শারদ অর্ঘ্য ১৪২৮ । আমার পুজো
আমাদের ছোটবেলায় গঙ্গাপাড়ের মফস্বলে একমাস আগে থেকেই পাড়ায় পাড়ায় শুরু হয়ে যেত বারোয়ারি পুজোর প্যান্ডেল বাঁধা। সে সব জায়গায় ঠাকুর আসত পানিহাটি কুমোরপাড়া থেকে। একমাত্র সুখচরের কালীতলা নাটমন্দিরেই কাঠামো বেঁধে তৈরী হতো ঠাকুর। দু জায়গাতেই সারাক্ষণ ঘুর ঘুর করতাম আমরা। ঠাকুর তৈরী এগোনো মানেই তো পুজোরও এগিয়ে আসা। নতুন জামাকাপড়। ছুটির ইশারা।
পুজোর কটা দিন পড়াশুনো না থাকায় তখন দুবেলাই ঠাকুর দেখে বেড়ানো। পায়ে ফোস্কা, পকেটে বড়দের দেওয়া খুচরো টাকা। আর শাসন না মেনে দেদার রাস্তার খাবার খেয়ে বেড়ানো।
একটু বড় হওয়ার পর, প্রথম কৈশোরে পুজো আমার কাছে আনন্দবেদনা মেশানো কেমন যেন একটা মন-কেমন-করা স্মৃতি। প্যান্ডেলে সারাদিন আমার ঘোরাঘুরির মধ্যে পাশের পাড়ার পছন্দের মেয়েটিকে যদি কিছুক্ষণের জন্য একবার দেখা যেত, বা হঠাৎই একঝলক হাসি বিনিময় হতো তার সঙ্গে, সেই বয়সে সে যে কতখানি পাওয়া!
পুজো প্যান্ডেলের আলোর ঝলকানি থেকে দূরে, মফস্বলের আলো-আঁধারি গলিঘুঁজিতে মাঝে মাঝে আমরা ঘুরে বেড়াতাম তখন। আমাদের প্রথম কৈশোর কাঁপিয়ে তখন সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রেম করতেন বিয়ে-না-হওয়া, চাকরি-না- হওয়া পাড়ার বড় বড় দাদা দিদিরা। সেই কৈশোরে আমাদেরও মনে হতো— ইস, যদি কথা বলতে পারতাম আমার প্রিয় মেয়েটির সঙ্গে। এখানেই। না , কথা বলা হয়নি কোনদিনই। পরিণতি না পাওয়া প্রথম প্রেমের ভীরু কম্পনের বেদনা নিয়েই হারিয়ে গেছে আমাদের কৈশোর আর কৈশোরের পুজো।
এখন অনেক আলো ঝলোমল আমাদের পুজো। বাবার হাত ধরে প্রথম কলকাতার ঠাকুর দেখার স্মৃতি ভুলিয়ে দিয়ে এখন পুজোর দিনগুলিতে কলকাতা আর সুখচরের মধ্যে আমাদের নিত্য যাতায়াত। কখনো কোনও অনুষ্ঠানে, কখনো দুর্গাপুজার বিচারক হয়ে। শিউলিফুলের মতো নরম আর স্নিগ্ধ সেই পুজোর দিনগুলোর বদলে এখনকার পুজো যেন অনেক চড়া আলোর চনমনে, প্রতিযোগিতায় গাঁথা। গলিঘুঁজির আলো আঁধারির রোমাঞ্চ হারিয়ে বড় বড় রেস্টুরেন্ট আর শপিংমলের চোখধাঁধানো গোলকধাঁধাঁয় পথ হারানো।
হতে পারে এ আমারই বিভ্রান্তি। এই প্রকাশ্যের উৎসবেও হয়ত ভীরু কম্পিত হৃদয়ে প্রেম খুঁজে পেয়ে যাচ্ছেন এখনকার সব সদ্যকৈশোরে পৌঁছনো লক্ষ্মী-সরস্বতীর দল। মা দুর্গার সঙ্গে তাদের মামা বাড়িতে ছুটি কাটাতে আসার দিনগুলো রঙিন হয়ে উঠুক।