Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

শারদ অর্ঘ্য ১৪২৮ ।  রম্য গদ্য

সু ক ল্প   চ ট্টো পা ধ্যা য়

sukalpa2

লুচি, হিমানীশ ও বাঙ্গালা সাহিত্যে অনুপ্রবেশকারী

সত্যি কথা বলতে কি লুচির প্রতি অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণই আমার সাহিত্য জগতে প্রবেশের প্রকৃত কারণ। আমার স্কুল বরাহনগর নরেন্দ্রনাথ বিদ্যামন্দিরের বাংলার শিক্ষক পরিমল চক্রবর্তীর কল্যাণে লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে আলাপ। তিনি সুপ্রাবন্ধিক ও কবি ছিলেন। যেসব পত্রিকার সৌজন্য সংখ্যা তাঁর দেখা হয়ে যেতো, তিনি এই বালককে দিয়ে দিতেন। তখন ক্লাস সিক্স-সেভেন হবে। তাঁর কল্যাণেই পরিচয়, বারোমাস, কৃত্তিবাস এরকম কত বিখ্যাত পত্রিকার পাশাপাশি আঞ্চলিক কাগজগুলি হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করা। সেসব পত্রিকার পাতার সুঘ্রাণ আজও । ক্লাস এইট নাগাদ আমাদের স্কুলের বাংলা ও ইতিহাসের দুরন্ত শিক্ষক ও বাগ্মী রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় হাতে তুলে দেন বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘বাংলা আধুনিক কবিতা’। রঞ্জনবাবুর প্রশ্রয়ে সাহিত্যের জ্ঞানকাণ্ডের বীজ মুকুর মেলতে শুরু করে। কিশোর প্রাণের জিজ্ঞাসা ভাষা খোঁজার সাহস পায়। সেকথা অন্য কোথাও বিস্তারে বলাই সাযুজ্যপূর্ণ হবে।

যাইহোক লুচিতেই যে আমার সাহিত্যরুচির নিয়তিকল্পটি বাঁধা ছিল সেকথা আপাতত খুলে বলি। তখন বরানগর জনপদে পাড়ায় পাড়ায় সাহিত্যগোষ্ঠী তৎসঙ্গে সাহিত্যসভার চল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পঞ্চাশোর্ধ সাহিত্যিকরাই সেইসব সভার উদ্যোক্তা। কারুর বাড়ির বৈঠকখানায় বা ঠাকুর দালানে অপরাহ্নের আলো পড়া মাত্রই শুরু হয়ে যেত স্বরচিত কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ পাঠের আসর। পরিমলবাবুর প্রশ্রয়ে নিজের অপটু যৎসামান্য সাহিত্য আয়োজন নিয়ে সভায় পাঠের জন্য সব সময় একপায়ে খাড়া। কারণ একটাই, সেইসব সতরঞ্চি এবং সাদা ফরাস পাতা সভার বিরতিতে পরিবেশিত হত ফুলকো লুচি। সঙ্গতে থাকতো আলুর দম, ছোলার ডাল অথবা সাদা আলুর চচ্চড়ি। শেষ পাতে রসগোল্লা, কালাকাঁদ, অথবা বোঁদে। আর আয়োজকদের কারও জন্মদিন হলে তো কথাই নেই। পরমান্নের জন্য বুক চিতিয়ে পাতে অপেক্ষা করতো লুচি। তখন পাকস্থলী এবং স্বাদকোরকের ভিতর অনন্ত এক তৃষা সর্বক্ষণ কিশোর হৃদয়ে রাবণের চিতা জ্বালিয়ে রেখেছে।

সভা শুরু হতো সভাপতি ও উদ্যোক্তার ভাষণ দিয়ে। আগে অথবা পরে বাড়ির কর্ত্রী অথবা আত্মীয়া দু’একজনের গান। এরপর কবিতা, গল্প ইত্যাদি। কেউ কেউ নিজ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে এতই দীর্ঘ রচনা পাঠ করতেন যে আমার উদরস্থ শয়তান গন্ধগোকুলটি ডন-বৈঠক মারা শুরু করে দিত। এদিকে তখন ভিতরমহল থেকে ভেসে আসা ডালডার লুচি এবং আলুর দমের হিং-এর গন্ধ বারবার চিত্তবিক্ষেপ ঘটাচ্ছে। এরকম অনেকবারই হয়েছে- আমার পাঠ শেষ হলে তবেই জলখাবার পরিবেশিত হবে। এই বিশেষ মুহূর্তের মুখোমুখি হলে ঝোলা থেকে বের করে পড়ার জন্য দু-তিন লাইনের বাংলা হাইকু সবসময় প্রস্তুত থাকতো। জীবন মধ্যাহ্নের বালুকাবেলায় দাঁড়িয়ে ফিরে তাকিয়ে বুঝেছি লুচির সঙ্গে মিলনের আকাঙ্ক্ষাই সনাতন বিরহী এই আত্মার সাহিত্য জগতে অনুপ্রবেশের কারণ। ওয়াগন ভাঙতে পারলে যদি কেউ পাত পেড়ে লুচি খাওয়াত, নির্দ্বিধায় সেই শিক্ষায় ব্রতী হতে যথোপযোগী গুরুর কাছে নাড়া বাঁধতুম, এতে কোনও সন্দেহ নেই।

