শারদ অর্ঘ্য ১৪২৮ । অন্য শহরের পুজো
ক্রিং… ক্রিং… ক্রিং।
সাইকেলের আওয়াজটা পেলে পড়িমরি করে ছুটতাম আমরা। ওই এসে গেল…
ময়লা রঙ, ঢোলা সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরা মাঝবয়সী ভদ্রলোকের নাম ছিল নারায়ণবাবু। লোকমুখে সেটা কী করে যেন নারাণবাবু হয়ে গিয়েছিল। আমরা নারাণবাবু বলেই ডাকতাম। পুজো এলেই কোনও একটা শনিবার বা রবিবারের সকালে পুজোবার্ষিকী আনন্দমেলা নিয়ে আসতেন নারাণবাবু। সাইকেলের হ্যান্ডেলে একটা চটের ব্যাগের মধ্যে থাকত মহার্ঘ্য সেই গুপ্তধন। পুজোসংখ্যা বলতাম না আমরা বলতাম পুজোবার্ষিকী।
কে আগে গুপ্তধনের দখল নিতে পারে, তা নিয়ে আমি আর আমার ভাইয়ের মধ্যে বহু ভারত-পাকিস্তান হয়ে গিয়েছে। এত বছর পরে পিছনে তাকালে সেইসব ‘যুদ্ধে’-র জন্য বুকটা হু হু করে ওঠে। সেই আটের দশকে মোবাইল ছিল না, লোডশেডিং ছিল। পিৎজা-হাট বা কেএফসি ছিল না, কিন্তু এগরোলের রমরমা ছিল। গুগল ছিল না, কিন্তু তখনও রাত জেগে ঠাকুর দেখা ছিল। ফেসবুক, সেলফিহীন সেই আশ্চর্য দুনিয়াতেও এখনকার মতোই ছিল ঢাকের আওয়াজ। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি রাস্তা জুড়ে বাঁশ বাঁধা শুরু হওয়া মানেই পুজো এসে গেল। ত্রিপল পড়ে গেল মানেই এই রাস্তা দিয়ে এখন আর গাড়ি যাবে না। প্যান্ডেলের পিছনটায় ব্যাট-বল নিয়ে দাপিয়ে শুরু হয়ে যাবে আন্ডারহ্যান্ড ক্রিকেট। আর ষষ্ঠী থেকে দশমী? ওই পাঁচটা দিন ছিল বাঁধনহীন। আমরা অবশ্যই সাপের পাঁচ পা দেখতাম। এ পাড়া, ও পাড়া ঘুরে দল বেঁধে ঠাকুর দেখা আর সন্ধে হলেই পাড়ার প্যান্ডেলের সামনে অতিরিক্ত উৎসাহ নিয়ে চেয়ারদখল। সেই চেয়ারদখলের কারণ অধিকাংশ সময়েই, ‘ও কখন বেরোবে’ থেকে ‘অ্যাই, আইসক্রিম খাবে?’ অবধি গড়াত। হাতে হাতে মোবাইল না থাকতে পারে, কিন্তু সাদা পাতা আর ফাউন্টেন পেন তো ছিল। ফলে ছোট-ছোট চিরকুট থেকে শুরু করে বঙ্গলিপি রুল টানা খাতার পাতা তিনেক— চিঠির বহর হতো প্রেমের মাত্রা অনুযায়ী। কে কতটা কেস খেয়েছে, তার উপর এসবের ডিগ্রি নির্ভর করত। যেমন একবার সুকান্তদার দশ পাতা চিঠি রিমলিদি রেগেমেগে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে বলে সুকান্তদা নাকি একসঙ্গে গোটা দশেক ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল। ঠিকঠাক সময়ে বলে ফেলায় রক্ষে, ডাক্তার ডেকে বমি-টমি করিয়ে সে যাত্রা সব সামলানো হয়েছিল।
আসলে পুজো ব্যাপারটা আমার কাছে রমাপদ চৌধুরীর ওই ‘বাড়ি বদলে যায়’ উপন্যাসের মতো। পুজো বদলে যায়। যত বয়স বাড়তে লাগল, বদলে যেতে লাগল পুজো। ক্রিং, ক্রিং, ক্রিং আর পুজোবার্ষিকীর পাতার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ল নানারকমের সব যাপন। অষ্টমীর রাতে বন্ধুর বাড়ির ছাদে উঠে একসঙ্গে দল বেঁধে ওল্ড মঙ্কের বোতল উড়িয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে প্রথম চুমু, সবই খুব দ্রুত ঘটে যাচ্ছিল। যে ভাবে ঘটে আর কী!
