শারদ অর্ঘ্য ১৪২৮ । বিশেষ রচনা
১৯৯৫ সালে খননের ফলে হরপ্পায় একটি প্রস্তরফলক পাওয়া যায়, যেখানে দেখা যায় যে একজন ব্যক্তি― পুরুষ (?)― একটি মহিষকে হত্যা করেছে। কার সামনে? একজন পুরোহিত― যিনি যোগীর মতো বসে আছেন। তাঁর হাতে বালা। মাথায় বিরাট একটি পালকের উষ্ণীষ। তিনি কি পুরুষ? হয়তো। পণ্ডিতেরা অনেকে বলেন এই ধরনের টেরাকোটায় উৎকীর্ণ প্রস্তরফলকে প্রাপ্ত মহিষমর্দনের ভাবনা থেকেই মহিষমর্দিনী দুর্গার জন্ম। কিন্তু, এর স্বপক্ষে খুব বেশি তথ্য এখনও উঠে আসে নি। হরপ্পার সময়কাল পণ্ডিতদের মতে ৩৩০০-১৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
সিন্ধুসভ্যতা যখন ক্রমশ বিলীয়মান, প্রায় সেই সময় থেকেই শুরু হয় বৈদিক যুগ (১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। উপেন্দ্রকুমার দাস মহাশয়ের শাস্ত্রমূলক ভারতীয় শক্তিসাধনায় পাওয়া যাচ্ছে― ‘অম্বিকা, উমা, দুর্গা, কালী… প্রভৃতি মহাদেবীর লোকপ্রসিদ্ধ নামগুলির একটিও ঋগ্বেদে পাওয়া যায় না।… তৈত্তরীয়-আরণ্যকে দুর্গার নামোল্লেখ করা হয়েছে। মন্ত্রটির ভাবার্থ এই― যিনি অগ্নিবর্ণা, যিনি তপস্যার দ্বারা জ্যোতির্ময়ী, যিনি বৈরোচনী, কর্মফলের নিমিত্ত যিনি উপাসিতা, সেই দুর্গা দেবীর শরণ নিলাম।… এখানে দুর্গাকে বলা হয়েছে বৈরোচনী। বিরোচন শব্দের অন্যতম অর্থ সূর্য বা অগ্নি। কাজেই বৈরোচনীর অর্থ সূর্য বা অগ্নির কন্যা।’ এখানে কিন্তু দুর্গা মহিষাসুরমর্দিনী নন। তাহলে তিনি মহিষাসুরমর্দিনী হলেন কবে?
দুর্গার মহিষাসুরমর্দিনীর রূপ আসে অনেক পরে। তার অপরূপ চিত্র আমরা পাই মার্কণ্ডেয় পুরাণে। পণ্ডিতদের মতে এই মার্কণ্ডেয় পুরাণ সংগৃহীত হয় ২৫০-৫৫০ খ্রিস্টাব্দের ভেতর। কিন্তু, দুর্গার কাহিনি যে কত পুরনো তা বলা অসম্ভব। সংগৃহীত হবার সময়টা তবু পুঁথি, বাক্যগঠন, শব্দ ও ব্যাকরণ দেখে বোঝা গেলেও কাহিনির উৎপত্তি ও বিবর্তন সম্বন্ধে কোনও নির্দিষ্ট কথা বলা খুবই শক্ত। উপেন্দ্রকুমার দাস জানাচ্ছেন― ‘ভিটাতে গুপ্তযুগের যেসব পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে তার মধ্যে আছে পাথরের তৈরি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মূর্তি (অলংকরণ মূর্তি)। মূর্তিগুলি দ্বিভুজা মহিষমর্দিনীর।’ এর আগেও কি দুর্গার আভাস ছিল? উপেন্দ্রকুমার বলছেন, ‘খ্রিস্টিয় প্রথম শতকের কুষাণনৃপতি প্রথম এজেসের মুদ্রায় দেখা যায়, এক দেবীর পাশে একটি পশুর সম্মুখভাগ উৎকীর্ণ রয়েছে। পশুটিকে সিংহ বলে সনাক্ত করতে পারলে দেবীমূর্তিকে সিংহবাহিনী দুর্গামূর্তি বলা যায়।’ কোনও কোনও পণ্ডিত ওটিকে সিংহবাহিনী দুর্গামূর্তি বলেই মনে করেন। দুর্গার সঙ্গে সিংহের অনুষঙ্গ কীভাবে ও কেন এল তার কোনও নির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে বাহন-এর একটি তত্ত্ব হল: দেব বা দেবীর স্বভাব তাঁর বাহনের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে দুর্গার সিংহ তাঁর স্বভাব ও শক্তির প্রতীক হয়ে উঠেছে।
তবে মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার ক্ষেত্রে যে জিনিসটি আমরা প্রথমেই লক্ষ্য করি, তা হল― এই দেবী একজন যোদ্ধা। তিনি একটি যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়ে লড়াই করে মহিষাসুর নামক এক পরাক্রান্ত রাজাকে পরাজিত করছেন। আর এটাও কি খুব আশ্চর্যের কথা নয় যে এত বড় বড় সব দেবতা থাকা সত্ত্বেও মহিষাসুরকে কেউ পরাজিত করতে পারলেন না? একজন নারীকে প্রয়োজন হল? আমরা যদি শুভ-অশুভ’র দ্বন্দ্ব’র রূপক থেকে বেরিয়ে দাঁড়াই― আমরা যদি পুরো ব্যাপারটিকে আলো-অন্ধকারের দার্শনিক দ্বৈরথের বাইরে বের করে আনতে চাই, তাহলে আমরা দেখতে পাব― একটি যুদ্ধক্ষেত্র। সেখানে দুটি দল― একটি দলের নেতৃত্ব করছেন পুরুষ, অন্য দলের নেতৃত্ব করছেন নারী।
এইখান থেকে প্রথমেই যে চিন্তাটি তৈরি হয়, সেটি হল এই ধরনের বিরাট যুদ্ধের কথা আমরা পড়েছি কি― যেখানে পুরুষ ও নারী প্রতিপক্ষ? রামায়ণে বা মহাভারতে? রাক্ষসীদের কথা পড়েছি অবশ্য। যেমন তাড়কা বা পুতনা। কিন্তু তারা ঠিক যোদ্ধা নয়। কেউ গুপ্তচর, কেউ বনচর। সেখানে আর্য অনার্যের সামাজিক দ্বন্দ্বের একটি ছবি উঠে এসেছে। কিন্তু দুর্গার মতো অসামান্য নারী-যোদ্ধা ক’জন রয়েছে মহাকাব্যে? চিত্রাঙ্গদা বা সত্যভামা যোদ্ধা, কিন্তু তাও ভয়ংকর শক্তিশালী তাঁরা নন। এই দু’জন ছাড়া কৈকেয়ীর কথা আসতে পারে। মহাকাব্য দু’টি খুঁড়লে আর খুব বেশি নারী যোদ্ধার নাম উঠে আসবে না হয়তো কারণ আর্যাবর্তের নারীরা খুব সুযোদ্ধা ছিলেন― এমন তথ্য পাওয়া যায় না। দু’একজন ছিলেন ব্যতিক্রম। তাঁরা বিরাট কোনও যুদ্ধ একা করেন নি। অম্বাকেও যুদ্ধ করতে চেয়ে পুরুষ হতে হয়েছে। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, দুর্গার মতো কোনও দ্বিতীয় চরিত্র আর্যসভ্যতায় জাত মহাকাব্যে পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে দুর্গা কি নিছকই প্রতীক? কবির কল্পনা? যে সভ্যতায় নারী প্রায় কখনোই যুদ্ধক্ষেত্রে যেত না, পুরাণকার ভক্তিরসে আপ্লুত হয়ে সেই নারীকেই দেবী করে যুদ্ধে পাঠিয়ে দিলেন? ব্যাপারটি এমনই কি?