তো যাই হোক ফিরে আসি সাহিত্যের সঙ্গে খামোকা জড়িয়ে পড়ার আরেক গল্পে। মাধ্যমিক পাশ করার পরই মনে রোখ চাপলো পত্রিকা করতে হবে। লিটল ম্যাগাজিন। লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের কথা কিছুই জানি না। কেবল এতটুকু জানি, এই ম্যাগাজিন করতে গেলে চাঁদা তুলে করতে হয়। আর ছাপাখানা, বাঁধাইখানা সকলকেই টাকা দিতে হলেও এক পয়সা লেখককে দেওয়া যাবে না।

আশপাশের অঞ্চলের প্রবীণ সাহিত্যিকরা তো খবর পেয়েই লেখা বর্ষণ করতে শুরু করলেন। কেউ কেউ বাড়িতে ডেকে আমাদের দলকে মিয়োনো নিমকি আর বাসি দানাদার খাইয়ে দেড় ফর্মার প্রবন্ধ গছিয়ে দিলেন। কিন্তু কোনও এক সন্ধ্যায় আমাদের সম্পাদকীয় সত্তায় বিবেকের উল্লম্ফন শুরু হল। সমস্বরে ঘোষণা করা হল, কিঞ্চিৎ জলখাবারের লোভে আমাদের তরুণ প্রাণ কিছুতেই নতি স্বীকার করবে না। পত্রিকায় লেখা ছাপানোর জন্য লুচি-কচুরি, পোলাও ইত্যাদি এই মুহূর্তে কেউ আমাদের মুখের সামনে তুলে ধরবেন না। পত্রিকা সমাদৃত হলে কী হবে পরে দেখা যাবে। সুতরাং কুচো নিমকি আর দানাদারের লোভে আত্মসমর্পণ নৈব নৈব চ। তরুণ এবং আঞ্চলিক প্রবীণ লেখকদের পাশাপাশি কয়েকজন নামজাদা লেখকের লেখাও পত্রিকায় থাকা প্রয়োজন। এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পর এলাকার বিখ্যাত সাহিত্যিকদের সঙ্গে যোগাযোগের ভার পড়লো এই অধমের ওপর।

পাশের পাড়াতেই থাকতেন হিমানীশ গোস্বামী। আনন্দমেলা ও দেশে তাঁর লেখা চেটেপুটে খেতুম আমরা। ঠিক হলো তাঁর কাছেই যাওয়া হবে প্রথম সংখ্যার জন্য লেখা আনতে। কোনও এক দিন সকালে জনা চারেক মিলে বেল টিপলুম দরজায়। নেমপ্লেটে জ্বলজ্বল করছে তাঁর বাবা সুবিখ্যাত লেখক, আলোকচিত্রী, সাংবাদিক পরিমল গোস্বামীর নাম। স্যান্ডো গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরিহিত রসসাহিত্যিক হিমানীশ বেরিয়ে এলেন। আমাদের প্রস্তাব শুনে বললেন, লিখতেই পারি, কিন্তু টাকা ছাড়া আমি তো লিখি না। আনন্দবাজার আমায় যে টাকা দেয়, তোমরা কি তা দিতে পারবে? স্বপ্নভঙ্গ হল। হতাশ হয়ে আট আনার চা খেয়ে যে যার আস্তানায় ফিরে এলুম।

দিন দুয়েক পরে বাজারে গেছি, এলাকার মাতব্বর বাবুদার (নাম পরিবর্তিত) সঙ্গে দেখা। বাবুদা এলাকার মস্তান হলেও সংস্কৃতিবান। সে যুগে আমাদের জনপদে এমন বেশ কয়েকজন দাদা ছিলেন যাঁদের বাহুতে রাজনৈতিক মামা-কাকাদের শক্তি মিশে থাকলেও শিল্প-সাহিত্য জগতের পর্যাপ্ত খবর তাঁরা রাখতেন। যাই হোক, বাবুদা বললো, কিরে, মুখ শুকনো কেন? শুনলাম তোরা পত্রিকা করছিস। সবটা খুলে বলতে বছর তিরিশের বাবুদা কপাল কুঁচকে বললো, হিমানীশ! মানে পরিমলের ছেলে! ১৮৯৭ সালে জন্মানো পরিমল গোস্বামীর নাম এমনভাবে উচ্চারিত হওয়ায় আমার তো ভিরমি খাওয়ার যোগাড়। সে ঘটনা ঘটতে দেওয়ার আগেই বাবুদার আশ্বাসবাণী, আচ্ছা, বাড়ি যা, দেখছি কী করা যায়।
বাড়ি ফিরে সেই ঘটনা তো প্রায় ভুলে মেরে দিয়েছি। বন্ধু মহলে আলোচনা চলছে আর কাকে বলা যায় লেখার জন্য। দিন পাঁচেক পর সকালবেলায় বাড়ির ল্যান্ড লাইন বেজে উঠল। বাবা ডেকে বললেন, তোর ফোন। একজন বয়স্ক মানুষ চাইছেন। ফোন ধরতেই প্রবীণ মধুমাখা কন্ঠস্বর ভেসে এল, তুমি কি সুকল্প বলছো? আমি হিমানীশ গোস্বামী। শোনো, আজ সকালেই চলে এসো পারলে, তোমাদের লেখাটা তৈরি আছে। কিছু বোঝা বা বলার আগেই ওপার থেকে ফোনটা কেটে গেল।