কিন্তু ধাক্কাটা এল কর্মজীবনে ঢুকতেই। ১৯৯২-এ ট্রেনি সাংবাদিক হিসেবে আনন্দবাজারে আর কাগজের অফিসে প্রথম পুজো আসার আগেই আবিষ্কার করলাম, আমার পুজো আবার পুরোপুরি বদলে গেল। পুজোয় সবার ছুটি থাকতে পারে, কিন্তু খবরের কাগজের নয়। আজ এই নিয়ম বদলেছে বটে, এখন পুজোর চারদিন ছুটি থাকে দৈনিক কাগজগুলিতে। অন্তত ছাপা সংস্করণ প্রকাশিত হয় না। কিন্তু নয়ের দশকের শুরুতে বা নতুন শতাব্দীর প্রথম দশ বছর মোটেই ব্যাপারটা সেরকম ছিল না। পুজোর চারদিন অফিস থাকত এবং বহু রাতে যখন অফিসের গাড়িতে বাড়ি ফিরতাম, একটাই দুশ্চিন্তা মাথায় ঘুরঘুর করত। কোন রাস্তা দিয়ে গেলে জ্যাম এড়ানো যাবে? ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়িতে বসে থাকার অভিজ্ঞতা বেশ কয়েকবার হয়েছে।
তবে আজ এত বছর পরে এ কথা স্বীকার করতে বাধা নেই, পেশার স্বার্থে বহুবার পুজোর সময় কলকাতার বাইরে থাকতে হয়েছে। কখনও কখনও থাকতে হয়েছে দেশের বাইরেও। মনে আছে কোনও একটা পুজোয় আমিরশাহির শারজায় ছিলাম, কোনওটায় আবার কেনিয়ার নাইরোবিতে।
নাইরোবির গল্পটাই বলি। সালটা ২০০০। সবে ক্যাপ্টেন হয়েছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। আর তারপরেই পুজোর সময়ে পড়েছে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। আর ক্রিকেট প্রতিনিধি হিসেবে আমার উপরে সেই টুনার্মেন্ট কভার করার দায়িত্ব। ম্যাচ গড়াপেটা কেলেঙ্কারি নিয়ে দেশ উত্তাল, এইরকম একটা সময়ে অধিনায়ক হওয়ার দায়িত্ব পড়েছিল সৌরভের উপরে। আর ক্যাপ্টেন হওয়ার পরে এটাই ছিল প্রথম বড় কোনও টুনার্মেন্ট।
ভারতের টিম? সৌরভের সঙ্গে ওপেনার সচিন, তারপরে দ্রাবিড়, কাম্বলি থাকলেও সেই সফরেই প্রথমবার টিমে জায়গা করে নিয়েছেন ১৯ বছরের যুবরাজ সিং। সঙ্গে তরুণ বাঁহাতি পেসার জাহির খান। রবিন সিং, বেঙ্কটেশ প্রসাদ, অনিল কুম্বলেরা ছিলেন, ছিলেন অজিত আগরকর।
সেই টুনার্মেন্টে ক্রিকেটে কী হয়েছিল, যাঁরা সৌরভ ভক্ত, সবাই জানেন। স্টিভ ওয়ের অস্ট্রেলিয়াকে কোয়ার্টার ফাইনালে এবং শন পোলকের দক্ষিণ আফ্রিকাকে সেমিফাইনালে হারিয়ে সৌরভের ভারত পৌঁছে গিয়েছিল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে। সেমিফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সচিনের সঙ্গে ওপেন করতে নেমে পুরো ৫০ ওভার ব্যাট করে ১৪১ নট আউটের অসাধারণ ইনিংস খেলেছিলেন সৌরভ। ম্যাচ জেতানো ইনিংস। তার পরে ফাইনালেও নিউ জিল্যান্ডের বিরুদ্ধে তাঁর ব্যাট থেকে এসেছিল ১১৭ রানের ইনিংস। কিন্তু সেই ম্যাচে একটা সময় ৩৮ ওভারে ২০২-১ অবস্থায় থেকেও সৌরভ আউট হওয়ার পরে ভারতের ইনিংস থমকে যায়। স্কোর ২৬৪ রানে আটকে যায়। এরপরে ১৩০ রানে পাঁচ উইকেট পড়ে যাওয়ার পরেও ক্রিস কেয়ার্নসের দুরন্ত সেঞ্চুরি নিউ জিল্যান্ডকে ট্রফি জিতিয়ে দেয়। সে তো ক্রিকেটের গল্প। গোটা টুনার্মেন্ট জুড়ে সৌরভের দাদাগিরির গল্প। কিন্তু তার পাশে অন্য কয়েকটা গল্পও যে জমে যাবে, কে জানত!
