শারদ অর্ঘ্য ১৪২৮ । গল্প
রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে সূতা তোলে উত্তরা। এক একবার ফুটন্ত ভাতের হাঁড়িটার দিকে চায়, একবার উঠানের দিকে। বাখারির গেটটা ঠেলে লজঝড় সাইকেলটা নিয়ে কেউ যদি ঢোকে? কে আবার ঢুকবে? ভাঙা সাইকেলটা তো গোয়ালঘরের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা আছে। একরাশ শুখনা পাতাপুতার মধ্যে। নামেই গোয়ালঘর, গরু নাই একটাও। কোনোকালে ছিল কি না কে জানে। এক বুড়া মুসলমানের কাছ থেকে এই অষ্টকাটা জায়গা ঘরবাড়ি-সহ কিনেছিল সদানন্দ একুশ বৎসর আগে। তার আগে ঐ মাঠ পেরিয়ে কলোনিতে বাসা করে থাকা। এতখানি জায়গা বলতে গেলে জলের দরে কেনা। বুড়া চলে যাবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল, ওরা যেমন আসার জন্যে আঁটুপাঁটু করছিল। বেড়ার গা ঘেঁষে সুপারি গাছ গুলো সব সেই বুড়ার পোঁতা। আমগাছটা আর একটা তেজপাতা গাছ। চলে যাবার সময় বুড়ার কী কান্না! কান্না দেখে চোখে জল আসার বয়স সেই একুশ বৎসর আগেই পেরিয়ে এসেছিল উত্তরা। উঠানে একরাশ তেজপাতা শুখাচ্ছে। হাসি পায়। তেজপাতা দিয়ে তরিবাতির রান্না যেন কত হচ্ছে। জোগাড় হল তো সময় নাই। ততক্ষণে অনেক নলি সূতা ভরা হয়ে যাবে।
দক্ষিণের ঘর থেকে বুড়িটা গোঙায়– অ বৌ।
– কী হইল আবার? এই তো পেসাবের কাঁথাকানি সরাইয়া মুড়ি খাওয়াইয়া আইলাম।
মুখে বলে, কিন্তু হাতের নলিটায় সূতা ভরেই ওঠে।
– কী কন?
– সনাতন আইল নাকি বৌ?
হায় রে! দ্যাশের জমিজিরাত, ভিটামাটির মতো সনাতনও তো কবেই হাওয়ায় মিলায়ে গেছে। সেকি আজকের কথা! বেঁচে থাকলে ছেলেটার বয়স হত চব্বিশ পঁচিশ। এত বৎসর আগের কথাটা বুড়ির মনে জ্বলজ্বল করছে। অথচ তিনমাস আগে যে মানুষটা বড় বাজারে মহাজনের গদিতে শাড়ি দিতে গিয়ে আর ফিরে এল না- তার কথা বুড়ির কিছুই স্মরণে নাই। কে এখন বসে ভ্যান্তারা শোনে? ওদিকে ভাত হয়ে এল। ভাতের মাড় ঝরতে দিয়ে আবার চরকায় বসে উত্তরা। সদানন্দ চলে যাবার পর থেকে তাদের জীবন এই চরকার সঙ্গে ঘুরে চলেছে। চরকা থামলে সংসার অচল। সে, তার ছেলে হারাধন আর ঐ বুড়ি। দুধের শিশু সনাতনকে বুক থেকে টেনে নিয়ে গেল রাজাকাররা, ছেলে সদানন্দ নিরুদ্দেশ, বুড়ির তবু মরার নাম নেই।
পিঠটা টাটাচ্ছে। উঠানে নেমে পিঠ টান করতে গিয়ে ঘোর কালো আকাশ দেখতে পায় উত্তরা। ভারি একটা ঝড় আসছে। তেজপাতাগুলি তাড়াতাড়ি তুলতে চায়। অমনি দমকা হাওয়ায় উঠানময় পাতা, তারে মেলা শাড়ি যেন এক্ষুনি উড়ে যাবে। ভেজা জামাকাপড় তুলতে তুলতে গেট খোলার ক্যাঁচকোচ শব্দে ঘাড় ঘোরায় উত্তরা। হরিমাধব আসছে। সূতা নিতে। লোকটাকে একদম পছন্দ নয় তার। বড় প্যাঁচাল পাড়ে। সদানন্দ কেন হঠাৎ নিরুদ্দেশ হল, কোনো মেয়ের সঙ্গে আসনাই ছিল কি না, আজ কী রান্না হল- সব ওর জানা চাই। তবু পেট বড় বালাই। উত্তরা বেঁটে টুলটা উঠানে পেতে বলে ‘বসেন দাদা, ব্যাগ দ্যান, নলিগুলি ভইরা দিই ব্যাগে।’
হরিমাধব টুলে বসে তেঁতুলবিচি দাঁত বত্রিশপাটি বার করে হাসে, ‘ব্যাগ তো আনি নাই বইন, মাঠ দিয়া যাইতেছিলাম, মন হইল একবার দেইখা যাই, ঘরের পুরুষ নিরুদ্দিশ, বুড়ি হাশুরি আর পোলাটারে লইয়া কেমন কইরা চলতাসে!’
