হয়ে গেছে। আপনি কি আরো কিছুদিন থাকবেন?

-মানে? আজ তো দু’দিন! আরো একদিন বাকি আছে!

-না স্যার! গতকাল আপনাদের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে! এই দেখুন এগ্রিমেন্ট কপি! আজ অক্টোবরের পাঁচ তারিখ!। চার তারিখ পর্যন্ত আপনাদের বুকিং ছিল।

-ওকে। আমি পরে জানাচ্ছি। এখন খুব টায়ার্ড ফিল করছি। আর হ্যাঁ, আজ থাকছি।

-থ্যাঙ্ক ইউ স্যার!

রুমে ঢুকে আমি চিন্তায় পড়লাম। কী হল ব্যাপারটা! অপু গায়েব! হোটেলের দিন সমস্যা। কী হচ্ছে এসব! এটা কোনো ভুতুড়ে হোটেল নাকি! তা কী করে হয়! ভূত-ফুত আবার কী! অন্য আরো লোক তো আছে হোটেলে! নিশ্চয় তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না!

মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকালাম। ব্যাটারি প্রায় শেষের দিকে। এটা তো হবার নয়! গত রাতে অপুর সঙ্গে ঐ এক্সপেরিমেন্টটা করার আগে ব্যাটারি ফুল চার্জ ছিল! এক রাতের মধ্যে সব চার্জ শেষ! কী করে সম্ভব! আমি তো গত রাতে এটা ইউজই করিনি। প্রশ্নই ওঠে না ইউজের। আমি তো তখন ঘুমাচ্ছিলাম!

মাথায় হঠাৎ একটা জিনিস ক্লিক করে গেল। ছুটে নিচে গেলাম রিসেপসনে। দেখি সেই ভদ্রলোক কিছু কাগজ নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। এগ্রিমেন্ট কপিটা আবার দেখাতে বললাম।

-হুম্‌! আজ কত তারিখ?

-সিক্সথ অক্টোবর।

-আর ইউ সিয়োর?

-রাইটফুলি স্যার! এই দেখুন ক্যালেন্ডার!

-ওকে।

-স্যার! আপনার ফ্রেন্ডকে দেখছি না!

-ও গত রাতে… না। না। গত পরশুদিন। সরি, রাতে অন্য হোটেলে শিফট করে গেছে।

-কিন্তু স্যার রিসেপসনে তো কোনো রেকর্ড নেই এই বিষয়ে! আপনাদের জানানো উচিত ছিল।

-এই তো এখন জানালাম!

-ওকে।

-ও হ্যাঁ! আমার জন্য লাঞ্চ পাঠান। এক্ষুনি বেরবো!

-ওকে স্যার! পনেরো মিনিটের মধ্যে পাঠাচ্ছি।

রুমে ফিরে এসে চিত হয়ে শুয়ে পড়লাম বিছানায়। সমস্ত ব্যাপারটা এখন পরিষ্কার হল এখন আমার কাছে। তার মানে আমি যে ঘুমটা ভেবেছিলাম কুড়ি মিনিটের, আসলে সেটা ছিল গোটা একটা দিন! কী করে সম্ভব এটা! আর অপু কোথায় চলে গেল! ও কী সমুদ্রে ভেসে গেছে! না। তা হতে পারে না! শেষবার আমার সামনেই তো ও বসে ছিল সেই এক্সপেরিমেন্টটা করার সময়! আমি কী করব বুঝতে পারছি না কিছুই। আর কাকেই বা বলব! এখানে কেউ তো পরিচিতও নেই! বস্তুত পক্ষে অপু ছাড়া আমার আর কোনো বন্ধুও নেই যাকে সব গোপন কথা বলা যায়!

 

(এখন)

 

বছর খানেক আগে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনাটা কাউকে আর বলিনি। অপুকেও আর দেখিনি চোখের সামনে। তারপর হঠাৎ করে একদিন তন্দ্রামতো অবস্থায় শুরু হয়েছিল আমাদের আবিষ্কৃত পদ্ধতিতে কথা বলা। এখন মাঝে মাঝেই কথা হয় অপুর সঙ্গে। ব্যাপারটা এখন এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে মোবাইল ফোনের মতোই ওর সঙ্গে কথা বলতে পারি। কিন্তু আজ ও বলছে কে বা কারা ওকে নাকি গাড়ি করে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে। আমাকে যেতেই হবে ওর কাছে। ট্রেনের টিকিট বুক করলাম। বাড়িতে বললাম অফিসের কাজে বাইরে যাচ্ছি।

অপুর দেওয়া ঠিকানা মত মুম্বাইয়ে পৌঁছে গেলাম সকাল দশটা নাগাদ। প্রথমেই ওর কম্পানির ব্রাঞ্চ অফিসের খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। ঐ ঠিকানায় ঐ নামে কোনো অফিস নেই। এরপর কী করব বুঝতে পারছি না। পুলিশের সাহায্য নেব! কিন্তু আমাদের নিজস্ব এইরকম যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকতে পুলিশের কী প্রয়োজন! দেখাই যাক ক’দিন।

হোটেলে পৌঁছে আগে ঢুকলাম স্নান করতে। দু’দিনের ট্রেন জার্নির পর গায়ে প্রথম জল পড়ল। স্বর্গসুখ হয়ত একেই বলে!

খাওয়া দাওয়ার পর রুমের লাইট নিভিয়ে জানলায় পর্দা টেনে শুয়ে পড়লাম। তন্দ্রা মতো অবস্থায় যেতে ঘন্টা খানেক লাগল। মাথাও ব্যথা করছে। হয়ত ট্রেন জার্নির জন্য। অপুকে ডাকলাম।

-কোথায় তুই এখন?