গ্রুপ পর্যায়ের ম্যাচে ভারত যখন কেনিয়ার সঙ্গে খেলছে, তখন মাঠে প্র্যাক্টিস চলার সময়েই আলাপ হয়েছিল নিখাদ ক্রিকেটপ্রেমী যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রাক্তনী মিহির দত্তের সঙ্গে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জমে গেল আমাদের। কলকাতার বাংলা কাগজ থেকে আমি ছাড়াও ছিলেন আজকালের দেবাশিস দত্ত। প্রতিদিনই আমাদের দৈনিক কপি লেখার কাজ শেষ হওয়ার পরে মিহিরদার বাড়িতে বসত খাওয়াদাওয়া আর পানীয়ের আসর। প্রবাসী বঙ্গসন্তান সুদীপ্তও থাকতেন সেই আড্ডায়। পদবীটা ভুলে গিয়েছি। সেই সুদীপ্তই সে বার পুজোয় সপ্তমীর দিন নিয়ে গিয়েছিল নাইরোবির পুজোয়। একচালায় ছোট ঠাকুর, আয়োজক বলতে কুড়ি-পঁচিশ জনের একটা টিম। কিন্তু উৎসাহ হোক বা আন্তরিকতা, কোথাও খামতি নেই। শুনলাম, অষ্টমীর দিন খিচুড়ি ভোগ খেতে স্থানীয় কেনিয়ানরাও ভিড় করেন মন্ডপে।
নাইরোবির সর্বজনীন পুজো দেখে ফেরার সময়েই সুদীপ্তর সাবধানবাণী এখনও কানে ভাসে। ‘গাড়ির জানলায় কখনও হাত রেখো না।’ কেন? সুদীপ্ত বলল, ‘নাইরোবির রাস্তা বরাবর ছিনতাইকারীদে্র স্বর্গ। প্রতিটি ট্র্যাফিক লাইটে ওরা ওত পেতে থাকে।’ তারপরেই বলেছিল, ‘অলিম্পিক্সে দ্যাখো না, লং ডিসট্যান্স রানিংয়ে কেনিয়ানদের কেউ হারাতে পারে না। কেন বলো তো?’
‘কেন?’
‘সব উগালি খাওয়া চেহারা। অফুরন্ত দম। হাত বাড়িয়ে ঘড়িটা নিয়েই সব অলিম্পিক্স ফাইনালের মতো দৌড়োয়!’ বলেছিল সুদীপ্ত।
উগালি? ব্যাপারটা কী? তখনই জেনেছিলাম, পুরো আফ্রিকা জুড়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার হল এই উগালি। নাইজেরিয়া, উগান্ডা, কেনিয়া, বতসোয়ানা, তানজানিয়া, কঙ্গো, সর্বত্র। প্রধানত ভুট্টার দানা থেকে তৈরি হয়, কিন্তু সঙ্গে গম আর মিলেটও থাকে। অনেকটাই মিল আছে খিচুড়ির সঙ্গে। পুষ্টিগুণ মারাত্মক, আবার একেবারেই দামি খাবার নয়। তখন জেনেছিলাম, উগালির সঙ্গে মিল আছে বলেই অষ্টমীর দিন নাইরোবিতে খিচুড়ি ভোগ খেতে ভিড় করেন স্থানীয়রা।
সে যা-ই হোক, আমরা থাকতাম নাইরোবি জিমখানা স্টেডিয়ামের লাগোয়া ক্লাবহাউসে। স্টেডিয়ামেই হচ্ছিল টুনার্মেন্ট। কিন্তু ম্যাচ না থাকলে স্টেডিয়ামের মিডিয়া অফিস খোলা থাকত না। ফলে প্রতিবেদন বা কপি কলকাতার কাগজের অফিসে পাঠানোর জন্য আমাদের যেতে হত ক্লাবহাউসের বাইরে প্রায় এক কিলোমিটার দূরের একটা ফ্যাক্সের দোকানে। আমি ২০০০ সালের কথা বলছি, তখনও ই-মেলে কপি পাঠানোর চল হয়নি। কপিও সাদা কাগজে পেন দিয়ে লিখে পাঠাতে হত।