সেই পুরানা ভ্যান্তারা!
– পান দিই, খান!
– দ্যাও।
শাশুড়ির তক্তপোশের নিচে পানের সরঞ্জাম। বুড়ির কাণ্ড দেখো। রাবার ক্লথ সরিয়ে তোশক ভেজানোর তাল করছে। কদিন ধরে কী বিস্টি। কাঁথাকানি শুকায় না, তায় তোশক।
– থাকেন ভিজা বিছানায় পইড়া, আমি আর পারুম না।
পান দেবার সময় হরিমাধব কি ইচ্ছা করেই হাত ছোঁয়? ঘোর আকাশে থেকে থেকে বিজলির চিক্কুস, হরিমাধবের চোখদুটো যেন জ্বলছে। খপ করে ওর আঁচলখানা ধরে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে,
-হেই শাড়ি কি হেই অঙ্গে মানায়?
তখনই গেট ঠেলে হারাধন ঢোকে। তিন বৎসর ধরে ক্লাস সিক্সে এঁটে বসে থাকা হারাধনের ঠোঁটের ওপর পাতলা মোচের রেখা, সে হরিমাধবের হাতে উত্তরার আঁচলখানা নিস্পৃহ চোখে দেখে বলে ‘মা খাইতে দ্যাও’।
– এত তাড়াতাড়ি ছুটি! ক্যান?
– আইজ ইস্কুল সাজাব উচা ক্লাসের ছেলেরা, তাই সেভেন পর্যন্ত ছুটি দিয়া দিল।
– সাজাব? ক্যান?
কাঁধের ব্যাগটা ঘরে রেখে এসে হারাধন দাঁত খিঁচায়,
-ক্যান! কাইল স্বাধীনতা দিবস না?
হরিমাধব বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ে।
-হ, ১৫ আগস্ট ব্যাবাক দ্যাশ স্বাধীন, পরিবার ছাইড়া, পোলাপান ফেইলা কে যার ইচ্ছামতো ভাগতাসে। স্বাধীন দ্যাশ।
হারাধন রাগ রাগ মুখে রান্নাঘরের দাওয়ায় চাটাই পেতে বসে। অমনি টিপিটিপি বৃষ্টি আসে। হরিমাধব বোকার মতো মুখ করে উঠানে টুলে বসে ভেজে। হারাধনের ভয়ে তাকে দাওয়ায় উঠে আসতে বলতে সাহস পায় না উত্তরা। যা খোমা রাগ! এক্কেরে বাপের মতো। কী না, হরিমাধবকে পসন্দ না, ওর চোখের দৃষ্টি ভালা না, এই ছিল সদানন্দের মুখের বুলি। আরে বাবা, তোমার একার উপায়ে সংসার চললে তো আর ভাবনা ছিল না। দিন নাই, রাত নাই চরকার ক্যাঁচকোচ, এ কি সাধ করে? খালিপেটের আবার পসন্দ অপসন্দ!
– যা বৃষ্টি আইল, বাড়ি যান দাদা, বউদি ভাত নিয়া বইসা থাকব।
– হুঁহ, বইসা থাকব! ছেলে ভিন্ন হইল। সে নাকি আমার জন্য। তাই তিনি গোঁসা কইরা মেয়ের বাড়ি গিয়া জামাইয়ের অন্ন খাইতাসেন। বইন, সদানন্দের একটা সাইকেল ছিল না? হেইডা দ্যাও। হাইটা জাইতে গেলে ভিজা চুপ্পুস হইয়া যাইব।
হারাধন মুখে ভাত নিয়ে বলে, ‘সাইকেল ভাঙা, চাকায় হাওয়া নাই’।
হরিমাধব তবু ওঠার নাম করে না। টুলটা নিয়ে দক্ষিণের দাওয়ায় যুত করে বসে ডাক পাড়ে,
-অ মামি, কেমন আছেন কন, দ্যাশের মানুষরে চিনতে পারেন?