২০০৫-০৬ এবং ২০১৮ সালে উত্তরপ্রদেশের সিনাউলিতে আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া একটি খননকার্য চালায় এবং এর ফলে আবিষ্কৃত হয় বিরাট একটি প্রত্নতাত্ত্বিক সম্ভার! তাতে পাওয়া যায় একটি চাকাশুদ্ধু রথ; পাওয়া যায় কবরস্থিত অলংকার, আয়না, চিরুনি, তলোয়ার, হেলমেট প্রভৃতি। পণ্ডিতেরা অনুমান করছেন যে সিনাউলিতে যা পাওয়া গেছে তার সময়কাল সিন্ধুসভ্যতার শেষের দিকে। খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৫০-১৫৫০। এই খননকার্যর ফলে একটি কবর থেকে পাওয়া গেছে নারীকঙ্কাল। এবং পণ্ডিতেরা বলছেন― এই নারীরা ছিল যোদ্ধা। তারা তলোয়ার চালানোয় প্রশিক্ষণ লাভ করেছিল এবং যুদ্ধক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যুদ্ধ করত। তারা তলোয়ার চালাতে জানত ও তীর ধনুক ব্যবহার করে পারত। তাদের ঢালের নক্সা পর্যন্ত আলাদা ছিল।
এইখান থেকে অনেকগুলো সূত্র একত্রিত হয়:
১। দুর্গার আদি কল্পনা ও রূপ বৈদিক না হওয়াই সম্ভব― যদিও বৈদিক যুগ থেকেই দুর্গা শব্দটির জন্ম।
২। হরপ্পার প্রস্তরফলকে সবক্ষেত্রে উৎকীর্ণ মূর্তি পুরুষ না নারী, তা বোঝা যাচ্ছে না। মহিষমর্দনের যে চিত্র পাওয়া যাচ্ছে, তা কি মহিষমর্দিনীর?
৩। প্রাক-বৈদিক যুগের নারীরা অস্ত্রশিক্ষায় এতটা উন্নত ও তুখোড় হয়ে উঠেছিলেন যে তাঁদের পুরুষ যোদ্ধাদের মতোই সসম্মানে কবর দেওয়া হয়েছিল― তাঁদের তলোয়ারের সঙ্গেই।
সিনাউলির খননকার্য আমাদের চোখের সামনে এ তথ্য তুলে ধরেছে যে― রথ আর্যরা বাইরে থেকে আনে নি। তা এ দেশেই ব্যবহার করা হত। সিনাউলিতে যে সাইটে নারী যোদ্ধাদের কঙ্কাল পাওয়া গেছে, সেখানেই পাওয়া গেছে চাকাশুদ্ধু রথ। দেবীকবচের একাদশমাতৃকা বর্ণনার শেষে আমরা পাচ্ছি:
‘দৃশ্যন্তে রথমারূঢ়া দেব্যঃ ক্রোধসমাকুলাঃ’
এই উক্তিটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ প্রতিটি দেবীর আসন উল্লেখ করার পর―অর্থাৎ শবাসনা চামুণ্ডা, মহিষারূঢ়া বরাহী, গজাসনা ঐন্দ্রী, গরুড়াসনা বৈষ্ণবী, মহাবীর্যা নারসিংহী প্রভৃতি বলার পর বলা হচ্ছে, তাঁরা ‘রথমারূঢ়া’। দেবীরা রথে আরোহণ করেছেন। সিনাউলির খননের পর এটি নিছক ভক্তিরসের কাল্পনিক উক্তি হয়ে উঠছে না। এর মধ্যে ঐতিহাসিক সত্যতার দূরাগত দ্যুতি প্রতিফলিত হয়ে উঠছে।
পুরাণে বাস্তবতা, কল্পনা ও ভক্তি এমনভাবে মিলে মিশে থাকে যে তার থেকে তার মূল উপাদানের সূত্রগুলোকে আলাদা করা শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কাব্য ও দর্শনের ভিত্তিভূমি যে বাস্তব জগৎ, তা কে না জানে! প্রাক-বৈদিক যুগের একজন বা একাধিক অসামান্য নারী-যোদ্ধার কীর্তি যে পরবর্তীকালে আখ্যানে ও কথায় রূপান্তরিত হয়ে দুর্গার জন্ম দেয় নি, তা কে বলতে পারে!