কিন্তু ওই এক কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে ফ্যাক্স করতে যাওয়া নিয়েও আমাদের পইপই করে সাবধান করে দিয়েছিলেন ক্লাবহাউসের নিরাপত্তাকর্মীরা। সঙ্গে যেন টাকা পয়সা একেবারেই বেশি না থাকে, ঘড়ি নিজেদের রুমে খুলে যাবেন, পাসপোর্ট নিয়ে যাবেন না, ইত্যাদি ইত্যাদি। বারবার সাবধান করে দেওয়ার কারণও আছে। মাত্র দু’দিন আগে স্টেডিয়ামেই একটা ঘটনা ঘটেছিল।
নিরাপত্তার কথা ভেবেই স্টেডিয়াম থেকে হোটেলে ফেরার জন্য বিদেশি সাংবাদিকদের সুবিধার্থে গাড়ির ব্যবস্থা করেছিলেন সংগঠকরা। একদিন কাজকর্ম সেরে সেইরকম একটা বড় ক্যারাভ্যান গাড়িতে এক সঙ্গে ফিরছিলেন চার বাংলাদেশি সাংবাদিক। মাঝে তাদের ইচ্ছে হয়, একটু ডাউনটাউন ঘুরে হোটেলে ফেরার। তাই করতে গিয়েই বিপত্তি। একটি ট্র্যাফিক লাইটে হঠাৎ একটা খোলা জানলা দিয়ে ভিতরে ঢুকে আসে রিভলবারের নল। মুহূর্তের মধ্যে গাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ে গোটা তিনেক বন্দুকধারী। তারপর ড্রাইভারের ঘাড়ে বন্দুক ঠেকিয়ে গাড়ি নিয়ে যাওয়া হয় জনমানবশূন্য হাইওয়েতে। সেখানে টাকা পয়সা, ঘড়ি আর যার কাছে মূল্যবান জিনিস যা যা ছিল, সব কেড়ে নিয়ে গাড়ি থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয়। ভাগ্য ভালো, বন্দুকধারীরা গুলি চালায়নি। চালালে কিচ্ছু করার ছিল না। অনেক রাতে কোনওরকমে বাংলাদেশের টিম হোটেলে খবর দিতে পেরে সে যাত্রা কোনও ভাবে রক্ষা পেয়েছিলেন সেই বাংলাদেশি সাংবাদিকেরা। স্থানীয় কাগজে পরের দিন খবরও হয়েছিল।
বাংলাদেশি বন্ধুদের অভিজ্ঞতা মাথায় ছিল বলেই ফ্যাক্স করতে যাওয়ার সময় ভয় করত। একটিমাত্র ফ্যাক্সের দোকানই ছিল সেই তল্লাটে, সঙ্গে এসটিডি-আইএসডি করার সুবিধে সহ ফোন। ফলে অধিকাংশ ভারতীয় সাংবাদিক ওখানেই ভিড় জমাতেন। দোকানে কর্মচারী হিসেবে ছিল একটি তরুণী। মেরেকেটে বাইশ-তেইশ বছর বয়স। কৃষ্ণাঙ্গী কোঁকড়া চুলের মেয়েটির নাম ছিল রোজি। সব সময়ই হাসিমুখ, আমাদের ভারতীয় সাংবাদিকদের জন্য সন্ধের পরেও কিছুক্ষণ দোকান খোলা রাখত রোজি। আর প্রতিদিন ফ্যাক্স করতে গেলেই হাসিমুখে বলত, ‘আর ইউ উইনিং টুডে?’
এই যে ‘আর ইউ উইনিং টুডে’ প্রশ্নটা আমাকে খুব টানত। মনে হত, সব কিছুতেই মেয়েটা কী আশ্চর্য ভাবে জেতা হারা দিয়ে বিচার করে। ফ্যাক্স আটকে গেলে সেটা ওর কাছে, ‘ইউ আর নট উইনিং টুডে’, আবার রোদ উঠলে, ‘উই আর উইনিং টুডে।’
সেবার দশমীর দিনেই ঘটে গেল ঘটনাটা। ফ্যাক্স করতে গিয়ে দেখি, রোজকার হাসিমুখ উধাও, তার বদলে রোজির গালে লাল দাগ। ঘাড়ের কাছে ব্যান্ডেজ।
‘হোয়াট হ্যাপেন্ড রোজি?’