বুড়ি হরিমাধবকে চেনে না, কিন্তু দেশের কথায় টং টং করে ওঠে। মরা মরা চক্ষু দু’টায় সন্ধ্যাবাতি জ্বেলে আপন মনে বকতে থাকে। ছেলের খাওয়ার পাশে গালে হাত দিয়ে বসে আকাশ পাতাল ভাবে উত্তরা। হারাধনের পোষা মুরগিটা বৃষ্টির মধ্যেই উঠানে টগবগিয়ে ঘুরে বেড়ায়। হারাধন বলে, ‘ভাত খাবা না?’
– তর ঠাকমারে আগে খাওয়াই।
বৃষ্টি জুরে আসে। কীসের একটা আজানা ভয় উত্তরার বুকে চেপে বসে। হরিমাধব রোজ পঞ্চাশ টাকার সূতা কেনে। সেটা বন্ধ হলে ভাতটুকুও জুটবে না। তার যত রাগ গিয়ে পড়ে সদানন্দ আর তার ওই লজঝড়া সাইকেলের ওপর।
– ওই সাইকেলটা বেইচা দেওন যায় না?
– কে কিনব?
– তবে হরিমাধব দাদাকে কই, সারাইয়া সুরাইয়া দিক, তুই চড়বি।
– চইড়া যাব কোথায়?
– বাপের তালাশ করতে।
– ইচ্ছা হইলে আপনিই আসব।
– তগো ইস্কুলে কাইল প্যাকেট দিব?
– প্রতি বৎসরই তো দ্যায়।
বৃষ্টি একটু ধরলে হরিমাধব উঠে পড়ে। যাওয়ার আগে উত্তরার হাতে ত্রিশটা টাকা গুঁজে দিয়ে বলে, ‘কাইল স্বাধীনতা দিবসে ভাইগনারে মিস্টি খাওয়াইয়ো বইন, বাপ নাই, মুখ শুকাইয়া ঘুইরা বেড়ায়, অর বাপ থাইকাও নাই আর আমার ছেলে থাইকাও নাই।’
ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে হরিমাধব চলে যায়। উত্তরার মনে হয় মানুষটা খুব খারাপ না বোধহয়। বাড়িতে শান্তি নাই। তাই একটু প্রাণের কথা কওয়ার মানুষ খোঁজে। পাতরাইল ছেড়ে, দ্যাশের মাটি ছেড়ে দুধের শিশু সনাতনরে ছেড়ে আসার পর একের পর এক ঝড় সামলাতে সামলাতে উত্তরাই কখন যেন ছোট হয়ে গেছে। নইলে ভিটাবাড়িতে লোক মানে লক্ষ্মী।
২
অন্ধকার থাকতেই বিছানা ছাড়ে উত্তরা। অত বড় উঠান ঝাঁট দেওয়া কি চাড্ডিখানি কথা? তারপর পূজা। যে সে পূজা নয়। গোপাল। নিজেরা খাও না খাও, তাকে চারবেলা খাওয়াতে হবে। দ্যাশ থেকে এই গোপাল ছাড়া কিছুই আনতে পারেনি। এই চারটে পেটের দায় তার ওপর চাপিয়ে দিব্যি ফুড়ুৎ হয়েছে সদানন্দ। মেয়েমানুষের রোগ তো কোনো কালে ছিল না। ইদানিং খুব বলত নতুন বাস হয়েছে, কিছু টাকা জমিয়ে একবার বাসে চেপে স্বাধীন দ্যাশ দেখে আসবে। এত বৎসর পর হঠাৎ কি দ্যাশ দেখার শখ জাগল? যাওয়ার হলে তো বিনা পাসপোর্টেই যাওয়া যায়, কত লোকই তো যাচ্ছে নিত্যদিন। দেখার আছেটাই বা কী? কিছু নাই। সব অচেনা মুখ। দ্যাশ মানে তো মানুষ না কি? মানুষগুলাই যদি না থাকল, তবে গিয়ে লাভটা কী?