খানিকটা ব্যোমভোলা হয়েই জনা তিনেক সাকরেদ নিয়ে ফের হানা দিলাম সেই বাড়িতে। এবার লেখকের করুণাঘন উষ্ণ সম্ভাষণ। বাইরে কেন, এসো এসো ভিতরে এসে বসো। সম্ভাষণের ইতি এখানেই নয়, ঘরে বসিয়ে ভিতর থেকে কাউকে ডেকে বললেন, তরুণ তুর্কীরা এসেছে, মিষ্টি দাও। আমরা তো যারপরনাই থতমত খেয়ে একাকার। একজন প্লেটে খান দশেক রসগোল্লা রেখে যেতেই হিমানীশ বললেন, তোমরা খাও বাবা, আমি আসছি। রসগোল্লা আমাদের বিগত দিনের সব অপমান ধুয়ে দিল। তিন জনের মধ্যে কে চারটে রসগোল্লা খাবে তার জন্য ক্ষণিকের মধ্যেই তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হল। চারটে গোল্লা প্রায় একসঙ্গে মুখে নিয়ে আমার যখন প্রায় বিষম খাওয়ার অবস্থা, পাশের ঘর থেকে লেখক উপস্থিত হলেন। হাতে পিন মারা খান তিরিশেক প্যাডের স্লিপ ভর্তি খুদে খুদে লেখা। হাতে দিয়ে সুমিষ্ট স্বরে বললেন, বাবুকে চেনো আগে বললেই পারতে!

সবিস্ময়ে স্লিপের প্রথম পাতার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, লেখার নাম- ‘ঘোর বিপদ’।

সেই লেখা আমরা ম্যাগাজিনের শেষে ছাপিয়েছিলাম। ভাবখানা ছিল, হুঁ, যে লেখক টাকা চায়, লিটল ম্যাগাজিনে তাঁর স্থান নেই। আমরা যেন করুণা করছি।

এই ঘটনা ঘটেছিল ১৯৯৭-৯৮ নাগাদ। এই তো সেদিন ঘর পরিষ্কারের মতো অপ্রিয় কাজ করতে করতে সেই পত্রিকার এক কপি কুড়িয়ে পেলাম। জঞ্জাল লাঞ্ছিত মুখে ভূষি-কালি পরিহিত চামড়ায় সেদিনের সম্পাদকের জীবনে ততদিনে গঙ্গা-পদ্মার বহু স্রোত বয়ে গেছে। পাতা ওলটাতে ওলটাতে লক্ষ্য করলাম কোনও লেখাই আসলে লেখা নয়। এমনকি নিজের লেখাটার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হলো এই লেখককে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারা উচিৎ। একমাত্র শেষ লেখাটাই প্রকৃত এবং লেখা। ‘ঘোর বিপদ’ শিরোনামে তিনি যে রম্যগদ্যটি লিখেছিলেন, তার মর্মবস্তু ছিল- ওষুধ কোম্পানি কীভাবে নিজেদের ব্যবসা বাড়ানোর জন্য রোগ সৃষ্টি করে। গত শতাব্দীর শেষ লগ্নে বিশ্বায়ন ভালো করে এ দেশের ঘরে ঢুকে পড়ার আগেই এই লেখা লিখেছিলেন হিমানীশ।

সে দিন অর্থ ছিল না, আজও বিশেষ নেই। হিমানীশ, কী দিয়ে আপনার প্রতিভাকে কুর্ণিশ জানাই। আপনি আমারও তো পূর্বপুরুষ। অঙ্গীকার করি, ভবিষ্যতে যদি কোনও দিন পত্রিকা সম্পাদনা করি, লিটল হোক বা বিগ, যৎসামান্য যাই হোক বা অসামান্য, লেখকের প্রাপ্য সাম্মানিক দেব। এই শপথটুকু তর্পণ করি হিমানীশ। ‘বাবুদা’-দের  চিনি সেকথা সেদিন না বললেও চলবে।

আরও পড়ুন...