উত্তরে কিছু বলল না। শুধু হাত বাড়িয়ে তিনটে পাতা ফ্যাক্স করার জন্য নিল। যতদূর মনে আছে, আমরা জনা তিনেক ছিলাম সেদিন। রোজই আমরা ওই দোকান থেকে ফ্যাক্স করি, কোনওদিন রোজিকে এত বিষণ্ণ দেখিনি। হঠাৎ হলটা কী?
একটু পরেই দেখলাম, দোকান থেকে সামান্য দূরে এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবক বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে। বারবার এ দিকেই তাকাচ্ছে। হাবভাব মোটেই সুবিধের মনে হচ্ছে না। ব্যাস, আমাদের বুকে লাবডুব শুরু হয়ে গেল। নিশ্চয়ই আমাদের উপর নজর রাখছে। ছিনতাই করার তাল। আমরা ফিসফাস করতে লাগলাম, কী করা যায়।
সেটা বুঝতে পেরেই সম্ভবত রোজি বলল, ‘আর ইউ লুজিং? অ্যাফরেড অফ হিম?’
‘হিম’ বলতে বাইক সহ কৃষ্ণাঙ্গ যুবক। আমরা ‘হ্যাঁ’ বলতেই রোজির মুখে দেখা গেল সেই পরিচিত হাসিটা। ‘ওহ নো, হি ইজ নট আ মাগার! হি ইজ ওয়েটিং ফর মি!’
তারপর সংক্ষেপে রোজি যা বলেছিল, স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আমরা তিনজন। জানিয়েছিল, অভাবের সংসারে তার বিয়ে এক বয়স্ক ধনী ব্যবসায়ীর সঙ্গে দিয়েছিলেন রোজির বাবা। কিন্তু বিয়ের কয়েকমাস পর থেকেই রোজির উপর শুরু হয় অত্যাচার। ওই দোকানের মালিক আবার রোজির বরের বন্ধু। আগের রাতেই নেশা করে এসে রোজিকে বেধড়ক মারধোর করেছে ওর বর। এ বার বাইক নিয়ে ছেলেটি রোজির প্রেমিক। যার নাম জুমা। তা জুমা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেই রাতেই রোজিকে নিয়ে পালাবে। নাইরোবি থেকে অনেক দূরে, ওদের গ্রামের বাড়িতে। যেখানে কোনও ভাবেই ওদের খুঁজে পাবে না রোজির বর। ডিভোর্সের মামলা করে নাকি লাভ নেই, প্রভাব খাটিয়ে রোজিকে অন্যত্র বিক্রিও করে দিতে পারে ওর বর। ফলে পালানো ছাড়া উপায় নেই। আর সে দিনই দোকান বন্ধ করে পালানোর প্ল্যান। এদিন দোকান খোলার কথাই নয়, কিন্তু আমাদের অসুবিধে হবে বলে রোজি দোকান খুলেছে!
আমরা নির্বাক, রোজি কিন্তু তখনও মাথা নীচু করে ফ্যাক্স মেশিনের দিকে তাকিয়ে। আরও তিন পাতা বাকি। আমাদের কেউ একজন বলল, ‘তোমার ওই বন্ধুর আবার অন্য কোনও মতলব নেই তো?’
রোজি কাঁধ ঝাঁকাল। তারপর ছোট্ট উত্তর, ‘আই ক্যান ট্রাস্ট হিম। হি ইজ গুড!’
ফ্যাক্স চলে গেল। দ্রুত দোকান বন্ধ করছিল রোজি। একটু দূরে বাইক নিয়ে অপেক্ষা করছে জুমা। আমরা ফিরছিলাম ক্লাবহাউসের দিকে। দশমীর রাত। কোথাও কোনও ঢাকের আওয়াজ নেই। শুধু আকাশে একফালি চাঁদ।
মনে মনে বলছিলাম, ‘দুগ্গা দুগ্গা… রোজি আর ওর প্রেমিক নিশ্চিন্তে পেরিয়ে যাক শহর। দেখো মা, ওদের যেন বরটা ধরতে না পারে…’