বিড়বিড় করে উঠান ঝাড়ু করে উত্তরা। মুরগিটাকে বার করতে গিয়ে দ্যাখে ঝুড়ির মধ্যে গ্যাঁট হয়ে বসে আছে, ডিম পাড়বে বোধহয়। ভালো, স্বাধীনতা দিবসে একটা ডিমই সই, ছেলেটা খেয়ে বাঁচুক। কাকভোরেই মাইকে গান বাজছে। প্রসন্ন মনে চরকায় বসে উত্তরা। হরিমাধবদা বলেছিল হারাধনকে তাঁতের কাজে ঢুকিয়ে দেবে। তাই ভালো। লেখাপড়া ওর আর হয়েছে! সূতা তুলতে তুলতে উত্তরা দেখে ইস্কুলের ড্রেস পরে হারাধন তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে যাচ্ছে।
– মুড়ি খাইলি না?
– সময় নাই।
ফেরে যখন, তখন তার হাতে ছোট একটা প্যাকেট আর কাগজের তেরঙ্গা পতাকা। পতাকাটা তুলসীমঞ্চে পুঁতে প্যাকেটটা মা’র হাতে দ্যায়। সদানন্দও ঠিক এমনই ছিল। কোথাও কেউ কোনো ভালো জিনিস খেতে দিলে ঠিক বাড়িতে নিয়ে আসবে। প্যাকেট খুলে উত্তরা দেখে লুচি, আলুর দম আর চমচম। বিছানায় পড়া মানুষ, তারে আর লুচি দিয়া কাজ নাই, পেট বালসাবে। এক টুকরা চমচম ভেঙে শাশুড়ির মুখে দিয়ে উত্তরা বলে, ‘ন্যান মা, স্বাধীনতা দিবসের চমচম খান।’
– পোড়াবাড়ির চমচম?
হায় রে! এ বুড়ি সারাজীবনটা ও দ্যাশেই পড়ে রইল! এখনো পোড়াবাড়ি! বুড়ি বিড়বিড় করে –সনাতন হইল, সদানন্দ পোড়াবাড়ি থিকা এক টিন চমচম লইয়া আইল, কী ভালো খাইলাম, তারপর কী হইল বৌ? সনাতনরে আর দেখি না ক্যান? মুখগুলি সব অচিনা ঠ্যাকে, এ কোথায় আইয়া পড়লাম?’
৩
উত্তরা ফুটন্ত তেলে তেজপাতা ছাড়ে। ভালো করে পেঁয়াজ আদা দিয়া কষকষে করে ডিমের ঝাল রাঁধে। হারাধন খেতে বসে ঠিক আধখানা ডিম তার পাতে তুলে দ্যায়। এরকম করলে কি শরীর থাকে?
আজ আকাশে একটুকরা মেঘও নাই। ঝলমল করছে রৌদ্র। উঠানে বেঁটে টুলটা পেতে বসে রেডিও’র সেন্টার ঘুরায় হারাধন। এইটা সদানন্দের শখের জিনিস। গত পূজায় কেনা। সাইকেলটার মতো লজঝড়া নয়। চকচকা নূতন। খবর হচ্ছে।
– আজ সারা দেশে বিশেষ শ্রদ্ধার সঙ্গে শোক দিবস পালিত হচ্ছে…
চরকা চালাতে চালাতে উত্তরা অবাক হয়ে ছেলেকে শুধায় ‘তুই যে কইলি স্বাধীনতা দিবস?’
হারাধন গম্ভীর গলায় বলে ‘রেডিও বাংলাদেশ ধরছি।’
– আইজ ওখানে শোক দিবস?
হারাধন উত্তর দেয় না। খবরের পর গান হয়, ‘আমার একটি কবিতার নাম মুজিবর’। উত্তরার বুকের মধ্যে ফাঁত ফাঁত করে। তার শাশুড়ি যে সময়টার জালে আটকে আছে, সেই সময়কার হারিয়ে যাওয়া শব্দগুলোর ভারে টনটন করে তার বুক। ভূতে পাওয়ার মতো ঘোরে চরকা চালায় উত্তরা। একই সূতায় কী করে যে স্বাধীনতা আর শোক বোনা যেতে পারে, তা কিছুতেই তার মাথায় ঢোকে না।