-অপু শুনতে পাচ্ছিস?

ঘুম ভাঙল বিকেলের দিকে। তাহলে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম! তাই হয়ত অপুর কথা শুনতে পাইনি! সন্ধ্যায় আবার চেষ্টা করতে হবে।

আশেপাশে ঘুরে হোটেলে ফিরে লাইট নিভিয়ে জানলায় পর্দা টেনে শুয়ে পড়লাম। তন্দ্রা-ঘুম কিছুই আসছে না।

উঠে পায়চারি করলাম কিছুক্ষণ। ক্লান্ত আর হতাশ লাগছে। আমি কি আর কখনো অপুর সঙ্গে কথা বলতে পারব না! ও কোথায়, কেমন আছে এখন! দূর থেকে কানে আসছে সমুদ্রের গর্জন। বিয়ার অর্ডার করলাম দুই বোতল। খাদ্যহীন পেটে ঢেলে দিলাম। মিনিট তিনেক পর আসল সেই আকাঙ্ক্ষিত তন্দ্রা। ডাক দিলাম অপুকে।

-শুনতে পাচ্ছিস অপু?

-হ্যাঁ।

-কোথায় তুই এখন?

-জানি না। চারদিক অন্ধকার।

-গাড়িতে না কোনো ঘরে?

-মনে হয় ঘরে।

-ঠিকমতো খেতে দেয় তো ওরা?

-তা দেয়।

-তোকে কেন আটক করেছে? কিছু বলেছে?

-না।

-ওরা কারা কিছু বুঝতে পারছিস?

-কথা শুনে মনে হয় পাকিস্তানি বা আফগানিস্তানি হবে। মনে হয় আফগানই হবে। ঠিক উর্দুতে কথা বলছে না।

-তালিবান নয় তো?

-জানি না। হতে পারে। নাও হতে পারে। আমি তো ওদের দেখতে পাচ্ছি না।

-কিচ্ছু চিন্তা করবি না। আমি এসে গেছি। তোকে ঠিক খুঁজে বের করব। মনের জোর হারাবি না একদম। আর ওদের কথার কোনো বিরোধিতা করবি না এখন। যা বলে তাই করবি।

-আচ্ছা।

গত রাতের এই কথাবার্তার পর আমার নিশ্চিত ধারণা হয়েছে অপু তালিবানদের হাতেই ধরা পড়েছে। এই অবস্থায় পুলিশের সাহায্য নেওয়াই স্থির করলাম। আমার একার পক্ষে আফগানিস্থান থেকে অপুকে নিয়ে আসা সম্ভব নয়।

থানা জায়গাটা ছোটবেলা থেকেই ভয় পাই আমি। কী বলতে কী বলে ফেলি এই ভয়। তবে এখানকার পুলিশ বেশ মন দিয়ে শুনলেন আমার কথা। তবে অপু কোথায় আছে এই নিশ্চিত সংবাদ আমি কী করে জানলাম বিষয়টা এড়িয়ে গেলাম। আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থাটা ইচ্ছে করেই গোপন রাখলাম। বললেও হয়ত বিশ্বাস করত না। পুলিশ আমাকে বলল ফোন নাম্বার দিয়ে যেতে। আর দুই দিন পর খোঁজ নিতে।

দু’দিনের পর তিনদিন হয়ে গেল। কোনো ফোন নেই। বাধ্য হয়ে থানায় গেলাম। ঘন্টা খানেক বসিয়ে রাখার পর সেই প্রথম দিনের অফিসার ডেকে পাঠালেন।

-ইস দিস ইয়োর ফ্রেন্ড? বলে অফিসার আমাকে একটা ছবি দেখালেন।  

-ইয়েস স্যার।

আমি চিনতে পারলাম অপুকে। কিন্তু গায়ের জামায় রক্তের দাগ। কোনো মতে মাথাটা উঁচু করে আছে। পুলিশ অফিসার আবার জিজ্ঞাসা করলেন।

-আর ইউ সিয়োর? দিস ইস ইয়োর ফ্রেন্ড’স পিকচার?

আমি আবার বললাম- ইয়েস! এনিথিং রং স্যার?

-দ্যাট’স হোয়াট উই গট লাস্ট ইয়ার। হি ওয়াজ কিডন্যাপড বাই দ্যা তালিবান। অ্যান্ড ফিউ ডেজ লেটার…

-হোয়াট হ্যাপেনড স্যার?

-দে শট হিম ব্রুটালি।

-হোয়াট স্যার? এ ইয়ার এগো?

-আওয়ার রেকর্ডস সে সো। 

-নো স্যার! ইট কান্ট বি!

-কন্ট্রোল ইয়োরসেলফ!

-নো স্যার! ইট কান্ট বি!

-প্লিজ কন্ট্রোল ইয়োরসেলফ!

-নো, নো স্যার! নেভার…

বলতে বলতে আমি থানা থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম।

পরদিন হোটেল ভাড়া মিটিয়ে আমি কলকাতার ট্রেন ধরি। দুলুনিটা বেশ ভালো লাগছিল। কয়েকটা স্টেশন পরেই তন্দ্রামতো এসে যায় চোখে। আমি অপুর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলাম। যদিও ভয় করছে ভীষণ।  

-অপু! … শুনতে পাচ্ছিস?

-কেন পাবো না?

আরও পড়ুন...